গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই খালেদা জিয়ার সংগ্রাম by সৈয়দ আবদাল আহমদ
লন্ডনভিত্তিক
সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সদ্য প্রকাশিত গণতন্ত্রের
সূচকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থান ২০১৭ সালে আগের বছরের
তুলনায় আরো আট ধাপ নেমে গেছে। দেশটিতে ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থা চলছে।
সেখানে অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত, বিরোধী দল ও গণমাধ্যম রয়েছে চাপে, আইনের
শাসন ও নাগরিক সমাজ দুর্বল, দুর্নীতির বিস্তার ব্যাপক। এ অবস্থার উত্তরণ
ঘটাতে হলে বাংলাদেশে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের
কাছে এ বক্তব্যের কোনো আবেদন নেই। কে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। সুষ্ঠু
নির্বাচন হলে তাদের কী লাভ? যে নির্বাচনে ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়া যায়,
সেদিকেই হাঁটবেন তারা। তারা চান নির্বাচনও হবে, ক্ষমতাও থাকবে- এমন একটা
কিছু। সেই ছক অনুযায়ীই সিলেট থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচার শুরু
করেছেন। সংসদে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সহায়ক সরকারের কোনো
সুযোগ নেই। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।’ অর্থাৎ, এই সংসদ বহাল
রেখে তার অধীনেই নির্বাচন হবে। অবস্থাদৃষ্টে আশঙ্কা হচ্ছে, আরেকটি একতরফা
নির্বাচনের ছকই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা মাত্র।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ দেশের সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেও এক ধরনের
সুখস্বপ্নে বিভোর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তা হচ্ছে তাদের গদি ছাড়তে হচ্ছে
না। তারা মনে করছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হচ্ছেন। তাই তৃতীয়
মেয়াদেও ক্ষমতার মসনদে তারাই থাকবেন। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা উৎফুল্ল ভাব সবার দৃষ্টি কাড়ছে। দলের সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিনই বিএনপির ‘দুরবস্থা’র কথা বয়ান
করছেন। বলছেন, বিএনপির আর কোনো আশা-ভরসা নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ
নাসিম সম্প্রতি আশুগঞ্জে গিয়ে জোর দিয়ে বলে এসেছেন, সামনের নির্বাচনের পর
বাটি চালান দিয়েও দেশের কোথাও বিএনপির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শরিক এইচ এম এরশাদ আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে ঘোষণা দেন-
‘খালেদা জিয়াকে কিছু দিনের মধ্যেই জেলে যেতে হবে।’ ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলার
রায়ের দিন ধার্য রয়েছে। অর্থাৎ, বিচারক এখনো কোনো রায় ঘোষণা করেননি। কিন্তু
ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে খুশির বন্যাই বয়ে যাচ্ছে। তারা
এমনভাবে কথাবার্তা বলছেন যেন রায়ে কী আছে সবকিছুই তাদের আগে ভাগেই জানা। ৮
ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে দেশে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারের
র্যাব ও পুলিশ বাহিনী দেশব্যাপী ঢালাও গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে
নিদারুণ অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক
নেতা এবং কয়েক শ’ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেককে গত ক’দিন নেয়া হয়েছে
রিমান্ডে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও জেলায় জেলায় নেতাদের বাড়িতে পুলিশ হানা
দিচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জমায়েত তো
দূরের কথা; রাজপথে কাউকে দাঁড়াতেই দেয়া হবে না। বাইরে থেকে বিএনপির লোকজন
যাতে আসতে না পারেন, সেজন্য ঢাকার প্রবেশ পথে পাহারা বসানো হচ্ছে। ফাঁকা
মাঠে গোল দিতে এবং বিনাপ্রতিযোগিতায় বাজিমাত করতে আওয়ামী লীগ খুব ভালোবাসে।
শত্রুর হাত-পা পিছমোড়া বেঁধে লড়াই করা তাদের স্টাইল। গত নয় বছর প্রতিপক্ষ
বিএনপিকে এভাবেই ঘায়েল করা হচ্ছে এবং কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই করতে দেয়া
হয়নি। দলের সভা সমাবেশ ও মিছিলে বাধা দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
র্যাব-পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে বিএনপির বিরুদ্ধে যথেচ্ছ ব্যবহার
ছাড়াও সশস্ত্র ক্যাডারদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের শাসনামলে এ পর্যন্ত
সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫০ হাজারের বেশি মামলা দেয়া হয়েছে।
আসামির সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। খুন করা হয়েছে ৭৭৩ জনকে। ক্রসফায়ার, গুম,
গুপ্ত হত্যা চালিয়ে দেশব্যাপী বিভীষিকার সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনবারের
নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অপমান-অপদস্ত,
নির্যাতন-নিষ্পেষণে জর্জরিত করা হয়েছে। তার নামে দেয়া হয় ৩৭টি মামলা।
নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার জন্য দু’টি মামলার বিচার কাজ শেষ
পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন তাকে আদালতে হাজির থাকতে হয়েছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা এজলাসে বসে থাকতে হয়েছে। তিনি কেন বেঁচে আছেন, এটাই যেন
তার অপরাধ। তিনি না থাকলে আওয়ামী লীগের আর কোনো বাধা থাকত না। তিনিই তাদের
পথের কাঁটা। তাই সব আক্রোশ তার ওপর। এমন আচরণ করা হচ্ছে যেন, খালেদা জিয়া
বানের জলে ভেসে এসেছেন। অথচ জানা উচিত, খালেদা জিয়ার শেকড় রয়েছে বাংলাদেশের
মূলে। তিনি বানের জলে ভেসে আসেননি। এ দেশের জন্য তার রয়েছে অপরিসীম
ত্যাগ-তিতিক্ষা। কেউ ইচ্ছে করলেই তাকে শেষ করে দিতে পারবে না। তাকে পরাজিত
