প্রধান বিচারপতি হতাশা থেকে কথাটা বলেছেন -সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক by মিজানুর রহমান খান
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক |
প্রধান
বিচারপতির সংস্কার উদ্যোগ, অবসরের পরে রায় লেখা, বিচারপতি নিয়োগ ও
অপসারণ আইন, জামায়াত নিষিদ্ধকরণসহ বিচার বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : প্রধান বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু অবসরে গিয়ে নয়, কর্মরতদের তরফে সংক্ষিপ্ত আদেশ বা রায় ঘোষণার তিন থেকে চার বছর পরে পূর্ণাঙ্গ রায় মিলছে, এ সমস্যার প্রতিকার কীভাবে?
আনিসুল হক: প্রধান বিচারপতি অবসরে রায় লেখাকে অসাংবিধানিক বলেছেন। কিন্তু এটা অসাংবিধানিক নয়। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিধিতে কোথাও লেখা নেই যে কত সময়ের মধ্যে রায় লিখতে হবে। তবে আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি একটা হতাশা থেকে কথাটা বলেছেন। কারণ, আমরা দেখছি যে তিন-চার বছরেও রায় মিলছে না। কিন্তু আচরণবিধিতে তাঁরা লেখেননি যে, রায় কত দিনে মিলবে। এখন তাঁরা যদি চান তাহলে রায় লেখার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে একটি ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ দিয়ে দিন। তাহলে জনগণ ও বিচার বিভাগ উপকৃত হবে।
প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বিষয়টিকে শুধুই দলীয়ভাবে নিল।
আনিসুল হক: প্রধান বিচারপতি এখন বলেই দিয়েছেন এ জন্য পুরোনো রায়গুলো বাতিল হবে না। আর আমি মনে করি না যে, রাজনৈতিক স্বার্থে কারও বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেওয়া কোনো দায়িত্বশীল রাজনীতির মধ্যে পড়ে।
প্রথম আলো: তার মানে আপনি অবিলম্বে রায় লেখা বিষয়ে একটি বিধি প্রণয়নের পক্ষে?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই। তার সব থেকে বড় কারণ হলো রায় বাস্তবায়নে, বিশেষ করে দেওয়ানি মামলার রায় কার্যকর করতে তার সার্টিফায়েড কপি লাগে।
প্রথম আলো: একজন বিচারক ১৯৪ মামলার রায় না লিখে সম্প্রতি অবসরে গেছেন।
আনিসুল হক: আমি যখন আইনজীবী ছিলাম তখনো আমি এই বিষয়টির দিকে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রথম আলো: ১৯৪টির মধ্যে এখনো ১৬৩টির রায় লেখা হয়নি বলে আমরা জানি। এখন এর কী হবে?
আনিসুল হক: সেটা তো আমি বলে দিতে পারব না। এ বিষয়ে যখন কোনো আইন নেই, তাই এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও তা ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা যাবে না। আমি শুধু এটুকুই বলব, যাঁর কাছে ১৬৩টি রায় লেখার কাজ পড়ে আছে, তিনি যেন অমানুষিক খাটুনি দিয়ে হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করে দেন।
প্রথম আলো: বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে টিভি চ্যানেলে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
আনিসুল হক: আমি একে কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। এটা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। আমার মনে হয়, এখানে টিভি চ্যানেলগুলোর সংযত হওয়ার ব্যাপার আছে। তাদেরও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় এসেছে। তারা সম্ভবত এ বিষয়ে ঠিক ভূমিকা রাখছে না।
প্রথম আলো: অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের আচরণবিধি দরকার কি না?
আনিসুল হক: কেউ কেউ কর্মরত থাকাকালেও আচরণবিধির ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর কী বলব বলুন। সে জন্যই আইন করতে হয়, সে বিষয়ে বলে আর লাভ নেই। কথা হলো দায়িত্বজ্ঞান তো মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই মনে হয় আমাদের অনেক দায়িত্বশীল হওয়ার দরকার।
প্রথম আলো: আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির কিছু বক্তব্য বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
আনিসুল হক: এটা আমার মন্তব্য নয় বলে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তবে আমি সবাইকে বলব, আমরা সবাই দায়িত্বশীল পদের অধিকারী। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সেই দায়িত্বশীল পদের যে দায়িত্ব, সেটার প্রতিফলন ঘটা উচিত।
প্রথম আলো: আপনি কি সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশেই বললেন?
আনিসুল হক: হ্যাঁ। আমি সবাইকেই বলছি।
প্রথম আলো: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। জামায়াত নিষিদ্ধ আইন কবে আসছে?
আনিসুল হক: শিগগিরই। মন্ত্রিসভায়খসড়া পাস হলে আমরা এর বিস্তারিত প্রকাশ করব। এটা হবে ’৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী।
প্রথম আলো: শিগগিরই মানে কবে? ন্যুরেমবার্গে বা বিশ্বের অন্যত্র কোথাও সংগঠনের বিচার হয়েছে?
আনিসুল হক: ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। বিশ্বের অন্যত্র হয়নি। এখানেও দরকার ছিল না, কারণ বাহাত্তরের সংবিধানে তো জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল আগেই। খুনি মোশতাক ও জিয়াউর রহমান এসে এটা বদলান।
প্রথম আলো: একাত্তরের ডিসেম্বরে জামায়াত নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ হয়, সংবিধানে হয়েছিল কেবল ধর্মীয় সংগঠন হিসেবেই।
আনিসুল হক: যখন সংবিধান প্রণীত হয়, তখন তাতে আগের আইনকে সুরক্ষাদেওয়া হয়। পরে যখন এই সংবিধান নিয়ে ফুটবল খেলা হলো, তখন জামায়াতকে আবার ঢোকানো হলো, তারা রাজনৈতিক দল হলো। এরপর ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণ দিলেন যে জামায়াতকে কাঠগড়ায় তোলা যায়।২০১৩ সালেআমরা সংবিধানে ‘সংগঠন’ শব্দটি ঢোকালাম, কিন্তু সেটাই তার বিচারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই বিচার-প্রক্রিয়ার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করতেই সংশোধনী আনা হচ্ছে।
প্রথম আলো: এ বিষয়ে এটাই হবে বিশ্বের প্রথম নজির?
আনিসুল হক: ইনশা আল্লাহ।
প্রথম আলো: বিচার বিভাগের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার খুব সফল কি? যেমন জেলায় জেলায় বিচার ভবন নির্মাণের একটি মেগা প্রকল্প সরকার নিয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।
আনিসুল হক: জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রিট পিটিশন করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হচ্ছে। যেমন ফরিদপুরে ‘বেলা’ রিট করেছিল, তাদের বলেছি দিঘি ভরাটের যে ধারণায় তারা এটা করেছে, তা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: এনবিআর, ভ্যাট, ট্যাক্স বা উন্নয়ন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট অনেক রিট, যা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে, তা নিষ্পত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যায় না?
আনিসুল হক: এসব বিষয়ে একটা বিহিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলোর যাতে দ্রুত শুনানি হয়, তার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এসব বিষয়ে আপিল শুনতে পাঁচটি বেঞ্চ দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, গাছ লাগালেই ফল পাব না। সুফল পেতে ছয় মাস লাগবেই। আমরা মামলাজট (প্রায় ৩০ লাখ) নিরসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু ২০-৩০ বছরের জট তো ছয় মাসে শেষ করতে পারব না।
প্রথম আলো: বর্তমানে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে শতাধিক বিচারকের পদ শূন্য। আপিল বিভাগে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১১টি পদের মধ্যে এখন ৫টি শূন্য।
আনিসুল হক: আপিল বিভাগে পদ শূন্য, এ কথা কিন্তু সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানির জন্য ১১টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কারণ, তখনকার আপিল বিভাগে ওই মামলা শোনার মতো পাঁচ বিচারক ছিলেন না।
প্রথম আলো: এখন না দরকার পড়লে প্রজ্ঞাপন শুধরে নিন। অনধিক ১১ নয়, প্রজ্ঞাপন বলেছে ১১ জনের সমন্বয়ে আপিল বিভাগ হবে। তা ছাড়া, প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগে তিনটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে কি কোনো নামের প্রস্তাব গেছে?
