এক তরুণের স্বপ্ন ও এক বিদেশি বন্ধু by হামিদ মোহাম্মদ
দ্য ক্যাফে আইটি স্কুলের ল্যাব |
সব
মানুষের স্বপ্ন থাকে বড় হওয়ার। এই স্বপ্নপূরণের জন্য প্রয়োজন সুযোগ এবং
সঙ্গে ইচ্ছা। যাদের জীবনে স্বপ্ন দেখা বা কোনো ইচ্ছারও সুযোগ নেই, তাদের
বেলায় কী বলা চাই। এ রকম অবাক করা এক তরুণের গল্প বলার সুযোগ আমার হয়েছে।
আমার সুযোগ হওয়া এ জন্য বললাম, আমরা অভ্যস্ত যেভাবে সেটা এতই ব্যতিক্রম, যা
চমকে দেওয়ার মতো। আমি চমকে গেছি, বিশ্বমাত্রিকতায় জায়গা করে নেওয়ার অদম্য
এক তরুণের স্বপ্নবাজির কথা শুনে। এই স্বপ্নবাজ তরুণের নাম মো. কবির উদ্দিন।
সিলেটের খাদিমনগরের দলইপাড়ার সন্তান।
কিন্তু প্রচলিত চিন্তাধারার ব্যতিক্রম কবির উদ্দিন। তিনি কোনো স্বপ্নই দেখেননি। সেই স্বপ্ন না দেখা কবির উদ্দিন এখন উচ্চতায় ছাড়িয়ে গেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার হতদরিদ্র ছ্যামছ্যামে বৃষ্টিভেজা, শীতে হাড়কাঁপানো মাটি ছোঁয়া অন্ধকার স্থানটি। অনেক দূরে বিজ্ঞানের আলো ঝলমল স্থানে তাঁর অবস্থান। তিনি ঘুরে বেড়ান, বক্তব্য দেন বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে, আইটি সেমিনারে, উপস্থাপন করেন সফটওয়্যারের নানা উদ্ভাবনী।
নিতান্ত দারিদ্র্যে ডুবে হাবুডুবু খাওয়া, কোনো রকম বেঁচে থাকার লড়াই করা জীবন ছিল তাঁর। নয় ভাইবোনের সংসার। বাবা কৃষক, অষ্টম শ্রেণি পাসÑনাম মো. মোখসেদ আলী। মা পঞ্চম শ্রেণি পাস আমীরুন নেসা। নিজের বাড়ি নেই। বাড়িভাড়া না দিতে পারায় আশ্রয় পান খাদিমনগর এফআইভিডিভির পাশে একটি মুরগির ফার্মের টিনের একচালায়। এফআইভিডিভির জমিতে চাষবাস করে দিন গুজরান চলে। চাষবাসে চলে না। তাই বাড়তি রোজগারের আশায় মোখসেদ আলী সন্তানদের খাদিমনগর প্রধান সড়কে চা-বিস্কুটের দোকান পেতে দেন। মোটের ওপর এই হলো কবির উদ্দিনদের পরিবারের বৃত্তান্ত।
এই বিদ্যুৎ-তরুণ কবির উদ্দিন তাঁর পরিবারের কষ্টের দিনগুলোর কথা এভাবেই বলছিলেন। পরিচয় বা তাঁর সম্পর্কে জানা হয়েছিল সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসনের মাধ্যমে। পত্রিকা অফিসে তিনি এসেছিলেন ২০১৭ সালে একবার। তখন তাঁর কাহিনি আংশিক জেনেছিলাম। তিনি ম্যানচেস্টার ও নরউইচে বিভিন্ন সেমিনারে ব্যস্ত। ফোনেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলাম। শুনতে থাকলাম তাঁর গল্প। জন্ম ১৯৯৩ সালে।
কবির উদ্দিন বলছিলেন তাঁর জীবনের মোড় নেওয়ার কাল ২০০৪ সালের কথা। তখন তাঁর বয়স ১১ বছর। রমজান মাস। বাবা মোখসেদ আলী ইফতার করতে এফআইডিভির ক্যানটিনে গেছেন, সেখানে জমি চাষাবাদ ও সামান্য চাকরি করার সুবাদে। কবির উদ্দিনও বাবার সঙ্গে গেলেন ক্যানটিনে। উদ্দেশ্য টিভি দেখা রেসলিং, অ্যাডভেঞ্চার।
ক্যানটিনে ছিলেন একজন ব্রিটিশ শিক্ষক। তিনি টিচার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন। নাম লুক ডয়েল। অ্যাডভেঞ্চার দেখার প্রতি অন্য দশ বালকের মতো তার আকর্ষণ দেখে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু কবির ইংরেজি বলতে বা উত্তর দিতে পারছিলেন না।
কবির উদ্দিনের অল্প লেখাপড়া। দলইপাড়া হজরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রহ.) মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর এফআইডিভি বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে অল্প দিন পর্যন্ত পড়া। দু-একটা ইংরেজি শব্দ-অনেকটা আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো। লুক ডয়েল পাশের রুমে রাখা ল্যাপটপ কম্পিউটারটি এনে তাকে টাইপ করে প্রশ্ন করলেন, যা বাংলায় দাঁড়ায় ‘এটা কি তুমি চালাতে পারো?’ কবির উদ্দিন কাঁচুমাচু করে বলল, না। লুক ডয়েল বললেন, ‘আমি তোমাকে শেখাব।’ লুক বুঝতে পারলেন, ছেলেটি শিখতে চায়-কম্পিউটারসহ আরও অনেক কিছু। চিক চিক করা তার চোখের ভাষায় সেই উত্তর ঝিলমিল করছে।
