কেমন আছেন হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ by শাহনেওয়াজ বাবলু
একটি
খুপরি ঘরে বাস করে কয়েকটি পরিবার। জায়গার অভাবে একসঙ্গেও ঘুমাতে পারেন না
অনেকে। পালাক্রমে একেক সময় একেকজনকে ঘুমাতে হয়। ঘরের ভেতর পর্দা করে কক্ষ
বানাতে হয়। আর এই কক্ষে গাদাগাদি আর ঠাসাঠাসির জীবন, সেখানেই আবার রান্নার
চুলা। সব মিলিয়ে এক অসহনীয় জীবনযাপন করছে পুরান ঢাকা হরিজন সম্প্রদায়ের
বাসিন্দারা। তাদের কেউ ঝাড়ুদার, কেউ পরিচ্ছন্নতাকর্মী । অন্য সব মানুষের
মতো তাদের জীবনেও আছে সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আছে চাওয়া-পাওয়া।
প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বের হয় ঝাড়ু, বেলচা আর ছোট্ট ট্রলি হাতে। অথচ, ঢাকা শহরের হরিজন জনগোষ্ঠীর নারীরা বঞ্চিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনি সুবিধা থেকে। বাল্যবিবাহ, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, মাতৃমৃত্যু, পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণসহ নানা সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে। জন্মের পর থেকে মুখোমুখি হতে হয় নানা বৈষম্যের।
পুরান ঢাকা আগা খান রোডে মিরনজিলা হরিজন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির সামনে কাপড়ের ছড়াছড়ি। কাপড় দেখলেই বুঝা যায় ওই এলাকায় কতো লোকের বসবাস।
গত তিন প্রজন্ম ধরেই একই ঘরে একই সাথে বসবাস করে আসছেন বেটি রানী। তিনি জানান, একটা ঘরে আমাগো থাকতে হয়। এর মধ্যে একটা রুম। গাদাগাদি করে থাকি। এর মধ্যে বড় বড় পোলাপানও আছে।
গৃহিনী রশ্নি জানান, আমরা কখনো একসাথে ঘুমাতে পারি না। একসাথে ঘুমানোর জায়গা নাই। আমরা মহিলারা রাতে ঘুমাই। আর পুরুষরা সকালে ঘুমায়।
ঝাড়ুদার শিল্পী রানী জানান, আমি যখন ঘুমাই আমার ছেলে বইয়া থাকে। আর আমার ছেলে যখন ঘুমায় আমি বইয়া থাকি। ছোট বাসা জায়গা পাইনা। কি করবো? আমাগোতো দেখার কেউ নাই।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেন বিশাল দাশ। তিনি জানান, কাপড় দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘর বানাতে হয় আমাদের। এভাবেই আমরা রাত্রি যাপন করি। ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারি না।
এদিকে, ঘরে জায়গা না থাকার পরেও জায়গা করে দিতে হয় নব বধূকে। এজন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘুমাতে হয় ঘরের বাইরে। রাহুল দাস বলেন, বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি কিছু দিন হলো। কিন্তু রুমতো একটাই। তাই মধ্যে পর্দা করে দেই। না হয় আমি আর আমার বউ মিলে বাইরে শুয়ে থাকি।
চকবাজারের অগ্নিকান্ডের পর মিরন জিল্লার হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা এখন আতঙ্কে আছে। বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার আগেই নিরাপদ মাথা গোজার ঠাই চান তারা। মিরনজিলা হরিজন সিটি কলোনির সভাপতি গগণ লাল বলেন, আমার পরিবার নিয়ে কিছুদিন আগে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছে, আমাদের হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের থেকে ওই চিড়িয়াখানার জানোয়াররাও ভালভাবে বসবাস করে। আমাদের এই এলাকা ভেঙে নাকি মার্কেট করা হবে। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। আর একটা বিষয় হচ্ছে, যদি কখনো এখানে আগুন লাগে, আমরা যে ঘর থেকে বের হবো এই সুযোগটাও নাই।
