হার্ভার্ডে বাংলাদেশ সম্মেলন -অন্য দেশ by ইব্রাহীম চৌধুরী
বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বিশ্বে নানামুখী প্রভাব রাখার জন্য খ্যাতিমান এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ক্যামব্রিজ নগরের খ্যাতি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই। ৯ ও ১০ অক্টোবর হার্ভার্ড চত্বরে সমবেত হয়েছিলেন বাংলাদেশি প্রাজ্ঞজনেরা। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি, যাঁরা জ্ঞানে-গবেষণায় নিজস্ব পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান, তাঁদের সমাবেশ ঘটেছিল হার্ভার্ডে। ‘পরবর্তী দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন: ধারণা এবং উদ্ভাবন’ বিষয়ে দুই দিনব্যাপী সম্মেলন হয়ে গেল।
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে সম্ভাবনাময় সব গভীর আলোচনা, দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ এবং প্রস্তাবনা প্রণয়নই ছিল এ সম্মেলনের লক্ষ্য।
সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (বিডিআই), ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ডিডিবিএফ) এবং হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের এশ ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংগঠন হিসেবে ১৯৮৮ সালে বিডিআই যাত্রা শুরু করে। প্যানসেলভেনিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে পরিচালিত এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাংলাদেশি শিক্ষাবিদেরা। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিনিময়ে কাজ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে এ সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাজ করে আসছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানসম্পন্ন উত্পাদন, শ্রমমান বৃদ্ধি এবং জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে বিডিআই কাজ করছে। বোস্টনভিত্তিক বাংলাদেশি শিক্ষাবিদদের পৃথক সংগঠন ডিডিবিএফ। দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার লক্ষ্য তাঁদের। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিসহ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ডিডিবিএফ কাজ করে আসছে। বিশ্বময় গণতান্ত্রিক শক্তিকে জোরদার করার কাজে জড়িত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাশ ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইনোভেশন। গবেষণা, প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ ও বিশ্বজুড়ে আন্তসংযোগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে এ ইনস্টিটিউট খ্যাতিমান। বৈষয়িক সমসাময়িক জটিল বিষয় নিয়ে সামাজিক গবেষণা, সমাধানের উপায় উদ্ভাবনে হার্ভার্ডের এ প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ যৌথ আয়োজন স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যেসব বাংলাদেশি জড়ো হয়েছিলেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁরা বিশেষজ্ঞ। স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা সময় দিয়েছেন দেশের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঙ্গরাজ্য থেকে তাঁরা ছুটে এসেছিলেন ক্যামব্রিজ নগরে। নিজেদের লব্ধ জ্ঞান-গবেষণাকে দেশের কাজে লাগানোর অদম্য ইচ্ছা থেকেই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলন উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে এসে যোগ দেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ ব্যক্তি; সরকারসংশ্লিষ্ট একাধিক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক দুজন উপদেষ্টা, পত্রিকার সম্পাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে হার্ভার্ড সম্মেলন হয়ে উঠেছিল তারকাময়। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুদিনের সম্মেলনে সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল এ সম্মেলনে।
বাংলাদেশ বিষয়ে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে নানা বিষয়ে প্রায় দুই ডজন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, সরকার পরিচালনা, শিক্ষা, অর্থনীতি, রপ্তানি, বিদ্যুত্, জ্বালানি, জলবায়ু, সংবাদমাধ্যমসহ মৌলিক ও জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। এসব আলোচনা শুধু বক্তব্য রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রতিটি বিষয়ের গভীর পর্যালোচনা, তথ্য-উপাত্তসহ চুলচেরা বিশ্লেষণ ছিল সেমিনারগুলোতে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্জন ও পাহাড়সম প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেশের অদম্য জনগোষ্ঠীর সাফল্যকে চিহ্নিত করেই প্রতিটি আলোচনা গৃহীত হয়েছে। প্রতিটি আলোচনা ও সেমিনার ছিল নির্মোহ দলনিরপেক্ষ। কোনো রাজনৈতিক বিভাজন বা ভাবাদর্শের প্রভাব ছিল না এসব আলোচনা ও সুপারিশে।