কিন্তু প্রচলিত চিন্তাধারার ব্যতিক্রম কবির উদ্দিন। তিনি কোনো স্বপ্নই দেখেননি। সেই স্বপ্ন না দেখা কবির উদ্দিন এখন উচ্চতায় ছাড়িয়ে গেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার হতদরিদ্র ছ্যামছ্যামে বৃষ্টিভেজা, শীতে হাড়কাঁপানো মাটি ছোঁয়া অন্ধকার স্থানটি। অনেক দূরে বিজ্ঞানের আলো ঝলমল স্থানে তাঁর অবস্থান। তিনি ঘুরে বেড়ান, বক্তব্য দেন বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে, আইটি সেমিনারে, উপস্থাপন করেন সফটওয়্যারের নানা উদ্ভাবনী।
নিতান্ত দারিদ্র্যে ডুবে হাবুডুবু খাওয়া, কোনো রকম বেঁচে থাকার লড়াই করা জীবন ছিল তাঁর। নয় ভাইবোনের সংসার। বাবা কৃষক, অষ্টম শ্রেণি পাসÑনাম মো. মোখসেদ আলী। মা পঞ্চম শ্রেণি পাস আমীরুন নেসা। নিজের বাড়ি নেই। বাড়িভাড়া না দিতে পারায় আশ্রয় পান খাদিমনগর এফআইভিডিভির পাশে একটি মুরগির ফার্মের টিনের একচালায়। এফআইভিডিভির জমিতে চাষবাস করে দিন গুজরান চলে। চাষবাসে চলে না। তাই বাড়তি রোজগারের আশায় মোখসেদ আলী সন্তানদের খাদিমনগর প্রধান সড়কে চা-বিস্কুটের দোকান পেতে দেন। মোটের ওপর এই হলো কবির উদ্দিনদের পরিবারের বৃত্তান্ত।
এই বিদ্যুৎ-তরুণ কবির উদ্দিন তাঁর পরিবারের কষ্টের দিনগুলোর কথা এভাবেই বলছিলেন। পরিচয় বা তাঁর সম্পর্কে জানা হয়েছিল সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসনের মাধ্যমে। পত্রিকা অফিসে তিনি এসেছিলেন ২০১৭ সালে একবার। তখন তাঁর কাহিনি আংশিক জেনেছিলাম। তিনি ম্যানচেস্টার ও নরউইচে বিভিন্ন সেমিনারে ব্যস্ত। ফোনেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলাম। শুনতে থাকলাম তাঁর গল্প। জন্ম ১৯৯৩ সালে।
কবির উদ্দিন বলছিলেন তাঁর জীবনের মোড় নেওয়ার কাল ২০০৪ সালের কথা। তখন তাঁর বয়স ১১ বছর। রমজান মাস। বাবা মোখসেদ আলী ইফতার করতে এফআইডিভির ক্যানটিনে গেছেন, সেখানে জমি চাষাবাদ ও সামান্য চাকরি করার সুবাদে। কবির উদ্দিনও বাবার সঙ্গে গেলেন ক্যানটিনে। উদ্দেশ্য টিভি দেখা রেসলিং, অ্যাডভেঞ্চার।
ক্যানটিনে ছিলেন একজন ব্রিটিশ শিক্ষক। তিনি টিচার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন। নাম লুক ডয়েল। অ্যাডভেঞ্চার দেখার প্রতি অন্য দশ বালকের মতো তার আকর্ষণ দেখে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু কবির ইংরেজি বলতে বা উত্তর দিতে পারছিলেন না।
কবির উদ্দিনের অল্প লেখাপড়া। দলইপাড়া হজরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রহ.) মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। তারপর এফআইডিভি বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে অল্প দিন পর্যন্ত পড়া। দু-একটা ইংরেজি শব্দ-অনেকটা আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো। লুক ডয়েল পাশের রুমে রাখা ল্যাপটপ কম্পিউটারটি এনে তাকে টাইপ করে প্রশ্ন করলেন, যা বাংলায় দাঁড়ায় ‘এটা কি তুমি চালাতে পারো?’ কবির উদ্দিন কাঁচুমাচু করে বলল, না। লুক ডয়েল বললেন, ‘আমি তোমাকে শেখাব।’ লুক বুঝতে পারলেন, ছেলেটি শিখতে চায়-কম্পিউটারসহ আরও অনেক কিছু। চিক চিক করা তার চোখের ভাষায় সেই উত্তর ঝিলমিল করছে।
ওয়াশিংটনে মাইক্রোসফট হেডকোয়ার্টারে মো. কবির উদ্দিন ও লুক ডয়েল |
লুক
ডয়েল লন্ডনের কেন্টের একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। গিয়েছিলেন
চ্যারিটি সংস্থার হয়ে সিলেটের এফআইভিডিভিতে শিক্ষকতায়-টিচার ট্রেইনার
হিসেবে। তিনি যেন খুঁজে পেলেন এখানে জীবনের সন্ধান, পেলেন এক
বিদ্যুৎ-বালককে। তাঁর হাত ধরেই শুরু হলো কবির উদ্দিনের সামনে চলা। যা
স্বপ্নেও কল্পনা করেননি তিনি। লুক ডয়েল তাঁকে অবাক করে দিয়েই দায়িত্ব নিলেন
তার পড়ালেখার ব্যয়ভার বহনের। ভর্তি করে দিলেন ইংলিশ মিডিয়ামে সিলেট
ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে।
কিন্তু ২০০৭ সালে আসে এক কঠিন সময়। ওই সময় বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। এ সরকার লুক ডয়েলকে ভিসা দেয় মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। বাংলাদেশে লুক ডয়েল থাকতে না পেরে চলে যান চীন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতায়। কিন্তু কবির উদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি।
২০১০ সালে লুক ডয়েল আবার যান বাংলাদেশে। তবে এবার সিলেটে নয়Ñঢাকায় যান একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতে। তখন কবিরকেও নিয়ে এলেন ঢাকায়। এ সময় বনানীর দ্য নিউ স্কুল অব ঢাকা থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন কবির উদ্দিন। একই সময়ে লুক ডয়েল ঢাকার বাড্ডায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দ্য ক্যাফে’ নামে একটি আইটি স্কুল। শুরু হলো অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের বিনা বেতনে বেসিক কম্পিউটার শিক্ষা থেকে প্রোগ্রামিং শিক্ষাদান পর্যন্ত। সেখানে কবিরও প্রোগ্রামিংসহ সফটওয়্যার প্রশিক্ষণ শিখে অল্প দিনেই শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণদান শুরু করেন।
একই সময়ে ঢাকায় একটি সংস্থা পরিচালিত লেফ নামে একটি আইটি স্কুল ছিল। লেফ মানে ‘লাভ, এডুকেশন ও ফুড’। তারা অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের সামাজিক বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাদান ও খাবারের ব্যবস্থা করত। পরিচয় হলো তাদের সঙ্গে। লুক ডয়েলের ভালো লাগল প্রজেক্টটি। জড়িয়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কম্পিউটার ও প্রোগ্রামিং শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিলেন। তাদের ১০টি কম্পিউটারও চ্যারিটির মাধ্যমে সংগ্রহ করে দেন। যাতে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতভাবে দাঁড়াতে পারে।
কিছুদিন পর, ২০১৬ সালে লুক ডয়েল আবার গেলেন সিলেটে। সেখানে খাদিমনগরে ১৫ হাজার টাকায় একটি ভাড়া বাড়ি নিয়ে কবির উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন আইটি স্কুল নাম দ্য ক্যাফে। ক্যাফের অর্থ কম্পিউটার আর ফ্রি ফর এভরি ওয়ান। অল্প দিনেই ৩০টি কম্পিউটারের ব্যবস্থা হলো বিভিন্ন চ্যারিটি সংস্থার বদান্যতায় ও নানা অনুদানে।
বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ২৫০ শিক্ষার্থী রয়েছেন। ৩০ জনের ব্যাচ, এক ঘণ্টা করে স্টাডি ক্লাস। শিক্ষার্থীদের বয়স ৬ থেকে ২৫ বছর। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্কুলের ক্লাসের পর আসেন, সপ্তাহে দুই দিন। এ ছাড়া যাঁরা নানা কারণে লেখাপড়ার সুযোগবঞ্চিত হয়ে পড়েছেন, কিছু করছেন না- তাঁদেরও যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়।
ক্যাফেতে প্রোগ্রামিং ও গ্রাফিক ছাড়াও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে নানা খেলনা তৈরি ও তা সঞ্চালনা শিশুদের শেখানো হয়। শেখানো হয় বিজ্ঞানমনস্কতা। কবির উদ্দিন প্রোগ্রামিং শিক্ষা থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির এই প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক।
কবির উদ্দিনের যে কথাটি আমাকে বিস্মিত করে বেশি তা হলোÑলুক ডয়েল তাঁর স্বপ্নঘেরা এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ভার নির্বাহ করতে যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশের চ্যারিটি সংস্থা থেকে ফান্ড জোগাড় করেন নিয়মিত। মূলত লুক ডয়েলই মানুষ তৈরির এক অদ্বিতীয় স্বপ্নযান, যাঁর উচ্চতা আকাশছোঁয়া। যে লোকটির স্বনিষ্ঠ প্রণোদনায় সহিংস পৃথিবীতে মানব তৈরির এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে সিলেটের খাদিমনগরে।