করা এত সহজ নয়। অতীত অভিজ্ঞতার সাক্ষী দিচ্ছে, তাকে পরাজিত করা যাবে না।
গ্রিক উপকথার সেই ফিনিক্স পাখির কাহিনী নিশ্চয়ই সবার জানা। শত শত বছর বেঁচে
ছিল এটি। পুড়িয়ে ফেলার পর ছাইভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখি যেমন জেগে ওঠে, তিনিও
জেগে উঠবেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামের এক অনির্বাণ শিখা বেগম খালেদা
জিয়া। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ফিনিক্স পাখি। তিনি জেগে উঠবেন।
অনেক বাধা সত্ত্বেও বিএনপি দলের নির্বাহী কমিটির সভা ৩ ফেব্রুয়ারি লা
মেরিডিয়ান হোটেলে করেছেন। সভায় খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ‘আমি
যেখানেই থাকি না কেন, আপনাদের সাথেই আছি। আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দমাতে
পারেনি, পারবেও না। আমি দলের নেতাকর্মী ও দেশের জনগণের সাথে আছি।’ তিনি আরো
বলেন, বিএনপির সাথে দেশের জনগণ, প্রশাসন, পুলিশ এবং সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে।
ভয় বিএনপির নেই। ভয় আছে আওয়ামী লীগের। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ছয় দফা
প্রস্তাব অবিলম্বে মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। এগুলো হচ্ছে- ভোট হতে হবে
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আসার মতো পরিবেশ তৈরি
করতে হবে, ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা
বজায় রেখে কাজ করতে হবে, ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে,
সেনাবাহিনী মোবাইল ফোর্স হিসেবে কাজ করবে এবং ভোটের জন্য ইভিএম/ডিভিএম
ব্যবহার করা যাবে না। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ দেশ জাগবে, জাতীয় ঐক্য গড়ে
উঠবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। বিপদ এলে
সম্মিলিতভাবে মোকাবেলার আহ্বান জানান তিনি। তার দিকনির্দেশনামূলক এ
বক্তব্যে এটাই পরিষ্কার যে, তার কি হবে সে ব্যাপারে তিনি চিন্তিত নন। কোনো
ষড়যন্ত্রই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভীষ্ট লড়াই থেকে তাকে ও তার দলকে সরাতে
পারবে না। একতরফা নির্বাচন করে আবার গদি দখল এত সহজ হবে না।
খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবন
রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার উত্থান এক বিস্ময়। একসময় তার ছিল এক শান্তিপূর্ণ বাধাহীন পারিবারিক জীবন। তার বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং তিনি ছিলেন একজন সামরিক অফিসারের প্রেমময়ী জীবনসঙ্গিনী। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে স্বামী জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করা, ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার ছিলেন এক রকম নিরুপদ্রব জীবন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তার জন্য ছিল ভয়াবহ নতুন অভিজ্ঞতা। এ সময় দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তিনি দিন কাটিয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকার আনাচে-কানাচে। গ্রেফতার হয়ে বন্দী শিবিরে যাওয়ার পর নতুন শঙ্কা দেখা দেয়। তিনি জানতেন না, তাকে অন্য বন্দীদের মতো মেরে ফেলা হবে বা স্বামীকে তার জীবনে কোনো দিন আর দেখতে পাবেন কি না। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর স্বামীকে পেয়েছেন বীরের বেশে। সদ্য স্বাধীন দেশে স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই কাটে তার জীবন। স্বামী যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনো তিনি একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। তাকেই একদিন গৃহকোণ থেকে রাজপথে এসে দাঁড়াতে হলো। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর একটি কুচক্রী মহলের হাতে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জিয়া মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়া তার স্বামীকে চিরতরে হারালেন। এই মৃত্যু তার মনে গভীর দাগ সৃষ্টি করে। হৃদয়ে সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী গভীর ক্ষত ও দুঃখ। তবে এই করুণ মৃত্যু তাকে এনে দেয় প্রবল এক শক্তি এবং সসম্মানে ও সাহসিকতার সাথে বেঁচে থাকার অনন্য প্রেরণা ও প্রত্যয়। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে তার তেজোদীপ্ত নেতৃত্ব থেকে বিএনপি যখন বঞ্চিত হয়েছে, তখন দলের নির্ভরযোগ্য কোনো উত্তরাধিকারী নির্ধারিত ছিলেন না। ফলে বেগম খালেদা জিয়াকে এক রকম বিএনপির নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। তিনি দলের সব সারির নেতৃত্বকে সুসংঘবদ্ধ করেছেন এবং দলকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করে দিয়ে সর্বসম্মতভাবে এর প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত অবস্থায় বিএনপির হাল ধরেছেন। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে দল সুদৃঢ় হয়েছে। তিনি দেশের যেমন প্রবল জনপ্রিয় নেত্রী, তেমনি দলেও শক্তিশালী এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল। রাজনীতির ৩৫ বছরের ইতিহাসে খালেদা জিয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন। তেমনি নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করেছেন এবং পূর্ণ মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রধান নির্বাহী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনি অলংকৃত করেছেন সংসদ নেতার পদ, পার্লামেন্টারি পার্টির সভাপতি, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সার্ক চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের সম্মানজনক আসন। দলীয় প্রধানের উচ্চাসন তাকে জাতীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। আশির