এশিয়াকে নিয়ে চীন ও আমেরিকার প্রতিযোগিতা by ব্রহ্ম চেলানি
এশিয়ার
শৃঙ্খলা নতুন করে বিন্যস্ত করার চীনা উচ্চাভিলাষ গোপন কিছু নয়। ‘এক বেল্ট
এক সড়ক’ পরিকল্পনা থেকে বেইজিং-ভিত্তিক এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক
(এআইআইবি) চীনের একটি বড় ধরনের উদ্যোগ। চীনকেন্দ্রিক এশিয়া গড়ে তোলার
লক্ষ্যে চীনা কৌশল ক্রমান্বয়ে, কিন্তু ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের
প্রতিবেশীরা ভালোভাবে জানে, দেশটির আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষ
ক্ষতিকর এমনকি বিপজ্জনকও হতে পারে। তবুও অন্য রাষ্ট্রের ওপর চীনের কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে অপর আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমন্বিত
কৌশল গ্রহণের কোনো উদ্যোগ আয়োজন নেই।
বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে অন্য শক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নির্ধারণ করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে এশিয়ার দিকে নজরদারি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এশিয়াকেন্দ্রিক কৌশলের সূচনা করেছে। এ দিকে ভারত ও তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসি উন্মোচন করেছে। একইভাবে অস্ট্রেলিয়া ভারত মহাসাগরের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং জাপান পশ্চিমামুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। কিন্তু সমন্বিত কার্যক্রম; এমনকি চুক্তি কৌশলে পরিহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার এশিয়াকেন্দ্রিক একটি প্রধান উপাদান, ১২ দেশের ট্রান্স-প্যাসিফিক-পার্টনারশিপ ট্রেড চুক্তি (টিপিপি) সেখানে কেবল চীনকে এর বাইরে রাখা হয়নি; বরং ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মার্কিন মিত্রদেরও বাইরে রাখা হয়েছে।
টিপিপি নিয়ে এটাই একমাত্র সমস্যা নয়, পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদনের দীর্ঘপ্রক্রিয়া একবার সম্পূর্ণ হয়ে বাস্তবায়ন শুরু হলে ধীরে ধীরে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে। সর্বোপরি, ইতোমধ্যে ছয়টি সদস্য দেশ আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে বলে দম্ভোক্তি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, টিপিপি’র প্রধান ফলাফল হবে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি মুক্তবাণিজ্য এলাকা (এফটিএ) সৃষ্টি করা। এটা একত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ টিপিপি দেশের সমন্বিত জিডিপির জন্য দায়ী থাকবে। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সমন্বয়ে আসিয়ানের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব। লক্ষণীয়, এই দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেই। এ সংস্থাটি সম্ভবত টিপিপি’র প্রভাব আরো দুর্বল করতে চায়।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক শক্তি আরো জোরদার করার লক্ষ্যে যে ‘এক বেল্ট এক সড়ক’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এটাকে তার সাথে তুলনা করে ভারত মহাসাগরের মতো এলাকায় চীনা উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্তমান সমুদ্রসীমাকে পুনঃপরীক্ষার মাধ্যমে সংশোধন করা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই উদ্যোগের মাধ্যমে যা করার পরিকল্পনা করেছেন তার অর্ধেকও অর্জন করতে পারলে এশিয়ার ভূরাজনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত হবে।
এই প্রেক্ষাপটে এশিয়ার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত। ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য, এই অঞ্চলের বড় খেলোয়াড়দের স্বার্থে অবশ্যই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কিন্তু চীন রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক শক্তির বাঁক ঘোরাতে আগ্রহী। চীন কয়েক দশক ধরে সার্বিকভাবে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, এরই ফল হিসেবে এখন নিজের শক্তিমত্তা নিয়ে এগোতে চায়। তাই এ ধরনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আলাপ-আলোচনা সহজ কোনো কৃতিত্বপূর্ণ কাজ নয়। যেহেতু চীন তার দৃঢ়শক্তি নিয়ে অটলভাবে দাঁড়িয়েছে, সেহেতু একক কোনো শক্তি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও চীনের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিশ্রুতির সাথে সমতা রক্ষা করতে পারবে না।
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য একই মানসিকতার দেশগুলোকে নিয়মনীতিভিত্তিক আঞ্চলিক শৃঙ্খলার সমর্থনে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তা হলে সামরিক ভয়ভীতি অথবা সরাসরি বল প্রয়োগের চেয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ আন্তর্জাতিক আইনবিধি মেনে চলার জন্য চীনকে বাধ্য করা যাবে।
এ ধরনের সহযোগিতা ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী অর্থনীতি হোঁচট খাওয়া, ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসন্তোষ, অবনতিশীল পরিবেশগত সঙ্কট অথবা পঙ্কিল রাজনীতির মতো অভ্যন্তরীণ উপাদানের মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হবে। চীনের শোধনবাদী উচ্চাভিলাষ বন্ধ করতে কোন কোন দেশের নেতৃত্ব দেয়া উচিত? মনে হয়, অন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় অবশ্য উল্লেখ করা হচ্ছে না। বিশেষভাবে এশিয়ার অন্য শক্তিগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্ফীত, তথা এগিয়ে যাওয়া ভারত এবং রাজনৈতিভাবে অধিকতর দৃঢ় জাপান। তারা চীনের উচ্চাভিলাষ বন্ধ করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শৃঙ্খলায় ভারত ও জাপানÑ উভয় দেশই হচ্ছে দীর্ঘ দিনের স্টেক হোল্ডার। উভয় দেশ তাদের নিজেদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। একটি স্থিতিশীল ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি, বর্তমান আঞ্চলিক তথা ভূখণ্ডগত ও সামুদ্রিক সীমারেখার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং নেভিগেশনের স্বাধীনতা সংরক্ষণসহ যেসব মূল্যবোধকে আমেরিকা মেনে চলে, সেগুলোর প্রতি সমর্থন দিচ্ছে ভারত ও জাপান। এ ছাড়াও বর্তমান এশিয়ান শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য তারা তাদের ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা শেয়ার করে থাকে।
২০১৪ সালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভারতীয় সমকক্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদি যখন টোকিও সফর করেন, তখন মোদি চীনের সম্প্রসারণবাদের অবগুণ্ঠনের ওপর জোরে আঘাত করেন এবং ‘অষ্টাদশ শতকের সম্প্রসারণবাদী মানসিকতার’ সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চার দিকে সর্বত্র’ এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অন্য দেশের ভূমি, তাদের জলসীমায় অনুপ্রবেশ এবং এমনকি ভূখণ্ড দখলের মতো ঘটনা ঘটছে।
গত মাসে আবে এবং মোদি সহযোগিতার লক্ষ্যে ছোট একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা উভয়ে যৌথভাবে সব দেশের প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে ‘একতরফা কর্মকাণ্ড এড়িয়ে’ যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তারা সেখানে চীনের কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টির সুস্পষ্টভাবে সমালোচনা করেন। এতে তারা ওটাকে ভূখণ্ডগত বিরোধে সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এভাবে চীন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সি লেইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।
সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, জাপান ও ভারত উভয়ে চীনের উচ্চাভিলাষের ব্যাপারে সচেতন। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে, চীনের উচ্চাভিলাষ তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তারা বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা তাদের নীতি এবং বিনিয়োগের সাথে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উভয় দেশ চীনা চাপের মুখে রয়েছে। এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
এশিয়ার প্রধান শক্তি জাপান ও ভারতকে দিয়ে শুরু। এতে যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। একটি নিরাপদ, কল্যাণকর ও স্থিতিশীল ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এ তিনটি দেশকেই একত্রে কাজ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান ‘মালাবার নৌ মহড়া’ সুফলদায়ক। কারণ এতে সামরিক শক্তি, সহযোগিতা এবং জাহাজ বা নৌপথের স্থিতিশীলতা জোরদার হবে।
কিন্তু বড় ধরনের অর্থনৈতিক উপাদান ছাড়া কোনো কৌশল সম্পূর্ণ হবে না। এশিয়ার ক্ষমতাকে এফটিএ’র বাইরে অবশ্যই তৎপর হতে হবে। যৌথ ভূ-অর্থনৈতিক প্রকল্পের সূচনা করার জন্য এটা প্রয়োজন- যাতে ক্ষুদ্র দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। তাহলে ওইসব ছোট ছোট দেশ তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চীনা বিনিয়োগ ও উদ্যোগের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না। ফলে অনেক দেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল নিয়মবিধি-ভিত্তিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এ ধরনের একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে চীনসহ সব দেশই সাফল্য লাভ করতে পারবে।
লেখক : নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রফেসর এবং বার্লিনের রবার্ট বুশ একাডেমির একজন ফেলো। তিনি এশিয়ান জাগারনট, ওয়াটার : এশিয়ার নিউ ব্যাটলগ্রাউন্ড এবং ওয়াটার, পিস অ্যান্ড ওয়ার : কনফ্রন্টিং দ্য ওয়াটার ক্রাইসিসসহ ৯টি বইয়ের রচয়িতা
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে অন্য শক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নির্ধারণ করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে এশিয়ার দিকে নজরদারি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এশিয়াকেন্দ্রিক কৌশলের সূচনা করেছে। এ দিকে ভারত ও তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসি উন্মোচন করেছে। একইভাবে অস্ট্রেলিয়া ভারত মহাসাগরের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং জাপান পশ্চিমামুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। কিন্তু সমন্বিত কার্যক্রম; এমনকি চুক্তি কৌশলে পরিহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার এশিয়াকেন্দ্রিক একটি প্রধান উপাদান, ১২ দেশের ট্রান্স-প্যাসিফিক-পার্টনারশিপ ট্রেড চুক্তি (টিপিপি) সেখানে কেবল চীনকে এর বাইরে রাখা হয়নি; বরং ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মার্কিন মিত্রদেরও বাইরে রাখা হয়েছে।
টিপিপি নিয়ে এটাই একমাত্র সমস্যা নয়, পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদনের দীর্ঘপ্রক্রিয়া একবার সম্পূর্ণ হয়ে বাস্তবায়ন শুরু হলে ধীরে ধীরে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে। সর্বোপরি, ইতোমধ্যে ছয়টি সদস্য দেশ আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে বলে দম্ভোক্তি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, টিপিপি’র প্রধান ফলাফল হবে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি মুক্তবাণিজ্য এলাকা (এফটিএ) সৃষ্টি করা। এটা একত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ টিপিপি দেশের সমন্বিত জিডিপির জন্য দায়ী থাকবে। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সমন্বয়ে আসিয়ানের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব। লক্ষণীয়, এই দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেই। এ সংস্থাটি সম্ভবত টিপিপি’র প্রভাব আরো দুর্বল করতে চায়।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক শক্তি আরো জোরদার করার লক্ষ্যে যে ‘এক বেল্ট এক সড়ক’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এটাকে তার সাথে তুলনা করে ভারত মহাসাগরের মতো এলাকায় চীনা উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্তমান সমুদ্রসীমাকে পুনঃপরীক্ষার মাধ্যমে সংশোধন করা। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই উদ্যোগের মাধ্যমে যা করার পরিকল্পনা করেছেন তার অর্ধেকও অর্জন করতে পারলে এশিয়ার ভূরাজনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত হবে।
এই প্রেক্ষাপটে এশিয়ার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত। ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য, এই অঞ্চলের বড় খেলোয়াড়দের স্বার্থে অবশ্যই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কিন্তু চীন রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক শক্তির বাঁক ঘোরাতে আগ্রহী। চীন কয়েক দশক ধরে সার্বিকভাবে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, এরই ফল হিসেবে এখন নিজের শক্তিমত্তা নিয়ে এগোতে চায়। তাই এ ধরনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আলাপ-আলোচনা সহজ কোনো কৃতিত্বপূর্ণ কাজ নয়। যেহেতু চীন তার দৃঢ়শক্তি নিয়ে অটলভাবে দাঁড়িয়েছে, সেহেতু একক কোনো শক্তি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও চীনের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিশ্রুতির সাথে সমতা রক্ষা করতে পারবে না।
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য একই মানসিকতার দেশগুলোকে নিয়মনীতিভিত্তিক আঞ্চলিক শৃঙ্খলার সমর্থনে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তা হলে সামরিক ভয়ভীতি অথবা সরাসরি বল প্রয়োগের চেয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ আন্তর্জাতিক আইনবিধি মেনে চলার জন্য চীনকে বাধ্য করা যাবে।
এ ধরনের সহযোগিতা ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী অর্থনীতি হোঁচট খাওয়া, ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসন্তোষ, অবনতিশীল পরিবেশগত সঙ্কট অথবা পঙ্কিল রাজনীতির মতো অভ্যন্তরীণ উপাদানের মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হবে। চীনের শোধনবাদী উচ্চাভিলাষ বন্ধ করতে কোন কোন দেশের নেতৃত্ব দেয়া উচিত? মনে হয়, অন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় অবশ্য উল্লেখ করা হচ্ছে না। বিশেষভাবে এশিয়ার অন্য শক্তিগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্ফীত, তথা এগিয়ে যাওয়া ভারত এবং রাজনৈতিভাবে অধিকতর দৃঢ় জাপান। তারা চীনের উচ্চাভিলাষ বন্ধ করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শৃঙ্খলায় ভারত ও জাপানÑ উভয় দেশই হচ্ছে দীর্ঘ দিনের স্টেক হোল্ডার। উভয় দেশ তাদের নিজেদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। একটি স্থিতিশীল ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি, বর্তমান আঞ্চলিক তথা ভূখণ্ডগত ও সামুদ্রিক সীমারেখার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং নেভিগেশনের স্বাধীনতা সংরক্ষণসহ যেসব মূল্যবোধকে আমেরিকা মেনে চলে, সেগুলোর প্রতি সমর্থন দিচ্ছে ভারত ও জাপান। এ ছাড়াও বর্তমান এশিয়ান শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য তারা তাদের ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা শেয়ার করে থাকে।
২০১৪ সালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভারতীয় সমকক্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদি যখন টোকিও সফর করেন, তখন মোদি চীনের সম্প্রসারণবাদের অবগুণ্ঠনের ওপর জোরে আঘাত করেন এবং ‘অষ্টাদশ শতকের সম্প্রসারণবাদী মানসিকতার’ সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চার দিকে সর্বত্র’ এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অন্য দেশের ভূমি, তাদের জলসীমায় অনুপ্রবেশ এবং এমনকি ভূখণ্ড দখলের মতো ঘটনা ঘটছে।
গত মাসে আবে এবং মোদি সহযোগিতার লক্ষ্যে ছোট একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা উভয়ে যৌথভাবে সব দেশের প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে ‘একতরফা কর্মকাণ্ড এড়িয়ে’ যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তারা সেখানে চীনের কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টির সুস্পষ্টভাবে সমালোচনা করেন। এতে তারা ওটাকে ভূখণ্ডগত বিরোধে সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এভাবে চীন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সি লেইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।
সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, জাপান ও ভারত উভয়ে চীনের উচ্চাভিলাষের ব্যাপারে সচেতন। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে, চীনের উচ্চাভিলাষ তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তারা বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা তাদের নীতি এবং বিনিয়োগের সাথে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উভয় দেশ চীনা চাপের মুখে রয়েছে। এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
এশিয়ার প্রধান শক্তি জাপান ও ভারতকে দিয়ে শুরু। এতে যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। একটি নিরাপদ, কল্যাণকর ও স্থিতিশীল ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এ তিনটি দেশকেই একত্রে কাজ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান ‘মালাবার নৌ মহড়া’ সুফলদায়ক। কারণ এতে সামরিক শক্তি, সহযোগিতা এবং জাহাজ বা নৌপথের স্থিতিশীলতা জোরদার হবে।
কিন্তু বড় ধরনের অর্থনৈতিক উপাদান ছাড়া কোনো কৌশল সম্পূর্ণ হবে না। এশিয়ার ক্ষমতাকে এফটিএ’র বাইরে অবশ্যই তৎপর হতে হবে। যৌথ ভূ-অর্থনৈতিক প্রকল্পের সূচনা করার জন্য এটা প্রয়োজন- যাতে ক্ষুদ্র দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। তাহলে ওইসব ছোট ছোট দেশ তাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চীনা বিনিয়োগ ও উদ্যোগের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না। ফলে অনেক দেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল নিয়মবিধি-ভিত্তিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এ ধরনের একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে চীনসহ সব দেশই সাফল্য লাভ করতে পারবে।
লেখক : নয়াদিল্লি-ভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রফেসর এবং বার্লিনের রবার্ট বুশ একাডেমির একজন ফেলো। তিনি এশিয়ান জাগারনট, ওয়াটার : এশিয়ার নিউ ব্যাটলগ্রাউন্ড এবং ওয়াটার, পিস অ্যান্ড ওয়ার : কনফ্রন্টিং দ্য ওয়াটার ক্রাইসিসসহ ৯টি বইয়ের রচয়িতা
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
No comments