আনিসুল হক: সংশোধন দরকার নেই। নাম প্রস্তাবও যায়নি। আর ১১ জন কিন্তু থাকতেই হবে না। প্রয়োজনে ১১ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তবে নিয়োগের বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। কিছুদিন আগেও নয়জন ছিল, তিনজন অবসরে যাওয়ায় এখন ছয়জন আছে। আপিল বিভাগে খুব শিগগির নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রথম আলো: কতজন? কোনো নাম নির্বাহী বিভাগের কাছে যায়নি? আর হাইকোর্টে কোনো নতুন নিয়োগ?
আনিসুল হক: সেটা প্রধান বিচারপতি জানেন। না, যায়নি। আপনি যদি ২০ বছর পেছনে তাকান, হাইকোর্টে ৬০ জন বিচারক ছিলেন। এখন সেখানে ৯৫ থেকে ১০০ জন। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতে-কমাতে পারি। যদি এমন বিচারক থাকেন, যার কোনো কাজ নেই, তেমন বিচারক তো নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না। এতে করদাতাদের কাঁধে বোঝা বাড়বে। আমরা তো সেটা করতে চাই না। প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে চাই। আমি আপনাকে হাইকোর্ট বিভাগ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাই। সেখানে গেলে দেখবেন, যে বেঞ্চে আপিল মামলার শুনানি চলে সেখানে ভিড় নেই। ওখানে কোনো আইনজীবী থাকবেন না। মোশন কোর্টে তাঁদের ভিড় দেখবেন।
প্রথম আলো: এই অবস্থা বদলানোর কোনো প্রয়াস, সংস্কারের কোনো চিন্তা?
আনিসুল হক: আমি কী সংস্কার করব? বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। এ বিষয়ে আমি কোনো কথাই বলতে চাই না। কিন্তু এটা সঠিক যে আপিল মামলার শুনানি খুব তাড়াতাড়ি হয় না। এ জন্যই মামলাজট। হাইকোর্টে অচিরে নতুন বিচারক আসবেন, তাও বলতে পারছি না।
প্রথম আলো: বিচারপতি নিয়োগ নীতিমালার কী হলো?
আনিসুল হক: এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
প্রথম আলো: দুই বছর আগেও এ কথা বলেছিলেন। জুডিশিয়াল কমিশন ধরনের কিছু হবে? আপিল বিভাগে নিয়োগের জন্যও কি?
আনিসুল হক: দুই বছর আগে ঠিকই বলেছিলাম, কিন্তু এটা এমন একটি বিষয়, এটা আজকে বললে কালকে করা যায় না। আমরা একটা নতুন বিষয়ের সূচনা ঘটাতে যাচ্ছি, যা আগে কখনো হয়নি। জুডিশিয়াল কমিশন বলব না। একটা নাম দেব। তবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বডি হবে। না, আপাতত হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগে বডি হবে। আপিল বিভাগের জন্য নয়।
প্রথম আলো: ইমপিচমেন্ট করার আইন কবে? খসড়া কি প্রস্তুত?
আনিসুল হক: খসড়া প্রস্তুত। তবে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, কথাটি ইমপিচ নয়, ৯৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অর্থাৎ দুই কারণে বিচারক অপসারণ করা যাবে। অভিশংসন মানে বিচার করা, এতে যে শুধু অপসারণ ঘটে, তা সত্য নয়। পদই শূন্য হবে না, শাস্তিও দেওয়া যাবে। তাই অভিশংসনে ক্ষমতা ব্যাপকতর। কিন্তু আমরা এখানে শুধু ওই দুটো বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকব। চলতি অধিবেশনে এটি পাস হয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্টের কাছে কি খসড়া পাঠাবেন? তাদেরমতামত নেবেন?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই। আমি এটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠাব। এবং সেই সঙ্গে এই অনুরোধও তাঁর কাছে রাখব যে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গেও যাতে তিনি বিষয়টিআলোচনা করেন।
প্রথম আলো: তিন মাসের মধ্যে এটি পাসের কথা বলেছিলেন। আপনি কি মানেন যে আইনটির অভাবে বিচারপতিসহ সব সাংবিধানিক পদধারীর জবাবদিহির জায়গায় কিছুটা শূন্যতা চলছে?
আনিসুল হক: হ্যাঁ। তা কিছুটা চলছে। তবে এই শূন্যতা এবারই প্রথম নয়। বাহাত্তর-পঁচাত্তরেও এটা শূন্য ছিল। কিন্তু এটা কাম্য নয়। এটা সুচিন্তিত ও অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে করা উচিত। বিচারপতিরা অত্যন্ত সম্মানিত ও বিজ্ঞ, তাঁদেরবিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: তাঁদের বিষয়ে তদন্তের জন্য শুধু কর্মরত বিচারকেরাই, নাকি ভারতের মতো বাইরে থেকেও অন্তর্ভুক্ত হবেন?
আনিসুল হক: মন্ত্রী হিসেবে আমি একটি নীতি নিয়েছি, সেটি হলো প্রস্তাবিত আইনের কোনো খসড়া মন্ত্রিসভায় পাস না হওয়া পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেব না।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের সপক্ষে মত দিয়েছেন।
আনিসুল হক: দেখুন, রোম সাম্রাজ্য এক দিনে গড়ে ওঠেনি। আপনারাই বলেন, ২০০৭-এ আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হয়েছে। কিন্তু তখন যেসব বিচারকার্য হয়েছিল, তা খুব স্বাধীনভাবে হয়নি।
প্রথম আলো: আমরা বলি, কিন্তু ঢালাওভাবে বলি না—
আনিসুল হক: এই স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ ও আরও সুদৃঢ় করতে আমি চেষ্টা করছি। ১৯৯৬ থেকে সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এবারের থোক বরাদ্দ ১১২ কোটি টাকা। আমরা একটি মাইন্ড সেট থেকে আরেকটি মাইন্ড সেটে যাচ্ছি। পঁচাত্তরের পরের হাইকোর্টে ইনডেমনিটি বিল বাতিলের জন্য তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে হয়েছিল। হাইকোর্টের যে স্বাধীনতা আজকে আছে, সেটা তখন কোথায় ছিল? পিআইএল (জনস্বার্থে মামলা) কেন তখন হয়নি? সংবিধান-সংক্রান্ত একটি মামলা জিয়ার আমলে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ সাহেব আমার বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হককে দিয়ে করিয়েছিলেন, দুদিন শোনার পরে তা খারিজ হয়েছিল। এভাবে তখনকার হাইকোর্ট যখনই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মামলা পেয়েছেন, বাতিল করেছেন। আমি নিজেই তার সাক্ষী। সেই হাইকোর্টের সঙ্গে কিন্তু আজকের হাইকোর্টের কোনো মিল নেই। আজকের হাইকোর্টও আপিল বিভাগ নির্বাহী বিভাগের শ্রদ্ধার পাত্র। হাইকোর্টের রায়ে আমাদের অনেক আইনে পরিবর্তন এসেছে।
প্রথম আলো: এই হাইকোর্ট যখন নিম্ন আদালতের বিচারক বদলির সিদ্ধান্ত দেন, তখন কখনো সরকারকে খড়্গহস্ত হতে দেখি—
আনিসুল হক: আপনাকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ তার যথাযথ ভাষায় পড়তে অনুরোধ করব। আমি তো কোনোশব্দ উদ্ভাবন করতে পারব না। আপনিও পারবেন না। ওখানে লেখা পরামর্শক্রমে। রাষ্ট্রপতি কোন কাজটি পরামর্শক্রমেকরেননি?