বিষয়-বৈচিত্র্য ও অংশগ্রহণকারীদের কর্মযজ্ঞে সম্মেলনটি হয়ে উঠেছিল রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের। প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদা গ্রুপে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা—মত পাল্টা মত উপস্থাপিত হচ্ছে, কখনো বিতর্ক করছেন প্রাজ্ঞজনেরা; সুপারিশ বেরিয়ে আসছে নতুন সব ধারণার সমন্বয়ে।
গণতন্ত্র ও সুশাসনবিষয়ক আলোচনাগুলো জমে উঠেছিল নানামুখী বিতর্কে। রাজনীতিতে পরিবর্তনের তীব্র জন-আকাঙ্ক্ষার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বেশির ভাগ আলোচকেরাই বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট চক্রেই দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতির এ অচলায়তন ভাঙার তাগিদ এসেছে কোনো কোনো আলোচকের বক্তব্যে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ দীর্ঘ ও ধৈর্য ধারণের। আলোচকেরা বলেছেন, নানা অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ক্রমবিকাশমান। অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়েই জনগণের সুনেতৃত্বের উন্মেষ ঘটবে বলে জোরালো আশাবাদ উচ্চারিত হয়েছে আলোচকদের কথায়।
দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে সমন্বিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে জাতীয় অনৈক্য আমাদের বিপর্যয় বাড়াবে এমন আশঙ্কা উচ্চারিত হয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে। পর্যালোচনা ও বিলম্ব প্রক্রিয়ার ফলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আলোচনায় একজন সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ণে ব্যর্থ হলে তা আর কখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের বিস্ফোরণ নিয়ে নানা সব কথা উচ্চারিত হয়েছে। সব বিষয় নজরদারি করার দায়িত্ব যাদের, তাদের নজরদারি কে করবে? প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম চমত্কার স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে বক্তারা বলেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটায় একটি অগোছালো অবস্থা বিরাজ করছে। সেমিনারে আলোচিত হয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব আচরণবিধি (কোড অব কনডাক্ট) নিয়ে। আচরণবিধি মেনে চলার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা আন্তরিক, তা নিয়েও কথা উঠেছে। প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
হার্ভার্ড সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এসব প্রস্তাবনা ও সুপারিশকে পাশ কাটানোর কোনো অবকাশ নেই। পরিবর্তনশীল বিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক উদ্ভাবনী ধারণায় প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছেন অংশগ্রহণকারীরা।
সম্মেলনের আয়োজকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের এসব প্রস্তাবনা ও সুপারিশ সরকার, বিরোধীদলসহ বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় লোক, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘে নিযুক্ত দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকেও সম্মেলনকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছাড়াও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপস্থিতি ছিল সার্বক্ষণিক।
দেশের উন্নয়নবিষয়ক এসব মূল্যবান প্রস্তাবনা ও সুপারিশ বাস্তবায়নে যাঁরা জড়িত, বিষয়টি তাঁরা কতটা গুরুত্বসহকারে দেখছেন, তাই এখন দেখার বিষয়। দেশের উন্নয়নধারণায় এসব প্রস্তাবনা ছিল রাজনীতি-নিরপেক্ষ ও নির্মোহ। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রস্তাবনা যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, স্বদেশে তাঁরা রাজনৈতিক পরিচয়ে চরমভাবে বিভক্ত। রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, আন্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নসহ বেশির ভাগ বিষয়েই বিভক্ত আমাদের রাজনীতিবিদেরা—হার্ভার্ডে সমবেত হওয়া বিজ্ঞজনদের কাছে এ বিষয়টি হয়তো বিবেচনায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতায় অংশগ্রহণকারীরা দেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার ঐক্য ছিল লক্ষণীয়। দেশের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সূত্র হতে পারে হার্ভার্ডে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্মেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ সমাবেশটি। সম্মেলনে ভিন্ন পক্ষকেও সম্পৃক্ত করার কোনো উপায়-অবকাশ আছে কি না—এ নিয়ে আয়োজকেরা ভাবতে পারেন।
