পণ করেছিলেন, জীবন দিয়েও এক রান নেবেনই by নাইর ইকবাল
১৯ বছর আগের কুয়ালালামপুরের সেই বিকেলটা কীভাবে ভোলেন হাসিবুল হোসেন? এ দেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের ইতিহাস রচনার সেই দিনটিতে হাসিবুল যে ছিলেন চূড়ান্ত দৃশ্যপটের মধ্যমণি হয়েই। আইসিসি ট্রফির শ্বাসরুদ্ধকর সেই ফাইনালে জয়ের জন্য শেষ বলে যখন বাংলাদেশের ১ রান দরকার, তখন ব্যাট হাতে স্ট্রাইকিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে যে তিনিই। মার্টিন সুজির বলটি কোনোমতে পায়ে লাগিয়েই তিনি দিলেন ভোঁ দৌড়। অপর প্রান্তে থাকা খালেদ মাসুদের সঙ্গে বোঝাপড়াটাও হলো দুর্দান্ত। হাসিবুল-মাসুদের সেই দৌড়ই বাংলাদেশকে নিয়ে গেল অন্য উচ্চতায়। এ দেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার সূচনাটাও যে হয়েছিল সেই দৌড়েই। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া, এই দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাংলার অলিতে-গলিতে পৌঁছে দেওয়া সেই আইসিসি ট্রফির ফাইনাল শুরু হয়েছিল আজ। ১৯৯৭-২০১৬। এক এক করে পেরিয়ে গেছে উনিশটি বছর। ক্রিকেট পেরিয়েছে কত চড়াই-উতরাই। সেদিনের আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ খেলেছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে। টেস্ট খেলাও হয়ে গেছে প্রায় এক শর কাছাকাছি। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাওয়া গেছে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের স্বাদ। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা অসংখ্য কৃতিত্বে ক্রিকেটের পরিসংখ্যান করেছেন সমৃদ্ধ। সবকিছুর কেন্দ্রে ১৯ বছর আগের সেই বিকেলটি যেন এখনো অন্য রকম আবেগ তৈরি করে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। সেদিন সেই অবিস্মরণীয় স্মৃতি যে চিরদিনই ক্রিকেটের প্রেরণার উৎস। হাসিবুল স্পষ্ট মনে করতে পারেন সেদিনের প্রতিটি মুহূর্ত, ‘শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১১ রান। পাইলট (খালেদ মাসুদ) প্রথম বলেই ছক্কা মেরে লক্ষ্যটা একেবারে নাগালের মধ্যে এনে দিল। পরের ৫ বল থেকে ৫ রান করাটা সেই হিসেবে সহজই ছিল। নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকবার আলাপ-আলোচনা করলাম। কোনো ঝুঁকিতে না গিয়ে জয় তুলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। সবকিছুই পরিকল্পনামতো হলো। শেষ বলে আমি স্ট্রাইকে। ‘পাইলট এসে বলল, “বল ব্যাটে লাগুক আর না লাগুক দৌড়াবি।” আমি ভাবলাম, কেবল আউটটাই হওয়া যাবে না। জীবন দিয়ে হলেও একটা রান নেবই। শেষ বলে জয়সূচক রানটা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে আমরা দুজনেই ছিলাম প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তুলেও নিলাম রানটা।’ ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালের অন্তিম মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করতে করতেই হাসিবুল চলে এলেন সাম্প্রতিক সময়ে, ‘জানেন, সেদিন বেঙ্গালুরুতে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচটির শেষ ওভারে আইসিসি ফাইনালের কথা খুব মনে পড়ছিল। শুভাগত আর মুস্তাফিজ যদি একটু সময় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিত! সেদিন আমরা অন্তত ম্যাচটা টাই করে ফিরতে পারতাম। হার্দিক পান্ডিয়া শেষ বলটি করার সময়ই মুস্তাফিজের দৌড় শুরুর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা উচিত ছিল। সেটা করতে পারলেই তো সে আর রান আউট হয় না। ম্যাচের স্কোর টাই হয়ে গেলেও তো সুপার ওভারে আরেকটা সুযোগ পেতাম।’ শেষ বলে রান নিয়েই আনন্দের আতিশয্যে এক দৌড়ে সাজঘরে চলে গিয়েছিলেন হাসিবুল। এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে হাসিবুলের সেই দৌড় এখনো ‘আইকনিক’ এক দৃশ্য হয়ে আছে। হাসিবুল বললেন, ‘উদ্যাপনটা আসলে কখনোই কোনো কিছু ভেবে হয় না। আমার সেই দৌড়ও আগে থেকে পরিকল্পনা করে নয়। আনন্দটা বাঁধভাঙা ছিল বলেই হয়তো তেমন দৌড় দিয়েছিলাম।’ হাসিবুল নিজেকে গর্বিত ভাবেন দেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার সূচনার অংশ হতে পেরে। ভাগ্যবানও মনে করেন নিজেকে, ‘হ্যাঁ, আমি ভাগ্যবান। গর্ব লাগে সেই মুহূর্তের অংশ ছিলাম বলে। খুব ভালো লাগে যখন দেখি, মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা সঠিক পথেই এগিয়ে নিচ্ছে দেশের ক্রিকেটকে। আমরা শুরু করে দিয়েছিলাম। সাকিব, তামিমরা একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলাদেশের ক্রিকেটকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবে—সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।’
No comments