রাজধানীসহ সারাদেশ প্রায় ১৫ লাখ হরিজন জনগোষ্ঠীর বসবাস। সরকারি কলোনিগুলোতে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন-যাপন করে তারা। ঢাকা শহরে কমলাপুর সংলগ্ন গোপিবাগ রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে ৪৫ বছর ধরে ১৭৭টি পরিবার কাঁচাঘরে বাস করছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হরিজনদের সমাজের মধ্যে ঢাকা শহরে অবহেলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তেলেগু একটি। বৃটিশ আমলে জঙ্গল পরিষ্কারের জন্য ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে কয়েকটি তেলেগু পরিবারকে ঢাকায় আনা হয়। পরে তাদের দিয়ে করানো হয় ময়লা পরিষ্কারের কাজ। তেলেগুরা সহজ-সরল বলে সামান্য খাবার দিয়ে তাদের সব কাজই করানো হতো। বৃটিশ আমলে চার-পাঁচটি তেলেগু পরিবার টিনের ঘর বানিয়ে থাকত পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। তখন তারা চাল-ডাল, সাবান পেত নামমাত্র মূল্যে। দিনে দিনে তেলেগু জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন লক্ষ্মীবাজার থেকে এনে তাদের জায়গা দেয়া হয় নারিন্দায়। এটাই এখন নারিন্দা মেথরপট্টি হিসেবে পরিচিত। ঘিঞ্জি এ জায়গায় ১৯৮৭ সালে তাদের একটি বহুতল ভবন দেয়া হয়। সেই ভবনে ঠাঁই হয় অনেকের। সিটি করপোরেশনের টেন্ডারে অংশ নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান হরিজনদের জন্য ভবনটি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়ার আগেই ভবনটি ভেঙে পড়তে থাকে। পরে সিটি করপোরেশন ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এর পর হরিজনদের ঠাঁই হয় দয়াগঞ্জ সিটি করপোরেশন মার্কেটের দোকান ঘরে। সেখানে থাকে কয়েকশ পরিবার।
নব্বই দশকের প্রথম দিকে কিছু তেলেগু পরিবারকে জায়গা দেয়া হয়েছিল ধলপুর সিটিপল্লীতে। সেখানে এখন এক হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। প্রায় ৫০০ জন থাকে কমলাপুর বস্তিতে। বিচ্ছিন্নভাবে থাকে মোহাম্মদপুর কলেজ গেট এলাকায়। তবে তেলেগু হরিজনদের মূল অংশ, পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে নারিন্দা মেথরপট্টিতেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো দলিতদের সংখ্যা। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন- চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি। এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত।
প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বের হয় ঝাড়ু, বেলচা আর ছোট্ট ট্রলি হাতে। অথচ, ঢাকা শহরের হরিজন জনগোষ্ঠীর নারীরা বঞ্চিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনি সুবিধা থেকে। বাল্যবিবাহ, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, মাতৃমৃত্যু, পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণসহ নানা সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে। জন্মের পর থেকে মুখোমুখি হতে হয় নানা বৈষম্যের।
পুরান ঢাকা আগা খান রোডে মিরনজিলা হরিজন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির সামনে কাপড়ের ছড়াছড়ি। কাপড় দেখলেই বুঝা যায় ওই এলাকায় কতো লোকের বসবাস।
গত তিন প্রজন্ম ধরেই একই ঘরে একই সাথে বসবাস করে আসছেন বেটি রানী। তিনি জানান, একটা ঘরে আমাগো থাকতে হয়। এর মধ্যে একটা রুম। গাদাগাদি করে থাকি। এর মধ্যে বড় বড় পোলাপানও আছে।
গৃহিনী রশ্নি জানান, আমরা কখনো একসাথে ঘুমাতে পারি না। একসাথে ঘুমানোর জায়গা নাই। আমরা মহিলারা রাতে ঘুমাই। আর পুরুষরা সকালে ঘুমায়।
ঝাড়ুদার শিল্পী রানী জানান, আমি যখন ঘুমাই আমার ছেলে বইয়া থাকে। আর আমার ছেলে যখন ঘুমায় আমি বইয়া থাকি। ছোট বাসা জায়গা পাইনা। কি করবো? আমাগোতো দেখার কেউ নাই।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেন বিশাল দাশ। তিনি জানান, কাপড় দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘর বানাতে হয় আমাদের। এভাবেই আমরা রাত্রি যাপন করি। ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারি না।
