বাংলাদেশে সমাজকর্মে উচ্চশিক্ষা -শিক্ষা by মুহাম্মদ সামাদ
১৮৯৮ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ শতকের গোড়া থেকে ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজকর্ম একটি ব্যবহারিক সামজিক বিজ্ঞান হিসেবে পঠিত ও অনুশীলিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকা শহরে অভিবাসী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত সামাজিক সেবাব্যবস্থা অনেকটা অপ্রতুল ও অকার্যকর প্রতীয়মান হয়। ফলে শহরের সামাজিক সেবা খাতকে উন্নত, কার্যকর ও সহজলভ্য করার লক্ষে সমাজকর্মের পেশাগত প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৫৪ সালে তত্কালীন সরকারের উদ্যোগে ও জাতিসংঘের সহায়তায় বংলাদেশে প্রথম সমাজকর্মের পেশাগত প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ প্রশিক্ষণ ছিল নয় মাস মেয়াদি। এ প্রশিক্ষণ চলাকালেই সমাজকর্ম বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স কোর্স চালুর প্রস্তাব গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৫৮ সালে ঢাকায় ‘কলেজ অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এ দেশের সমাজকর্মের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে এটি ‘সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট’রূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে অদ্যাবধি সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে আসছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯২ সালে জগন্নাথ কলেজ, ১৯৯৩ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে সমাজকর্মে উচ্চশিক্ষা চালু হয়েছে।
এ বছর আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের সমাজকর্মশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সংস্থা ‘কাউন্সিল অন সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (সিএসডব্লিউই)’ পরিচালিত ‘ক্যাথেরিন ক্যানডাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন’-এ আমার একটি ফেলোশিপ করার সৌভাগ্য হয়। আমার গষেণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সমাজকর্ম শিক্ষা ও সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন অভিজ্ঞতা’। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজকর্ম একটি পেশাগত বিষয় এবং এর পাঠদানে সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন বা অনুমোদন বাধ্যতামূলক। বর্তমানে সিএসডব্লিউইর অনুমোদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দিয়ে আসছে।
এবার আসি অনুশীলন বা পেশাগত দিকে। যুক্তরাষ্ট্র বা যেসব দেশে সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি রয়েছে, সেসব দেশে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর দুই বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হয়। তারপর চিকিত্সক-আইনজীবীদের মতো লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলে তাঁরা পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। অনেকে ব্যক্তিগত ক্লিনিক খুলে মনোসামাজিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাউন্সেলিং করে ভালো আয় করেন। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা খুবই কার্যকর। এশিয়ার মধ্যে সমাজসেবা ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ায় পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগের হার সম্ভবত সর্বোচ্চ হবে। এ বছরের ১৫-১৮ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত ‘সমাজকর্ম শিক্ষার উন্নয়ন ও অনুশীলন’ শীর্ষক এশিয়া-প্যাসিফিক (অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই পর্যন্ত) অঞ্চলের ২১টি দেশের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সিউল সম্মেলনে বাংলাদেশের সমাজকর্মশিক্ষার ওপর একটি প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ হয়েছিল আমার। এ সম্মেলন থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র স্ব দেশেই সমাজকর্মশিক্ষার উন্নয়ন এবং সরকার ও এনজিও পরিচালিত সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন—দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার; শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি, গণতন্ত্র-মানবাধিকার, অপরাধ-কিশোর অপরাধ, মানব পাচার, পরিবেশ-জীববৈচিত্র সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগ অধিক ফলপ্রসূ। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারের সমাজসেবা বিভাগে ‘সমাজসেবা কর্মকর্তা’ পদটি সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের স্নাতকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পরে তা সব বিষয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে পেশাগত সমাজকর্ম বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। উপযুক্ত পেশাদার সংগঠনের অভাবে বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও নেতৃত্বকেও আমরা এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞানের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানাতে পারিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে করা আমার ছোট গবেষণাকর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, বাংলাদেশে পেশাগত সমাজকর্মের যাত্রাকালের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষে সমাজকর্মশিক্ষার উন্নয়ন ও প্রয়োগ সম্পর্কিত করণীয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। এ কাজটি করতে গিয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাক্রিডিটেশন-সংক্রান্ত ম্যানুয়েল-বই-দলিলপত্র ঘেঁটেছি; ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড, জর্জ ম্যাসন, ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়; পেনসিলভেনিয়ার ওয়েস্ট চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়; টেক্সাসের হিউজটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিনেসোটার উইনোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়ার্ক স্কুলের ডিন ও অধ্যাপকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি; সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন বা ক্যান্ডিড্যাসি কর্মশালায় অংশ নিয়েছি।
আলোচনার সূত্রপাত এ অর্থে যে ১৯৫৮ সালে থেকে বাংলাদেশে সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স চালু হলেও এটি এখনো পেশাগত স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো অ্যাক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি এবং সমাজকর্মশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হলে অ্যাক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তা করতে হলে আমাদের ছাত্র ভর্তিপদ্ধতি, কারিকুলাম, সিলেবাস, বিষয়সূচিতে পরিবর্তন-পরিমার্জনা জরুরি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ইচ্ছা ও মনোভঙ্গি পরীক্ষা’ (Attitude and Aptitude Test) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; পাঠ্যসূচিতে একদিকে যেমন সিএসডব্লিউইর নির্দেশনা অনুসরণ করে নতুন কোর্স যুক্ত করতে হবে; অন্যদিকে তেমনি দেশ বা স্থানীয় সমস্যা মোকাবিলার লক্ষে দেশজ সাহিত্য বা জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কোর্স তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরস্পরের একাডেমিক সফর, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও ছাত্র-শিক্ষক শিক্ষা বিনিময়; স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার-ওয়ার্কশপের আয়োজন করা একান্ত আবশ্যক। আর সমাজকর্মশিক্ষা ও অনুশীলনের মান উন্নয়ন এবং যুগোপযোগী করার লক্ষে বিশ্বব্যাপী যেসব সংস্থা যেমন—সিএসডব্লিউই, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল ওয়ার্কারস (এনএএসডব্লিউ), এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (এপিএএসডব্লিউ) প্রভৃতির সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন ও একযোগে কাজ করতে হবে।
এসব করতে হলে বাংলাদেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিভাগ থেকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। আর তা যদি সম্ভব হয়, তবেই বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলনের মান উন্নয়ন সম্ভব হবে। এভাবে একদিকে যেমন সরকারের সমাজসেবা বিভাগ ও দেশের এনজিও সেক্টরে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের স্নাতকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের সামাজিক উন্নয়ন খাত সমৃদ্ধ হবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষা ও অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত (সরকারি-বেসরকারি সমাজসেবা খাতে কর্মরত) সবাইকে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
ড. মুহাম্মদ সামাদ: অধ্যাপক ও পরিচালক; সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বছর আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের সমাজকর্মশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সংস্থা ‘কাউন্সিল অন সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (সিএসডব্লিউই)’ পরিচালিত ‘ক্যাথেরিন ক্যানডাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন’-এ আমার একটি ফেলোশিপ করার সৌভাগ্য হয়। আমার গষেণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সমাজকর্ম শিক্ষা ও সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন অভিজ্ঞতা’। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজকর্ম একটি পেশাগত বিষয় এবং এর পাঠদানে সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন বা অনুমোদন বাধ্যতামূলক। বর্তমানে সিএসডব্লিউইর অনুমোদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দিয়ে আসছে।
এবার আসি অনুশীলন বা পেশাগত দিকে। যুক্তরাষ্ট্র বা যেসব দেশে সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি রয়েছে, সেসব দেশে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর দুই বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হয়। তারপর চিকিত্সক-আইনজীবীদের মতো লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলে তাঁরা পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। অনেকে ব্যক্তিগত ক্লিনিক খুলে মনোসামাজিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাউন্সেলিং করে ভালো আয় করেন। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা খুবই কার্যকর। এশিয়ার মধ্যে সমাজসেবা ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ায় পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগের হার সম্ভবত সর্বোচ্চ হবে। এ বছরের ১৫-১৮ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত ‘সমাজকর্ম শিক্ষার উন্নয়ন ও অনুশীলন’ শীর্ষক এশিয়া-প্যাসিফিক (অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই পর্যন্ত) অঞ্চলের ২১টি দেশের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সিউল সম্মেলনে বাংলাদেশের সমাজকর্মশিক্ষার ওপর একটি প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ হয়েছিল আমার। এ সম্মেলন থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র স্ব দেশেই সমাজকর্মশিক্ষার উন্নয়ন এবং সরকার ও এনজিও পরিচালিত সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন—দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার; শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি, গণতন্ত্র-মানবাধিকার, অপরাধ-কিশোর অপরাধ, মানব পাচার, পরিবেশ-জীববৈচিত্র সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগ অধিক ফলপ্রসূ। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারের সমাজসেবা বিভাগে ‘সমাজসেবা কর্মকর্তা’ পদটি সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের স্নাতকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পরে তা সব বিষয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে পেশাগত সমাজকর্ম বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। উপযুক্ত পেশাদার সংগঠনের অভাবে বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও নেতৃত্বকেও আমরা এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞানের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানাতে পারিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে করা আমার ছোট গবেষণাকর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, বাংলাদেশে পেশাগত সমাজকর্মের যাত্রাকালের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষে সমাজকর্মশিক্ষার উন্নয়ন ও প্রয়োগ সম্পর্কিত করণীয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। এ কাজটি করতে গিয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাক্রিডিটেশন-সংক্রান্ত ম্যানুয়েল-বই-দলিলপত্র ঘেঁটেছি; ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ড, জর্জ ম্যাসন, ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়; পেনসিলভেনিয়ার ওয়েস্ট চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়; টেক্সাসের হিউজটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিনেসোটার উইনোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়ার্ক স্কুলের ডিন ও অধ্যাপকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি; সিএসডব্লিউইর অ্যাক্রিডিটেশন বা ক্যান্ডিড্যাসি কর্মশালায় অংশ নিয়েছি।
আলোচনার সূত্রপাত এ অর্থে যে ১৯৫৮ সালে থেকে বাংলাদেশে সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স চালু হলেও এটি এখনো পেশাগত স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো অ্যাক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি এবং সমাজকর্মশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হলে অ্যাক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তা করতে হলে আমাদের ছাত্র ভর্তিপদ্ধতি, কারিকুলাম, সিলেবাস, বিষয়সূচিতে পরিবর্তন-পরিমার্জনা জরুরি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে ‘ইচ্ছা ও মনোভঙ্গি পরীক্ষা’ (Attitude and Aptitude Test) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; পাঠ্যসূচিতে একদিকে যেমন সিএসডব্লিউইর নির্দেশনা অনুসরণ করে নতুন কোর্স যুক্ত করতে হবে; অন্যদিকে তেমনি দেশ বা স্থানীয় সমস্যা মোকাবিলার লক্ষে দেশজ সাহিত্য বা জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কোর্স তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরস্পরের একাডেমিক সফর, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও ছাত্র-শিক্ষক শিক্ষা বিনিময়; স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার-ওয়ার্কশপের আয়োজন করা একান্ত আবশ্যক। আর সমাজকর্মশিক্ষা ও অনুশীলনের মান উন্নয়ন এবং যুগোপযোগী করার লক্ষে বিশ্বব্যাপী যেসব সংস্থা যেমন—সিএসডব্লিউই, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল ওয়ার্কারস (এনএএসডব্লিউ), এশিয়া প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (এপিএএসডব্লিউ) প্রভৃতির সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন ও একযোগে কাজ করতে হবে।
এসব করতে হলে বাংলাদেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিভাগ থেকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। আর তা যদি সম্ভব হয়, তবেই বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলনের মান উন্নয়ন সম্ভব হবে। এভাবে একদিকে যেমন সরকারের সমাজসেবা বিভাগ ও দেশের এনজিও সেক্টরে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের স্নাতকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের সামাজিক উন্নয়ন খাত সমৃদ্ধ হবে। তাই আর কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষা ও অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত (সরকারি-বেসরকারি সমাজসেবা খাতে কর্মরত) সবাইকে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
ড. মুহাম্মদ সামাদ: অধ্যাপক ও পরিচালক; সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments