প্রধান বিচারপতি বেছে নেওয়া by মিজানুর রহমান খান
নবনিযুক্ত
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে অভিনন্দন জানাই। আমরা আশা করব যে
আগামী প্রায় চার বছর তিনি বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা দৃঢ় করতে তাঁর
পক্ষে সম্ভব সব রকম ব্যবস্থা নিতেই সচেষ্ট হবেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস
কে সিনহা আদালতের অবস্থাকে ডুবু ডুবু অবস্থায় নাক উঁচু করে রাখার মতো
পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। গতকাল প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনায়
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মুখে উচ্চ আদালতের ব্যবস্থাপনাগত সমস্যার
এক উদ্বেগজনক চিত্র পেলাম। এই মলিন চিত্র বদলাতে একটি যথাযথ বিচার বিভাগীয়
নেতৃত্ব দরকার। ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগপর্বে আমরা আমাদের বিচার বিভাগের
ইতিহাসের সব থেকে কার্যকর একটি ধ্রুপদি পদত্যাগ দেখলাম। এর আগে ২০১১ সালে
দ্বিতীয়বার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হয়ে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর
রহমান নীরবে পদত্যাগ করেছিলেন। বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার এই
প্রতিবাদী পদত্যাগ এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন সমাজ থেকে ‘ত্যাগ’ বিলুপ্ত হতে
চলেছে। তাঁর পদত্যাগের সঙ্গে আমরা ৪৫ বছর আগে ১৯৭৩ সালে ভারতের সুপ্রিম
কোর্টের তিন বিচারপতি শিলাত, হেগড়ে ও গ্রোভারের একযোগে পদত্যাগের ঘটনার
কিছুটা তুলনা করতে পারি। আরও বেশি আদর্শস্থানীয় হতো যদি এটি ‘নীতিগত’
মহিমায় মহিমান্বিত হতো। তিনি যথার্থই লিখেছেন, অনিবার্য ব্যক্তিগত কারণে
তিনি পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠতার কোনো রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি, কারণ
নীতি হিসেবে এটা সব সময় কার্যকর থাকুক, তা সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের কেউ
আন্তরিকভাবে চান বা অতীতে চেয়েছেন-এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
ইন্দিরা গান্ধী যখন আগাম জেনেছিলেন যে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংসদ বদলাতে
পারে কি পারে না-সংক্রান্ত মামলায় (কেশবানন্দ ভারতী) ১৩ সদস্যের বেঞ্চের
সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তিনি পরাজয়ের স্বাদ পেতে যাচ্ছেন এবং রায় ঘোষণার
নির্ধারিত তারিখের এক দিন আগে পরবর্তী প্রধান বিচারপতির নাম ঘোষণার ক্ষণ
উপস্থিত, তখন তিনি সাত সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় সমর্থক ওই তিন জ্যেষ্ঠ
বিচারপতিকে ডিঙিয়ে সংখ্যালঘু রায় অর্থাৎ তাঁর পক্ষে ছয় রায়দানকারীর প্রধান এ
এন রায়কে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দিনটি ভারতের বিচার
বিভাগের ইতিহাসের ‘কৃষ্ণতম অধ্যায়’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রমাণিত
হয়েছে, বিতর্কিত ওই ডিঙানোর ঘটনাটি ছিল দুই বছর পরের জরুরি অবস্থা জারির
পূর্বলক্ষণ।
বিচার বিভাগে জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার
অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো এটা জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ ও
মনোযোগের বাইরে জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়নি। আমাদের উচ্চ আদালত অবশ্য
বলেছেন, ‘জ্যেষ্ঠতাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না, মেধাও দেখতে হবে।’
এর অর্থ হলো জ্যেষ্ঠতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন আমাদের
চোখে পড়ে। কিন্তু কী উপায়ে কখন মেধা যাচাই হবে, তার কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া
শুরু করার কোনো চাহিদা সংশ্লিষ্ট মহলে নেই বললে বাড়তি বলা হবে না। বাংলাদেশ
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বিএনপি ঘরানার হলেও তার তরফে এ বিষয়ে যথারীতি
কোনো দৃঢ় নৈতিক বিবৃতি নেই। সমিতি ক্ষীণ কণ্ঠে ঠেকায় পড়া মুখরক্ষার
প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনে সমিতির সমর্থন নেই। বস্তুত এটা দলীয় ও
গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত সমিতির কাছে আদৌ কোনো অ্যাজেন্ডা নয়, হওয়ারও নয়। ১৯৭৩
সালে ইন্দিরার ওই স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইনজীবী সমাজ রুখে
দাঁড়িয়েছিল। সারা দেশে আইনজীবী সমিতিগুলো কর্মবিরতি করেছিল। অথচ আমাদের
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কাছে মন্তব্য চাওয়া হলে
দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি সাংবাদিকদের সর্বাগ্রে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে
