ঢাকায় ৪৪ শিশু খুনের বিচার আটকে আছে by আসাদুজ্জামান
হাবিবুল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম রাজধানীর পল্লবীতে নিজেদের জন্য একটি বাড়ি বানানোর চেষ্টা করছিলেন। এই বাড়ি বানাতে গিয়েই এক নৃশংস শিশু খুনের মামলায় জড়িয়ে গেছেন আনোয়ারা। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আনোয়ারা বেগম এক ভাড়াটে খুনির সহায়তায় সুমন নামে প্রতিবেশী ছয় বছরের এক শিশুকে ধরে এনে নিজেদের নির্মাণাধীন বাড়িতে জবাই করে হত্যা করিয়েছেন। কারণ, কুসংস্কারে বিশ্বাসী আনোয়ারা স্বপ্নে দেখেছিলেন, বাড়িটি নির্মাণ নির্বিঘ্ন করতে কোনো মানুষের রক্ত লাগবে। অর্থাৎ কাউকে ‘বলি’ দিতে হবে। সেটা ২০০৬ সালের ১৯ এপ্রিলের ঘটনা। হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর পুলিশ যে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাতে এ বিবরণই লেখা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আসামি আনোয়ারা বেগম, তাঁর দেবর ইউসুফ আলী এবং রতন নামে এক ভাড়াটে খুনি। ২০০৯ সালে তিনজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। কিন্তু গত সাত বছরে ৩২ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন সুমনের বাবাসহ মাত্র পাঁচজন। অন্যরা কেউ আদালতে আসেন না। এর মধ্যে পুলিশেরই আছেন ১৪ জন সাক্ষী। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি মো. সালাহউদ্দিন মিয়া অভিযোগ করেন, পুলিশের জন্যই নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে। সাক্ষীদের হাজির না পেয়ে আদালত এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিলেও তা তামিল করা হয়নি। সাক্ষী হাজির করতে কারও গরজ নেই, ঠিকমতো জারি হয় না সমন। বছরের পর বছর এ অবস্থা শুধু ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতেই এ রকম আরও ১৫টি শিশু খুনের মামলা বিচারাধীন। সবগুলোরই বিচারের গতি নানা কারণে ঝিমিয়ে আছে। ঢাকা মহানগরে আরও ১২টি আদালতে এ রকম ৪৩টি শিশু হত্যার বিচার চলছে বছরের পর বছর। এর কোনো কোনোটি ১৬ বছরের পুরোনো। মামলাগুলোর বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, কখনো পুলিশ বাহিনীর সদস্য, কখনো সরকারি আইন কর্মকর্তা (পিপি), আবার কখনো আদালতের কর্মচারীদের গাফিলতি আটকে দিয়েছে বিচারের গতি। অনেক মামলায় আদালত টানা অনুপস্থিত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পুলিশ তাঁদের ধরে এনে হাজির করছে না। আর সরকারি কৌঁসুলিরা বছরের পর বছর দায়সারা সময় চেয়ে আবেদন করে চলেছেন। অন্যদিকে, আদালত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারির আদেশ দিলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছেন না আদালতের পেশকাররা, যাঁরা আদালতের দাপ্তরিক দিকটি সমাধা করেন। ছয় বছরের শিশু রুমী খুনের মামলা ঢাকার ২ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পাঁচ বছর আগে। রুমীর ভাই মো. শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় আজ পর্যন্ত আদালতের কোনো সমন কিংবা ওয়ারেন্ট কিছুই পাননি। তিনি নিজে সাক্ষ্য দেবেন কীভাবে? মামলাটি কোন আদালতে বিচারাধীন, তা-ও জানেন না তিনি। অথচ আদালত মামলাটির বিচার শুরুর আদেশ দেন ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, শিশু খুনের মামলায় পুলিশের কোনো গাফিলতি সহ্য করা হবে না। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিশু খুনের মামলায় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানা জারির আদেশ কেন বাস্তবায়িত হয় না, তদন্ত করা হবে। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব খুনের মামলার অধিকাংশ সাক্ষীর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছেন। অথচ আদালতের ওই সব আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বিচারের নথিতে পরোয়ানা জারির কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটা জারি করাই হয়নি। ফলে আদালতের সমন বা ওয়ারেন্ট না পেয়ে হাজির হননি সাক্ষীরা। আর সরকারি কৌঁসুলিরা সাক্ষী হাজির করার জন্য আদালতের কাছে সময়ের আবেদন করে গেছেন। আদালত সাক্ষীদের হাজির করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়ে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরও আদেশের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। তারপরও সাক্ষীর দেখা মেলেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, আদালতের সমন পেলে তা তামিল করে পুলিশ। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার কোন কোন আদালতে শিশু খুনের মামলা আছে, তা তাঁর জানা নেই। আদালতের অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপিরাও তাঁকে কিছুই জানাননি। তবে এখন থেকে তিনি খোঁজ রাখবেন। ঢাকার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১৯টি শিশু খুনের মামলা বিচারাধীন। আর ঢাকা মহানগরের অপর ছয়টি বিচারিক আদালতে বিচারাধীন আরও নয়টি শিশু খুনের মামলা। এসব আদালতেও শিশু হত্যার বিচারের একই চিত্র। গরহাজির সাক্ষীদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সঠিকভাবে জারি না করার অভিযোগ রয়েছে আদালতের কর্মাচারীদের বিরুদ্ধে। ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. সালাহউদ্দিন মিয়া স্বীকার করেন, তাঁর আদালতেও সাক্ষীদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঠিকমতো জারি করেননি পেশকাররা। তবে ওই আদালতের পেশকার নূরে আলম ও ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের পেশকার তৈয়েবুল আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা আদালতগুলোতে নতুন যোগদান করেছেন। আদালতের আদেশ পালনে গড়িমসির ঘটনা ঘটে থাকলে সেগুলো ঘটেছে তাঁরা যোগ দেওয়ার আগে। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলছেন, পুলিশ নিজেই আদালতের কাছে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে সমন জারির আবেদন করে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশসহ অন্য সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। পিপিরাও দায়সারা কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আদালতের আদেশ আদালতের কর্মচারীরা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করে থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? পুলিশ, পিপি, পেশকারসহ বিচার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
No comments