জানলাম এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেসিক কম্পিউটার শিক্ষাসহ প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট শিখছে শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় ৬৫ ভাগ রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থী। শিক্ষা সমাপ্তির পর নিজ নিজ ক্ষেত্রে এবং স্বউদ্যোগে স্বাধীনভাবে ঘরে বসেই সফটওয়্যার ও গ্রাফিক ডিজাইন তৈরি করে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন অনেকেই। স্বাবলম্বী হচ্ছে শত শত তরুণ-তরুণী ও পরিবার।
কিন্তু ২০০৭ সালে আসে এক কঠিন সময়। ওই সময় বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। এ সরকার লুক ডয়েলকে ভিসা দেয় মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য। বাংলাদেশে লুক ডয়েল থাকতে না পেরে চলে যান চীন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতায়। কিন্তু কবির উদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি।
২০১০ সালে লুক ডয়েল আবার যান বাংলাদেশে। তবে এবার সিলেটে নয়Ñঢাকায় যান একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতে। তখন কবিরকেও নিয়ে এলেন ঢাকায়। এ সময় বনানীর দ্য নিউ স্কুল অব ঢাকা থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন কবির উদ্দিন। একই সময়ে লুক ডয়েল ঢাকার বাড্ডায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দ্য ক্যাফে’ নামে একটি আইটি স্কুল। শুরু হলো অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের বিনা বেতনে বেসিক কম্পিউটার শিক্ষা থেকে প্রোগ্রামিং শিক্ষাদান পর্যন্ত। সেখানে কবিরও প্রোগ্রামিংসহ সফটওয়্যার প্রশিক্ষণ শিখে অল্প দিনেই শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণদান শুরু করেন।
একই সময়ে ঢাকায় একটি সংস্থা পরিচালিত লেফ নামে একটি আইটি স্কুল ছিল। লেফ মানে ‘লাভ, এডুকেশন ও ফুড’। তারা অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের সামাজিক বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাদান ও খাবারের ব্যবস্থা করত। পরিচয় হলো তাদের সঙ্গে। লুক ডয়েলের ভালো লাগল প্রজেক্টটি। জড়িয়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কম্পিউটার ও প্রোগ্রামিং শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিলেন। তাদের ১০টি কম্পিউটারও চ্যারিটির মাধ্যমে সংগ্রহ করে দেন। যাতে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতভাবে দাঁড়াতে পারে।
কিছুদিন পর, ২০১৬ সালে লুক ডয়েল আবার গেলেন সিলেটে। সেখানে খাদিমনগরে ১৫ হাজার টাকায় একটি ভাড়া বাড়ি নিয়ে কবির উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন আইটি স্কুল নাম দ্য ক্যাফে। ক্যাফের অর্থ কম্পিউটার আর ফ্রি ফর এভরি ওয়ান। অল্প দিনেই ৩০টি কম্পিউটারের ব্যবস্থা হলো বিভিন্ন চ্যারিটি সংস্থার বদান্যতায় ও নানা অনুদানে।
বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ২৫০ শিক্ষার্থী রয়েছেন। ৩০ জনের ব্যাচ, এক ঘণ্টা করে স্টাডি ক্লাস। শিক্ষার্থীদের বয়স ৬ থেকে ২৫ বছর। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্কুলের ক্লাসের পর আসেন, সপ্তাহে দুই দিন। এ ছাড়া যাঁরা নানা কারণে লেখাপড়ার সুযোগবঞ্চিত হয়ে পড়েছেন, কিছু করছেন না- তাঁদেরও যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়।
ক্যাফেতে প্রোগ্রামিং ও গ্রাফিক ছাড়াও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে নানা খেলনা তৈরি ও তা সঞ্চালনা শিশুদের শেখানো হয়। শেখানো হয় বিজ্ঞানমনস্কতা। কবির উদ্দিন প্রোগ্রামিং শিক্ষা থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির এই প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক।