ইতিপূর্বেও জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন ঘটেছে। যেন এটাও একটা বৈধতার উৎস! বিষয়টি এমন
যে অতীতে যেহেতু ঘটেছে, এখন ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনে
ইন্দিরা গান্ধীর ওই সিদ্ধান্তের বৈধতা রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল।
নিয়োগপত্রে রাষ্ট্রপতি গিরি সই করলেও এ জন্য তাঁকে কেউ দায়ী করেনি। কিন্তু
আমরা যেন এক ভিন্ন সংসদীয় সংস্কৃতির চর্চা করছি, যেখানে ধরে নেওয়া হয় যে
নিয়োগের সব দায় রাষ্ট্রপতির। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগে
ভারত ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা অভিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশে
জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিষয়টিকে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হয়ে
থাকে। হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগের সময়ের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের সঙ্গে
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮৫
সালে তিনজনকে ডিঙিয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও এ টি এম আফজাল, ১৯৮৯ সালে
দুজনকে ডিঙিয়ে মোস্তাফা কামাল, ১৯৯৯ সালে দুজনকে ডিঙিয়ে মাহমুদূল আমীন
চৌধুরী, ২০০০ সালে ওই দুজনকে আবার ডিঙিয়ে মইনুর রেজা চৌধুরী আপিল বিভাগে
যাওয়ার পর সেখানকার জ্যেষ্ঠতার ক্রম বজায় রেখেই প্রত্যেকে প্রধান বিচারপতি
হয়েছিলেন। কোনো বিতর্ক ওঠেনি। কারণ, যাঁদের ডিঙিয়ে তাঁরা আপিল বিভাগে
গিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ আপিল বিভাগেই যাননি। জ্যেষ্ঠকে টপকিয়ে প্রথম প্রধান
বিচারপতি নিয়োগ পান বিচারপতি কে এম হাসান। হাসান হাইকোর্টের বিচারক হন ১৯৯১
সালে, এর ছয় মাস পর একত্রে নিয়োগ পান মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, সৈয়দ জে আর
মুদাচ্ছির হোসেন ও মো. রুহুল আমীন। আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের জানুয়ারিতে
হাসান ও মোদাচ্ছিরকে টপকে (মোদাচ্ছিরের চেয়ে বয়সে রুহুল কনিষ্ঠ ছিলেন)
রাব্বানী ও রুহুল আমীনকে এবং চার মাস পরে ফজলুল করিমকে আপিল বিভাগে
নিয়েছিল। এই টপকানোর বৈধতা অ্যাডভোকেট এস এন গোস্বামী চ্যালেঞ্জ করলেও তা
খারিজ হয়েছিল ২০০১ সালের জুনে। এর পরবর্তী জুনের আগেই বিএনপি হাসান ও
মোদাচ্ছিরকে আপিল বিভাগে আনে। ২০০৩ সালের ২৩ জুনে প্রধান বিচারপতির পদ
শূন্য হলে তখনকার আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠতম ছিলেন মো. রুহুল আমীন, দ্বিতীয়
জ্যেষ্ঠ ছিলেন ফজলুল করিম। এই দুজনই বয়সে এবং হাইকোর্টে যোগদানের দিক থেকে
কে এম হাসানের কনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু আপিল বিভাগে তাঁরা দুজনেই হাসানের
জ্যেষ্ঠ হিসেবে গণ্য হলেন। কারণ, আপিল বিভাগে নিয়োগ কোনো পদোন্নতি নয়,
প্রতিটি নিয়োগই নতুন নিয়োগ। ফলে হাসানকে যখন ১৩ তম প্রধান বিচারপতি করা হয়
তখন ওই দুজনকে ডিঙিয়ে তা করা হয়। সেই অর্থে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পথ বিএনপিই দেখিয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে
একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালুর প্রয়োজনীয়তা এখন খুবই জরুরি হয়ে
পড়েছে। তবে নেতৃত্বটা বিচার বিভাগকেই দিতে হবে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
চ্যালেঞ্জের মামলা খারিজ করে ২০১৫ সালে আপিল বিভাগের এক রায়ে নবনিযুক্ত
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন লিখেছিলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বেছে নেওয়া
রাষ্ট্রপতির বিশেষ অধিকার। তিনি এককভাবে প্রধান বিচারপতি বেছে নিতে
পারেন।’ অবিকল একই ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও ঐতিহ্যের আওতায় ১৯৭৩ সালে
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি। ১৯৯৩ সালে ভারতের
সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, প্রধান বিচারপতি কে হবেন, এর সঙ্গে বিচার বিভাগের
নাড়ির সম্পর্ক, সর্বদা সেটা সুপ্রিম কোর্টই বলে দেবেন। আর আমাদের এখানে
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা ২০১১ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে নিজেই লিখেছিলেন,
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে বিচারক বেছে নিতে নির্বাহী বিভাগের
দৃষ্টিভঙ্গিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! দুই প্রতিবেশীর সর্বোচ্চ আদালতের
দৃষ্টিভঙ্গিতে কত মৌলিক তফাত!
মিজানুর রহমান খান যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
mrkhanbd@gmail.com
মিজানুর রহমান খান যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
mrkhanbd@gmail.com
No comments