হিংস্র পশুর নিন্দা বন্ধ করুন by হামিদ মীর
সিনেটর
পারভেজ রশীদ হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে একটি ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন। ওই
ভিডিও ক্লিপে একটি দেশী মুরগিকে কুকুরের সাথে লড়াই করতে দেখা যায়। মুরগিটি
তার ঠোঁট ও ডানা দিয়ে কুকুরের মুখে ঝাপটা মেরে অব্যর্থ হামলা করে যায় এবং
প্রতিটি হামলার পর কুকুর আরো হামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে যায়। কিন্তু
মুরগি শান্ত হয় না। সে আবার ডানা ফোলায়। নতুন করে হামলা শুরু হয়। কুকুর
জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে মুরগিকে ভয় দেখায়, কিন্তু মুরগি ভীত না হয়ে হামলা
অব্যাহত রাখে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কুকুর ময়দান ছেড়ে পালায়। এরপর মুরগি
তার পিছু ধাওয়া করে, আর কুকুর প্রাণ রক্ষার জন্য ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে।
কুকুর একটি হিংস্র পশু। আর মুরগি একটি নিরীহ পাখি। সে পাখির হাতে একটি
হিংস্র পশুর লজ্জাজনক পরাজয়ের আনন্দে সিনেটর পারভেজ রশীদ আমাকেও শরিক করা
জরুরি মনে করেছেন। আগে থেকেই মানুষের হাতে হিংস্র পশুর চরিত্রহননে ক্ষুব্ধ
আমি। ওই ভিডিও দেখে হিংস্র পশুর জন্য আমার সহমর্মিতাবোধ আরো বেড়ে গেল।
মানুষের ব্যাপারে আমার অভিযোগ রয়েছে, তারা যখনই একে অপরের ওপর জুলুম করে,
একজন অন্যজনের রক্ত ঝরায়, তখন ওই জুলুম ও রক্তপাতের নিন্দুকেরা তাকে হিংস্র
পশু হিসেবে আখ্যায়িত করে হিংস্র পশুর দলে ঠেলে দেয়। যেভাবে সব মানুষ এক
ধরনের নয়, তেমনিভাবে সব হিংস্র পশুও এক রকমের হয় না। প্রিয় চ্যানেল
অ্যানিমেল প্লানেটে এমন কিছু ফিল্ম দেখেছি, যেখানে বন্য কুকুর দলবদ্ধ হয়ে
বাঘের মোকাবেলা করতেও পিছপা হয় না। আবার এমন বাঘিনীও দেখেছি,
যে মা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ছোট্ট হরিণ ছানাকে গিলে খাওয়ার পরিবর্তে তাকে আদর করে।
অপর একটি বাঘ যখন ওই হরিণ ছানাটির ওপর হামলা করে, তখন বাঘিনী ওই ছানাকে
রক্ষা করেছে। অপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মে পশু বিশেষজ্ঞদের এমন একটি
বাঘিনীর ওপর গবেষণা করতে দেখা গেছে, যে মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি
হরিণশাবককে শুধু নিজের হেফাজতেই নেয়নি, বরং তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে
দেয়ার জন্য যত্নও করতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই বাঘিনীর বাচ্চা সম্ভবত
মারা গিয়েছিল এবং এ কারণে বাঘিনী মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হরিণ শাবককে
মা হয়ে লালন-পালন শুরু করে। এ ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখে আমার কাসুরের সাত বছর
বয়সী যয়নবের কথা মনে পড়ল, যাকে এক জালেম তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা শয়তানের
ঘৃণিত লালসার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হত্যা করেছে এবং অবশিষ্ট মানুষেরা ওই
ঘটনাকে পাশবিকতা বা পশুসুলভ হিংস্রতা আখ্যায়িত করে নিন্দা জ্ঞাপন শুরু
করেছে। আপনাদের মতো মানুষদের জিজ্ঞাসা করছি, হিংস্র পশু কি স্বজাতির