কবির উদ্দিনের যে কথাটি আমাকে বিস্মিত করে বেশি তা হলোÑলুক ডয়েল তাঁর স্বপ্নঘেরা এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ভার নির্বাহ করতে যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশের চ্যারিটি সংস্থা থেকে ফান্ড জোগাড় করেন নিয়মিত। মূলত লুক ডয়েলই মানুষ তৈরির এক অদ্বিতীয় স্বপ্নযান, যাঁর উচ্চতা আকাশছোঁয়া। যে লোকটির স্বনিষ্ঠ প্রণোদনায় সহিংস পৃথিবীতে মানব তৈরির এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে সিলেটের খাদিমনগরে।
জানলাম এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেসিক কম্পিউটার শিক্ষাসহ প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট শিখছে শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় ৬৫ ভাগ রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থী। শিক্ষা সমাপ্তির পর নিজ নিজ ক্ষেত্রে এবং স্বউদ্যোগে স্বাধীনভাবে ঘরে বসেই সফটওয়্যার ও গ্রাফিক ডিজাইন তৈরি করে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন অনেকেই। স্বাবলম্বী হচ্ছে শত শত তরুণ-তরুণী ও পরিবার।
মো. কবির উদ্দিন |
উপার্জন
বিষয়ে কবির উদ্দিন উদাহরণ হিসেবে বললেন, তাঁর ছোট ভাই ফয়েজ উদ্দিন, বয়স
১৪। সে দুই ঘণ্টায় রোজগার করে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তাঁর ভাই কিশোর বয়সেই
যে টাকা রোজগার করছে সে জায়গায় তাদের বাবা এক মাসেও কখনো সেই টাকা চাষবাস
করে উপার্জন করতে পারেননি।
আর কবির উদ্দিন ও তাঁর ভাই ফয়েজ উদ্দিন কিশোর বয়সেও সফটওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ে লন্ডনের রেভেনাসবোর্ন কলেজে এসেছেন ২০১৭ সালে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। এই মেলায় প্রদর্শিত সফটওয়্যারটি ছিল কোনো শিশু জলে পড়লে কীভাবে তাঁর মা-বাবা জানবেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ঘড়ির মতো একটি ডিভাইস থাকবে শিশুটির কবজিতে আরেকটি ডিভাইস থাকবে মা-বাবার কাছে। কোনো নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই ডিভাইসটি সতর্ক বার্তা দেবে। এটা তাঁদের নিজস্ব উদ্ভাবনী। এই সফটওয়্যারটির প্রদর্শনীতে সহ-প্রোগ্রামার ছিলেন বর্তমানে কবির উদ্দিনের সহধর্মিণী ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রোকশানা আকতারও।
কবির উদ্দিন এবার ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে এসেছেন বেশ কয়েকটি এক্সপো মেলা ও সেমিনারে অংশ নিতে। এর মধ্যে অংশ নিয়েছেন ম্যানচেস্টারে ৪ মে থেকে ৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্লে এক্সপোতে। ডানস্টবলের ওয়াদার ফিল্ড একাডেমিতে প্রোগ্রামিং শিক্ষার সফটওয়্যার প্রদর্শন caffebd.org ওয়েবসাইটে গেলেই বিস্তারিত জানা যাবে। এ ছাড়া ২৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নরউইচ গেম ফেস্টিভ্যালে যোগ দেন কবির।
এর আগে কবির উদ্দিন আটবার (২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত) যুক্তরাজ্যে এসেছেন। সব সফরই বিভিন্ন এক্সপোতে যোগদান ও চ্যারিটির নানা কাজে। এর ব্যয়ভার কখনো বহন করেছেন লুক নিজে, কখনো চ্যারিটি সংস্থার সৌজন্যে। যুক্তরাষ্ট্রেও কবির উদ্দিন গিয়েছেন, ওয়াশিংটনে মাইক্রোসফট হেডকোয়ার্টারে ২০১৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে, সঙ্গে ছিলেন লুক ডয়েলও।
বিভিন্ন দেশ ও নানা এক্সপো মেলায় যোগদান করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে এবং যে সাহস তৈরি হয়েছেÑতাতে কবির উদ্দিন এখন স্বপ্ন দেখছেন।
