কানের কাছে বাজছিল ‘মারে’ by কেএমএস আলম টুটুল

মনের অনুভূতিগুলো পাঠকদের মনের মাঝে বাস্তবে প্রতিফলন হবে কি না, তা আমি জানি না। তারপরও চেষ্টা করেছি আমাদের দেশের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অসহায় মানুষের কথা তুলে ধরতে। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস বিভাগের ২৩তম ব্যাচের তৌফিকের কাছ থেকে প্রথমে জানা, সেখান থেকে ‘এক টাকার দান বাক্স’ (একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান)-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এউএসটি স্কুল অব বিজনেস আল্যামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ঢাকার মৈনারটেক, উত্তরখান উত্তরায় অবস্থিত "আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম" এর জন্য কিছু করার প্রত্যাশা থেকেই আমাদের ছোট্ট প্রয়াস এবং সেখানে যাওয়া। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটাব। দুপুর নাগাদ আমরা "আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম" এ পৌঁছে বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক সৈয়দা সেলিনা শেলী আপার কাছে আমাদের পক্ষ থেকে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য নিয়ে যাওয়া উপহারসামগ্রী পৌঁছে দেই। এছাড়া এউএসটি স্কুল অব বিজনেস আল্যামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমের সবার জন্য খাওয়ার আয়োজন করি। "আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম" এর একজন মায়ের জানতে চাইলাম "মা" কেমন আছেন? বয়সের ভারে ভেঙে যাওয়া গালে ফোকলা মুখে হেসে যা বললেন তা বোঝা সহজ ছিল না। আগে থেকেই কান বাড়িয়ে ছিলাম বলেই বুঝতে পারলাম বলছেন, ভালো আছি। শেলী আপা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কয় ছেলে? আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন দুই ছেলে। শেলী আপা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়ি যাবা? ডুকরে কেঁদে উঠলেন, অনেকটা আর্তনাদ করেই বললেন "না"..... আপা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? যা বললেন তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না.....দুঃখে লজ্জায় কাতর হয়ে মা বললেন "মারে"..... ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত আমাদের কারও পক্ষেই চোখের পানি ধরে রাখার মতো অবস্থা ছিল না.....বিস্ময়ে, কষ্টে কিছুক্ষণের জন্য সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কেউ কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিল না, সম্ভবও ছিল না.....মনের ভেতরে সবাই যে উত্তরটা হাতরে বেড়াচ্ছিল সেটা হচ্ছে লজ্জাটা আসলে কার? সৈয়দা সেলিনা শেলী আপার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া এই বৃদ্ধাশ্রম। আপার কাছ থেকেই আমরা জানলাম এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ার পেছনের ইতিহাস, অবহেলিত এই মা বোনদের জীবনের নিদারুণ গল্প আর সেখান থেকে কিভাবে টুনটুনি, জোহড়া বিবি, নুরিয়া বেগম, সামসুন নাহার, মাহমুদা, তানিয়া, নাজনিনের মতো ৩৫ জন হতভাগা মানুষের এই বৃদ্ধাশ্রমে আসা।
এখানে আশ্রিত যাদের বেশির ভাগই শারীরিক অথবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। জরাজীর্ণ সেই ভবনে নেই গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি কিংবা পানির সুব্যবস্থা। নেই চিকিৎসার সুব্যবস্থা। কিন্তু সেখানে গাদাগাদি করে থাকা মানুষের শারীরিক কিংবা মানসিক যে কষ্টই থাকুক না কেন, মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আর সম্মানটুকু অবশ্যই আছে। এদের কাউকে সাভার, কাউকে টঙ্গী, কাউকে পুরান ঢাকার কোন এলাকা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে সম্পূর্ণ নগ্ন, অত্যাচারিত কিংবা আহত অবস্থায়। মানুষ ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিজের ময়লা নিজেই খেয়েছে বহুদিন। বিছানায় শুয়ে থাকা ফুটফুটে শিশুটির সম্পূর্ণভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবতী মা প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বারান্দার রেলিং ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে জবুথুবু হয়ে বসে আছে এক কোণায়। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েও কোন অমানুষের যৌনলিপ্সা থেকে মুক্তি পাইনি মেয়েটা। এই সমাজে পাগলদেরও রেহাই নেই। এসব মানুষ ফিরে যেতে চায় না আর অবহেলিত, নিপীড়িত কিংবা অসম্মানের কোনো জায়গায়। প্রচার নেই সেভাবে, বেশি কেউ জানে না তাদের কথা, অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এই বৃদ্ধাশ্রমের কথা। দৈন্যতা আর দুর্দশা এদের তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত। এমনকি মারা গেলেও পোহাতে হয় অপরিসীম ভোগান্তি। একবেলার খাবার জোগাড় করতেও এদের হিমশিম খেতে হয়। নিয়মিতভাবে সাহায্যর কোনো উৎসও এদের নেই। সাহায্যের কথা যতবার না বলেছেন আমাদের তার চেয়ে আরও বেশিবার বলেছেন এই ধরনের মানুষ থাকলে সন্ধান দিতে। একটা বেলা কাটিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম আমরা, তখন কিছুতেই নিজের মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। কষ্ট তো অবশ্যই হচ্ছিল কিন্তু কেন জানি খুব রাগও হচ্ছিল, কানের কাছে বাজছিল ‘মারে’...

No comments

Powered by Blogger.