প্রথম আলো: বিচারকের কর্মস্থল নির্ধারণে সুপ্রিম কোর্টের স্বপ্রণোদিত পরামর্শ কি সংবিধানের চেতনাবিরুদ্ধ?
আনিসুল হক: না, প্রশ্ন হলো পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা। পরামর্শক্রমে পরামর্শ গ্রহণ করা হয় কি না? শুনুন, আমার মনে হয় না কেউ আমার সঙ্গে দ্বিমত করবেন যে, ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মানা হয়। এখন কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তো তাঁর ডিসক্রিশন প্রয়োগ করতেই পারেন। আইন তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছে। এখানে অন্যায় কোথায়?
প্রথম আলো: আপনি বদলির নীতিমালার কথা বলেছিলেন। সেটার কী হলো? কোথাও বছরের পর বছর কেউ টিকে আছেন, আবার ছয় মাস না যেতেই তাঁকে বদলির প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন।
আনিসুল হক: আমি যে অধস্তন আদালত উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, সেখানে বিচারক ও লোকবলের সংকট ছিল। আমি এটা মেটাতে পদোন্নতির শর্ত দুই বছর থেকে ছয় মাস বা এক বছরে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি আমলে বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল। কী করে আমি ছয় মাসে তা পূরণ করব? তাড়াহুড়ো করলে আপনি বিচারক পাবেন, বিচার পাবেন না। যেখানে পরিবর্তন দরকার ছিল, সেখানে পরিবর্তন আনতে পিছপা হইনি। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সিলেবাস পরিবর্তন করতেবলেছেন, করে দিয়েছি। তিনি যেভাবে বলছেন সেভাবে করারই চেষ্টা করছি। সুতরাং প্রক্রিয়া চলমান আছে। এর সুফল পেতে আপনাকে ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে।
প্রথম আলো: ২০০৭ সালে দেড় হাজার বিচারক দিয়ে শুরু হয় পৃথক্করণ। অথচ গত আট বছরে আপনারা কোনো নতুন পদ সৃষ্টি করেননি, শুধু শূন্যতা পূরণ করেছেন মাত্র।
আনিসুল হক: ৩৪৯ বিচারকের নতুন পদসৃষ্টিতে আমি সম্প্রতি জনপ্রশাসনকে লিখেছি। সেই সঙ্গে ৩৪৯ জনের সহায়ক জনবল হিসেবে মোট ১ হাজার ১৮ জন নিয়োগ পাবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
প্রথম আলো: জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ থেকে যুগ্ম জেলা জজ হয়েছেন। এরপর দ্বিতীয়বার পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত জেলা জজ হয়েছেন। অথচ তাঁরা বেতন পান দুই ধাপ নিচেরজ্যেষ্ঠ সহকারী জজ হিসেবে। পদোন্নতি আছে, দায়িত্ব পালন আছে, কিন্তু প্রাপ্য মজুরি নেই। আমাদের হিসাবে এর ফলে তিন শর বেশি বিচারক অন্তত ১৫ কোটি টাকা বঞ্চিত। বিচারকদের প্রতি এ কেমন বিচার?
আনিসুল হক: আমি বিষয়টি নিশ্চয়ই দেখব।
প্রথম আলো: বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার পে-কমিশন পর্যালোচনায় আট মন্ত্রী নিয়ে কমিটি হয়েছে। কিন্তু কবে রিপোর্ট দেবেন, তার তারিখ না দিয়ে ১২ জানুয়ারি গেজেট করেছেন।
আনিসুল হক: আমরা চার মন্ত্রী সব কটি কমিটিতে আছি। সকলের নতুন পে-স্কেল হয়ে গেছে। বিজ্ঞ বিচারকেরা কেন বঞ্চিত হবেন। বিষয়টি নিরসন করা দরকার। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, এ সমস্যার ত্বরিত সমাধান দরকার। এই ইস্যু শেষ করতেই মন্ত্রিসভা কমিটি হয়েছে। এক মাস বা তার কম সময়ে স্কেল দেব। তাঁরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে বিশেষ নজর দেব।
প্রথম আলো: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৬ থেকে চার-পাঁচ বছরের বকেয়াসহ জজদের বেতন-ভাতা দিতে বললে সব রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়েছে। আর ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সবাই যখন বেতন পেল, তখন জজদের ঠকানো হলো। এমনকি তাঁদের প্রাপ্য তুলে নেওয়ার পর অলিখিত আদেশে তা ফেরত দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কেমন আর্থিক শৃঙ্খলা?
আনিসুল হক: যখন বেতন কমিটির সভা হবে, তখন আমি এ বিষয়টি সেখানে তুলব। আমি এর সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিয়ে এর একটা সুরাহা করা যায় কি না, সে ব্যবস্থা আমি নেব।
প্রথম আলো: আমরা এর একটা হিসাব করেছি। তাতে বিচারকদের বঞ্চিত করা অর্থের পরিমাণ দেখলাম ৭৫ কোটি ৭৫ লাখ ১৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এক বিচারক তো এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এর প্রতিকার চেয়ে আপিল বিভাগে দরখাস্ত পেন্ডিং। এটা কিন্তু রিটেও চ্যালেঞ্জযোগ্য।
আনিসুল হক: ঠিক আছে। আমি এর যথাবিহিত ব্যবস্থা নেব।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যদি অবকাঠামোগত সুবিধা সরকার নিশ্চিত করে, তাহলে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ হতে পারে।
আনিসুল হক: তিনি নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। তবে এখন এর সাধন পদ্ধতি তাঁর ব্যাপার, তিনি যখন যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই হবে। আগে স্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ অষ্টম সংশোধনীতে বাতিল হয়েছিল। এখন তিনি অস্থায়ী বেঞ্চ করতে আমাকে জিজ্ঞেস করলে সেভাবে আমি পরামর্শ দেব। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী কী বিবেচনায় হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ করতে চেয়েছেন—
আনিসুল হক: অনেক সময় অঞ্চলগত মামলার সংখ্যা বাড়ে-কমে। যেমন বন্দরনগর হিসেবে চট্টগ্রামের কাস্টমসের মামলা কখনো বেড়ে যায়। সেখানে তখন হাইকোর্ট বিভাগ চট্টগ্রামে বসবেন। স্থানীয় আইনজীবীরা তখন শুনানিতে অংশ নিতেপারবেন। এটা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও বটে। তাতে হয়তো কোনো একটি এলাকার মামলার ত্বরিত নিষ্পত্তি হবে। আইনজীবীদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এটা বিকেন্দ্রীকরণ। আমরা জনগণের ক্ষমতা সর্বদা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট।
প্রথম আলো: বিচার ও নির্বাহী বিভাগীয়একটা সংলাপের সূচনা আমরা সম্প্রতি দেখলাম।
আনিসুল হক: আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচার বিভাগের উৎকর্ষ সাধনে সংলাপ অব্যাহত রেখেছি। তাঁর স্বপদের এক বছর পূর্তিতে আমি গিয়ে সাক্ষাৎ করেছি। গত এক বছরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যতবার আমার বৈঠক হয়েছে, আমার মনে হয় না এমনটা আগে কোনো আইনমন্ত্রীর সঙ্গে ঘটেছে।
প্রথম আলো: এই সংলাপটাকি আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে হতে পারে? যেমন আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারক থাকলেন—
আনিসুল হক: আমার আপত্তি নেই। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় রকমের হতে পারে। সর্বোপরি আমরা সবাই দেশের জন্য কাজ করছি। কোনো একটি অঙ্গকে বাদ দিয়ে কিন্তু দেশ চলবে না। তাই সমন্বয়সাধনের জন্য আলাপ-আলোচনার দরকার, আর তার মধ্যে আমি আছি।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকার কথা বলেছেন, আবার কোনো একটা কষ্টের জায়গা থেকে হয়তো বলেছেন যে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। আপনি কীভাবেদেখছেন?
