কাটছাঁট হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা
নানা
উদ্যোগ সত্ত্বেও উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। ফলে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি
(এডিপি) থেকে বাদ যাচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। মূল এডিপিতে বরাদ্দ
ছিল ৫৭ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে কাটছাঁট করে নামিয়ে আনা হচ্ছে ৫২ হাজার
৫০ কোটি টাকায়। গত সপ্তাহে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এ অঙ্ক
চূড়ান্ত করে পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এত বিপুল অর্থের ব্যবহার করতে
না পারায় উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আসতে হচ্ছে সরকারকে। এর
কারণ হিসেবে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলাকে দুষছেন পরিকল্পনামন্ত্রী
আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ
পরিস্থিতিকে গোড়ায় গলদ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, নতুন করে যে বরাদ্দ
ধরা হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সেটিও বাস্তবায়ন ঝুঁকিতে রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ সূত্র জানায়, অর্থবছরের ছয় মাস যেতে না
যেতেই এডিপি কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু করে ইআরডি। গত ৩১ ডিসেম্বর এবং ১
জানুয়ারি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে সংস্থাটি। এর মধ্য দিয়ে
সংশোধিত এডিপি প্রণয়নের জন্য সব বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের প্রকল্প
সাহায্য বরাদ্দের প্রাক্কলন নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে এডিপি বরাদ্দের
জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যয়ের ভিত্তিতে সংশোধিত এডিপিতে
প্রকল্পভিত্তিক বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়,
সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তা কাটছাঁট হচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও
সেতু মন্ত্রণালয়, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। বিপরীতে বরাদ্দ বাড়ছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের। এ
প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল রোববার
যুগান্তরকে বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর প্রায় সব প্রকল্প থেকে
বিদেশিরা চলে যায়। তাদের ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লেগেছিল। সেই প্রভাব চলতি
অর্থবছরেও রয়েছে। ফলে এত টাকা বাদ দিতে হচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে এডিপির
বাস্তবায়ন কিন্তু গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে। এর আগে ইআরডি সচিব কাজী
শফিকুল আযম জানিয়েছিলেন, চলতি অর্থবছর বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার বাড়বে।
এজন্য ইতিমধ্যেই ২০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি
নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। যেসব প্রকল্পের কিছুটা বাস্তবায়ন কম সেগুলোকে ডিও
লেটার দেয়ার কথাও জানান তিনি। তা ছাড়া পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেও ৩৫০ কোটি
টাকার উপরে বরাদ্দ পাওয়া প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও
বিভাগগুলোর সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈদেশিক অর্থ বাদ দেয়ার বিষয়ে
ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন রোববার
যুগান্তরকে বলেন, আমরা শুরুতেই বলেছিলাম এটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য। এই টাকা
ব্যয় করা সম্ভব হবে না। এখন সেটিই প্রমাণিত হল। সংশোধিত এডিপিতে যে লক্ষ্য
ধরা হচ্ছে অর্থবছর শেষে সে টাকাও ব্যয় করতে পাড়বে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
কেননা সামনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ সময় কর্মকর্তারা স্থিতিশীলতা
রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগী থাকবেন। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন মনোযোগ
থাকবে না। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রত্যেক বছর এভাবে এডিপির লক্ষ্যমাত্রা
ভুল প্রমাণিত হয়। ফলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। শুরু থেকেই কেউ সিরিয়াসভাবে
কাজ করে না। তারা ধরেই নেয় এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে না। এ ক্ষেত্রে
লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের গোড়ায় গলদ রয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে মন্ত্রণালয় ও
বিভাগগুলোর বরাদ্দ হচ্ছে : কৃষি মন্ত্রণালয় ২৮৫ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ
মাধ্যমিক বিভাগ ৬১৩ কোটি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ৩৯৩ কোটি,
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণায় সাড়ে ২৭ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ দুই হাজার
২৬২ কোটি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ৫৯৯ কোটি, প্রাথমিক ও
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৭৫ কোটি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১৮৮ কোটি,
স্থানীয় সরকার বিভাগ সাত হাজার ৬২৩ কোটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় ছয় হাজার ৭০০
কোটি, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ ছয় হাজার ১৪২ কোটি, সেতু বিভাগ এক হাজার ৭৫৫
কোটি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯৪৯ কোটি, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৮ কোটি,
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ১১ কোটি, তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয় এক হাজার ৯৯৩ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ সাত হাজার কোটি,
খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০৮ কোটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ ৭৩ কোটি,
ভূমি মন্ত্রণালয় ২২ লাখ, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ৫৫১ কোটি, আইন ও বিচার বিভাগ
১০ কোটি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১৫১ কোটি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৫১ কোটি,
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৭ কোটি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ৩৭
কোটি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ১৫৬ কোটি, তথ্য মন্ত্রণালয় ১৯ কোটি, নির্বাচন
কমিশন ৪৪৯ কোটি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ৩৯ কোটি, পরিসংখ্যান ও তথ্য
ব্যবস্থাপনা বিভাগ ২৮৩ কোটি, আইএমইডি ৩৩ কোটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেড়
কোটি, সংসদ সচিবালয় ৭৫ লাখ, বিদ্যুৎ বিভাগ ১১ হাজার ৯৬ কোটি, জ্বালানি ও
খনিজসম্পদ বিভাগ ৪২৯ কোটি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১১০ কোটি,
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৪০ কোটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ৯০ লাখ, শিল্প
মন্ত্রণালয় ১০ কোটি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ৬০ কোটি, গৃহায়ন ও
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৩৩৮ কোটি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তিন কোটি, নিরাপত্তা
সেবা বিভাগ ৬০ কোটি, জননিরাপত্তা বিভাগ সাড়ে সাত কোটি এবং দুর্নীতি দমন
কমিশনের অনুকূলে বরাদ্দ থাকছে এক কোটি টাকা। এ ছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে এক
হাজার ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইআরডির
অতিরিক্ত সচিব ফরিদা নাসরিন বলেন, সংশোধিত এডিপিতে মোট টাকার অঙ্কের আর
কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ কম-বেশি হতে পারে। এ
প্রক্রিয়া চলমান। এমনকি সংশোধিত এডিপি অনুমোদন হওয়ার পরও এরকম করা হতে
পারে। তিনি জানান, গত অর্থবছর কমেছিল সাত হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় এ
অর্থবছর কম কমছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ কিছু বাধা
চিহ্নিত করেছে বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
এগুলোর অন্যতম হচ্ছে : কর্ম পরিকল্পনা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা, জমি অধিগ্রহণের জটিলতা, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, দরপত্র মূল্যায়নে দীর্ঘসূত্রতা, সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, উন্নয়নসহযোগীদের প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে মালামাল ক্রয়ে অসুবিধা, ঠিকাদারদের পেশাদারিত্বের অভাব, ভৌত নির্মাণ কাজের ধীরগতি, চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়াই কার্যক্রম চালু রাখা, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে দ্রব্যের মান ও মূল্য নির্ধারণে অদূরদর্শিতা এবং পরামর্শক সংস্থার ওপর অতি নির্ভরশীলতা।
এগুলোর অন্যতম হচ্ছে : কর্ম পরিকল্পনা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা, জমি অধিগ্রহণের জটিলতা, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, দরপত্র মূল্যায়নে দীর্ঘসূত্রতা, সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, উন্নয়নসহযোগীদের প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে মালামাল ক্রয়ে অসুবিধা, ঠিকাদারদের পেশাদারিত্বের অভাব, ভৌত নির্মাণ কাজের ধীরগতি, চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়াই কার্যক্রম চালু রাখা, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে দ্রব্যের মান ও মূল্য নির্ধারণে অদূরদর্শিতা এবং পরামর্শক সংস্থার ওপর অতি নির্ভরশীলতা।
No comments