চীন-আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধ জোরদার হচ্ছে by ফজলুল কবির
যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলতে ভালোবাসেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় সুযোগ পেলেই তিনি কথার ফুলঝুরি ছোটান। সেসব
কথায় সব সময় যে আস্থা রাখতে নেই, তা এত দিনে পুরো বিশ্ব বুঝে যাওয়ার কথা।
যদিও বা বোঝায় কিছু ঘাটতি থাকে, তবে সম্প্রতি শেষ হওয়া চীন-যুক্তরাষ্ট্র
বাণিজ্য আলোচনার পর তাঁর বক্তব্য ও পদক্ষেপের দিকে তাকালেই হবে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা গত ৩১ জুলাই শেষ হয়। এই আলোচনাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘গঠনমূলক’ উল্লেখ করে বলেছেন, অংশীদারত্বের ভিত্তিতে দুই দেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। নিঃসন্দেহে খুবই ইতিবাচক বক্তব্য। মনে হতেই পারে যে, দুই পরাশক্তির ঠান্ডা লড়াই এই বুঝি শেষ হলো। এর সঙ্গে যখন হোয়াইট হাউস জানায়, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি কৃষিপণ্য কিনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তখন আশাবাদী হতেই হয়। কিন্তু এরপরই যখন জানা যায়, ১ সেপ্টেম্বর থেকেই চীনের আরও ৩০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র ১০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করছে, তখন সে আশার বেলুন চুপসে যেতে বাধ্য। এমন পদক্ষেপের অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীনা প্রায় সব পণ্যকেই শুল্কের আওতায় নিয়ে আসছে।
এ ধরনের ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যযুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলবে। চীন বিষয়টিকে নিজেদের মতো করেই মোকাবিলা করবে। এই ঘোষণা বাণিজ্য আলোচনা ‘ব্যর্থ হয়েছে’ বলেই বার্তা দেয়। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বিশ্ববাজারেই, যা এরই মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। ঘোষণাটি আসার পরপরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক একটি ঝাঁকুনি লেগেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে মার্কিন বিভিন্ন শেয়ারের দাম এরই মধ্যে নিম্নমুখী হয়েছে। কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের বিপরীতে সুদহার।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, ওয়ালস্ট্রিটে অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থানে চলে গেছেন। ডাউ ও নাসদাক কম্পোজিট সূচকে বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। শুল্কারোপের ঘোষণার পরপরই ডাউ সূচক কমেছে ৩০০ পয়েন্ট। আর নাসদাকে অবনমন হয়েছে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে নতুন আরেক সংকট সৃষ্টি হয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ঘিরে। জাপান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে দক্ষিণ কোরীয় পণ্যে যে সুবিধা দিত, তা প্রত্যাহার করেছে। এতে বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বে।
এ সব ঘটনাই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিদ্যমান শঙ্কাকে সামনে আনছে। বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় অন্য কোনো নিরাপদ ক্ষেত্র খুঁজছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অবশ্য বলছে, এমন পরিস্থিতির বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণাটির পরপরই বাজারে যে ঝাঁকুনি লেগেছে, তাই বলে দেয় যে, ওই সতর্ক বার্তা যথেষ্ট ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) করা প্রস্তাবের ওপর গত জুনেই সাত দিনব্যাপী শুনানি হয়েছে। সেখানে আরও শুল্কারোপের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা নিজেদের সংকট ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা নিয়ে কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে তাঁদের দেউলিয়া হতে হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে মার্কিন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু এসব বিষয়কে শেষ পর্যন্ত আমলে না নিয়েই নতুন শুল্কারোপের ঘোষণাটি এল। সর্বশেষ গত জুনে শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি কার্যকর হয়। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে নতুন শুল্কারোপ হলে ব্যবসায়ীদের নিজেদের হিসাব নিয়ে নতুন করে বসতে হবে। যেখানে আগের হিসাবটিই তারা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ফলে পুরো বাজার ব্যবস্থাতেই একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
নতুন করে শুল্কারোপের কারণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দায় চাপাচ্ছে চীনের ঘাড়েই। তাদের বক্তব্য, চীন বাণিজ্য আলোচনায় তাদের অবস্থান বদল করেনি। কোনো ধরনের সমঝোতার প্রয়াস তাদের মধ্যে নেই। আরও বেশি মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি তারা আগেও দিয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তারা ফেন্টানিলের মতো ভয়াবহ ওষুধ রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্যে পরিস্থিতির এক পাশ উঠে এলেও অন্যটি একেবারে অনালোচিত থেকে যাচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপও দুই দেশের দ্বৈরথে ক্রমাগত জ্বালানি দিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন শুল্কারোপ করে চীনকে চাপপ্রয়োগের নীতি সমঝোতার ক্ষেত্র একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ চাপে চীন সহজে নতি স্বীকার করবে না বলেই মনে হয়। তাদের অবস্থান স্পষ্ট, যেকোনো সমঝোতার পূর্বশর্ত হচ্ছে, আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের কারণে তারা শুধু আশাহতই হচ্ছে। সর্বশেষ আলোচনাকে একদিকে ‘ইতিবাচক’ বলে, অন্যদিকে নতুন শুল্কারোপের ঘোষণাকে তারা ‘অপমান’ হিসেবে দেখতেই পারে। এতে পারস্পরিক আস্থায় এরই মধ্যে সৃষ্ট চিড় আরও বিস্তৃত হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকছে না।