আনিসুল হক: আমি এটা অস্বীকার করব না যে আমার সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে গত ১৭ জানুয়ারি আলাপ হয়েছে। যে ঘটনার কারণে তাঁর এই মন্তব্য সেটা আমি শুনেছি। যখন তিনি এটা বলেছেন তার আগে নয়, পরে আলাপ হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনি মনে হয় বিষয়টি পাঠককে অবহিত করতে পারেন। মনে হচ্ছে তাঁর ওই মন্তব্য কোনো নীতিগত নয়, নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার কারণে—
আনিসুল হক: আপনার সঙ্গে আমি একমত। এটা একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। তিনি যখন আমাকে বলেন যে, এটাই ব্যাপারটা, তখন আমি তাঁকে বলেছি যে, আমি ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। সেটা জেনে প্রধান বিচারপতি খুশি হয়েছেন।
প্রথম আলো: তার মানে যে কারণে প্রধান বিচারপতির উষ্মা, তার অপনোদন ঘটেছে?
আনিসুল হক: দেখুন, বিচারকার্য বিচারকেরা ছাড়া অন্য কেউ করুন, এটা তো ঠিক হবে না। ব্যাপারটা হচ্ছে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি নিশ্চয় কিছু কাজ করবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা বিচার বিভাগের কাজটা করে ফেলবে, সেখানে আমার মনে হয় একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা সমন্বয়ের দরকার আছে।
প্রথম আলো: আমরা মনে করি, যেসব সরকারি কর্মকর্তা যখন মোবাইল কোর্টে বিচারকাজ করবেন, তখন সেই সময়ের জন্য তাঁর জবাবদিহি সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকতে পারে। এখন এখানে একটা শূন্যতা চলছে।
আনিসুল হক: আপনি কথাটি বেঠিকবলেননি। আমরা এ রকম কিছু ভাবছি।
প্রথম আলো: আপনার এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক—
আনিসুল হক: সেটাই ব্যাপার। প্রধানবিচারপতিওকিছুদিন আগে বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করেন না এবং সেটা তিনি রক্ষা করছেন। হ্যাঁ, যেটার ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন, সে ক্ষেত্রে আমরাও সজাগ। প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চান।
প্রথম আলো: ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে কী করে নিম্ন আদালতে ১০৭, হাইকোর্টে ১৪৯ ও আপিল বিভাগে ১৬২ শতাংশ মামলা হ্রাস পেল?
আনিসুল হক: প্রথমত তদারকি। রাকিব ও রাজন হত্যার যে দ্রুত বিচার, তা ইতিহাসে প্রথম। আর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে ৩৪ বছর লেগেছিল। সুতরাং একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। আপনারা আমাদের সমালোচনা না করে উৎসাহিত করুন। কারণ, আমরা সঠিক পথে যাচ্ছি। উৎসাহ পেলে কাজ আরও বেড়ে যাবে।
১৯৮৪-৮৬ পর্বে হাইকোর্টে মামলার শুনানি করা যেত না। আমাদের চেম্বারেই দেখেছি, আসামি সাজা খেটে ফেলেছে। কিন্তু তার আপিল শুনানি হয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সময়ে দুটো বিজ্ঞপ্তি বের করা হয়েছিল, যাতে সাজার রেয়াত দেওয়া হয়েছিল। যেমন যাবজ্জীনের সাজা ছিল ২০ বছর। বলা হয়েছিল, যাঁরা ১০ বছর খেটে ফেলেছেন তাঁকে জেলমুক্ত কর। এই করে তখনকার জট অনেকটা ঘোচানো হয়েছিল। দু-একটি ছাড়া এ রকম মামলা আজ আর নেই। আজ তিন থেকে পাঁচবছর দেরি হয়।
প্রথম আলো: এটা কি ঠিক যে কারাগারগুলোতে দোষী সাব্যস্তদের চেয়ে বিচারাধীন কয়েদিরা সংখ্যায় বেশি?
আনিসুল হক: তাঁরা অনেক বেশি। কিন্তু তার মানে কী, তাঁরা তো এখনো সাজাপ্রাপ্ত নন।
প্রথম আলো: তাঁরা বিনা বিচারে বন্দী।
আনিসুল হক: এটা বলা যাবে না। কারণ, দণ্ডবিধির ৩৫ ধারা বলেছে, যেদিন দোষী সাব্যস্ত হবে, তার আগ পর্যন্ত যতটুকু জেল খেটেছে, তা তার সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে।
প্রথম আলো: আর যাঁরা নির্দোষ হবেন, তাঁদের কারাবাসের কী হবে?
আনিসুল হক: এই সমস্যা সারা বিশ্বে চলছে। আমরা তার কী করব? তবে হ্যাঁ, এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করছি আমরা। যতগুলো জামিনযোগ্য ধারা আছে, সেখানে শিথিলভাবে দেখে জামিন দেওয়া হচ্ছে। কিছু মামলায় জামিন প্রদানে রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। হত্যা মামলার চেয়েও সন্ত্রাসী মামলায় প্রসিকিউশন কঠোর হওয়ার চেষ্টা করছে। অভ্যাসগত অপরাধ মাদক প্রভৃতি এমন কিছু ব্যাধি রয়েছে, যা সমাজকে কলুষিতই করে না, সমাজের গঠন ধ্বংস করে দেয়। এসব অপরাধের বিষয়ে আমরা নমনীয় হব না।
প্রথম আলো: মামলাজট কমাতে প্রধান বিচারপতি একটি সফল নেতৃত্ব দেখিয়েছেন?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই, আমি তা স্বীকার করব।
প্রথম আলো: তাহলে ২৭ হাজার মামলা নিষ্পত্তিতে আইন কমিশন যে তিন হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে বলেছে, তার দরকার হবে?
আনিসুল হক: আমাদের ভবিষ্যৎ দেখতে হবে না? যেমনটা বলছিলাম যে মোশন কোর্টে ভিড় থাকে, তার মানে এন্ট্রি পয়েন্ট অর্থাৎ নতুন মামলা রুজু করার পর্যায়ে ভিড় থাকে। জনসংখ্যা বাড়ছে। সুতরাং সেসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু সব ব্যাপার আদালতে নিতে আমাদের যে প্রবণতা, তা থেকে জনগণকে বিমুখ করতে হবে। আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তবে এ রকম নতুন ব্যবস্থার ওপরে যতক্ষণ না মানুষের বিশ্বাস জন্মায়, ততক্ষণ তো এর ওপরে তারা নির্ভরশীল হবে না।
প্রথম আলো: কিন্তু আইনের শাসনের সূচক, যা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট, বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাক করেছে, তার সবটাতেই বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। এটা কীভাবে দেখবেন?
