দ্বিভাষী থেকে ভাষাহীন, অবশেষে দুর্বৃত্ত! -যুক্তি তর্ক গল্প by আবুল মোমেন
ব্রিটিশ আমলে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির উদ্ভব। এই শিক্ষিত বাঙালি ছিল দ্বিভাষী। তখন স্কুলের গণ্ডি পেরুলেই মোটামুটি মানের বাংলা ও ইংরেজি শেখা হয়ে যেত। সে আমলের অনেক মেট্রিকুলেটের ইংরেজি ভাষায় দখল ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
তাঁদের কেবল ভাষায় দখল হতো না, ভাষা শেখার সূত্রে তাঁরা বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতেন। এমনকি ইংরেজির সূত্রে পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞান ও মননচর্চার সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম হয়ে যেতেন। তাঁরা সাহিত্য এবং জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ কৃতীর সঙ্গেও পরিচিত হয়ে যেতেন।
আজ যে আমরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে, নীতি-আদর্শের দৈন্যে হাহাকার করি তার পেছনে শিক্ষার দৈন্য ও শিক্ষার অবক্ষয় যে বড় ভূমিকা রাখছে তা যেন ধরতে পারছি না।
স্কুলশিক্ষাকে ভাষা, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার মূল কাজ থেকে সরিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত ও সমস্যা জানা এবং সেসব মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ায় সীমাবদ্ধ করেছি। ফলে স্কুল দীর্ঘ দশ বছরেও ছাত্রকে মানুষ হওয়ার মূল উপাচার জীবনবোধ, বিচারবোধ, বিবেকবোধ ইত্যাদির জোগান দিতে পারে না। সেকালে স্কুলে স্কুলে এমন অনেক শিক্ষকই থাকতেন যাঁরা জ্ঞানচর্চার (এবং জীবনচর্চার) ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি তিনটি ভাষাতেই বা মাধ্যমেই হতেন দক্ষ। তাঁদের ইংরেজি, বাংলা ও গণিতে সমান পারদর্শিতা দেখা যেত। জ্ঞানচর্চা ও তার বাহনে দক্ষতার চর্চায় তাঁরা যেমন আনন্দ পেতেন, তেমনি জীবনের সার্থকতার বোধও পেতেন।
কাল বদলেছে, সেটা মানতেই হবে। কিন্তু জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বা জ্ঞানচর্চার বাহনে দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব তাতে হ্রাস পেতে পারে না। আর মানুষের জন্য জীবনবোধ, বিচারবোধ, বিবেকবোধেরওবা গুরুত্ব হ্রাস পাবে কী করে?
মানুষের অর্থের প্রয়োজন বাড়তে পারে, চাকরির ধরন বদলাতে পারে, জীবনযাপনে পরিবর্তন আসতে পারে, চাহিদা-প্রয়োজনে নানা রূপান্তর ঘটতে পারে—কিন্তু এসব তো কোনোভাবেই মনুষ্যত্বের মৌলিক গুণাবলির পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্যের একটা চিরায়ত রূপ থাকার কথা, যা আমরা বিস্মৃত হচ্ছি কিংবা গুরুত্ব দিচ্ছি না।
জাতীয়ভাবে আমাদের জ্ঞানচর্চা ও জীবনসাধনার অবক্ষয়ের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে আমরা একে শিক্ষার অবক্ষয়ের ফলাফল হিসেবেও দেখতে পারি। আমরা যেন একদিক গোছাতে গিয়ে অন্যদিক সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছি বারবার। তাতে অগ্রযাত্রা ভারসাম্যপূর্ণ হয়নি, হয়নি টেকসই।
ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। বাঙালির সে অবিস্মরণীয় জাগরণের ফলে শেষ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেয়েছি। বাংলা ভাষার পরিণতি, ভাষাগত দক্ষতা-পূর্ণতা অর্জন বিলম্বিত হয়েছে কারণ বাংলা বস্তুত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কখনো সরকারি ভাষা (বা রাষ্ট্রভাষা) ছিল না।