ইব্রাহীম চৌধুরী: প্রথম আলোর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি।
ibrahim.chowdhury@gmail.com
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে সম্ভাবনাময় সব গভীর আলোচনা, দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা ও অগ্রগতি নিয়ে গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ এবং প্রস্তাবনা প্রণয়নই ছিল এ সম্মেলনের লক্ষ্য।
সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (বিডিআই), ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ডিডিবিএফ) এবং হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের এশ ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংগঠন হিসেবে ১৯৮৮ সালে বিডিআই যাত্রা শুরু করে। প্যানসেলভেনিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে পরিচালিত এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাংলাদেশি শিক্ষাবিদেরা। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিনিময়ে কাজ করার পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে এ সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক কাজ করে আসছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানসম্পন্ন উত্পাদন, শ্রমমান বৃদ্ধি এবং জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে বিডিআই কাজ করছে। বোস্টনভিত্তিক বাংলাদেশি শিক্ষাবিদদের পৃথক সংগঠন ডিডিবিএফ। দলনিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার লক্ষ্য তাঁদের। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিসহ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ডিডিবিএফ কাজ করে আসছে। বিশ্বময় গণতান্ত্রিক শক্তিকে জোরদার করার কাজে জড়িত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাশ ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইনোভেশন। গবেষণা, প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ ও বিশ্বজুড়ে আন্তসংযোগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে এ ইনস্টিটিউট খ্যাতিমান। বৈষয়িক সমসাময়িক জটিল বিষয় নিয়ে সামাজিক গবেষণা, সমাধানের উপায় উদ্ভাবনে হার্ভার্ডের এ প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ যৌথ আয়োজন স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যেসব বাংলাদেশি জড়ো হয়েছিলেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁরা বিশেষজ্ঞ। স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁরা সময় দিয়েছেন দেশের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঙ্গরাজ্য থেকে তাঁরা ছুটে এসেছিলেন ক্যামব্রিজ নগরে। নিজেদের লব্ধ জ্ঞান-গবেষণাকে দেশের কাজে লাগানোর অদম্য ইচ্ছা থেকেই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলন উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে এসে যোগ দেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ ব্যক্তি; সরকারসংশ্লিষ্ট একাধিক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক দুজন উপদেষ্টা, পত্রিকার সম্পাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে হার্ভার্ড সম্মেলন হয়ে উঠেছিল তারকাময়। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুদিনের সম্মেলনে সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল এ সম্মেলনে।
বাংলাদেশ বিষয়ে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে নানা বিষয়ে প্রায় দুই ডজন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, সরকার পরিচালনা, শিক্ষা, অর্থনীতি, রপ্তানি, বিদ্যুত্, জ্বালানি, জলবায়ু, সংবাদমাধ্যমসহ মৌলিক ও জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। এসব আলোচনা শুধু বক্তব্য রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রতিটি বিষয়ের গভীর পর্যালোচনা, তথ্য-উপাত্তসহ চুলচেরা বিশ্লেষণ ছিল সেমিনারগুলোতে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্জন ও পাহাড়সম প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেশের অদম্য জনগোষ্ঠীর সাফল্যকে চিহ্নিত করেই প্রতিটি আলোচনা গৃহীত হয়েছে। প্রতিটি আলোচনা ও সেমিনার ছিল নির্মোহ দলনিরপেক্ষ। কোনো রাজনৈতিক বিভাজন বা ভাবাদর্শের প্রভাব ছিল না এসব আলোচনা ও সুপারিশে।