আনিসুল হক: শুনুন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ওনাদের এই সূচকটা কোথায় ছিল? যখন ইনডেমনিটি ছিল, ১৮ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার বিচার হবে না। তখন সূচক বুঝি খুব হাই ছিল? আর এখন আইনের শাসন সূচক নিম্নমুখী হয়েছে! এই সূচক আমি গ্রহণ করি না। বাংলাদেশেরমানুষ দেখছে, এখানে কী হচ্ছে। আপনারা এটা তুলনা করুন, তখন কি বলার ছিল না যে, এখানে আইনের শাসন নেই। তখন কি তারা তেমন বিবৃতি দিয়েছিল? কখনোই নয়। তারা সমর্থন করেছিল। আজ যখন এসব জঞ্জাল দূর করছি, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, যখন মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে যেকোনো অপরাধ হলে তারা বিচার পাবে, তখন তাঁরা বলেন আইনের শাসন সূচক খুব উচ্চ নয়, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ
আনিসুল হক: ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : প্রধান বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু অবসরে গিয়ে নয়, কর্মরতদের তরফে সংক্ষিপ্ত আদেশ বা রায় ঘোষণার তিন থেকে চার বছর পরে পূর্ণাঙ্গ রায় মিলছে, এ সমস্যার প্রতিকার কীভাবে?
আনিসুল হক: প্রধান বিচারপতি অবসরে রায় লেখাকে অসাংবিধানিক বলেছেন। কিন্তু এটা অসাংবিধানিক নয়। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিধিতে কোথাও লেখা নেই যে কত সময়ের মধ্যে রায় লিখতে হবে। তবে আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি একটা হতাশা থেকে কথাটা বলেছেন। কারণ, আমরা দেখছি যে তিন-চার বছরেও রায় মিলছে না। কিন্তু আচরণবিধিতে তাঁরা লেখেননি যে, রায় কত দিনে মিলবে। এখন তাঁরা যদি চান তাহলে রায় লেখার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে একটি ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ দিয়ে দিন। তাহলে জনগণ ও বিচার বিভাগ উপকৃত হবে।
প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বিষয়টিকে শুধুই দলীয়ভাবে নিল।
আনিসুল হক: প্রধান বিচারপতি এখন বলেই দিয়েছেন এ জন্য পুরোনো রায়গুলো বাতিল হবে না। আর আমি মনে করি না যে, রাজনৈতিক স্বার্থে কারও বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেওয়া কোনো দায়িত্বশীল রাজনীতির মধ্যে পড়ে।
প্রথম আলো: তার মানে আপনি অবিলম্বে রায় লেখা বিষয়ে একটি বিধি প্রণয়নের পক্ষে?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই। তার সব থেকে বড় কারণ হলো রায় বাস্তবায়নে, বিশেষ করে দেওয়ানি মামলার রায় কার্যকর করতে তার সার্টিফায়েড কপি লাগে।
প্রথম আলো: একজন বিচারক ১৯৪ মামলার রায় না লিখে সম্প্রতি অবসরে গেছেন।
আনিসুল হক: আমি যখন আইনজীবী ছিলাম তখনো আমি এই বিষয়টির দিকে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রথম আলো: ১৯৪টির মধ্যে এখনো ১৬৩টির রায় লেখা হয়নি বলে আমরা জানি। এখন এর কী হবে?
আনিসুল হক: সেটা তো আমি বলে দিতে পারব না। এ বিষয়ে যখন কোনো আইন নেই, তাই এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও তা ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা যাবে না। আমি শুধু এটুকুই বলব, যাঁর কাছে ১৬৩টি রায় লেখার কাজ পড়ে আছে, তিনি যেন অমানুষিক খাটুনি দিয়ে হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করে দেন।
প্রথম আলো: বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে টিভি চ্যানেলে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
আনিসুল হক: আমি একে কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। এটা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। আমার মনে হয়, এখানে টিভি চ্যানেলগুলোর সংযত হওয়ার ব্যাপার আছে। তাদেরও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় এসেছে। তারা সম্ভবত এ বিষয়ে ঠিক ভূমিকা রাখছে না।
প্রথম আলো: অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের আচরণবিধি দরকার কি না?
আনিসুল হক: কেউ কেউ কর্মরত থাকাকালেও আচরণবিধির ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর কী বলব বলুন। সে জন্যই আইন করতে হয়, সে বিষয়ে বলে আর লাভ নেই। কথা হলো দায়িত্বজ্ঞান তো মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই মনে হয় আমাদের অনেক দায়িত্বশীল হওয়ার দরকার।
প্রথম আলো: আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির কিছু বক্তব্য বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
আনিসুল হক: এটা আমার মন্তব্য নয় বলে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তবে আমি সবাইকে বলব, আমরা সবাই দায়িত্বশীল পদের অধিকারী। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সেই দায়িত্বশীল পদের যে দায়িত্ব, সেটার প্রতিফলন ঘটা উচিত।
প্রথম আলো: আপনি কি সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশেই বললেন?
আনিসুল হক: হ্যাঁ। আমি সবাইকেই বলছি।
প্রথম আলো: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। জামায়াত নিষিদ্ধ আইন কবে আসছে?
আনিসুল হক: শিগগিরই। মন্ত্রিসভায়খসড়া পাস হলে আমরা এর বিস্তারিত প্রকাশ করব। এটা হবে ’৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী।
প্রথম আলো: শিগগিরই মানে কবে? ন্যুরেমবার্গে বা বিশ্বের অন্যত্র কোথাও সংগঠনের বিচার হয়েছে?
আনিসুল হক: ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। বিশ্বের অন্যত্র হয়নি। এখানেও দরকার ছিল না, কারণ বাহাত্তরের সংবিধানে তো জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল আগেই। খুনি মোশতাক ও জিয়াউর রহমান এসে এটা বদলান।
প্রথম আলো: একাত্তরের ডিসেম্বরে জামায়াত নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ হয়, সংবিধানে হয়েছিল কেবল ধর্মীয় সংগঠন হিসেবেই।
আনিসুল হক: যখন সংবিধান প্রণীত হয়, তখন তাতে আগের আইনকে সুরক্ষাদেওয়া হয়। পরে যখন এই সংবিধান নিয়ে ফুটবল খেলা হলো, তখন জামায়াতকে আবার ঢোকানো হলো, তারা রাজনৈতিক দল হলো। এরপর ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণ দিলেন যে জামায়াতকে কাঠগড়ায় তোলা যায়।২০১৩ সালেআমরা সংবিধানে ‘সংগঠন’ শব্দটি ঢোকালাম, কিন্তু সেটাই তার বিচারের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই বিচার-প্রক্রিয়ার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করতেই সংশোধনী আনা হচ্ছে।
প্রথম আলো: এ বিষয়ে এটাই হবে বিশ্বের প্রথম নজির?
আনিসুল হক: ইনশা আল্লাহ।
প্রথম আলো: বিচার বিভাগের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার খুব সফল কি? যেমন জেলায় জেলায় বিচার ভবন নির্মাণের একটি মেগা প্রকল্প সরকার নিয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।
আনিসুল হক: জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রিট পিটিশন করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হচ্ছে। যেমন ফরিদপুরে ‘বেলা’ রিট করেছিল, তাদের বলেছি দিঘি ভরাটের যে ধারণায় তারা এটা করেছে, তা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: এনবিআর, ভ্যাট, ট্যাক্স বা উন্নয়ন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট অনেক রিট, যা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে, তা নিষ্পত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যায় না?