সংস্কৃত, পালি হয়ে ফার্সিও অনেককাল দরবারি ভাষা ছিল। পরে ইংরেজি এল এবং তার হাত ধরে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে।
এদিক থেকে বলা যায়, বাঙালির আধুনিক মন-মানসের বিকাশে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য এবং পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলার ছিল মূল ভূমিকা। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় এ মানসের সূচনা হলেও শিক্ষার মাধ্যমে তা-ই সারা বাংলায় ছড়িয়েছে। ১৯১৪ সালে মাদ্রাসাশিক্ষায় নিউস্কিম প্রকল্প প্রবর্তনের ফলে মুসলিম সমাজেও এই একই মনমানসের বিস্তার ঘটে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নটা স্বীকৃতির পর্যায়ে চলে আসে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হলে তাতে বাংলা উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। তবে তার পরও কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজকর্ম চলছিল ইংরেজি ভাষায়। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতীয়তার চেতনা জোরদার হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে জাতীয় বিকাশের প্রশ্ন তীব্রতর হতে থাকলে জাতীয় জীবনে ক্ষমতার রাজনীতি বা ক্ষমতাদখলের রাজনীতি জোরদার হয় ও মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে ছাত্রদের জীবনে এবং শিক্ষিত নাগরিক জীবনে রাজনীতি চরম ও পরম বিষয় হয়ে উঠতে থাকে। জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য পাঠ কিংবা জীবনচর্চার বৃহত্তর, ব্যাপ্ততর ও গভীরতর অনুষঙ্গগুলো গুরুত্ব হারাতে থাকে। বলা যায়, এ সময় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিশাল সম্ভাবনা ও প্রাপ্তির নিচে জীবনসাধনার গভীর-সূক্ষ্ম বিষয়গুলো যেন হারিয়ে গেল। স্বাধীনতার পরে সংগত কারণেই বাংলা সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষার যথার্থ মর্যাদা পেল। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন-প্রাপ্তির টালমাটাল সময়ে সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র শিক্ষা সঠিক গুরুত্ব পায়নি, ভাষাচর্চা একেবারেই উপেক্ষিত হলো। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ইংরেজির অবস্থান দুর্বল হলো আর রাষ্ট্রশক্তির দূরদর্শিতার অভাবে ইংরেজি-বাংলা সব ভাষাচর্চা, সাহিত্যপাঠ এবং জীবনসাধনার বিষয়গুলো চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল আর ভোগ-বিলাসের দিকে ঝুঁকতে থাকল। সেই ধারা উত্তরোত্তর কেবল বেগবান হয়েছে এবং পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
এই অবক্ষয়ের ফলে একটি দ্বিভাষী শিক্ষিত সমাজ দৃশ্যত একভাষী হয়ে গেল আর কার্যত ভাষাহারা হয়ে পড়ল। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর নৈরাজ্য ও ডামাডোলে আদতে ভাষাচর্চাই গুরুত্ব হারিয়ে বসেছিল, এবং সাহিত্যের সহযোগ ব্যতীত ভাসা-ভাসাভাবে নিছক ভাষার চর্চা ছাত্রদের মানসলোকে কোনো স্থায়ী দাগ কাটেনি, তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। ফলে জাতি এক অর্থে ভাষাহারা এবং জীবনবোধ-হারা হয়ে পড়েছে। এ বাস্তবতায় বরং শিক্ষার আলো ও সুবিধাবঞ্চিত বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীই তাদের মাটিসম্পৃক্ত লোকজ সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের সমাজকে কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক যেভাবে বিপুল দরিদ্র কৃষকসমাজ তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলেছে আজ বহুকাল। জিডিপির সিংহভাগ জোগানদাতা তারাই।