শিশুদের সাথে ওই কর্ম করে, যা একজন মানুষ নিষ্পাপ যয়নবের সাথে করেছে? এক
হিংস্র পশু অপর হিংস্র পশুকে মেরে ফেলে এবং একজন মানুষও অপর মানুষকে মেরে
ফেললে আফসোস হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষ নিজ কন্যার বয়সী যয়নবের সাথে যা
করেছে, তা কি কোনো হিংস্র পশু করতে পারে? এ জন্য আমি যয়নবের সাথে ঘটে যাওয়া
জুলুমকে পশুসুলভ আচরণ বলে মানতে রাজি নই। এ ঘৃণ্য অপকর্ম শুধু মানুষই করতে
পারে। এ অধম আপনাদের এমন কিছু সত্যকাহিনী শোনাতে পারবে, যেখানে হিংস্র পশু
মানুষের হারানো শিশুকে শুধু মৃত্যু থেকে রক্ষা করেনি, বরং তাকে লালন-পালনও
করেছে। দক্ষিণ স্পেনের মার্কোস রজার কুইজ পিন্টু জ্যা-এর জীবনী নিয়ে বহু
গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং পিএইচডিও হয়েছে। মার্কোস তার সৎ মায়ের অত্যাচারে
অতিষ্ঠ হয়ে খুব ছোট্ট বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং একটি জঙ্গলে হারিয়ে
গিয়েছেন। জঙ্গলে এক নেকড়ের বাচ্চাদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর
বাচ্চাগুলোর মা মার্কোসকে তাদের গুহায় নিয়ে যায়।
মার্কোস বারো বছর
পর্যন্ত ওই নেকড়ের বাচ্চাদের সাথে বসবাস করে। বারো বছর পর কিছু শিকারী তাকে
ধরে ফেলে এবং মনুষ্য সমাজে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বক্তব্য শুধু এটাই যে, সাপ
নিজের বাচ্চা খেয়ে ফেলে, আর কাক অন্য পাখির বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাঘ, চিতা,
নেকড়ে ও কুকুর নিজেদের বাচ্চা খেয়ে ফেলে, তবে অন্যদের বাচ্চার সাথে ওই
অন্যায় অপকর্ম করে না, যা একজন মানুষ যয়নবের সাথে করেছে। হিংস্র পশুর
নিন্দা বন্ধ করে মানুষের নিজের মাঝে লুকিয়ে থাকা শয়তানের নিন্দা করা উচিত।
যয়নবের ঘটনায় আমার কাছে অধিকৃত কাশ্মির থেকে কয়েকটি শোকগাথামূলক পত্র
পৌঁছেছে। স্বাধীনতাকামী বিখ্যাত নেতা আসিয়া আন্দ্রাবি সম্প্রতি ভারতের
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, পাকিস্তানি
ভূখণ্ডে সাত বছরের এক শিশুকন্যাকে ধর্ষণ ও হত্যা ভেতর থেকে আমাদের নাড়িয়ে
দিয়েছে। এ অত্যাচারী কে হতে পারে?’ জবাব দিলাম, এ অন্যায় কোনো মানসিক রোগী
করেছে। আমার বোন আসিয়া আন্দ্রাবি তৎক্ষণাৎ আমার সাথে একমত পোষণ করেন। সত্য
হচ্ছে, যা কিছু যয়নবের সাথে হয়েছে, তা নতুন নয়। এ অন্যায় পাকিস্তানের
সর্বত্র হচ্ছে। এ অন্যায় বিশ্বের প্রতিটি কোনায় হচ্ছে। এ অন্যায় সর্বত্র
মানুষই করে, হিংস্র পশু এটা করে না। এ ধরনের নিকৃষ্ট অপকর্মকারী নীচ মানুষ
কোথাও বাইরে থেকে আসে না। বরং সে আমাদেরই বংশ ও বন্ধুমহলের মধ্য থেকেই হয়ে
থাকে। আপনারা নিজেদের আশপাশে নজর বুলান। কিছুটা যাচাই করলে শিশুদের সাথে
যৌন নির্যাতনের অনেক ঘটনাই জানতে পারবেন। এ ধরনের নিকৃষ্ট অপকর্মকারী
ব্যক্তিকে দেখে সাধারণত বড় ভদ্র, উত্তম চরিত্র ও সৎ মনে হয়। অথচ তাদের
বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা একেবারে ভিন্ন। যয়নবের সাথে ঘটে যাওয়া
অন্যায়ের পর খাদেম হুসাইন রিজভী ও তার মতো কিছু ব্যক্তি শিশুদের সাথে যৌন
নির্যাতনের ঘটনার দায় মিডিয়ার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন, মিডিয়া
