সংকটে আইনের শাসন by গাই ভারহোফস্টা
দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইউরোপীয় দেশগুলো একীভবন, সহায়তা ও যৌথ সার্বভৌমত্বের লক্ষ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাতে নিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশকের চিত্তাকর্ষক অর্জন সত্ত্বেও ইউরোপীয় প্রকল্প ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অমীমাংসিত আর্থিক সংকট, শরণার্থী সংকট, ক্রমহ্রাসমান নিরাপত্তা ও থেমে যাওয়া একীভবন প্রক্রিয়ার কারণে ইউরোপজুড়ে এক বিষাক্ত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রিয়তাবাদ ও জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠছে। সম্ভবত এর সবচেয়ে পরিষ্কার নিদর্শন হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের শাসনের অবক্ষয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্য হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ইউরোপের কষ্টার্জিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর এর মাধ্যমে তারা ইউরোপের একীভবনের মূল লক্ষ্যকেই খাটো করছে। হাঙ্গেরির উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের কাঠামোগত আক্রমণের মুখে পড়েছে। ২০১০ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর এই ভিক্টর অরবান হাঙ্গেরিকে এই কর্তৃত্বপরায়ণ জাতীয়তাবাদী পথে পরিচালিত করছেন। আর তিনি শরণার্থী সংকটকে কাজে লাগিয়ে ‘ঘেরাও মানসিকতা’ তৈরি করেছেন, যার কারণে তাঁর পক্ষে মানুষের সমর্থন লাভ করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে, শরণার্থীদের দানব বানানো হচ্ছে। আর অরবান ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে নিজের ক্ষমতায় যা কুলায় তা-ই করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলো অরবানকে যতই তরিকা বদলের পরামর্শ দিচ্ছে, তাঁর সাহস ততই লাগামছাড়া হচ্ছে, আর গণতান্ত্রিক রীতির ওপর হামলে পড়ছেন তিনি। এদিকে পোল্যান্ডেও গণতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যার শুরুটা হয় গত অক্টোবরে। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইউরো সম্পর্কে সন্দিহান দল ল অ্যান্ড জাস্টিস (পিআইএস) জনপ্রিয় অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন ও সব বিবেচনায় ‘পোল্যান্ডই প্রথম অগ্রাধিকার’—এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এরা আবার অভিবাসনবিরোধী। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের পর থেকে পিআইএস পোলিশ সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে শুরু করেছে। পোল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত সংস্কারের লক্ষ্যে দেশটির সরকার যে আইন করেছে, আদালত তার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। ইউরোপীয় গণতন্ত্রের নজরদারি প্রতিষ্ঠান ভেনিস কমিশনও তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। সরকার খুবই কার্যকরভাবে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিধি জারি করা থেকে আদালতকে বিরত রাখতে পেরেছে। এতে গণতন্ত্রের আইনের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা পোল্যান্ড ও ইউরোপের জন্য একইভাবে খুবই গুরুতর সমস্যা।
ইউরোপে ডানপন্থা জেঁকে বসেছে, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড সেই ধারার সামনের কাতারের দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থী ও আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, কিছু রাজনৈতিক দল তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সমীকরণ কে ওল্টাবে? গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের শত্রুদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক পন্থায় লড়াই করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বহির্বিশ্বের দেশগুলোর হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে এটা বোঝানোর যে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয়তাবাদ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে নিশ্চয়তা দেয় তা ভুয়া। ইউরোপের পেটের মধ্যে থাকা এ দুটি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। ফলে আরও সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ তাদের আছে, যেটা তাদের ছুড়ে ফেলা উচিত হবে না।
এই দুটি দেশই কিন্তু ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আয়রন কার্টেনের পতনের পর তারা উভয়েই ন্যাটোর কট্টর মিত্রে পরিণত হয়, তখনো তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়নি। ইউরোপের একতার ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত যুক্তি বেশ জোরালো, আর হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ছাড়া একীভূত ইউরোপের কথা চিন্তা করা যায় না।
কিন্তু আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে অবশ্যই এ কথা মনে রাখতে হবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ন্যাটোও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে সরকার এই নীতি লঙ্ঘন করে, তারা একতার নীতি ও মিত্রতার সংহতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্য সদস্যদের এটা বলা জরুরি যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার যে ব্যবস্থা আছে তা রক্ষা করতে হবে। পোল্যান্ডে যদি সাংবিধানিক সংকট থাকে এবং দেশটির সরকার আইনের শাসন ও মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথা অগ্রাহ্য করে, তাহলে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের পক্ষে আগামী জুন মাসে ওয়ারশতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করা অকল্পনীয় ব্যাপার হবে।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে এটা অবশ্যই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোকে দুর্বল করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছেন। ইউরোপকে যদি ক্রেমলিনের আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির এই সংস্থা দুটির মূল নীতি ও মূল্যবোধ মেনে চলা জরুরি।