আনিসুল হক: এসব বিষয়ে একটা বিহিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলোর যাতে দ্রুত শুনানি হয়, তার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এসব বিষয়ে আপিল শুনতে পাঁচটি বেঞ্চ দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, গাছ লাগালেই ফল পাব না। সুফল পেতে ছয় মাস লাগবেই। আমরা মামলাজট (প্রায় ৩০ লাখ) নিরসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু ২০-৩০ বছরের জট তো ছয় মাসে শেষ করতে পারব না।
প্রথম আলো: বর্তমানে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে শতাধিক বিচারকের পদ শূন্য। আপিল বিভাগে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ১১টি পদের মধ্যে এখন ৫টি শূন্য।
আনিসুল হক: আপিল বিভাগে পদ শূন্য, এ কথা কিন্তু সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানির জন্য ১১টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কারণ, তখনকার আপিল বিভাগে ওই মামলা শোনার মতো পাঁচ বিচারক ছিলেন না।
প্রথম আলো: এখন না দরকার পড়লে প্রজ্ঞাপন শুধরে নিন। অনধিক ১১ নয়, প্রজ্ঞাপন বলেছে ১১ জনের সমন্বয়ে আপিল বিভাগ হবে। তা ছাড়া, প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগে তিনটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে কি কোনো নামের প্রস্তাব গেছে?
আনিসুল হক: সংশোধন দরকার নেই। নাম প্রস্তাবও যায়নি। আর ১১ জন কিন্তু থাকতেই হবে না। প্রয়োজনে ১১ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তবে নিয়োগের বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। কিছুদিন আগেও নয়জন ছিল, তিনজন অবসরে যাওয়ায় এখন ছয়জন আছে। আপিল বিভাগে খুব শিগগির নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রথম আলো: কতজন? কোনো নাম নির্বাহী বিভাগের কাছে যায়নি? আর হাইকোর্টে কোনো নতুন নিয়োগ?
আনিসুল হক: সেটা প্রধান বিচারপতি জানেন। না, যায়নি। আপনি যদি ২০ বছর পেছনে তাকান, হাইকোর্টে ৬০ জন বিচারক ছিলেন। এখন সেখানে ৯৫ থেকে ১০০ জন। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতে-কমাতে পারি। যদি এমন বিচারক থাকেন, যার কোনো কাজ নেই, তেমন বিচারক তো নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না। এতে করদাতাদের কাঁধে বোঝা বাড়বে। আমরা তো সেটা করতে চাই না। প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে চাই। আমি আপনাকে হাইকোর্ট বিভাগ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাই। সেখানে গেলে দেখবেন, যে বেঞ্চে আপিল মামলার শুনানি চলে সেখানে ভিড় নেই। ওখানে কোনো আইনজীবী থাকবেন না। মোশন কোর্টে তাঁদের ভিড় দেখবেন।
প্রথম আলো: এই অবস্থা বদলানোর কোনো প্রয়াস, সংস্কারের কোনো চিন্তা?
আনিসুল হক: আমি কী সংস্কার করব? বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। এ বিষয়ে আমি কোনো কথাই বলতে চাই না। কিন্তু এটা সঠিক যে আপিল মামলার শুনানি খুব তাড়াতাড়ি হয় না। এ জন্যই মামলাজট। হাইকোর্টে অচিরে নতুন বিচারক আসবেন, তাও বলতে পারছি না।
প্রথম আলো: বিচারপতি নিয়োগ নীতিমালার কী হলো?
আনিসুল হক: এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
প্রথম আলো: দুই বছর আগেও এ কথা বলেছিলেন। জুডিশিয়াল কমিশন ধরনের কিছু হবে? আপিল বিভাগে নিয়োগের জন্যও কি?
আনিসুল হক: দুই বছর আগে ঠিকই বলেছিলাম, কিন্তু এটা এমন একটি বিষয়, এটা আজকে বললে কালকে করা যায় না। আমরা একটা নতুন বিষয়ের সূচনা ঘটাতে যাচ্ছি, যা আগে কখনো হয়নি। জুডিশিয়াল কমিশন বলব না। একটা নাম দেব। তবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বডি হবে। না, আপাতত হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগে বডি হবে। আপিল বিভাগের জন্য নয়।
প্রথম আলো: ইমপিচমেন্ট করার আইন কবে? খসড়া কি প্রস্তুত?
আনিসুল হক: খসড়া প্রস্তুত। তবে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, কথাটি ইমপিচ নয়, ৯৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অর্থাৎ দুই কারণে বিচারক অপসারণ করা যাবে। অভিশংসন মানে বিচার করা, এতে যে শুধু অপসারণ ঘটে, তা সত্য নয়। পদই শূন্য হবে না, শাস্তিও দেওয়া যাবে। তাই অভিশংসনে ক্ষমতা ব্যাপকতর। কিন্তু আমরা এখানে শুধু ওই দুটো বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকব। চলতি অধিবেশনে এটি পাস হয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্টের কাছে কি খসড়া পাঠাবেন? তাদেরমতামত নেবেন?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই। আমি এটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠাব। এবং সেই সঙ্গে এই অনুরোধও তাঁর কাছে রাখব যে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গেও যাতে তিনি বিষয়টিআলোচনা করেন।
প্রথম আলো: তিন মাসের মধ্যে এটি পাসের কথা বলেছিলেন। আপনি কি মানেন যে আইনটির অভাবে বিচারপতিসহ সব সাংবিধানিক পদধারীর জবাবদিহির জায়গায় কিছুটা শূন্যতা চলছে?
আনিসুল হক: হ্যাঁ। তা কিছুটা চলছে। তবে এই শূন্যতা এবারই প্রথম নয়। বাহাত্তর-পঁচাত্তরেও এটা শূন্য ছিল। কিন্তু এটা কাম্য নয়। এটা সুচিন্তিত ও অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে করা উচিত। বিচারপতিরা অত্যন্ত সম্মানিত ও বিজ্ঞ, তাঁদেরবিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: তাঁদের বিষয়ে তদন্তের জন্য শুধু কর্মরত বিচারকেরাই, নাকি ভারতের মতো বাইরে থেকেও অন্তর্ভুক্ত হবেন?
আনিসুল হক: মন্ত্রী হিসেবে আমি একটি নীতি নিয়েছি, সেটি হলো প্রস্তাবিত আইনের কোনো খসড়া মন্ত্রিসভায় পাস না হওয়া পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেব না।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের সপক্ষে মত দিয়েছেন।
আনিসুল হক: দেখুন, রোম সাম্রাজ্য এক দিনে গড়ে ওঠেনি। আপনারাই বলেন, ২০০৭-এ আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হয়েছে। কিন্তু তখন যেসব বিচারকার্য হয়েছিল, তা খুব স্বাধীনভাবে হয়নি।
প্রথম আলো: আমরা বলি, কিন্তু ঢালাওভাবে বলি না—
আনিসুল হক: এই স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ ও আরও সুদৃঢ় করতে আমি চেষ্টা করছি। ১৯৯৬ থেকে সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এবারের থোক বরাদ্দ ১১২ কোটি টাকা। আমরা একটি মাইন্ড সেট থেকে আরেকটি মাইন্ড সেটে যাচ্ছি। পঁচাত্তরের পরের হাইকোর্টে ইনডেমনিটি বিল বাতিলের জন্য তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে হয়েছিল। হাইকোর্টের যে স্বাধীনতা আজকে আছে, সেটা তখন কোথায় ছিল? পিআইএল (জনস্বার্থে মামলা) কেন তখন হয়নি? সংবিধান-সংক্রান্ত একটি মামলা জিয়ার আমলে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ সাহেব আমার বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হককে দিয়ে করিয়েছিলেন, দুদিন শোনার পরে তা খারিজ হয়েছিল। এভাবে তখনকার হাইকোর্ট যখনই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মামলা পেয়েছেন, বাতিল করেছেন। আমি নিজেই তার সাক্ষী। সেই হাইকোর্টের সঙ্গে কিন্তু আজকের হাইকোর্টের কোনো মিল নেই। আজকের হাইকোর্টও আপিল বিভাগ নির্বাহী বিভাগের শ্রদ্ধার পাত্র। হাইকোর্টের রায়ে আমাদের অনেক আইনে পরিবর্তন এসেছে।
প্রথম আলো: এই হাইকোর্ট যখন নিম্ন আদালতের বিচারক বদলির সিদ্ধান্ত দেন, তখন কখনো সরকারকে খড়্গহস্ত হতে দেখি—
আনিসুল হক: আপনাকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ তার যথাযথ ভাষায় পড়তে অনুরোধ করব। আমি তো কোনোশব্দ উদ্ভাবন করতে পারব না। আপনিও পারবেন না। ওখানে লেখা পরামর্শক্রমে। রাষ্ট্রপতি কোন কাজটি পরামর্শক্রমেকরেননি?