অশ্লীলতা ও নগ্নতা ছড়াচ্ছে, এর কারণে যৌন নির্যাতন বেড়ে চলেছে।
মিডিয়ায়
অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা একেবারেই দেখানো উচিত নয়। তবে আমার প্রশ্ন, আমাদের
সমাজে যে গালিগালাজ করা হয়, তার অর্থের প্রতি খেয়াল করুন। এ গালিগুলো আজ
থেকে নয়, বরং যুগ যুগ ধরে দেয়া হচ্ছে। এ গালিগুলোর সম্পর্ক আত্মীয়
সম্পর্কীয় নারীদের সাথে হয়ে থাকে। প্রতিটি গালি একটি জঘন্য অভিযোগের
ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এর অর্থ এ জঘন্য অভিযোগ অনেক পুরনো। আজকের যুগে এ
অভিযোগ মিডিয়ার মাধ্যমে বাস্তব হয়ে বারবার সামনে আসছে। এ কারণে
আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার কিছু মানুষ যৌন নির্যাতনের দায় মিডিয়ার ওপর চাপিয়ে
দিয়ে বাস্তবতাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। নিষ্পাপ যয়নব ঘর থেকে কুরআন শরিফ
পড়তে বেরিয়ে নির্যাতনের শিকার হলো। ওই কুরআন শরিফেই লুত সম্প্রদায়ের কথাও
উল্লেখ রয়েছে। ওই সম্প্রদায় যে মন্দকর্মে লিপ্ত ছিল, ওই মন্দকর্ম কি সমাজে
আপনাদের নজরে পড়ে না? এ কর্ম কি মিডিয়া ছড়িয়েছে? মিডিয়াকে অবশ্যই সমালোচনা
করবেন, তবে ওই দুশ্চরিত্র লোকদের বাঁচাবেন না, যাদের থেকে আমাদের শিশুদের
রক্ষা করা জরুরি। সময় এসে গেছে, স্কুলে আমাদের শিশুদের বলতে হবে, লুত
সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহ তায়ালা কেন আজাব নাজিল করেছিলেন এবং এ ধরনের
দুশ্চরিত্র লোকদের কবল থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ দিকটাও বেদনাদায়ক
যে, নিষ্পাপ যয়নবের সাথে ঘটে যাওয়া জুলুমকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ
রাজনীতির চমক দেখাচ্ছে। যয়নবের নামে রাজনীতি করে তার প্রতি বাড়তি জুলুম যেন
করা না হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, যয়নবের হত্যাকারীর গ্রেফতার ও অতি
দ্রুত তার শাস্তির দাবি কারা, কিন্তু সাথে সাথে সমাজে শিশুদের ওপর যৌন
নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা নিরসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের
প্রতিও তাদের নজর দিতে হবে। শিশুদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য পাঞ্জাব
সরকার প্রশিক্ষণ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সিন্ধু ও খায়বার
পাখতুনখাওয়াতেও এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বেলুচিস্তানে নতুন মুখ্যমন্ত্রী
এসেছেন। তার হাতে মাত্র কয়েক মাস রয়েছে। অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়ার পরামর্শ
তার শোনা উচিত নয়। বরং এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন
করা উচিত। এটা অনেক কাজে লাগবে। তিনি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে যৌন নির্যাতন
থেকে রক্ষা পাওয়ার শিক্ষা তো যুক্ত করতে পারেন। আপনাদের সবার কাছে নিবেদন,
মানুষের একে অপরের প্রতি অন্যায়কে পাশবিকতা বা পশুসুলভ হিংস্রতা আখ্যায়িত
করবেন না, কেননা হিংস্র পশু নিজেদের বাচ্চাদের সাথে ওই অপকর্ম করে না, যা
যয়নবের সাথে করা হয়েছে।
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
No comments