মধ্যরাতে মোরগ ডাকার রহস্য by জয়া ফারহানা

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমাদের দশা হয়েছে ঘর পোড়া গরুর। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারার অন্যায় ব্যবহার এবং ব্যবহারের প্রবণতার কারণে বহু সাংবাদিকের হয়রানি দেখেছি। উদাহরণ দেয়ার প্রয়োজন দেখছি না। নাম এবং ঘটনাগুলো মনে হয় মোটামুটি সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন কি নতুন মহার্ঘ জিনিস প্রসব করল? এই আইনের সঙ্গে তো চরিত্র ও চেহারায় সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে সেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের। এক হিসাবে একে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সম্প্রসারণ বললেও বোধহয় খুব বাড়িয়ে বলা হয় না। এ এমন এক আইন, যেখানে অনলাইনে সদ্য আগত আনাড়ি ফেসবুকার না বুঝে বা ভুল বুঝে বা অর্ধেক বুঝে কোনো স্ট্যাটাস সমর্থনের কারণেও ফেঁসে যেতে পারেন কিংবা কেউ তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। নিরপরাধ বহু মানুষের ভোগান্তির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। অনেকের ধারণা প্রিন্ট মিডিয়া এই আইনের আওতাবহির্ভূত। ঠিক নয়। প্রিন্ট মিডিয়ার যে লেখাগুলো অনলাইন সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, সেসব লেখার কোনো একটি বাক্যও যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতমূলক, কোনো ইজ্জতদারের ইজ্জতনাশক, মানহানিকর অথবা গুপ্তচরবৃত্তির দোষে দোষণীয় হয় তবে এ আইনের দায় থেকে প্রিন্ট মিডিয়ার লেখাও মুক্ত থাকে না। অতএব কোনো সংবাদ মাধ্যমেরই একে বরণীয় আইন ভেবে ফুরফুরে মেজাজে থাকার সুযোগ নেই।
সামরিক গর্ভে যেসব দলের জন্ম, তাদের আমলে হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার, যে সরকার আবার গঠন করেছে এমন দল, যে দলের ইতিহাস মানে বাংলাদেশের ইতিহাস, তাদের শাসনামলে কী করে অংশীজনদের মতামত ছাড়া সবাইকে ফাঁসাতে পারে এমন একটি আইন মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে দিল, তা কিছুতেই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। প্রায় সব শ্রেণী-পেশার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত রকম বাধাগ্রস্ত করবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করবে, নানামাত্রিক গবেষণার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে। কেউ কেউ একে মধ্যযুগের আইন হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। এই মন্তব্যের যথার্থতাও আছে। একমাত্র মধ্য যুগেই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে রা কাড়লে শূলে চড়তে হতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ একরকম ডিজিটাল শূল, যে শূলে প্রতিপক্ষকে চড়ানোর সমস্ত বন্দোবস্তই রাখা হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক পেশাজীবী-শ্রেণী এর বিরোধিতা করেছেন। কেবল আমলারা বলছেন, এসবের কিছুই হবে না, কাউকেই শূলে চড়ানো হবে না। আমলাদের এই আশ্বাসবাণী এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে অটোমেটিক বেরিয়ে যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর খসড়া পড়লে দেখা যাবে, সংশ্লিষ্ট মহলের ‘সদিচ্ছা’ থাকলে প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য এর চেয়ে ভালো আইন আর নেই। ৩২ ধারা নিয়ে তো সরকারসমর্থক সাংবাদিকগোষ্ঠীই লজ্জা পেয়েছেন। এত স্থূল কৌশলে যে ৫৭ ধারা আবার ফেরত আসবে, সম্ভবত তারাও তা ভাবতে পারেননি। নতুন সংযোজিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করলে বা করতে সহায়তা করলে তিনি ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হবেন। যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা। এই ধারা কেবল সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, একই সঙ্গে তথ্য অধিকার আইনেরও পরিপন্থী। একই সঙ্গে ৩২ ধারার