প্রথম আলো: বিচারকের কর্মস্থল নির্ধারণে সুপ্রিম কোর্টের স্বপ্রণোদিত পরামর্শ কি সংবিধানের চেতনাবিরুদ্ধ?
আনিসুল হক: না, প্রশ্ন হলো পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা। পরামর্শক্রমে পরামর্শ গ্রহণ করা হয় কি না? শুনুন, আমার মনে হয় না কেউ আমার সঙ্গে দ্বিমত করবেন যে, ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মানা হয়। এখন কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তো তাঁর ডিসক্রিশন প্রয়োগ করতেই পারেন। আইন তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছে। এখানে অন্যায় কোথায়?
প্রথম আলো: আপনি বদলির নীতিমালার কথা বলেছিলেন। সেটার কী হলো? কোথাও বছরের পর বছর কেউ টিকে আছেন, আবার ছয় মাস না যেতেই তাঁকে বদলির প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন।
আনিসুল হক: আমি যে অধস্তন আদালত উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, সেখানে বিচারক ও লোকবলের সংকট ছিল। আমি এটা মেটাতে পদোন্নতির শর্ত দুই বছর থেকে ছয় মাস বা এক বছরে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি আমলে বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল। কী করে আমি ছয় মাসে তা পূরণ করব? তাড়াহুড়ো করলে আপনি বিচারক পাবেন, বিচার পাবেন না। যেখানে পরিবর্তন দরকার ছিল, সেখানে পরিবর্তন আনতে পিছপা হইনি। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সিলেবাস পরিবর্তন করতেবলেছেন, করে দিয়েছি। তিনি যেভাবে বলছেন সেভাবে করারই চেষ্টা করছি। সুতরাং প্রক্রিয়া চলমান আছে। এর সুফল পেতে আপনাকে ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে।
প্রথম আলো: ২০০৭ সালে দেড় হাজার বিচারক দিয়ে শুরু হয় পৃথক্করণ। অথচ গত আট বছরে আপনারা কোনো নতুন পদ সৃষ্টি করেননি, শুধু শূন্যতা পূরণ করেছেন মাত্র।
আনিসুল হক: ৩৪৯ বিচারকের নতুন পদসৃষ্টিতে আমি সম্প্রতি জনপ্রশাসনকে লিখেছি। সেই সঙ্গে ৩৪৯ জনের সহায়ক জনবল হিসেবে মোট ১ হাজার ১৮ জন নিয়োগ পাবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
প্রথম আলো: জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ থেকে যুগ্ম জেলা জজ হয়েছেন। এরপর দ্বিতীয়বার পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত জেলা জজ হয়েছেন। অথচ তাঁরা বেতন পান দুই ধাপ নিচেরজ্যেষ্ঠ সহকারী জজ হিসেবে। পদোন্নতি আছে, দায়িত্ব পালন আছে, কিন্তু প্রাপ্য মজুরি নেই। আমাদের হিসাবে এর ফলে তিন শর বেশি বিচারক অন্তত ১৫ কোটি টাকা বঞ্চিত। বিচারকদের প্রতি এ কেমন বিচার?
আনিসুল হক: আমি বিষয়টি নিশ্চয়ই দেখব।
প্রথম আলো: বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার পে-কমিশন পর্যালোচনায় আট মন্ত্রী নিয়ে কমিটি হয়েছে। কিন্তু কবে রিপোর্ট দেবেন, তার তারিখ না দিয়ে ১২ জানুয়ারি গেজেট করেছেন।
আনিসুল হক: আমরা চার মন্ত্রী সব কটি কমিটিতে আছি। সকলের নতুন পে-স্কেল হয়ে গেছে। বিজ্ঞ বিচারকেরা কেন বঞ্চিত হবেন। বিষয়টি নিরসন করা দরকার। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, এ সমস্যার ত্বরিত সমাধান দরকার। এই ইস্যু শেষ করতেই মন্ত্রিসভা কমিটি হয়েছে। এক মাস বা তার কম সময়ে স্কেল দেব। তাঁরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে বিশেষ নজর দেব।
প্রথম আলো: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৬ থেকে চার-পাঁচ বছরের বকেয়াসহ জজদের বেতন-ভাতা দিতে বললে সব রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়েছে। আর ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সবাই যখন বেতন পেল, তখন জজদের ঠকানো হলো। এমনকি তাঁদের প্রাপ্য তুলে নেওয়ার পর অলিখিত আদেশে তা ফেরত দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কেমন আর্থিক শৃঙ্খলা?
আনিসুল হক: যখন বেতন কমিটির সভা হবে, তখন আমি এ বিষয়টি সেখানে তুলব। আমি এর সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিয়ে এর একটা সুরাহা করা যায় কি না, সে ব্যবস্থা আমি নেব।
প্রথম আলো: আমরা এর একটা হিসাব করেছি। তাতে বিচারকদের বঞ্চিত করা অর্থের পরিমাণ দেখলাম ৭৫ কোটি ৭৫ লাখ ১৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এক বিচারক তো এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। এর প্রতিকার চেয়ে আপিল বিভাগে দরখাস্ত পেন্ডিং। এটা কিন্তু রিটেও চ্যালেঞ্জযোগ্য।
আনিসুল হক: ঠিক আছে। আমি এর যথাবিহিত ব্যবস্থা নেব।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যদি অবকাঠামোগত সুবিধা সরকার নিশ্চিত করে, তাহলে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ হতে পারে।
আনিসুল হক: তিনি নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। তবে এখন এর সাধন পদ্ধতি তাঁর ব্যাপার, তিনি যখন যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই হবে। আগে স্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ অষ্টম সংশোধনীতে বাতিল হয়েছিল। এখন তিনি অস্থায়ী বেঞ্চ করতে আমাকে জিজ্ঞেস করলে সেভাবে আমি পরামর্শ দেব। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী কী বিবেচনায় হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ করতে চেয়েছেন—
আনিসুল হক: অনেক সময় অঞ্চলগত মামলার সংখ্যা বাড়ে-কমে। যেমন বন্দরনগর হিসেবে চট্টগ্রামের কাস্টমসের মামলা কখনো বেড়ে যায়। সেখানে তখন হাইকোর্ট বিভাগ চট্টগ্রামে বসবেন। স্থানীয় আইনজীবীরা তখন শুনানিতে অংশ নিতেপারবেন। এটা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও বটে। তাতে হয়তো কোনো একটি এলাকার মামলার ত্বরিত নিষ্পত্তি হবে। আইনজীবীদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এটা বিকেন্দ্রীকরণ। আমরা জনগণের ক্ষমতা সর্বদা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট।
প্রথম আলো: বিচার ও নির্বাহী বিভাগীয়একটা সংলাপের সূচনা আমরা সম্প্রতি দেখলাম।
আনিসুল হক: আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিচার বিভাগের উৎকর্ষ সাধনে সংলাপ অব্যাহত রেখেছি। তাঁর স্বপদের এক বছর পূর্তিতে আমি গিয়ে সাক্ষাৎ করেছি। গত এক বছরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যতবার আমার বৈঠক হয়েছে, আমার মনে হয় না এমনটা আগে কোনো আইনমন্ত্রীর সঙ্গে ঘটেছে।
প্রথম আলো: এই সংলাপটাকি আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে হতে পারে? যেমন আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারক থাকলেন—
আনিসুল হক: আমার আপত্তি নেই। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় রকমের হতে পারে। সর্বোপরি আমরা সবাই দেশের জন্য কাজ করছি। কোনো একটি অঙ্গকে বাদ দিয়ে কিন্তু দেশ চলবে না। তাই সমন্বয়সাধনের জন্য আলাপ-আলোচনার দরকার, আর তার মধ্যে আমি আছি।
প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকার কথা বলেছেন, আবার কোনো একটা কষ্টের জায়গা থেকে হয়তো বলেছেন যে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। আপনি কীভাবেদেখছেন?