দশকে রাজনীতিতে পদার্পণের পরপরই তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদের সামরিক সরকার বিএনপি নেতাদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে দলে ভাঙনের অপচেষ্টা চালান একের পর এক। এ অবস্থায় এক দিকে দল রক্ষা ও পুনর্গঠন এবং অন্য দিকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে নতুন নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর। স্বৈরশাসনের অবসানের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে সাতদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। রাজনীতি ও সংগ্রামে সেই যে এলেন আর তিনি ফিরে তাকাননি পেছনে। শুধু এগিয়েই গেছেন রাজনীতির মহাসড়ক ধরে। নব্বইয়ে এরশাদ স্বৈরাচারের পতন ছিল ওই মহাসড়কের পাশে একটি গন্তব্য। আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় তারই নেতৃত্বে। বেগম জিয়া ও চারদলীয় জোটের বক্তব্য ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে দুঃশাসন চালাচ্ছে ও দুর্নীতি করছে, তাই ভোটের মাধ্যমে তাদের সরাতে হবে। ২০০১ সালে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেছিলেন তিনি। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তার দল বিএনপি জনগণের ভোটে বিস্ময়করভাবে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তেমনি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় ঐক্যজোট নীরব ভোট বিপ্লবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। দুই দফায় দেশ পরিচালনা করে দেশের উন্নয়নে তিনি রাখেন অনন্য অবদান।
দু’টি সরকারের নির্যাতন-নিষ্পেষণ
জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক আপসহীন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংগ্রামে তাকে সইতে হয়েছে অত্যাচার নির্যাতন। সাতবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। রাজপথে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন। কাঁদানে গ্যাসের শেল তার শরীরে আঘাত করেছে। গ্যাসের ঝাঁঝালো ধোঁয়া ছুড়ে মারা হয় তার চোখে মুখে। এ সময় তার প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয়েছিল। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে, দেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলের সভানেত্রী ঘোষণা দেন- ‘এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবো না’। তার ডাকা ১৭৩ দিনের হরতাল অবরোধ, অসহযোগ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ে খালেদা জিয়া শেষের দিকে ঠিকই শান্তিতে আর দেশ চালাতে পারেননি। তার সরকারকে পদে পদে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালায়। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গুলি ও টিয়ার শেল মেরে পল্টনে খালেদা জিয়াকে গুরুতর আহত করা এবং তার জনসভা ভেঙে দেয়া হয়। রাজনৈতিক আক্রোশে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি মামলাও দেয়া হয়।
১/১১ ও এর আঁতাতের সরকারের নির্যাতন
মইন-মাসুদ গংয়ের সাথে গোপন আঁতাতের অশুভ প্রক্রিয়ায় ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। প্রথমে তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বিদেশে সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা চলে। এটা ব্যর্থ হলে তাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরে গ্রেফতার করে এক বছর নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দিয়ে চালানো হয় সীমাহীন কুৎসা ও অপপ্রচার। তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। তারেক রহমানের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। বন্দী থাকার কারণে মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাকে গুরুতর অসুস্থ দু’সন্তানকে দেখতেও দেয়া হয়নি। এক বছর পর প্যারোলে মুক্তি পেলেও পরিবার থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সরকার খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে নিঃশেষ করার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এই বাড়িটি ছিল স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের সাথে তার ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সারা দিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। অথচ তার নামে তৎকালীন সংসদ বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল। এ দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ডিওএইচএস গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক কর্মকর্তাকে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও ডিওএইচএসে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি। অন্য কোথাও তার নিজের নামে একখণ্ড জমিও ছিল না। তাই শাহাদাতের পর রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এবং সেটা সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেই। সেই সিদ্ধান্তের সাথে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগও ছিল। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে সেই বাড়ির বরাদ্দও বাতিল করা হলো। মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু ঘটে। এ সময় মা খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। লাশ দেশে আনার পর জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না মায়ের। তবে কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে জানিয়ে দে, জিয়া পরিবারের পাশে বরাবরের মতোই তারা আছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। এর অংশ হিসেবেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচন চান। কিন্তু নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সরকার ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কাজ এগিয়ে যান। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জনগণকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় মার্চ করার কর্মসূচি আহ্বান করেন। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়। তার বাসভবনের সামনে বালির ট্রাক বসিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই দিন বাসভবন থেকে তাকে আসতে দেয়া হয়নি। ফলে গেটে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা দেন। তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেই ৫ জানুয়ারি একতরফাভাবে নির্বাচনী তামাশা করা হয়। ৫ জানুয়ারির পর ওই সরকারকে গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের জন্য এক বছর সময় দেন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি কোনো কর্মসূচি দেননি। কিন্তু সরকার নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। ২০১৫ সালে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’কে সামনে রেখে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হয়। এ অবস্থায় ৩ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে গুলশান কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়। বের হতে চাইলে তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় মরিচের গুঁড়া। এরপর তাকে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন, ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। অফিস লক্ষ্য করে ইট, ককটেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে তাকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা করা হয়। বেগম জিয়া ও তার সাথের লোকদের অভুক্ত রাখার জন্য গুলশান অফিসে খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক জীবনের অসামান্য রেকর্ড
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন থেকে অষ্টম নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রার্থী হয়ে চারবারই সব আসনে জয়ী হন। নবম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই তিনি জয়লাভ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে আবারো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রথম রেকর্ড তিনিই সৃষ্টি করেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবও তিনিই অর্জন করেন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়াই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। বগুড়া-৬ আসনে দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মাহবুব আলম ভোট পান ৫৪ হাজার ৭৭৭। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে রেকর্ড স্থাপনের এমন নজির অতীতে দেখা যায়নি।
নতুন সংগ্রামেও বিজয় অনিবার্য
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ১/১১’র মইন-মাসুদ চক্রের সরকারের বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অসামান্য নারী বেগম খালেদা জিয়া হিমালয়সম দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই দৃঢ়তাই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত হতে শক্তি জুগিয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সব দুর্যোগ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন আন্দোলনে এভাবেই তিনি নিজেকে অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলন করে রেখেছেন। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে তার এবারের সংগ্রামেও বিজয় সুনিশ্চিত। এ জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারেও যে তিনি প্রস্তুত, ইতোমধ্যে সে কথা নেতাকর্মী এবং দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। তার এই অপরিসীম ত্যাগ নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না। একদিন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবন
রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার উত্থান এক বিস্ময়। একসময় তার ছিল এক শান্তিপূর্ণ বাধাহীন পারিবারিক জীবন। তার বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং তিনি ছিলেন একজন সামরিক অফিসারের প্রেমময়ী জীবনসঙ্গিনী। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে স্বামী জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করা, ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার ছিলেন এক রকম নিরুপদ্রব জীবন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তার জন্য ছিল ভয়াবহ নতুন অভিজ্ঞতা। এ সময় দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তিনি দিন কাটিয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকার আনাচে-কানাচে। গ্রেফতার হয়ে বন্দী শিবিরে যাওয়ার পর নতুন শঙ্কা দেখা দেয়। তিনি জানতেন না, তাকে অন্য বন্দীদের মতো মেরে ফেলা হবে বা স্বামীকে তার জীবনে কোনো দিন আর দেখতে পাবেন কি না। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর স্বামীকে পেয়েছেন বীরের বেশে। সদ্য স্বাধীন দেশে স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই কাটে তার জীবন। স্বামী যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনো তিনি একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। তাকেই একদিন গৃহকোণ থেকে রাজপথে এসে দাঁড়াতে হলো। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর একটি কুচক্রী মহলের হাতে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জিয়া মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়া তার স্বামীকে চিরতরে হারালেন। এই মৃত্যু তার মনে গভীর দাগ সৃষ্টি করে। হৃদয়ে সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী গভীর ক্ষত ও দুঃখ। তবে এই করুণ মৃত্যু তাকে এনে দেয় প্রবল এক শক্তি এবং সসম্মানে ও সাহসিকতার সাথে বেঁচে থাকার অনন্য প্রেরণা ও প্রত্যয়। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে তার তেজোদীপ্ত নেতৃত্ব থেকে বিএনপি যখন বঞ্চিত হয়েছে, তখন দলের নির্ভরযোগ্য কোনো উত্তরাধিকারী নির্ধারিত ছিলেন না। ফলে বেগম খালেদা জিয়াকে এক রকম বিএনপির নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। তিনি দলের সব সারির নেতৃত্বকে সুসংঘবদ্ধ করেছেন এবং দলকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করে দিয়ে সর্বসম্মতভাবে এর প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত অবস্থায় বিএনপির হাল ধরেছেন। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে দল সুদৃঢ় হয়েছে। তিনি দেশের যেমন প্রবল জনপ্রিয় নেত্রী, তেমনি দলেও শক্তিশালী এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল। রাজনীতির ৩৫ বছরের ইতিহাসে খালেদা জিয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন। তেমনি নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করেছেন এবং পূর্ণ মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রধান নির্বাহী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনি অলংকৃত করেছেন সংসদ নেতার পদ, পার্লামেন্টারি পার্টির সভাপতি, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সার্ক চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের সম্মানজনক আসন। দলীয় প্রধানের উচ্চাসন তাকে জাতীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। আশির দশকে রাজনীতিতে পদার্পণের পরপরই তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদের সামরিক সরকার বিএনপি নেতাদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে দলে ভাঙনের অপচেষ্টা চালান একের পর এক। এ অবস্থায় এক দিকে দল রক্ষা ও পুনর্গঠন এবং অন্য দিকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে নতুন নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর। স্বৈরশাসনের অবসানের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে সাতদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। রাজনীতি ও সংগ্রামে সেই যে এলেন আর তিনি ফিরে তাকাননি পেছনে। শুধু এগিয়েই গেছেন রাজনীতির মহাসড়ক ধরে। নব্বইয়ে এরশাদ স্বৈরাচারের পতন ছিল ওই মহাসড়কের পাশে একটি গন্তব্য। আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় তারই নেতৃত্বে। বেগম জিয়া ও চারদলীয় জোটের বক্তব্য ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে দুঃশাসন চালাচ্ছে ও দুর্নীতি করছে, তাই ভোটের মাধ্যমে তাদের সরাতে হবে। ২০০১ সালে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেছিলেন তিনি। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তার দল বিএনপি জনগণের ভোটে বিস্ময়করভাবে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তেমনি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় ঐক্যজোট নীরব ভোট বিপ্লবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। দুই দফায় দেশ পরিচালনা করে দেশের উন্নয়নে তিনি রাখেন অনন্য অবদান।
দু’টি সরকারের নির্যাতন-নিষ্পেষণ
জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক আপসহীন গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সংগ্রামে তাকে সইতে হয়েছে অত্যাচার নির্যাতন। সাতবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। রাজপথে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন। কাঁদানে গ্যাসের শেল তার শরীরে আঘাত করেছে। গ্যাসের ঝাঁঝালো ধোঁয়া ছুড়ে মারা হয় তার চোখে মুখে। এ সময় তার প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয়েছিল। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে, দেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলের সভানেত্রী ঘোষণা দেন- ‘এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবো না’। তার ডাকা ১৭৩ দিনের হরতাল অবরোধ, অসহযোগ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ে খালেদা জিয়া শেষের দিকে ঠিকই শান্তিতে আর দেশ চালাতে পারেননি। তার সরকারকে পদে পদে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালায়। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গুলি ও টিয়ার শেল মেরে পল্টনে খালেদা জিয়াকে গুরুতর আহত করা এবং তার জনসভা ভেঙে দেয়া হয়। রাজনৈতিক আক্রোশে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি মামলাও দেয়া হয়।
১/১১ ও এর আঁতাতের সরকারের নির্যাতন
মইন-মাসুদ গংয়ের সাথে গোপন আঁতাতের অশুভ প্রক্রিয়ায় ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। প্রথমে তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বিদেশে সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা চলে। এটা ব্যর্থ হলে তাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরে গ্রেফতার করে এক বছর নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দিয়ে চালানো হয় সীমাহীন কুৎসা ও অপপ্রচার। তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। তারেক রহমানের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। বন্দী থাকার কারণে মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাকে গুরুতর অসুস্থ দু’সন্তানকে দেখতেও দেয়া হয়নি। এক বছর পর প্যারোলে মুক্তি পেলেও পরিবার থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সরকার খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে নিঃশেষ করার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এই বাড়িটি ছিল স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের সাথে তার ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সারা দিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। অথচ তার নামে তৎকালীন সংসদ বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল। এ দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ডিওএইচএস গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক কর্মকর্তাকে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও ডিওএইচএসে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি। অন্য কোথাও তার নিজের নামে একখণ্ড জমিও ছিল না। তাই শাহাদাতের পর রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এবং সেটা সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেই। সেই সিদ্ধান্তের সাথে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগও ছিল। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে সেই বাড়ির বরাদ্দও বাতিল করা হলো। মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু ঘটে। এ সময় মা খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। লাশ দেশে আনার পর জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না মায়ের। তবে কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে জানিয়ে দে, জিয়া পরিবারের পাশে বরাবরের মতোই তারা আছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এক নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। এর অংশ হিসেবেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচন চান। কিন্তু নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সরকার ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কাজ এগিয়ে যান। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জনগণকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় মার্চ করার কর্মসূচি আহ্বান করেন। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়। তার বাসভবনের সামনে বালির ট্রাক বসিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ওই দিন বাসভবন থেকে তাকে আসতে দেয়া হয়নি। ফলে গেটে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা দেন। তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেই ৫ জানুয়ারি একতরফাভাবে নির্বাচনী তামাশা করা হয়। ৫ জানুয়ারির পর ওই সরকারকে গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের জন্য এক বছর সময় দেন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি কোনো কর্মসূচি দেননি। কিন্তু সরকার নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। ২০১৫ সালে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’কে সামনে রেখে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হয়। এ অবস্থায় ৩ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে গুলশান কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়। বের হতে চাইলে তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় মরিচের গুঁড়া। এরপর তাকে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় তার অফিসের বিদ্যুৎ লাইন, ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। অফিস লক্ষ্য করে ইট, ককটেল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে তাকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা করা হয়। বেগম জিয়া ও তার সাথের লোকদের অভুক্ত রাখার জন্য গুলশান অফিসে খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক জীবনের অসামান্য রেকর্ড
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন থেকে অষ্টম নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রার্থী হয়ে চারবারই সব আসনে জয়ী হন। নবম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই তিনি জয়লাভ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে আবারো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রথম রেকর্ড তিনিই সৃষ্টি করেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবও তিনিই অর্জন করেন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়াই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। বগুড়া-৬ আসনে দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মাহবুব আলম ভোট পান ৫৪ হাজার ৭৭৭। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে রেকর্ড স্থাপনের এমন নজির অতীতে দেখা যায়নি।
নতুন সংগ্রামেও বিজয় অনিবার্য
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ১/১১’র মইন-মাসুদ চক্রের সরকারের বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অসামান্য নারী বেগম খালেদা জিয়া হিমালয়সম দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই দৃঢ়তাই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত হতে শক্তি জুগিয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সব দুর্যোগ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন আন্দোলনে এভাবেই তিনি নিজেকে অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলন করে রেখেছেন। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে তার এবারের সংগ্রামেও বিজয় সুনিশ্চিত। এ জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারেও যে তিনি প্রস্তুত, ইতোমধ্যে সে কথা নেতাকর্মী এবং দেশবাসীকে অবহিত করেছেন। তার এই অপরিসীম ত্যাগ নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না। একদিন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
No comments