মশার ‘যম’ নিম! by সাদ্দিফ অভি
রাজধানীর পান্থপথ সড়কে লাগানো একটি নিম গাছ। (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন) |
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ছিটানো ওষুধ যখন মশা নিধনে অকার্যকর এবং
নগরবাসীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ, তখন জানা গেলো—আমাদের চারপাশে প্রকৃতির
মধ্যেই রয়েছে মশা প্রতিরোধের ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিমে বিদ্যমান
অ্যালকালাইড মশার ‘যম’। অ্যালকালাইডের কারণে মশা দূরে সরে যায়। ভেষজ গাছ
নিমের পাতা এবং এর তেল মশার আক্রমণ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে।
রসায়নবিদ, প্রাণিবিদ, উদ্ভিদবিদ এবং কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে এসব তথ্য
জানা গেছে।
নিমের গুণাগুণ
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, নিম ফুলের
মধু অন্যান্য ফুলের মধুর তুলনায় বেশি পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণসম্পন্ন; নিম
মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে। কৃষি জমির পাশে (আইলে) নিম গাছ লাগালে
ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। নিম থেকে তৈরি ওষুধ, প্রসাধনী, জৈবসার ও
কীট বিতাড়ক বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ ও কাঠসহ সব অংশই
রফতানিযোগ্য।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক উপপরিচালক কৃষিবিদ ড.
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, নিমগাছ গরু ও ছাগলে খায় না এবং বাঁচে
৪০০ বছরের বেশি। নিম জৈব কীট বিতাড়ক ও সারের জন্য উপকারী। কোনও কীটপতঙ্গ বা
ব্যাকটেরিয়া এর ক্ষতি করে না।
রাসায়নিক উপাদান হিসেবে নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও
তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান, যেমন—স্যাপোনিন, অ্যালকালয়েড নিমবিডিন,
নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব
অ্যাসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন,
মারগোসিন, এজমডারিন এসব থাকে।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, নিমে ৫০টির বেশি অ্যালকালয়েড
থাকে। এদের মধ্যে এজাডিরাকটিন ও নিমবিন মশা দমন করে। জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার
বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিম গাছে অ্যালকালয়েড থাকে, যার কারণে মশা দূরে
সরে যায়। শুধু মশা নয়, নানা ধরনের পোকামাকড়ও নিমের কাছে ভিড়তে পারে না।
বিছানায় ছারপোকা হলে সেখানে নিম পাতা দিয়ে রাখলে ছারপোকা দূরে সরে যায়।
আবার নিমের তেল গায়ে মাখলেও মশার ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান
অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিম গাছের পাতা
পানি দিয়ে হালকা পিষে যে রস বের হবে, ওটা পায়ের পাতায় ও হাতে যদি দেওয়া হয়,
তাহলে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আরেকটা হচ্ছে, নিমের পাতা পানিতে
সিদ্ধ করার পর যেটা বের হবে, ওই পানি এবং নিমের তেল খানিকটা মিশিয়ে গায়ে
মাখলে মশায় কামড়াবে না।
ড. কাদের বলেন, ‘আমরা একটি গবেষণা করেছিলাম এ নিয়ে।
চুলে নিম পাতার রস দিলে উকুন মারা যায়। আবার নিমের তেলের ছোঁয়া পেলেই উকুন
মারা যায়। দিনাজপুরে সাঁওতালরা মহিষ পালন করে। তারা নিমের তেল মহিষের গায়ে
মেখে দেয়। তাতে উকুন সব মরে যায় এবং গায়ের চামড়া খুব নরম হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিমের তেল হাতে পায়ে দিলে কোনও ক্ষতি
নেই। যদি মুখের ভেতরে কোনও কারণে চলে যায়, তাতেও কোনও ক্ষতি নেই।
বাচ্চাদের জন্য এটা খুব উপকারী। আমরা একটি জারের মধ্যে নিমের তেল রেখে একটি
মশা রেখেছিলাম সেখানে। মশাটি কিন্তু মারা গিয়েছিল। নিমের একটি বিশেষ গুণ
হচ্ছে—মশা তাড়ানো এবং একই সময়ে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশেষ উপায়।
আমি নিজে আমার ছেলেমেয়ের হাত ও পায়ে নিমের তেল লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি।
চমৎকার কাজ হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক
ড. মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই নিম গাছের
শুকনা পাতা মশার কয়েলের মতো ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অনেক কোম্পানির মশার
কয়েলেও নিমের ব্যবহার আছে। নিম গাছের পাতায় কিছু উপাদান আছে, যেটাকে মশা
সহ্য করতে পারে না। নিমের আরও ভেষজ গুণ আছে। চর্মরোগের ক্ষেত্রেও এটা
উপকারী।’
নিম কথা
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, নিমের বৈজ্ঞানিক নাম
‘আজাডিরাক্টা ইন্ডিকা এ জাস’। নিমকে নিম্ব, ভেপা, তামারসহ আরও অনেক নামেই
ডাকা হয়। নিমের পাতা থেকে বাকল, শিকড় থেকে ফুল, ফল থেকে বীজ সবগুলোই কাজে
লাগে। নিম অনেক দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। নিম বহু বর্ষজীবী মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ
বৃক্ষ। পূর্ণ বয়সে ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে শুকনো
জায়গায় পত্রঝরা বৃক্ষের মতো আচরণ করে। এই গাছে সারা বছর পাতা গজায়। তবে
বসন্ত ঋতুতে বেশিরভাগ পাতা ঝরে যায়। ৪৫০ থেকে ১১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
নিমগাছের জন্য উত্তম। তবে যেখানে বৃষ্টি কম সেখানেও নিম খুব ভালোভাবে
বৃদ্ধি পায়, যার প্রমাণ সৌদি আরবের পবিত্র নগরীর আরাফাতের ময়দান। নিম খরা
সহনশীল।
নিম একটি ঔষধি গাছ। প্রাণি ও উদ্ভিদকুলের জন্য এত
উপকারী গাছ এ পর্যন্ত আর আবিষ্কার হয়নি। এজন্য বলা হয় নিম পৃথিবীর সবচেয়ে
দামি বৃক্ষ। নিমের এ গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার
বছর আগে থেকেই ভারত উপমহাদেশে নিমের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। এই গাছের
গুণাগুণ সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধারণা থাকলেও নিম নিয়ে
বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। ভারত উপমহাদেশে নিম নিয়ে
গবেষণা শুরু হয় ১৯৪২ সালে। পশ্চিমা বিশ্বে গবেষণা শুরু হয়েছে আরও অনেক
পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিম নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৭২ সালে।
সংস্থাটি আরও বলছে, নিম বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা
গেলেও উত্তরাঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। বলা হয়, এর আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত আর
মিয়ানমারে। এ গাছটি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও
সৌদি আরবে জন্মে। বর্তমানে এই উপমহাদেশসহ উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলীয় সব দেশেই
নিম গাছের বিভিন্ন প্রজাতি ছড়িয়ে আছে। বলা হয়ে থাকে, কেউ যদি নিমতলে
বিশ্রাম নেয়, কিংবা শুয়ে ঘুমায়, তাহলে তার রোগ কমে যায়, সুস্থ থাকে, মনে
প্রাণে শরীরে অধিকতর স্বস্তি আসে। এজন্য ঘরের আশপাশে দু-চারটি নিমের গাছ
লাগিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়।
No comments