বিষয়-বৈচিত্র্য ও অংশগ্রহণকারীদের কর্মযজ্ঞে সম্মেলনটি হয়ে উঠেছিল রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের। প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদা গ্রুপে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা—মত পাল্টা মত উপস্থাপিত হচ্ছে, কখনো বিতর্ক করছেন প্রাজ্ঞজনেরা; সুপারিশ বেরিয়ে আসছে নতুন সব ধারণার সমন্বয়ে।
গণতন্ত্র ও সুশাসনবিষয়ক আলোচনাগুলো জমে উঠেছিল নানামুখী বিতর্কে। রাজনীতিতে পরিবর্তনের তীব্র জন-আকাঙ্ক্ষার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বেশির ভাগ আলোচকেরাই বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট চক্রেই দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতির এ অচলায়তন ভাঙার তাগিদ এসেছে কোনো কোনো আলোচকের বক্তব্যে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ দীর্ঘ ও ধৈর্য ধারণের। আলোচকেরা বলেছেন, নানা অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ক্রমবিকাশমান। অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়েই জনগণের সুনেতৃত্বের উন্মেষ ঘটবে বলে জোরালো আশাবাদ উচ্চারিত হয়েছে আলোচকদের কথায়।
দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে সমন্বিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে জাতীয় অনৈক্য আমাদের বিপর্যয় বাড়াবে এমন আশঙ্কা উচ্চারিত হয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে। পর্যালোচনা ও বিলম্ব প্রক্রিয়ার ফলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আলোচনায় একজন সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ণে ব্যর্থ হলে তা আর কখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের বিস্ফোরণ নিয়ে নানা সব কথা উচ্চারিত হয়েছে। সব বিষয় নজরদারি করার দায়িত্ব যাদের, তাদের নজরদারি কে করবে? প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম চমত্কার স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে বক্তারা বলেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটায় একটি অগোছালো অবস্থা বিরাজ করছে। সেমিনারে আলোচিত হয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব আচরণবিধি (কোড অব কনডাক্ট) নিয়ে। আচরণবিধি মেনে চলার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা আন্তরিক, তা নিয়েও কথা উঠেছে। প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
হার্ভার্ড সম্মেলন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এসব প্রস্তাবনা ও সুপারিশকে পাশ কাটানোর কোনো অবকাশ নেই। পরিবর্তনশীল বিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক উদ্ভাবনী ধারণায় প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছেন অংশগ্রহণকারীরা।
সম্মেলনের আয়োজকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের এসব প্রস্তাবনা ও সুপারিশ সরকার, বিরোধীদলসহ বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় লোক, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘে নিযুক্ত দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকেও সম্মেলনকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছাড়াও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপস্থিতি ছিল সার্বক্ষণিক।
দেশের উন্নয়নবিষয়ক এসব মূল্যবান প্রস্তাবনা ও সুপারিশ বাস্তবায়নে যাঁরা জড়িত, বিষয়টি তাঁরা কতটা গুরুত্বসহকারে দেখছেন, তাই এখন দেখার বিষয়। দেশের উন্নয়নধারণায় এসব প্রস্তাবনা ছিল রাজনীতি-নিরপেক্ষ ও নির্মোহ। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রস্তাবনা যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, স্বদেশে তাঁরা রাজনৈতিক পরিচয়ে চরমভাবে বিভক্ত। রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, আন্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নসহ বেশির ভাগ বিষয়েই বিভক্ত আমাদের রাজনীতিবিদেরা—হার্ভার্ডে সমবেত হওয়া বিজ্ঞজনদের কাছে এ বিষয়টি হয়তো বিবেচনায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতায় অংশগ্রহণকারীরা দেশের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে চিন্তা-চেতনার ঐক্য ছিল লক্ষণীয়। দেশের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সূত্র হতে পারে হার্ভার্ডে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্মেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ সমাবেশটি। সম্মেলনে ভিন্ন পক্ষকেও সম্পৃক্ত করার কোনো উপায়-অবকাশ আছে কি না—এ নিয়ে আয়োজকেরা ভাবতে পারেন।
ইব্রাহীম চৌধুরী: প্রথম আলোর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি।
ibrahim.chowdhury@gmail.com
No comments