একজন কৃতী মানুষের প্রস্থান by এম ফাওজুল কবির খান

এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা সারা জীবন আলো ছড়ান। তাঁদেরই একজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের সাবেক ডিন ও অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কৃতবিদ্য মানুষ নিজে জ্ঞানের জগতে অবদান রাখেন আর পরবর্তী প্রজন্মকে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন। গুগল স্কলার সার্চ করে দেখলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী তাঁর নিজের ও সহকর্মীদের সঙ্গে লেখা গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধৃতির (সাইটেশন) সংখ্যা সর্বমোট ৪৮৭ টি। গত পাঁচ বছর তিনি অসুস্থ ছিলেন। এ সময়েও, অর্থাৎ ২০১৩ সালের পর উদ্ধৃতির সংখ্যা ১৬৯টি। কেমন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী?
কুওরা ডটকম বলে একটি ওয়েবসাইট আছে। সেখানে যে কেউ, যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট যে কেউ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল, বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কারা? জবাবে প্রথমেই যে নামটি এসেছে তা হলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। জবাবে আরেকটি কথা উল্লেখ আছে, অধ্যাপক চৌধুরী ক্লাসে কখনোই হাজিরা নিতেন না। কিন্তু তাঁর ক্লাসে সব সময় থাকত উপচে পড়া ভিড়। একই প্রশ্ন আমি নিজেও জিজ্ঞেস করেছিলাম অধ্যাপক চৌধুরীর ছাত্র ও কিস্টোনে আমার সাবেক সহকর্মী তৌফিক ইমামকে। তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, মোহাম্মদ আলী স্যার ‘বাই ফার অ্যান্ড মাইলস’। মোহাম্মদ আলী আমার ছেলেবেলার বন্ধু লিয়াকত আলী চৌধুরীর ছোট ভাই। তাঁদের বাবা মরহুম আবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন আয়কর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাবার সরল ও অনাড়ম্বর জীবন মোহাম্মদ আলী ও তাঁর ভাইদের জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। কলেজে তাঁকে দেখেছি সাদা পায়জামা, সাদা শার্ট ও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে পায়জামার বদলে সাধারণ প্যান্ট ছাড়া আর বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখিনি। আমি ১৯৯৮ সালে ইডকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই। সে সময় বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থায়নের জন্য আমাদের বিবেচনাধীন ছিল। তাই পরামর্শের জন্য আমি মোহাম্মদ আলীর শরণাপন্ন হই। মোহাম্মদ আলীকে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি পরদিন আমাদের অফিসে হাজির হন। আমি তাঁকে উদ্দেশ্য জানালে তিনি আমাকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘বদ্দা (বড় ভাই), আমি আপনার সব কাজ করে দেব, কিন্তু কোনো টাকাপয়সা নিতে পারব না।’ আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি, এটা আমার ব্যক্তিগত কোনো কাজ নয়, তিনি টাকা নেবেন না কেন? তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যে টাকা পান, তা-ই তাঁর খরচ হয় না; বাড়তি টাকা দিয়ে তিনি কী করবেন? আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। বিদ্যুৎ-সচিব হওয়ার পর আমরা মন্ত্রণালয়ে একটি নাগরিক পরামর্শক কমিটি করি, যাতে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও অন্যান্য সুধীর সঙ্গে মোহাম্মদ আলীকেও অন্তর্ভুক্ত করি। কমিটির প্রথম সভায় মোহাম্মদ আলী কীভাবে আসবেন ভেবে সচিবের গাড়িটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে পাঠাই। চালক ফিরে এসে জানান, প্রফেসর সাহেব তাঁকে বলেছেন চলে যেতে। মোহাম্মদ আলী হেঁটে সময়মতো সভায় হাজির হন। পাঁচ বছর আগে হৃদ্ ও কর্কট রোগ একসঙ্গে তাঁর ওপর হামলে পড়ে। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাই। সেখানে ডাক্তাররা পরামর্শ দেন অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বিদেশে নিয়ে যাওয়ার। এটা জেনে আমরা অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিই। এই সংবাদ জানাজানি হতেই ইউরোপ,
উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে মোহাম্মদ আলীর ছাত্ররা অনবরত ফোন করতে থাকেন। সবার একই কথা, টাকা পাঠানোর জন্য একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। মোহাম্মদ আলী স্যারের ছাত্ররা থাকতে চিকিৎসার টাকার অভাব হবে না। এ ছাড়া দেশে মোহাম্মদ আলীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। আমরা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ, এখানে চিকিৎসার ঝুঁকি, অর্থ সাহায্য ইত্যাদি প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করি। তাঁকে আমরা জানাই যে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁর সম্মতি পেলেই যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হতে পারে। কিন্তু তাঁর জবাব ছিল, ‘তাঁর যা চিকিৎসা ঢাকাতেই হবে এবং তাঁর নিজস্ব সঞ্চয় থেকেই হবে। দেশের বাইরে বা অন্যের টাকায় তাঁর চিকিৎসা হবে না।’ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী দেশেই ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁর অপারেশন হয়। সে সময় তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীদের যে অনুরাগ দেখেছি, তা ভোলার নয়। পালা করে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাঁরা রাত-দিন স্যারের ডিউটি করেছেন। অকৃতদার মোহাম্মদ আলীর জীবনে বুয়েট ও এর ছাত্রছাত্রীরাই ছিলেন সব। কারও টাকার প্রয়োজন, মোহাম্মদ আলী স্যার আছেন। কারও থাকার জায়গা নেই, মোহাম্মদ আলী স্যারের বাসা আছে। ইউনিভার্সিটির ল্যাবে সরঞ্জাম নেই, মোহাম্মদ আলী স্যার আছেন। পড়াশোনা, চাকরিতে সাহায্যের কথা আর না-ই বললাম। তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা শুধু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়; সহকর্মী, বুয়েটের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, এমনকি পলাশীর বাজারের দোকানদার থেকে শুরু করে রিকশাচালক, বাজারের টোকাই ছেলেটি, কেউই বাদ পড়েনি। আজ তাই তাঁর প্রয়াণে অনেক মানুষ অশ্রু বিসর্জন করছেন। তাঁদের দাবি, কিংবদন্তিতুল্য এই মানুষটির স্মৃতি রক্ষার জন্য কিছু একটা করা হোক। বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাঁর কর্মস্থল ‘ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং’টিকে তাঁর নামে নামকরণের বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
এম ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.