কথার শেষ পর্যায়ে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি একটি আইটি ইনস্টিটিউট করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য ৮ শতক ভূমি সিলেটে ক্রয় করেছেন। এর অর্থ দিয়েছে কয়েকটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। বহুতল ভবন নির্মাণ করবেন সেখানে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত টাকা পাবে কই? উত্তরে কবির হেসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, চ্যারিটি সংস্থাসমূহের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করব। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে আমাদের সহায়তা করছেÑতারা তো আছেই। তবে ফান্ড রাইজিংয়ে আগামী অক্টোবরে তিনি ইংল্যান্ডের বরমাউথে অনুষ্ঠিতব্য ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেবেন। তাঁর আশা, বড় একটা ফান্ড সংগ্রহ হবে তখন।
সবকিছু শুনে মনে হলো-কবিরকে স্বপ্ন দেখানোর মানুষ লুক ডয়েল একজন নিরহংকার শিক্ষানুরাগী শিক্ষক শুধু নয়, মানব তৈরির এক অসামান্য দূত এই লোকটি। কবির উদ্দিন তাঁর অবদান সম্পর্কে বারবার বলছিলেন নানা উচ্চতায়। জীবনকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করার দীপ্তি ছিল কবিরের প্রতিটি কথায়।
লুক ডয়েলের হাতে গড়া সিলেটের আইটি প্রতিষ্ঠান দ্য ক্যাফেতে আছেন ছয়জন শিক্ষক। এঁদের বেতন মাসে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। কোনো চ্যারিটি সংস্থা থেকে যদি এই অর্থ সংগ্রহ সম্ভব না হয়Ñলুক যুক্তরাজ্যে তাঁর শিক্ষকতার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তা সংকুলান করেন। এতে তাঁর বাবা-মায়েরও উৎসাহ কম নয়।
কবির উদ্দিন তাদের প্রকল্পের নানা উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে বললেন, আমরা সিলেট অঞ্চলের প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম এলাকার যেকোনো স্কুলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চাই। যেমন এমন কোনো স্কুল রয়েছে, যাদের কম্পিউটারসহ সব ব্যবস্থাদি আছে, কিন্তু প্রশিক্ষক নেই। সেসব স্কুলে আমরা আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত আছি। তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্মানী দেবেন, যা আমাদের প্রতিষ্ঠান ক্যাফের ব্যয় বহন করার কাজে ব্যবহৃত হবে। আবার যাদের সামর্থ্য আছেÑকিন্তু কম্পিউটার ও ল্যাবের ব্যবস্থা নেই, তাদের আমাদের এক্সপার্টাইজ দিয়ে ল্যাব স্থাপনসহ অল্প টাকার বিনিময়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তুতিও আমাদের আছে। তবে সবকিছুই দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ার মাধ্যমে কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা হবে।
কবিরের এসব সাহসী কথা শুনে বললাম-অনেক বড় ভাবনা তোমার। এগুলো বাস্তবায়নে তো শুধু সাহস নয়, অর্থেরও দরকার। কবির জানালেন, দেশে-বিদেশে অনেক বিত্তবান আছেন,-যাঁরা সামাজিক নানা কাজে আর্থিক সহায়তা করে থাকেন। তাঁদের কাছে আমাদের বার্তা, আসুন, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সন্তানদের পাশে দাঁড়াই, তাদের কচি কচি হাতকে সৃষ্টিশীল করে তুলি। আমরাও প্রস্তুত রয়েছি আপনাদের সহযোগী-বন্ধু হিসেবে। এ ক্ষুদ্র সেতুবন্ধনই হতে পারে জাতির জন্য এক অভাবনীয় ঘটনা,-যা বিশ্বদরবারে আমাদের বাংলাদেশের উচ্চতা আকাশসমান হতে পারে।
কিন্তু কবিরের কথাগুলোর ভেতরে আমি বারবার দেখতে পাই লুক ডয়েলকে, বাংলাদেশে স্বপ্ন চাষ করা এই বিদেশি বন্ধুটিকে। কথা শেষ করতে গিয়ে শেষ হলো না। কবির কথায় কথায় বললেন, সুযোগ পেলে লুক ডয়েলকে নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে আপনাদের অফিসে আসতে পারি।
২৩ মে সকালে কবিরের ফোন। বিকেল সাড়ে চারটায় এসে হাজির লুক ডয়েল ও কবির উদ্দিন। এই সুযোগে আমার লেখাটির ছোটখাটো তথ্য সংশোধন করার পর আমরা কিছু চমৎকার স্নিগ্ধ সময় পার করি। উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী। গোটা কয়েক ছবিও তোলা হলো। অন্যত্র যাওয়ার তাড়া থাকায় অল্প সময় পরই বিদায় দিলাম লুক ডয়েল ও কবিরকে।
লুক ডয়েলকে শত শ্রদ্ধা। শত অভিনন্দন স্বপ্ন না দেখা তরুণ কবির উদ্দিনকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অভিবাদন শত ঝরে পড়া শিশু-কিশোর-কিশোরীকে প্রেরণা জোগানোর জন্য। শুভেচ্ছা জানাই পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার কর্মে স্বপ্নচারী কবির উদ্দিনকেও।
কবিরের এই স্বপ্নের পথযাত্রা নিয়ে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন <caffebd@gmail.com> ই–মেইলে। এ ছাড়া <caffebd.org> ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন।
আর কবির উদ্দিন ও তাঁর ভাই ফয়েজ উদ্দিন কিশোর বয়সেও সফটওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ে লন্ডনের রেভেনাসবোর্ন কলেজে এসেছেন ২০১৭ সালে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। এই মেলায় প্রদর্শিত সফটওয়্যারটি ছিল কোনো শিশু জলে পড়লে কীভাবে তাঁর মা-বাবা জানবেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ঘড়ির মতো একটি ডিভাইস থাকবে শিশুটির কবজিতে আরেকটি ডিভাইস থাকবে মা-বাবার কাছে। কোনো নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই ডিভাইসটি সতর্ক বার্তা দেবে। এটা তাঁদের নিজস্ব উদ্ভাবনী। এই সফটওয়্যারটির প্রদর্শনীতে সহ-প্রোগ্রামার ছিলেন বর্তমানে কবির উদ্দিনের সহধর্মিণী ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রোকশানা আকতারও।
কবির উদ্দিন এবার ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে এসেছেন বেশ কয়েকটি এক্সপো মেলা ও সেমিনারে অংশ নিতে। এর মধ্যে অংশ নিয়েছেন ম্যানচেস্টারে ৪ মে থেকে ৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্লে এক্সপোতে। ডানস্টবলের ওয়াদার ফিল্ড একাডেমিতে প্রোগ্রামিং শিক্ষার সফটওয়্যার প্রদর্শন caffebd.org ওয়েবসাইটে গেলেই বিস্তারিত জানা যাবে। এ ছাড়া ২৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নরউইচ গেম ফেস্টিভ্যালে যোগ দেন কবির।
এর আগে কবির উদ্দিন আটবার (২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত) যুক্তরাজ্যে এসেছেন। সব সফরই বিভিন্ন এক্সপোতে যোগদান ও চ্যারিটির নানা কাজে। এর ব্যয়ভার কখনো বহন করেছেন লুক নিজে, কখনো চ্যারিটি সংস্থার সৌজন্যে। যুক্তরাষ্ট্রেও কবির উদ্দিন গিয়েছেন, ওয়াশিংটনে মাইক্রোসফট হেডকোয়ার্টারে ২০১৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে, সঙ্গে ছিলেন লুক ডয়েলও।
বিভিন্ন দেশ ও নানা এক্সপো মেলায় যোগদান করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে এবং যে সাহস তৈরি হয়েছেÑতাতে কবির উদ্দিন এখন স্বপ্ন দেখছেন।
কথার শেষ পর্যায়ে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি একটি আইটি ইনস্টিটিউট করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য ৮ শতক ভূমি সিলেটে ক্রয় করেছেন। এর অর্থ দিয়েছে কয়েকটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। বহুতল ভবন নির্মাণ করবেন সেখানে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত টাকা পাবে কই? উত্তরে কবির হেসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, চ্যারিটি সংস্থাসমূহের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করব। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে আমাদের সহায়তা করছেÑতারা তো আছেই। তবে ফান্ড রাইজিংয়ে আগামী অক্টোবরে তিনি ইংল্যান্ডের বরমাউথে অনুষ্ঠিতব্য ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেবেন। তাঁর আশা, বড় একটা ফান্ড সংগ্রহ হবে তখন।