এদিকে গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে প্রথমে ঢাকায় ও পরে সারা দেশে ইংরেজি শেখার ধুম পড়ে যায়। প্রথমে এটা ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমে তা মধ্যবিত্ত হয়ে এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাঙালি হুজুগে জাতি—এটা আমরা সবাই জানি। একবার হুজুগে মেতে উঠে ইংরেজিকে চরম অবহেলা করেছে, এমনকি বাংলা ভাষা চর্চায়ও প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়নি। বাঙালি হুজুগে মেতে জাতীয়তাবাদী হলেও জীবনে আর ধ্যানধারণায় সে আজ একেবারে সর্বাংশে পশ্চিমের মুখাপেক্ষী। পশ্চিম থেকে নানা ধুয়া শুনে সে দোহারকির কাজ করে তা এ দেশে চালানোর চেষ্টা শুরু করে। এখন স্কুলশিক্ষায় সাহিত্য কৌলীন্য খুইয়ে ব্রাত্যজন, বৃত্তি-পেশা এমনই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে যে জীবনসাধনার প্রাথমিক রসদগুলোও আর স্কুল থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-ব্যবসায়ী-প্রশাসক মিলছে ভূরি ভূরি কিন্তু মানুষের আকাল কেবলই বেড়ে চলেছে।
একজন মানুষের খাঁটি মানুষ হওয়ার জন্য শিকড়ও চাই, সঠিক বাতাবরণও প্রয়োজন। সেটাই সংস্কৃতি। স্কুল সে কাজ করা থেকে বিরত রয়েছে আজ বহুকাল। একালে শিক্ষার একটাই ফসল—তা হলো পরীক্ষায় সাফল্য। এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে শিক্ষকেরা শিক্ষাকে তাঁদের জীবনমান বাড়ানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে শিক্ষককে কেন্দ্র করে স্কুলে যে শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা সে কাজ হতে পারে না। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীদের শতকরা ৯৯ জনের পক্ষে এ জীবনে আর বঙ্কিম-শরত্চন্দ্র-মীর মশাররফ-তারাশঙ্কর-বিভূতি-মানিক পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। থাকবে না মাইকেল-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-শামসুর রাহমানের কবিতার রস আস্বাদনের উপায়।
এদের ডিঙিয়ে যখন বাউল গানে ভক্তি দেখা যায় তখন তা ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি একজন বিদেশির কৌতূহলী উত্সাহের সঙ্গেই তুলনীয়। কারণ ভাষার যে ব্যঞ্জনা, নানা ভাবগত, ইতিহাসগত অনুষঙ্গ থাকে এবং যা ভাষার ব্যবহারিক প্রকাশে অনবরত বিস্তৃত-সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা সাহিত্যের মাধ্যমে সঞ্জীবিত-সৃজিত হতে থাকে তা ক্রমেই এদের কাছে দুর্বোধ্য অচেনা হয়ে পড়বে। এরা কেবল অল্প কিছু চেনা শব্দের মাধ্যমে কোনোমতে কথাটুকু বলতে পারবে। কান পাতলেই এবং খেয়াল করলেই ধরা পড়বে যে এসব বঙ্গসন্তানের শব্দভাণ্ডার কতই ক্ষীণ, প্রমিত বাংলায় মনের ভাব প্রকাশে কতটা অক্ষম হয়ে পড়ছে তারা।
আবার যে ইংরেজি শেখা হচ্ছে তা কথা বলায় পারদর্শিতাটুকুই এনে দিচ্ছে কিন্তু গভীর জটিল মৌলিক ভাবনা লেখার মতো দক্ষতা তাতে অর্জিত হয় না। কারণ ভাষা তো সজীব প্রাণবন্ত বিষয়, তাই জীবন্ত-সংস্কৃতির যোগ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় মৌলিক কিছু লেখা কঠিন।
এভাবে আমরা সমৃদ্ধ দ্বিভাষী শিক্ষিত সমাজকে কখনো একভাষী কখনো ভাষাহীন (অর্থাত্ বোবা), কখনো বা ভাষাবিকৃতি-কবলিত, আর কখনো ভাষা-সংস্কৃতিহীন মানুষে রূপান্তরিত করছি। এভাবে আমরা মানুষ হিসেবে কেবল দীন হচ্ছি তা নয়, গুণগতভাবে খারাপ হয়ে পড়ছি।
দেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন দুর্বৃত্তের সংখ্যা এমনি এমনি বাড়ছে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
তাঁদের কেবল ভাষায় দখল হতো না, ভাষা শেখার সূত্রে তাঁরা বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতেন। এমনকি ইংরেজির সূত্রে পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞান ও মননচর্চার সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম হয়ে যেতেন। তাঁরা সাহিত্য এবং জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ কৃতীর সঙ্গেও পরিচিত হয়ে যেতেন।
আজ যে আমরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে, নীতি-আদর্শের দৈন্যে হাহাকার করি তার পেছনে শিক্ষার দৈন্য ও শিক্ষার অবক্ষয় যে বড় ভূমিকা রাখছে তা যেন ধরতে পারছি না।
স্কুলশিক্ষাকে ভাষা, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার মূল কাজ থেকে সরিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত ও সমস্যা জানা এবং সেসব মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ায় সীমাবদ্ধ করেছি। ফলে স্কুল দীর্ঘ দশ বছরেও ছাত্রকে মানুষ হওয়ার মূল উপাচার জীবনবোধ, বিচারবোধ, বিবেকবোধ ইত্যাদির জোগান দিতে পারে না। সেকালে স্কুলে স্কুলে এমন অনেক শিক্ষকই থাকতেন যাঁরা জ্ঞানচর্চার (এবং জীবনচর্চার) ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি তিনটি ভাষাতেই বা মাধ্যমেই হতেন দক্ষ। তাঁদের ইংরেজি, বাংলা ও গণিতে সমান পারদর্শিতা দেখা যেত। জ্ঞানচর্চা ও তার বাহনে দক্ষতার চর্চায় তাঁরা যেমন আনন্দ পেতেন, তেমনি জীবনের সার্থকতার বোধও পেতেন।
কাল বদলেছে, সেটা মানতেই হবে। কিন্তু জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বা জ্ঞানচর্চার বাহনে দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব তাতে হ্রাস পেতে পারে না। আর মানুষের জন্য জীবনবোধ, বিচারবোধ, বিবেকবোধেরওবা গুরুত্ব হ্রাস পাবে কী করে?
মানুষের অর্থের প্রয়োজন বাড়তে পারে, চাকরির ধরন বদলাতে পারে, জীবনযাপনে পরিবর্তন আসতে পারে, চাহিদা-প্রয়োজনে নানা রূপান্তর ঘটতে পারে—কিন্তু এসব তো কোনোভাবেই মনুষ্যত্বের মৌলিক গুণাবলির পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্যের একটা চিরায়ত রূপ থাকার কথা, যা আমরা বিস্মৃত হচ্ছি কিংবা গুরুত্ব দিচ্ছি না।
জাতীয়ভাবে আমাদের জ্ঞানচর্চা ও জীবনসাধনার অবক্ষয়ের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে আমরা একে শিক্ষার অবক্ষয়ের ফলাফল হিসেবেও দেখতে পারি। আমরা যেন একদিক গোছাতে গিয়ে অন্যদিক সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছি বারবার। তাতে অগ্রযাত্রা ভারসাম্যপূর্ণ হয়নি, হয়নি টেকসই।
ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। বাঙালির সে অবিস্মরণীয় জাগরণের ফলে শেষ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র পেয়েছি। বাংলা ভাষার পরিণতি, ভাষাগত দক্ষতা-পূর্ণতা অর্জন বিলম্বিত হয়েছে কারণ বাংলা বস্তুত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কখনো সরকারি ভাষা (বা রাষ্ট্রভাষা) ছিল না।
সংস্কৃত, পালি হয়ে ফার্সিও অনেককাল দরবারি ভাষা ছিল। পরে ইংরেজি এল এবং তার হাত ধরে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে।
