শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা উচিত
দেশের
বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, প্রশ্নফাঁস ভয়ঙ্কর রূপ
নিয়েছে। সরকারের এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকতে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের চিহ্নিত ও
ফাঁসের উৎস বের করতে না পারা হতাশাজনক। দিনের পর দিন প্রশ্নফাঁসের কারণে
পাবলিক পরীক্ষার ওপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে গেছে। এভাবে কোনো দেশের শিক্ষা ও
পরীক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। সরকারকে এবার কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় তালগোল পাকানো, দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্রের সুরক্ষা দিতে
ব্যর্থতার দায়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
তিনি পদত্যাগ না করলে
সরকারের উচিত তাকে বরখাস্ত করা। এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এখন
পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দুই বিষয়ের প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে করণীয়
সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা উল্লিখিত পরামর্শ দিয়েছেন। তারা
অপরাধীদের যে কোনো মূল্যে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার সুপারিশও করেছেন।
তারা বলেন, প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এর শাস্তি পাচ্ছে
শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা
ঠিক নয়। এই নিয়ম নিবর্তনমূলক। প্রশ্নফাঁসের উৎস খুঁজে বের করতে সরকারের সব
সেক্টরের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
প্রশ্নফাঁস রোধে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ক্লাসরুমে লেখাপড়া ফিরিয়ে আনা ও
আইন করে কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। বরেণ্য
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন
ক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর সফলতা আছে। কিন্তু যারা প্রশ্নফাঁস করছে,
তারা কী এতই দুর্ধর্ষ? যদি অন্য ক্ষেত্রে সরকার সফল হয়, তাহলে এক্ষেত্রে
কেন ব্যর্থ হবে?’ তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র নিয়ে মনে হচ্ছে খেলাধুলা হচ্ছে।
এখানে বিশাল বাণিজ্য জড়িত। নিশ্চয়ই পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা
আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমের পরীক্ষাও তো নেয়া হয়।
তার প্রশ্ন ফাঁসের কথা শোনা যাচ্ছে না। তাহলে কি ওদের আর আমাদের
ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য আছে?’ অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি এখন
সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। শিক্ষা খাতও সেই গ্রাসের ভেতরে। (শিক্ষা খাতের এক
মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে) কারও কারও ঘরের ভেতরে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতার নামও
উঠে আসছে। এসব লক্ষণ ভালো নয়। প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, এখন শিক্ষার চেয়ে
পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। শিক্ষা যে গুরুত্বপূর্ণ খাত, তাও যেন ভুলে
গেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। শিক্ষা যেন ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত কিনা- এমন প্রশ্নে সিরাজুল ইসলাম
চৌধুরী বলেন, ওনার স্বীকার করতে হবে যে, তিনি (শিক্ষামন্ত্রী) প্রশ্নফাঁস ও
শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বন্ধে ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির
অধ্যাপক কথাসাহিত্যিক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধ করা ও
ফাঁসকারীদের ধরার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকারের। তাদের কেন ধরছে
না? আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কী এতই দুর্বল! যদি ধরতে না-ই পারে, তাহলে
তাদের (গোয়েন্দা সংস্থা) রেখে লাভ কী?’ তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে
যারা প্রশ্নফাঁস করছে তাদের ধরা কোনো ব্যাপারই নয়। যে কোনো হ্যাকারকে
দায়িত্ব দিলেও অল্প সময়ে তারা ধরে দিতে পারবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে সরকারের
সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো কেন পারছে না?’ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এবারের এসএসসির
দুই পরীক্ষারই প্রশ্নফাঁস হয়েছে। এর আগেও হয়েছে। যে দায়িত্বটা (প্রশ্নফাঁস
রোধ) মন্ত্রণালয়ের বা শিক্ষামন্ত্রীর, তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পরীক্ষার্থীর
ওপর। তাদের সাড়ে ৯টার মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢুকতে বলা হয়েছে। এটা একটা
অমানবিক সিদ্ধান্ত। পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট পরও ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার
হলে ঢোকার অধিকার আছে। কেননা যানজটসহ নানা বাস্তবতা আছে। বরং যে পরে ঢুকবে
সে কম লিখবে। মন্ত্রণালয়ের এই নিয়মটাকে আমি নিবর্তনমূলক বলে মনে করি।’
মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের কথা বলে।
কিন্তু যেখানে শিক্ষার্থী ও জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত, সেখানে তার প্রতিফলন
দেখছি না। বরং দিনের পর দিন প্রশ্নফাঁসের ঘটনা অস্বীকার হয়েছে। তিনি বলেন,
প্রশ্নফাঁসে বাইরের লোক জড়িত নয়। এর দায় শিক্ষার্থী বা শিক্ষকের ওপর চাপানো
যাবে না। প্রশ্নফাঁস অবশ্যই রোধ করতে হবে। এজন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি
গঠন করে দোষীদের বের করতে হবে। সব সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে দোষীদের ধরতে
হবে। কেননা জঙ্গিবাদের মতোই এটা বড় একটা অপরাধ।
অপরাধীদের শাস্তি দিতেই
হবে। প্রশ্নফাঁস, দুর্নীতির দায়ে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়াসহ কয়েক
বছর ধরে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত কিনা?
জবাবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, তিনি কী করবেন সেটা তার ব্যাপার। তবে
প্রশ্নফাঁসের দায় শিক্ষামন্ত্রীকেই নিতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে)
নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এমনই হতাশ যে এর
(প্রশ্নফাঁস) প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এটা
বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। প্রযুক্তিবিদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
কঠোর ও দৃঢ় পদক্ষেপে এটা বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু তারা অপরাধীকে ধরছে না
কেন? তক্কে তক্কে থাকা অপরাধীরা সুযোগ পায় কীভাবে?’ তিনি বলেন, ‘কঠিন সত্য
হচ্ছে, প্রশ্নফাঁস হয়। সেটা ৩০ মিনিট আগেই হোক, আর এক ঘণ্টা আগে হোক। আর এ
কারণে পরীক্ষার প্রতি অভিভাবকদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। অনেককেই বলতে শুনেছি,
পরীক্ষা দেয়ায় লাভ কী?’ তার মতে, ‘প্রশ্নফাঁসের জন্য শিক্ষক-অভিভাবককে
দোষারোপ করা হচ্ছে। অভিভাবককে বলা হচ্ছে আপনারা প্রশ্নের পেছনে ছুটবেন না।
এমন সস্তা কথা বলাই যায়। কিন্তু যেখানে প্রশ্নফাঁস হচ্ছে, সেখানে অভিভাবকের
প্রশ্নের পেছনে ছোটাই স্বাভাবিক। সরকারকে এমন কথা না বলে দায়িত্ব নিয়ে
প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে হবে।’ রাশেদা চৌধুরী বলেন, ‘অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে
পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা ভালো। কিন্তু যাদের ইতিমধ্যে ধরা হয়েছে কী
শাস্তি হয়েছে। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কতদিন চলা যায়? প্রশ্নফাঁস বন্ধে
সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ক্লাসরুমের লেখাপড়া কোচিং সেন্টারে চলে গেছে।
সেটা আবার ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনতে সরকারকেই উপায় বের করতে হবে।’ রাশেদা
চৌধুরী আরও বলেন, আমি সরকারকে একটা কারণে সাধুবাদ জানাতে চাই। তা হচ্ছে,
সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কোচিং বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। আমি মনে করি আইন করে
কোচিং স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া উচিত। অপরদিকে পাবলিক পরীক্ষা হোক আর নিয়োগ
পরীক্ষারই হোক- যে কোনো প্রশ্নফাঁস যে বা যারাই করুক, তাদের দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি দিতে হবে। আইনের ফাঁক গলে যেন বেরিয়ে যেতে না পারে। এদিকে আমরা
এখনও শিথিলতা দেখতে পাই। এছাড়া প্রশ্নফাঁসকারী ধরার পর জেলে পাঠানোর আগে
ঘোড়ার গাড়িতে বেঁধে গলায় জুতার মালা পরিয়ে নগরে ঘোরাতে হবে।’ অধ্যাপক ড.
আসিফ নজরুল বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এটা এখন প্রমাণিত।
প্রশ্নপত্র যে হারে ফাঁস হচ্ছে তার প্রথম প্রতিকার হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রীর
পদত্যাগ। কোনো সভ্য দেশে পাবলিক পরীক্ষার একটা প্রশ্ন ফাঁস হলেই
শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করতেন। কিন্তু আত্মসম্মানবোধ, দায়িত্ববোধ এবং
ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ থাকলে তার (শিক্ষামন্ত্রী) বহু আগেই পদত্যাগ করা
উচিত ছিল। তিনি যদি পদত্যাগ না করেন তাহলে সরকারের উচিত তাকে অপসারণ করা।
কেননা প্রশ্নফাঁসের বহুবিধ ঘটনার কারণে পাবলিক পরীক্ষার ওপর থেকে জনগণের
আস্থা চলে গেছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে তাকে বরখাস্ত করা উচিত। আসিফ
নজরুল বলেন, পদত্যাগ বা বরখাস্ত আরেকটি কারণে করতে হবে। সেটি হচ্ছে- তিনি
ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে শুধু ব্যর্থই হননি। বরং তার কাছের লোক, তার ব্যক্তিগত
কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রাথমিক
প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি নিজে মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের
সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে বলেছেন।’ তিনি বলেন, ‘পত্রিকা থেকে জেনেছি,
প্রশ্নপত্র ফাঁসকে ঘিরে বিশাল একটা অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে। দিনের পর দিন
তিনি নানা পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি- এমন কথাও
বলেছেন।’ প্রশ্নফাঁসের উৎস বের করতে এই শিক্ষাবিদ একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন
তদন্ত কমিটি গঠনের তাগিদ দিয়ে বলেন, নিবিড়ভাবে ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান
করতে হবে। এজন্য ওই কমিটিতে সরকারের সব সেক্টরের লোক রাখতে হবে। তিনি
বলেন, প্রশ্নফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করা শুরু করলেও একটা জটিলতা আছে।
কিন্তু পরীক্ষার দিন গুটিকয়েক লোক যদি প্রশ্ন পেয়েও থাকে, তার কারণে
পরীক্ষা বাতিল করলে এর শাস্তিটা লাখ লাখ শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই পাবে। এখন
প্রশ্নফাঁসের বিষয়টা কতটা তীব্র ছিল তা অনুসন্ধান করে আগে বের করতে হবে।
তারপর বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে অতটা তীব্র না হলে বাতিল না
করাই ভালো।
No comments