প্রতিটি শব্দ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার দাবি রাখে। প্রশাসনের স্বচ্ছতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে কেবল কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া সরকারের আর সব সংস্থার তথ্য পাওয়ার অধিকার সবার ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এই অধিকার হরণ করল। হিসাব করে দেখলাম, এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের চারটি পত্রিকা এবং কয়েকটি চ্যানেলের পক্ষেই কেবল টিকে থাকা সম্ভব এবং বাকি সব পত্রিকা এবং চ্যানেল যদি ওই চার পত্রিকা এবং চ্যানেলকে অনুসরণ করতে পারে তাহলেই কেবল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ নিয়ে চিন্তার কিছু থাকে না। অবশ্য সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর মতো কোনো আইন প্রণয়নেরও প্রয়োজন নেই। সরকারের অনেক আমলা এবং কোনো কোনো মন্ত্রী নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন।
আশ্বস্ত করেছেন ভয়ের কিছু নেই। আমরা জানি অনেকের জন্যই ভয়ের কিছু নেই। এবং কারও জন্যই ভয়ের কিছু থাকত না যদি সংবাদ শুরু করা যেত এভাবে- ‘সংবাদ সংস্থা বাসসের মাধ্যমে পাওয়া খবর অনুযায়ী...’। সংশ্লিষ্ট মহল দাবি করেছে, কোন অপরাধে কোন ধারা প্রযোজ্য হবে এবারের আইনে তা পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু পরিষ্কার হয়েও হল না পরিষ্কার। আইসিটি অ্যাক্টের সঙ্গে কী এমন তফাৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের। পরিবর্তন দেখছি কেবল একটি জায়গাতেই। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় মানহানির মামলায় শাস্তি ছিল চৌদ্দ বছর এবং তা জামিন অযোগ্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির মামলায় সাজা কমিয়ে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং জামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। ২৮ ধারার কথাই যদি বলি, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ১০ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। ২৯ ধারায় মানহানির শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে গত বছর আগস্টে বিস্তর আলাপ হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সুবাদে নাসিরনগর এবং ঠাকুরপাড়া জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ব্যাখ্যা কী তা আইসিটি আইনেও যেমন অস্পষ্ট ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও তেমন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থেকে গেল। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। মনিব অনুকূলের শিশুপুত্র খোকাবাবুকে হারানোর খেসারত হিসেবে নিজের শিশুপুত্রকেই মনিবের ঘরে প্রতিস্থাপন করেছিল ভৃত্য রাইচরণ। প্রত্যাবর্তনের ক্ষণে মনিব অনুকূল যখন রাইচরণকে জিজ্ঞেস করল এমন বিশ্বাসঘাতকতা কেমন করে করল। রাইচরণের জবাব, বিশ্বাসঘাতক আমি নই প্রভু, বিশ্বাসঘাতক আমার ঈশ্বর, আমার অদৃষ্ট। কিন্তু আমাদের তো রাইচরণের মতো সে উপায়ও নেই। অ্যানালগের কালে না হয় অদৃষ্টকে দোষারোপ করে পার পাওয়ার উপায় ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনরূপে প্রত্যাবর্তনের এই ডিজিটাল যুগে তা মানানসইও হবে না। আইন-কানুনের ট্রুমা ভোলার সুযোগে আমরা বরং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের চেহারা কেমন হতে পারে তা ভেবে নিতে পারি। ধরা যাক কোনোরকম বাধাবিঘœ ছাড়া দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাস হয়ে গেল। কেমন হবে তখন গণমাধ্যম?
পুত্রের প্রশ্ন পিতাকে। বাবা মোরগ ডাকে কেন?
কেউ মিথ্যা বললেই মোরগ ডেকে ওঠে।
তাহলে মধ্যরাতে মোরগগুলো সবচেয়ে উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে কেন?
ওই সময় যে চ্যানেলগুলোয় টকশোগুলো শুরু হয়। আর সব পত্রিকা ছাপা হতে থাকে।
জয়া ফারহানা : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.