শীর্ষ ১০ ব্যাংকের ঘাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ
খেলাপি
ঋণের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের ঘাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার বোঝা। এ ঋণ মোট
খেলাপি ঋণের ৬৫ ভাগ। আর ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে অপর ১০ ব্যাংকের ঘাড়ে ৭০
ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকাররা
জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা সৎব্যবহার করেননি।
আবার কেউ কেউ লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। এ কারণে তারা ঋণ পরিশোধ করতে
পারছেন না। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ঋণ নবায়ন করার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে চাপ
দিচ্ছেন। কিন্তু ঋণ নবায়ন করার জন্য যে ন্যূনতম এককালীন অর্থ পরিশোধ করতে
হয় (ডাউন পেমেন্ট) তা তারা করতে পারছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের
দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ
করছেন না। তাদেরকে নানাভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। বার বার ফোন
করছেন। কিন্তু উদ্যোক্তারা ফোন রিসিভ করছেন না। নিরুপায় হয়ে তাদের কাছে লোক
পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তারা ব্যাংকের লোককে পাত্তা দিচ্ছেন না। এখন উপায় মামলা
করা। কিন্তু মামলা করে সহজে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।
সব মিলে ব্যাংকগুলো গুটিকয়েক বড় ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অপর এক
ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে তা
সৎব্যবহার করেননি। শিল্প কারখানার জন্য ঋণ নিয়েছেন, কিন্তু তা শিল্প
কারখানায় ব্যবহার না করে জমি কিনেছেন। কেউবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ওই কর্মকর্তা বলেন,
চট্টগ্রামের ব্যাংকিং খাত নিয়ে তারা রীতিমতো আতঙ্কে আছেন। প্রায় প্রতি
সপ্তাহেই ব্যাংকের এমডি, না হয় ডিএমডি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে
যাচ্ছেন। কিন্তু জমিতে বিনিয়োগ করায় তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে
পারছেন না। আবার শুধু জমি বা পুঁজিবাজারেই নয়, কেউ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে
(এলটিআর, লিম ইত্যাদি) ব্যাংকের ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ওইসব ঋণ আর পরিশোধ
করেননি। এসব ঋণের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জামানত নেয়া হয়নি।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী
উদ্যোক্তার কাছেই বড় অঙ্কের টাকা আটকে রয়েছে। সব মিলে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের
ক্ষেত্রে অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০
ব্যাংকের মধ্যে প্রথম ৬টিই সরকারি। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের
খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটির সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ১২
হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের ১৫ ভাগ। এর পরেই রয়েছে
জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা,
যা মোট খেলাপির ১০ দশমিক ২২ ভাগ। ৯ দশমিক ৬২ ভাগ নিয়ে বেসিক ব্যাংক রয়েছে
তৃতীয় অবস্থানে। ব্যাংকটির সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আগের ত্রৈমাসিকের ৭
হাজার ৩৯০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয় ৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ৬
দশমিক ৭৯ ভাগ, রূপালী ব্যাংকের ৫ দশমিক ৫৫ ভাগ এবং কৃষি ব্যাংকের ৫ দশমিক
১৭ ভাগ। বেসরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ৩
হাজার ২৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩ দশমিক ৭৮ ভাগ। এর পরেই রয়েছে
পূবালী ব্যাংক ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ২ দশমিক ২০ শতাংশ
এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি
ঋণের ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ দিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কেবল বেড়েই
যাচ্ছে না, কিছু কিছু ব্যাংক খেলাপি ঋণ অবলোপনও করছে সমান তালে। ঋণ
অবলোপনের দিক থেকে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে পিছিয়ে নেই বেসরকারি ব্যাংকও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সমগ্র
ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে
শীর্ষ ১০ ব্যাংকের ঘাড়েই রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট
অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের ৬৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণ অবলোপন করা শীর্ষ ১০ ব্যাংকের
মধ্যে ৪টি সরকারি ব্যাংক এবং বাকি ৬টি বেসরকারি। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে
সবচেয়ে বেশি ঋণ অবলোপন করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটি ঋণ
অবলোপন করেছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের
প্রায় ৫ ভাগ। এর পরেই রয়েছে প্রাইম ব্যাংকের প্রায় ১ হাজার সাড়ে ৬ শ’ কোটি
টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। দি সিটি ব্যাংকের
প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের সাড়ে ৪ ভাগ।
আইএফআইসি ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা
মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ব্র্যাক ব্যাংক অবলোপন করেছে
৯২৭ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর
সাউথইস্ট ব্যাংকের ৯০৪ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের ২ দশমিক ৫১
শতাংশ। সরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৭ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা,
যা মোট অবলোপনকৃত ঋণের ২০ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের ৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা,
যা মোট অবলোপনকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ২০৬ কোটি
টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট
ব্যাংকের (বিডিবিএল) ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত ঋণের ৫ দশমিক
শূন্য চার শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলো খেলাপি
ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করতে পারছে না। বেশির ভাগ ঋণই ব্যাংকের খাতায় থেকে
যাচ্ছে। যেমন- সেপ্টেম্বর শেষে দশ ব্যাংকের অবলোপন হওয়া ২৪ হাজার ৮৬৩ কোটি
টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ১২২ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপনকৃত ঋণের মাত্র
শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর ১০ ব্যাংকের মোট ৫২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি
ঋণের মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের
মাত্র ৩ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় না হওয়ায় আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার
উন্নতি না হলে সামনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ দেয়া বা ঋণ বিতরণ করা কষ্টকর হয়ে
পড়বে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর হবে না।
No comments