কিন্তু ইউনিয়নের মধ্যে আইনের শাসনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই আরও পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনৈতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজস্ব কার্যসাধন পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু ইউরোপ তো আর শুধু অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়, এটা মূল্যবোধেরও ইউনিয়ন, কোনো সদস্য তা লঙ্ঘন করবে, অথচ তার ফল ভোগ করবে না, তা হতে পারে না।
সরকার গঠন হয় আবার তার পতনও হয়, রাজনীতিকেরা আসেন, আবার চলে যান। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে যেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড যদি আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করে, তাহলে তাদের কেউই তা পেত না। এর অর্থ কী দাঁড়ায়, দেশটির জনগণকে তা সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। তাদের বর্তমান নেতারা বলছেন, তঁারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপের বাকি দেশগুলো যদি তাদের কোণঠাসা করে ফেলে, তাহলে কি সেটা তাদের স্বার্থের পক্ষে যাবে?
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
গাই ভারহোফস্টাড: বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
ইউরোপে ডানপন্থা জেঁকে বসেছে, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড সেই ধারার সামনের কাতারের দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থী ও আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, কিছু রাজনৈতিক দল তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সমীকরণ কে ওল্টাবে? গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের শত্রুদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক পন্থায় লড়াই করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বহির্বিশ্বের দেশগুলোর হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে এটা বোঝানোর যে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয়তাবাদ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে নিশ্চয়তা দেয় তা ভুয়া। ইউরোপের পেটের মধ্যে থাকা এ দুটি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। ফলে আরও সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ তাদের আছে, যেটা তাদের ছুড়ে ফেলা উচিত হবে না।
এই দুটি দেশই কিন্তু ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আয়রন কার্টেনের পতনের পর তারা উভয়েই ন্যাটোর কট্টর মিত্রে পরিণত হয়, তখনো তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়নি। ইউরোপের একতার ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত যুক্তি বেশ জোরালো, আর হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ছাড়া একীভূত ইউরোপের কথা চিন্তা করা যায় না।
কিন্তু আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে অবশ্যই এ কথা মনে রাখতে হবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ন্যাটোও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে সরকার এই নীতি লঙ্ঘন করে, তারা একতার নীতি ও মিত্রতার সংহতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্য সদস্যদের এটা বলা জরুরি যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার যে ব্যবস্থা আছে তা রক্ষা করতে হবে। পোল্যান্ডে যদি সাংবিধানিক সংকট থাকে এবং দেশটির সরকার আইনের শাসন ও মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথা অগ্রাহ্য করে, তাহলে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের পক্ষে আগামী জুন মাসে ওয়ারশতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করা অকল্পনীয় ব্যাপার হবে।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মানুষকে এটা অবশ্যই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোকে দুর্বল করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছেন। ইউরোপকে যদি ক্রেমলিনের আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির এই সংস্থা দুটির মূল নীতি ও মূল্যবোধ মেনে চলা জরুরি।
কিন্তু ইউনিয়নের মধ্যে আইনের শাসনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই আরও পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনৈতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজস্ব কার্যসাধন পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু ইউরোপ তো আর শুধু অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়, এটা মূল্যবোধেরও ইউনিয়ন, কোনো সদস্য তা লঙ্ঘন করবে, অথচ তার ফল ভোগ করবে না, তা হতে পারে না।
সরকার গঠন হয় আবার তার পতনও হয়, রাজনীতিকেরা আসেন, আবার চলে যান। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে যেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড যদি আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করে, তাহলে তাদের কেউই তা পেত না। এর অর্থ কী দাঁড়ায়, দেশটির জনগণকে তা সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। তাদের বর্তমান নেতারা বলছেন, তঁারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপের বাকি দেশগুলো যদি তাদের কোণঠাসা করে ফেলে, তাহলে কি সেটা তাদের স্বার্থের পক্ষে যাবে?
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
গাই ভারহোফস্টাড: বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
No comments