সবকিছু শুনে মনে হলো-কবিরকে স্বপ্ন দেখানোর মানুষ লুক ডয়েল একজন নিরহংকার শিক্ষানুরাগী শিক্ষক শুধু নয়, মানব তৈরির এক অসামান্য দূত এই লোকটি। কবির উদ্দিন তাঁর অবদান সম্পর্কে বারবার বলছিলেন নানা উচ্চতায়। জীবনকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করার দীপ্তি ছিল কবিরের প্রতিটি কথায়।
লুক ডয়েলের হাতে গড়া সিলেটের আইটি প্রতিষ্ঠান দ্য ক্যাফেতে আছেন ছয়জন শিক্ষক। এঁদের বেতন মাসে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। কোনো চ্যারিটি সংস্থা থেকে যদি এই অর্থ সংগ্রহ সম্ভব না হয়Ñলুক যুক্তরাজ্যে তাঁর শিক্ষকতার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তা সংকুলান করেন। এতে তাঁর বাবা-মায়েরও উৎসাহ কম নয়।
কবির উদ্দিন তাদের প্রকল্পের নানা উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে বললেন, আমরা সিলেট অঞ্চলের প্রত্যন্ত কোনো গ্রাম এলাকার যেকোনো স্কুলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চাই। যেমন এমন কোনো স্কুল রয়েছে, যাদের কম্পিউটারসহ সব ব্যবস্থাদি আছে, কিন্তু প্রশিক্ষক নেই। সেসব স্কুলে আমরা আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত আছি। তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্মানী দেবেন, যা আমাদের প্রতিষ্ঠান ক্যাফের ব্যয় বহন করার কাজে ব্যবহৃত হবে। আবার যাদের সামর্থ্য আছেÑকিন্তু কম্পিউটার ও ল্যাবের ব্যবস্থা নেই, তাদের আমাদের এক্সপার্টাইজ দিয়ে ল্যাব স্থাপনসহ অল্প টাকার বিনিময়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তুতিও আমাদের আছে। তবে সবকিছুই দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ার মাধ্যমে কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা হবে।
কবিরের এসব সাহসী কথা শুনে বললাম-অনেক বড় ভাবনা তোমার। এগুলো বাস্তবায়নে তো শুধু সাহস নয়, অর্থেরও দরকার। কবির জানালেন, দেশে-বিদেশে অনেক বিত্তবান আছেন,-যাঁরা সামাজিক নানা কাজে আর্থিক সহায়তা করে থাকেন। তাঁদের কাছে আমাদের বার্তা, আসুন, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সন্তানদের পাশে দাঁড়াই, তাদের কচি কচি হাতকে সৃষ্টিশীল করে তুলি। আমরাও প্রস্তুত রয়েছি আপনাদের সহযোগী-বন্ধু হিসেবে। এ ক্ষুদ্র সেতুবন্ধনই হতে পারে জাতির জন্য এক অভাবনীয় ঘটনা,-যা বিশ্বদরবারে আমাদের বাংলাদেশের উচ্চতা আকাশসমান হতে পারে।
কিন্তু কবিরের কথাগুলোর ভেতরে আমি বারবার দেখতে পাই লুক ডয়েলকে, বাংলাদেশে স্বপ্ন চাষ করা এই বিদেশি বন্ধুটিকে। কথা শেষ করতে গিয়ে শেষ হলো না। কবির কথায় কথায় বললেন, সুযোগ পেলে লুক ডয়েলকে নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে আপনাদের অফিসে আসতে পারি।
২৩ মে সকালে কবিরের ফোন। বিকেল সাড়ে চারটায় এসে হাজির লুক ডয়েল ও কবির উদ্দিন। এই সুযোগে আমার লেখাটির ছোটখাটো তথ্য সংশোধন করার পর আমরা কিছু চমৎকার স্নিগ্ধ সময় পার করি। উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী। গোটা কয়েক ছবিও তোলা হলো। অন্যত্র যাওয়ার তাড়া থাকায় অল্প সময় পরই বিদায় দিলাম লুক ডয়েল ও কবিরকে।
লুক ডয়েলকে শত শ্রদ্ধা। শত অভিনন্দন স্বপ্ন না দেখা তরুণ কবির উদ্দিনকে স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অভিবাদন শত ঝরে পড়া শিশু-কিশোর-কিশোরীকে প্রেরণা জোগানোর জন্য। শুভেচ্ছা জানাই পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার কর্মে স্বপ্নচারী কবির উদ্দিনকেও।
কবিরের এই স্বপ্নের পথযাত্রা নিয়ে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন <caffebd@gmail.com> ই–মেইলে। এ ছাড়া <caffebd.org> ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন।
দ্য ক্যাফে আইটি স্কুলের ল্যাবে শিক্ষার্থীরা |
No comments