এ অবস্থায় চীন বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চীন চাইলে আগের মতোই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্কারোপ করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের হাতে বিকল্প কম। কারণ, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোটাদাগে ১২ হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এ ছাড়া প্রযুক্তি পণ্যের জন্য জরুরি বিরল ধাতু রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে দেশটি, যা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে। কারণ, এ ধরনের ১৭টি ধাতুর প্রায় ৯০ শতাংশের উৎপাদনই নিয়ন্ত্রণ করে চীন। এ ছাড়া মুদ্রা অবমূল্যায়নও তাদের একটি পদক্ষেপ হতে পারে, যার মাধ্যমে রপ্তানিতে পড়া নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে বেইজিং। কিন্তু এতে অর্থপাচারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যার মুখোমুখি চীন এর আগেও হয়েছিল। আর সবচেয়ে বেশি যা করার আছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৃষ্ট অবিশ্বাসের সম্পর্ককে পুঁজি করেই বিশ্বে মার্কিনবিরোধী ব্লকগুলোকে নিজের সঙ্গে নেওয়া চেষ্টা।
বর্তমান পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই চীনকে তার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ কর্মসূচিকে আরও জোরদারে উদ্বুদ্ধ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ কর্মসূচি যত জোরদার হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক তত ভঙ্গুর হতে বাধ্য। কারণ প্রশ্নটি তখন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এই পরিস্থিতি চীন অনেক ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশটির সরকারি প্রতিনিধিদল নিজ দেশের বিভিন্ন প্রদেশ পরিদর্শনে বেরিয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট। তারা নিজ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নিতে চাইছে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি তারা মোকাবিলা করতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। তাদের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আসন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে যাচ্ছে। তারা চীনের সঙ্গে চলমান দ্বৈরথের ফলে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে খোলাখুলি। এ দুটি তৎপরতাই সারা বিশ্বের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হতে বাধ্য। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলে যেকোনো মুহূর্তেই চীনের ওপর আরোপিত যাবতীয় শুল্ক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। কিন্তু তা দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট অবিশ্বাসকে রাতারাতি আস্থায় রূপান্তরিত করতে পারবে না। ফলে এ বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠতে বিশ্বকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা গত ৩১ জুলাই শেষ হয়। এই আলোচনাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘গঠনমূলক’ উল্লেখ করে বলেছেন, অংশীদারত্বের ভিত্তিতে দুই দেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। নিঃসন্দেহে খুবই ইতিবাচক বক্তব্য। মনে হতেই পারে যে, দুই পরাশক্তির ঠান্ডা লড়াই এই বুঝি শেষ হলো। এর সঙ্গে যখন হোয়াইট হাউস জানায়, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি কৃষিপণ্য কিনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তখন আশাবাদী হতেই হয়। কিন্তু এরপরই যখন জানা যায়, ১ সেপ্টেম্বর থেকেই চীনের আরও ৩০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র ১০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করছে, তখন সে আশার বেলুন চুপসে যেতে বাধ্য। এমন পদক্ষেপের অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীনা প্রায় সব পণ্যকেই শুল্কের আওতায় নিয়ে আসছে।
এ ধরনের ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যযুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলবে। চীন বিষয়টিকে নিজেদের মতো করেই মোকাবিলা করবে। এই ঘোষণা বাণিজ্য আলোচনা ‘ব্যর্থ হয়েছে’ বলেই বার্তা দেয়। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বিশ্ববাজারেই, যা এরই মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। ঘোষণাটি আসার পরপরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক একটি ঝাঁকুনি লেগেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে মার্কিন বিভিন্ন শেয়ারের দাম এরই মধ্যে নিম্নমুখী হয়েছে। কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের বিপরীতে সুদহার।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, ওয়ালস্ট্রিটে অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থানে চলে গেছেন। ডাউ ও নাসদাক কম্পোজিট সূচকে বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। শুল্কারোপের ঘোষণার পরপরই ডাউ সূচক কমেছে ৩০০ পয়েন্ট। আর নাসদাকে অবনমন হয়েছে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে নতুন আরেক সংকট সৃষ্টি হয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ঘিরে। জাপান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে দক্ষিণ কোরীয় পণ্যে যে সুবিধা দিত, তা প্রত্যাহার করেছে। এতে বিশেষত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বে।