এদিক থেকে বলা যায়, বাঙালির আধুনিক মন-মানসের বিকাশে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য এবং পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলার ছিল মূল ভূমিকা। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় এ মানসের সূচনা হলেও শিক্ষার মাধ্যমে তা-ই সারা বাংলায় ছড়িয়েছে। ১৯১৪ সালে মাদ্রাসাশিক্ষায় নিউস্কিম প্রকল্প প্রবর্তনের ফলে মুসলিম সমাজেও এই একই মনমানসের বিস্তার ঘটে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নটা স্বীকৃতির পর্যায়ে চলে আসে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হলে তাতে বাংলা উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। তবে তার পরও কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজকর্ম চলছিল ইংরেজি ভাষায়। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতীয়তার চেতনা জোরদার হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে জাতীয় বিকাশের প্রশ্ন তীব্রতর হতে থাকলে জাতীয় জীবনে ক্ষমতার রাজনীতি বা ক্ষমতাদখলের রাজনীতি জোরদার হয় ও মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে ছাত্রদের জীবনে এবং শিক্ষিত নাগরিক জীবনে রাজনীতি চরম ও পরম বিষয় হয়ে উঠতে থাকে। জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য পাঠ কিংবা জীবনচর্চার বৃহত্তর, ব্যাপ্ততর ও গভীরতর অনুষঙ্গগুলো গুরুত্ব হারাতে থাকে। বলা যায়, এ সময় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিশাল সম্ভাবনা ও প্রাপ্তির নিচে জীবনসাধনার গভীর-সূক্ষ্ম বিষয়গুলো যেন হারিয়ে গেল। স্বাধীনতার পরে সংগত কারণেই বাংলা সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষার যথার্থ মর্যাদা পেল। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন-প্রাপ্তির টালমাটাল সময়ে সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র শিক্ষা সঠিক গুরুত্ব পায়নি, ভাষাচর্চা একেবারেই উপেক্ষিত হলো। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ইংরেজির অবস্থান দুর্বল হলো আর রাষ্ট্রশক্তির দূরদর্শিতার অভাবে ইংরেজি-বাংলা সব ভাষাচর্চা, সাহিত্যপাঠ এবং জীবনসাধনার বিষয়গুলো চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল আর ভোগ-বিলাসের দিকে ঝুঁকতে থাকল। সেই ধারা উত্তরোত্তর কেবল বেগবান হয়েছে এবং পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
এই অবক্ষয়ের ফলে একটি দ্বিভাষী শিক্ষিত সমাজ দৃশ্যত একভাষী হয়ে গেল আর কার্যত ভাষাহারা হয়ে পড়ল। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর নৈরাজ্য ও ডামাডোলে আদতে ভাষাচর্চাই গুরুত্ব হারিয়ে বসেছিল, এবং সাহিত্যের সহযোগ ব্যতীত ভাসা-ভাসাভাবে নিছক ভাষার চর্চা ছাত্রদের মানসলোকে কোনো স্থায়ী দাগ কাটেনি, তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। ফলে জাতি এক অর্থে ভাষাহারা এবং জীবনবোধ-হারা হয়ে পড়েছে। এ বাস্তবতায় বরং শিক্ষার আলো ও সুবিধাবঞ্চিত বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীই তাদের মাটিসম্পৃক্ত লোকজ সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের সমাজকে কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক যেভাবে বিপুল দরিদ্র কৃষকসমাজ তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলেছে আজ বহুকাল। জিডিপির সিংহভাগ জোগানদাতা তারাই।