এদিকে, ঘরে জায়গা না থাকার পরেও জায়গা করে দিতে হয় নব বধূকে। এজন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘুমাতে হয় ঘরের বাইরে। রাহুল দাস বলেন, বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি কিছু দিন হলো। কিন্তু রুমতো একটাই। তাই মধ্যে পর্দা করে দেই। না হয় আমি আর আমার বউ মিলে বাইরে শুয়ে থাকি।
চকবাজারের অগ্নিকান্ডের পর মিরন জিল্লার হরিজন সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা এখন আতঙ্কে আছে। বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার আগেই নিরাপদ মাথা গোজার ঠাই চান তারা। মিরনজিলা হরিজন সিটি কলোনির সভাপতি গগণ লাল বলেন, আমার পরিবার নিয়ে কিছুদিন আগে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছে, আমাদের হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের থেকে ওই চিড়িয়াখানার জানোয়াররাও ভালভাবে বসবাস করে। আমাদের এই এলাকা ভেঙে নাকি মার্কেট করা হবে। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। আর একটা বিষয় হচ্ছে, যদি কখনো এখানে আগুন লাগে, আমরা যে ঘর থেকে বের হবো এই সুযোগটাও নাই।
রাজধানীসহ সারাদেশ প্রায় ১৫ লাখ হরিজন জনগোষ্ঠীর বসবাস। সরকারি কলোনিগুলোতে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন-যাপন করে তারা। ঢাকা শহরে কমলাপুর সংলগ্ন গোপিবাগ রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে ৪৫ বছর ধরে ১৭৭টি পরিবার কাঁচাঘরে বাস করছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হরিজনদের সমাজের মধ্যে ঢাকা শহরে অবহেলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তেলেগু একটি। বৃটিশ আমলে জঙ্গল পরিষ্কারের জন্য ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে কয়েকটি তেলেগু পরিবারকে ঢাকায় আনা হয়। পরে তাদের দিয়ে করানো হয় ময়লা পরিষ্কারের কাজ। তেলেগুরা সহজ-সরল বলে সামান্য খাবার দিয়ে তাদের সব কাজই করানো হতো। বৃটিশ আমলে চার-পাঁচটি তেলেগু পরিবার টিনের ঘর বানিয়ে থাকত পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। তখন তারা চাল-ডাল, সাবান পেত নামমাত্র মূল্যে। দিনে দিনে তেলেগু জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন লক্ষ্মীবাজার থেকে এনে তাদের জায়গা দেয়া হয় নারিন্দায়। এটাই এখন নারিন্দা মেথরপট্টি হিসেবে পরিচিত। ঘিঞ্জি এ জায়গায় ১৯৮৭ সালে তাদের একটি বহুতল ভবন দেয়া হয়। সেই ভবনে ঠাঁই হয় অনেকের। সিটি করপোরেশনের টেন্ডারে অংশ নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান হরিজনদের জন্য ভবনটি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়ার আগেই ভবনটি ভেঙে পড়তে থাকে। পরে সিটি করপোরেশন ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এর পর হরিজনদের ঠাঁই হয় দয়াগঞ্জ সিটি করপোরেশন মার্কেটের দোকান ঘরে। সেখানে থাকে কয়েকশ পরিবার।
নব্বই দশকের প্রথম দিকে কিছু তেলেগু পরিবারকে জায়গা দেয়া হয়েছিল ধলপুর সিটিপল্লীতে। সেখানে এখন এক হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। প্রায় ৫০০ জন থাকে কমলাপুর বস্তিতে। বিচ্ছিন্নভাবে থাকে মোহাম্মদপুর কলেজ গেট এলাকায়। তবে তেলেগু হরিজনদের মূল অংশ, পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে নারিন্দা মেথরপট্টিতেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো দলিতদের সংখ্যা। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন- চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি। এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত।
No comments