এ সব ঘটনাই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিদ্যমান শঙ্কাকে সামনে আনছে। বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় অন্য কোনো নিরাপদ ক্ষেত্র খুঁজছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অবশ্য বলছে, এমন পরিস্থিতির বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণাটির পরপরই বাজারে যে ঝাঁকুনি লেগেছে, তাই বলে দেয় যে, ওই সতর্ক বার্তা যথেষ্ট ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) করা প্রস্তাবের ওপর গত জুনেই সাত দিনব্যাপী শুনানি হয়েছে। সেখানে আরও শুল্কারোপের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা নিজেদের সংকট ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা নিয়ে কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে তাঁদের দেউলিয়া হতে হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে মার্কিন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু এসব বিষয়কে শেষ পর্যন্ত আমলে না নিয়েই নতুন শুল্কারোপের ঘোষণাটি এল। সর্বশেষ গত জুনে শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি কার্যকর হয়। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে নতুন শুল্কারোপ হলে ব্যবসায়ীদের নিজেদের হিসাব নিয়ে নতুন করে বসতে হবে। যেখানে আগের হিসাবটিই তারা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ফলে পুরো বাজার ব্যবস্থাতেই একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
নতুন করে শুল্কারোপের কারণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দায় চাপাচ্ছে চীনের ঘাড়েই। তাদের বক্তব্য, চীন বাণিজ্য আলোচনায় তাদের অবস্থান বদল করেনি। কোনো ধরনের সমঝোতার প্রয়াস তাদের মধ্যে নেই। আরও বেশি মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি তারা আগেও দিয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তারা ফেন্টানিলের মতো ভয়াবহ ওষুধ রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্যে পরিস্থিতির এক পাশ উঠে এলেও অন্যটি একেবারে অনালোচিত থেকে যাচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপও দুই দেশের দ্বৈরথে ক্রমাগত জ্বালানি দিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন শুল্কারোপ করে চীনকে চাপপ্রয়োগের নীতি সমঝোতার ক্ষেত্র একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ চাপে চীন সহজে নতি স্বীকার করবে না বলেই মনে হয়। তাদের অবস্থান স্পষ্ট, যেকোনো সমঝোতার পূর্বশর্ত হচ্ছে, আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের কারণে তারা শুধু আশাহতই হচ্ছে। সর্বশেষ আলোচনাকে একদিকে ‘ইতিবাচক’ বলে, অন্যদিকে নতুন শুল্কারোপের ঘোষণাকে তারা ‘অপমান’ হিসেবে দেখতেই পারে। এতে পারস্পরিক আস্থায় এরই মধ্যে সৃষ্ট চিড় আরও বিস্তৃত হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকছে না।
এ অবস্থায় চীন বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চীন চাইলে আগের মতোই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্কারোপ করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের হাতে বিকল্প কম। কারণ, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোটাদাগে ১২ হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এ ছাড়া প্রযুক্তি পণ্যের জন্য জরুরি বিরল ধাতু রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে দেশটি, যা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে। কারণ, এ ধরনের ১৭টি ধাতুর প্রায় ৯০ শতাংশের উৎপাদনই নিয়ন্ত্রণ করে চীন। এ ছাড়া মুদ্রা অবমূল্যায়নও তাদের একটি পদক্ষেপ হতে পারে, যার মাধ্যমে রপ্তানিতে পড়া নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে বেইজিং। কিন্তু এতে অর্থপাচারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যার মুখোমুখি চীন এর আগেও হয়েছিল। আর সবচেয়ে বেশি যা করার আছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৃষ্ট অবিশ্বাসের সম্পর্ককে পুঁজি করেই বিশ্বে মার্কিনবিরোধী ব্লকগুলোকে নিজের সঙ্গে নেওয়া চেষ্টা।
বর্তমান পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই চীনকে তার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ কর্মসূচিকে আরও জোরদারে উদ্বুদ্ধ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ কর্মসূচি যত জোরদার হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক তত ভঙ্গুর হতে বাধ্য। কারণ প্রশ্নটি তখন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এই পরিস্থিতি চীন অনেক ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশটির সরকারি প্রতিনিধিদল নিজ দেশের বিভিন্ন প্রদেশ পরিদর্শনে বেরিয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট। তারা নিজ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নিতে চাইছে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি তারা মোকাবিলা করতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। তাদের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আসন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে যাচ্ছে। তারা চীনের সঙ্গে চলমান দ্বৈরথের ফলে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে খোলাখুলি। এ দুটি তৎপরতাই সারা বিশ্বের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হতে বাধ্য। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলে যেকোনো মুহূর্তেই চীনের ওপর আরোপিত যাবতীয় শুল্ক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। কিন্তু তা দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট অবিশ্বাসকে রাতারাতি আস্থায় রূপান্তরিত করতে পারবে না। ফলে এ বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠতে বিশ্বকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
No comments