এদিকে গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে প্রথমে ঢাকায় ও পরে সারা দেশে ইংরেজি শেখার ধুম পড়ে যায়। প্রথমে এটা ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমে তা মধ্যবিত্ত হয়ে এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাঙালি হুজুগে জাতি—এটা আমরা সবাই জানি। একবার হুজুগে মেতে উঠে ইংরেজিকে চরম অবহেলা করেছে, এমনকি বাংলা ভাষা চর্চায়ও প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়নি। বাঙালি হুজুগে মেতে জাতীয়তাবাদী হলেও জীবনে আর ধ্যানধারণায় সে আজ একেবারে সর্বাংশে পশ্চিমের মুখাপেক্ষী। পশ্চিম থেকে নানা ধুয়া শুনে সে দোহারকির কাজ করে তা এ দেশে চালানোর চেষ্টা শুরু করে। এখন স্কুলশিক্ষায় সাহিত্য কৌলীন্য খুইয়ে ব্রাত্যজন, বৃত্তি-পেশা এমনই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে যে জীবনসাধনার প্রাথমিক রসদগুলোও আর স্কুল থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-ব্যবসায়ী-প্রশাসক মিলছে ভূরি ভূরি কিন্তু মানুষের আকাল কেবলই বেড়ে চলেছে।
একজন মানুষের খাঁটি মানুষ হওয়ার জন্য শিকড়ও চাই, সঠিক বাতাবরণও প্রয়োজন। সেটাই সংস্কৃতি। স্কুল সে কাজ করা থেকে বিরত রয়েছে আজ বহুকাল। একালে শিক্ষার একটাই ফসল—তা হলো পরীক্ষায় সাফল্য। এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে শিক্ষকেরা শিক্ষাকে তাঁদের জীবনমান বাড়ানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে শিক্ষককে কেন্দ্র করে স্কুলে যে শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা সে কাজ হতে পারে না। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীদের শতকরা ৯৯ জনের পক্ষে এ জীবনে আর বঙ্কিম-শরত্চন্দ্র-মীর মশাররফ-তারাশঙ্কর-বিভূতি-মানিক পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। থাকবে না মাইকেল-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-শামসুর রাহমানের কবিতার রস আস্বাদনের উপায়।
এদের ডিঙিয়ে যখন বাউল গানে ভক্তি দেখা যায় তখন তা ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি একজন বিদেশির কৌতূহলী উত্সাহের সঙ্গেই তুলনীয়। কারণ ভাষার যে ব্যঞ্জনা, নানা ভাবগত, ইতিহাসগত অনুষঙ্গ থাকে এবং যা ভাষার ব্যবহারিক প্রকাশে অনবরত বিস্তৃত-সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা সাহিত্যের মাধ্যমে সঞ্জীবিত-সৃজিত হতে থাকে তা ক্রমেই এদের কাছে দুর্বোধ্য অচেনা হয়ে পড়বে। এরা কেবল অল্প কিছু চেনা শব্দের মাধ্যমে কোনোমতে কথাটুকু বলতে পারবে। কান পাতলেই এবং খেয়াল করলেই ধরা পড়বে যে এসব বঙ্গসন্তানের শব্দভাণ্ডার কতই ক্ষীণ, প্রমিত বাংলায় মনের ভাব প্রকাশে কতটা অক্ষম হয়ে পড়ছে তারা।
আবার যে ইংরেজি শেখা হচ্ছে তা কথা বলায় পারদর্শিতাটুকুই এনে দিচ্ছে কিন্তু গভীর জটিল মৌলিক ভাবনা লেখার মতো দক্ষতা তাতে অর্জিত হয় না। কারণ ভাষা তো সজীব প্রাণবন্ত বিষয়, তাই জীবন্ত-সংস্কৃতির যোগ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় মৌলিক কিছু লেখা কঠিন।
এভাবে আমরা সমৃদ্ধ দ্বিভাষী শিক্ষিত সমাজকে কখনো একভাষী কখনো ভাষাহীন (অর্থাত্ বোবা), কখনো বা ভাষাবিকৃতি-কবলিত, আর কখনো ভাষা-সংস্কৃতিহীন মানুষে রূপান্তরিত করছি। এভাবে আমরা মানুষ হিসেবে কেবল দীন হচ্ছি তা নয়, গুণগতভাবে খারাপ হয়ে পড়ছি।
দেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন দুর্বৃত্তের সংখ্যা এমনি এমনি বাড়ছে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments