আপনি তুমি তুই by উম্মে মুসলিমা
অকালপ্রয়াত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ একটি টিভি রিয়েলিটি শো ‘এবং ঋতুপর্ণ’তে অতিথি তারকাদের প্রায় সবাইকে তুই সম্বোধন করতেন। তা তাঁরা ঋতুর চেয়ে বয়সে ছোট বা বড় যে-ই হোন না কেন। পশ্চিমবঙ্গের কোনো শোর উপস্থাপকই আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সচরাচর আপনি সম্বোধন করেন না। তুই না হলেও তুমি তো বটেই। একবার ঋতুপর্ণকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবাইকে তুই বলার কারণ। তিনি বলেছিলেন, তুই বললে একে অন্যকে কাছের আর বেশি আপন মনে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অন্তরঙ্গ হওয়া সহজ হয়। আমাদের দেশের উপস্থাপকেরা তুই দূরে থাক, তুমিও বলেন কম। বেশির ভাগই আপনি। তবে রেডিওর জকিরা নিজেদের মধ্যে তুমিটুমি চালান।
এখনকার গান, বিশেষ করে সিনেমার গানগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপে তুমি সম্বোধিত হলেও গানে কিন্তু তুই।
‘তুই চিরদিন তোর দরজা খুলে থাকিস,
অবাধ আনাগোনার হিসেব কেন রাখিস?’
‘ভাল্লাগে হাঁটতে তোর হাতটি ধরে’
এ ধরনের তুই-তোকারি গান বছর তিন-চার আগেও গানের জগতে আসন গেড়ে বসেনি। হারানো সুর চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ গেয়ে বাঙালি প্রেমিক-হৃদয়ে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে শঙ্খবেলা চলচ্চিত্রে উত্তম আর মাধবী ‘কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,...তুমি না আমি’ গেয়েছিলেন। চার দশক আগে আমাদের চলচ্চিত্রের একটা গান ছিল এ রকম, ‘তুমি বলে ডাকলে বড় মধুর লাগে, আজ থেকে আর আপনি বলে ডেকো না আমাকে’। কী সুন্দর এসব গানের আবেদন!
আর এখন ‘আমার স্বপ্নজুড়ে তুই’, ‘আমার দিলের উইলে লিখে দেব তোর নাম রে’, ‘এসেছি তোকে নিয়ে ফিরব বলে, মনেরই পথ চিনে আয় না চলে’—এ ধরনের গান খুব হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি শ্রীজাতের লেখা প্রেমের গানগুলোতেও তুই-তোকারি আছে। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে শ্রীজাত বলেন, ‘আমি বা আমরা যখন থেকে প্রেম করছি, তখন থেকেই তুই-তোকারিতে অভ্যস্ত। এমনকি বিয়ের পরেও গত আট-দশ বছরে আমার স্ত্রী আর আমি তুই-তোকারি করি। শুধু আমি নই, আরও অনেকেই করেন। তো এটাই বাস্তব। ফলে যখন আমাকে গান লিখতে হয়, তখন এই “তুই”টাই আসে। এখন কাহিনির প্রয়োজনে যদি “তুমি” লিখতে হয়, তখন পরিচালক আমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখেন।’ এখন ওদের দেখাদেখি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রেও ‘তুই’ সম্বোধনে গান আসছে বানের জলের মতো।
ভেবে দেখুন, হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘তুই রাজাকার’ না হয়ে ‘আপনি রাজাকার’ হলে কেমন হতো?
আমরা যখন সত্তর-আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন বিপরীত লিঙ্গের ক্লাসমেট বা ইয়ারমেটদের ঘনিষ্ঠ হলে তুমি, না হলে আপনি সম্বোধন করতাম। এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা এসব শুনে আকাশ থেকে পড়ে। ‘তুই’ ছাড়া কেউ বন্ধু হতে পারে? অথচ ‘তুমি’ শব্দটিতে যে একটা আলাদা মাধুর্য জড়ানো, তা ওরা কীভাবে বুঝবে? বাসরঘরে নতুন বউয়ের মুখ থেকে ‘তুমি’ শোনার জন্য বরের কত মিষ্টি ছলচাতুরী! ইংরেজি বা অন্য ভাষায় যাদের ‘আপনি’ নেই বা কেবলই ‘তুমি’ আছে, তাদের কী দুর্ভাগ্য! তাদের জীবনে, সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে এমন মধুর একটি বিষয় কোনোভাবেই আর আসতে পারে না।
অনেকে বলবেন, ‘তুমি’ নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী হলো? প্রথম ‘তুমি’ বলে ফেলার পর আর কত দিনই-বা এর মাধুর্য টিকে থাকে? কিন্তু শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘এ জীবনের কোনো কিছুই সত্যি নয়, সত্যি শুধু চঞ্চল মুহূর্তগুলো, আর এর চলে যাওয়ার ছন্দটুকু।’ কোনো অপ্রত্যাশিত উপহার, প্রথম ছোঁয়া, প্রথম চুম্বনই কি আর সারা জীবন থাকে? কিন্তু চঞ্চল মুহূর্তগুলো যে আমাদের জীবনের পরম পাওয়া!
‘তুই’ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। গ্রামেগঞ্জে স্বামীরা এখনো স্ত্রীদের ‘তুই’ সম্বোধন করেন। স্ত্রীকে ‘তুমি’ ডাকলে এসব পুরুষকে স্ত্রৈণ বলেন পাড়ার অন্য পুরুষেরা। স্বামীকেও তুমি ডাকতে পারেন অল্পসংখ্যক নারী। ‘আপনি’ ডাকেন বেশির ভাগ। মার খেতে খেতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন স্ত্রীও স্বামীকে তুই-তোকারি করতে ছাড়েন না। বাসার বয়স্ক গৃহপরিচারিকাকে গৃহকর্তার পাঁচ-দশ বছরের পুত্র বা কন্যারা তুই-তুমি ডাকে, গৃহপরিচারিকা তাদের আপনি-আজ্ঞে করেন।
তবে যখন কোনো সংবাদ-কলাম-প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে রাজাকার, অপরাধী, সন্ত্রাসী, ধর্ষক, নির্যাতক, হন্তারককে আপনি-আজ্ঞে করতে দেখি, অর্থাৎ তিনি এই করেছিলেন, সেই বলেছিলেন—এ রকম লেখা থাকে, তখন ভারী বিরক্ত লাগে। ভেবে দেখুন, হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘তুই রাজাকার’ না হয়ে ‘আপনি রাজাকার’ হলে কেমন হতো? তবে ইংরেজির ‘ইউ’ (you)-এর মতো সর্বজনীন সম্বোধন এক হিসেবে ভালো। যদিও এতে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ ডাকার রোমান্টিক মুহূর্ত বাঙালির জীবন ও সাহিত্য থেকে বিদায় নিত, কিন্তু আমাদের টক শো বা সাক্ষাৎকারে উচ্চশিক্ষিত লোকজনের ‘উনি বলেছিল, উনি করেছিল, উনি এসেছিল’—এ-জাতীয় গুরুচণ্ডালী ভাষার ব্যবহার এড়ানো যেত। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে তুই বলনেওয়ালারা একান্ত ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে ‘তুমি’ বলে যদি অধরা সুখের সন্ধান পান, তাহলে আমাদের ভাষায় তুই তুমি দুই-ই থাক না। ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেক ভেবেচিন্তেই ‘আপনি’ বর্জন করেছিলেন। সবাইকে আপন করে পেতে হলে ‘আপনি’ আপনিই কেটে পড়বে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
এখনকার গান, বিশেষ করে সিনেমার গানগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপে তুমি সম্বোধিত হলেও গানে কিন্তু তুই।
‘তুই চিরদিন তোর দরজা খুলে থাকিস,
অবাধ আনাগোনার হিসেব কেন রাখিস?’
‘ভাল্লাগে হাঁটতে তোর হাতটি ধরে’
এ ধরনের তুই-তোকারি গান বছর তিন-চার আগেও গানের জগতে আসন গেড়ে বসেনি। হারানো সুর চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ গেয়ে বাঙালি প্রেমিক-হৃদয়ে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে শঙ্খবেলা চলচ্চিত্রে উত্তম আর মাধবী ‘কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,...তুমি না আমি’ গেয়েছিলেন। চার দশক আগে আমাদের চলচ্চিত্রের একটা গান ছিল এ রকম, ‘তুমি বলে ডাকলে বড় মধুর লাগে, আজ থেকে আর আপনি বলে ডেকো না আমাকে’। কী সুন্দর এসব গানের আবেদন!
আর এখন ‘আমার স্বপ্নজুড়ে তুই’, ‘আমার দিলের উইলে লিখে দেব তোর নাম রে’, ‘এসেছি তোকে নিয়ে ফিরব বলে, মনেরই পথ চিনে আয় না চলে’—এ ধরনের গান খুব হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি শ্রীজাতের লেখা প্রেমের গানগুলোতেও তুই-তোকারি আছে। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে শ্রীজাত বলেন, ‘আমি বা আমরা যখন থেকে প্রেম করছি, তখন থেকেই তুই-তোকারিতে অভ্যস্ত। এমনকি বিয়ের পরেও গত আট-দশ বছরে আমার স্ত্রী আর আমি তুই-তোকারি করি। শুধু আমি নই, আরও অনেকেই করেন। তো এটাই বাস্তব। ফলে যখন আমাকে গান লিখতে হয়, তখন এই “তুই”টাই আসে। এখন কাহিনির প্রয়োজনে যদি “তুমি” লিখতে হয়, তখন পরিচালক আমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখেন।’ এখন ওদের দেখাদেখি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রেও ‘তুই’ সম্বোধনে গান আসছে বানের জলের মতো।
ভেবে দেখুন, হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘তুই রাজাকার’ না হয়ে ‘আপনি রাজাকার’ হলে কেমন হতো?
আমরা যখন সত্তর-আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন বিপরীত লিঙ্গের ক্লাসমেট বা ইয়ারমেটদের ঘনিষ্ঠ হলে তুমি, না হলে আপনি সম্বোধন করতাম। এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা এসব শুনে আকাশ থেকে পড়ে। ‘তুই’ ছাড়া কেউ বন্ধু হতে পারে? অথচ ‘তুমি’ শব্দটিতে যে একটা আলাদা মাধুর্য জড়ানো, তা ওরা কীভাবে বুঝবে? বাসরঘরে নতুন বউয়ের মুখ থেকে ‘তুমি’ শোনার জন্য বরের কত মিষ্টি ছলচাতুরী! ইংরেজি বা অন্য ভাষায় যাদের ‘আপনি’ নেই বা কেবলই ‘তুমি’ আছে, তাদের কী দুর্ভাগ্য! তাদের জীবনে, সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে এমন মধুর একটি বিষয় কোনোভাবেই আর আসতে পারে না।
অনেকে বলবেন, ‘তুমি’ নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী হলো? প্রথম ‘তুমি’ বলে ফেলার পর আর কত দিনই-বা এর মাধুর্য টিকে থাকে? কিন্তু শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘এ জীবনের কোনো কিছুই সত্যি নয়, সত্যি শুধু চঞ্চল মুহূর্তগুলো, আর এর চলে যাওয়ার ছন্দটুকু।’ কোনো অপ্রত্যাশিত উপহার, প্রথম ছোঁয়া, প্রথম চুম্বনই কি আর সারা জীবন থাকে? কিন্তু চঞ্চল মুহূর্তগুলো যে আমাদের জীবনের পরম পাওয়া!
‘তুই’ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। গ্রামেগঞ্জে স্বামীরা এখনো স্ত্রীদের ‘তুই’ সম্বোধন করেন। স্ত্রীকে ‘তুমি’ ডাকলে এসব পুরুষকে স্ত্রৈণ বলেন পাড়ার অন্য পুরুষেরা। স্বামীকেও তুমি ডাকতে পারেন অল্পসংখ্যক নারী। ‘আপনি’ ডাকেন বেশির ভাগ। মার খেতে খেতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন স্ত্রীও স্বামীকে তুই-তোকারি করতে ছাড়েন না। বাসার বয়স্ক গৃহপরিচারিকাকে গৃহকর্তার পাঁচ-দশ বছরের পুত্র বা কন্যারা তুই-তুমি ডাকে, গৃহপরিচারিকা তাদের আপনি-আজ্ঞে করেন।
তবে যখন কোনো সংবাদ-কলাম-প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে রাজাকার, অপরাধী, সন্ত্রাসী, ধর্ষক, নির্যাতক, হন্তারককে আপনি-আজ্ঞে করতে দেখি, অর্থাৎ তিনি এই করেছিলেন, সেই বলেছিলেন—এ রকম লেখা থাকে, তখন ভারী বিরক্ত লাগে। ভেবে দেখুন, হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘তুই রাজাকার’ না হয়ে ‘আপনি রাজাকার’ হলে কেমন হতো? তবে ইংরেজির ‘ইউ’ (you)-এর মতো সর্বজনীন সম্বোধন এক হিসেবে ভালো। যদিও এতে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ ডাকার রোমান্টিক মুহূর্ত বাঙালির জীবন ও সাহিত্য থেকে বিদায় নিত, কিন্তু আমাদের টক শো বা সাক্ষাৎকারে উচ্চশিক্ষিত লোকজনের ‘উনি বলেছিল, উনি করেছিল, উনি এসেছিল’—এ-জাতীয় গুরুচণ্ডালী ভাষার ব্যবহার এড়ানো যেত। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে তুই বলনেওয়ালারা একান্ত ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে ‘তুমি’ বলে যদি অধরা সুখের সন্ধান পান, তাহলে আমাদের ভাষায় তুই তুমি দুই-ই থাক না। ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেক ভেবেচিন্তেই ‘আপনি’ বর্জন করেছিলেন। সবাইকে আপন করে পেতে হলে ‘আপনি’ আপনিই কেটে পড়বে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
No comments