আনিসুল হক: আমি এটা অস্বীকার করব না যে আমার সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে গত ১৭ জানুয়ারি আলাপ হয়েছে। যে ঘটনার কারণে তাঁর এই মন্তব্য সেটা আমি শুনেছি। যখন তিনি এটা বলেছেন তার আগে নয়, পরে আলাপ হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনি মনে হয় বিষয়টি পাঠককে অবহিত করতে পারেন। মনে হচ্ছে তাঁর ওই মন্তব্য কোনো নীতিগত নয়, নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার কারণে—
আনিসুল হক: আপনার সঙ্গে আমি একমত। এটা একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। তিনি যখন আমাকে বলেন যে, এটাই ব্যাপারটা, তখন আমি তাঁকে বলেছি যে, আমি ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। সেটা জেনে প্রধান বিচারপতি খুশি হয়েছেন।
প্রথম আলো: তার মানে যে কারণে প্রধান বিচারপতির উষ্মা, তার অপনোদন ঘটেছে?
আনিসুল হক: দেখুন, বিচারকার্য বিচারকেরা ছাড়া অন্য কেউ করুন, এটা তো ঠিক হবে না। ব্যাপারটা হচ্ছে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি নিশ্চয় কিছু কাজ করবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা বিচার বিভাগের কাজটা করে ফেলবে, সেখানে আমার মনে হয় একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা সমন্বয়ের দরকার আছে।
প্রথম আলো: আমরা মনে করি, যেসব সরকারি কর্মকর্তা যখন মোবাইল কোর্টে বিচারকাজ করবেন, তখন সেই সময়ের জন্য তাঁর জবাবদিহি সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকতে পারে। এখন এখানে একটা শূন্যতা চলছে।
আনিসুল হক: আপনি কথাটি বেঠিকবলেননি। আমরা এ রকম কিছু ভাবছি।
প্রথম আলো: আপনার এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক—
আনিসুল হক: সেটাই ব্যাপার। প্রধানবিচারপতিওকিছুদিন আগে বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করেন না এবং সেটা তিনি রক্ষা করছেন। হ্যাঁ, যেটার ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন, সে ক্ষেত্রে আমরাও সজাগ। প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চান।
প্রথম আলো: ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে কী করে নিম্ন আদালতে ১০৭, হাইকোর্টে ১৪৯ ও আপিল বিভাগে ১৬২ শতাংশ মামলা হ্রাস পেল?
আনিসুল হক: প্রথমত তদারকি। রাকিব ও রাজন হত্যার যে দ্রুত বিচার, তা ইতিহাসে প্রথম। আর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে ৩৪ বছর লেগেছিল। সুতরাং একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। আপনারা আমাদের সমালোচনা না করে উৎসাহিত করুন। কারণ, আমরা সঠিক পথে যাচ্ছি। উৎসাহ পেলে কাজ আরও বেড়ে যাবে।
১৯৮৪-৮৬ পর্বে হাইকোর্টে মামলার শুনানি করা যেত না। আমাদের চেম্বারেই দেখেছি, আসামি সাজা খেটে ফেলেছে। কিন্তু তার আপিল শুনানি হয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সময়ে দুটো বিজ্ঞপ্তি বের করা হয়েছিল, যাতে সাজার রেয়াত দেওয়া হয়েছিল। যেমন যাবজ্জীনের সাজা ছিল ২০ বছর। বলা হয়েছিল, যাঁরা ১০ বছর খেটে ফেলেছেন তাঁকে জেলমুক্ত কর। এই করে তখনকার জট অনেকটা ঘোচানো হয়েছিল। দু-একটি ছাড়া এ রকম মামলা আজ আর নেই। আজ তিন থেকে পাঁচবছর দেরি হয়।
প্রথম আলো: এটা কি ঠিক যে কারাগারগুলোতে দোষী সাব্যস্তদের চেয়ে বিচারাধীন কয়েদিরা সংখ্যায় বেশি?
আনিসুল হক: তাঁরা অনেক বেশি। কিন্তু তার মানে কী, তাঁরা তো এখনো সাজাপ্রাপ্ত নন।
প্রথম আলো: তাঁরা বিনা বিচারে বন্দী।
আনিসুল হক: এটা বলা যাবে না। কারণ, দণ্ডবিধির ৩৫ ধারা বলেছে, যেদিন দোষী সাব্যস্ত হবে, তার আগ পর্যন্ত যতটুকু জেল খেটেছে, তা তার সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে।
প্রথম আলো: আর যাঁরা নির্দোষ হবেন, তাঁদের কারাবাসের কী হবে?
আনিসুল হক: এই সমস্যা সারা বিশ্বে চলছে। আমরা তার কী করব? তবে হ্যাঁ, এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করছি আমরা। যতগুলো জামিনযোগ্য ধারা আছে, সেখানে শিথিলভাবে দেখে জামিন দেওয়া হচ্ছে। কিছু মামলায় জামিন প্রদানে রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। হত্যা মামলার চেয়েও সন্ত্রাসী মামলায় প্রসিকিউশন কঠোর হওয়ার চেষ্টা করছে। অভ্যাসগত অপরাধ মাদক প্রভৃতি এমন কিছু ব্যাধি রয়েছে, যা সমাজকে কলুষিতই করে না, সমাজের গঠন ধ্বংস করে দেয়। এসব অপরাধের বিষয়ে আমরা নমনীয় হব না।
প্রথম আলো: মামলাজট কমাতে প্রধান বিচারপতি একটি সফল নেতৃত্ব দেখিয়েছেন?
আনিসুল হক: নিশ্চয়ই, আমি তা স্বীকার করব।
প্রথম আলো: তাহলে ২৭ হাজার মামলা নিষ্পত্তিতে আইন কমিশন যে তিন হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে বলেছে, তার দরকার হবে?
আনিসুল হক: আমাদের ভবিষ্যৎ দেখতে হবে না? যেমনটা বলছিলাম যে মোশন কোর্টে ভিড় থাকে, তার মানে এন্ট্রি পয়েন্ট অর্থাৎ নতুন মামলা রুজু করার পর্যায়ে ভিড় থাকে। জনসংখ্যা বাড়ছে। সুতরাং সেসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু সব ব্যাপার আদালতে নিতে আমাদের যে প্রবণতা, তা থেকে জনগণকে বিমুখ করতে হবে। আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তবে এ রকম নতুন ব্যবস্থার ওপরে যতক্ষণ না মানুষের বিশ্বাস জন্মায়, ততক্ষণ তো এর ওপরে তারা নির্ভরশীল হবে না।
প্রথম আলো: কিন্তু আইনের শাসনের সূচক, যা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট, বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাক করেছে, তার সবটাতেই বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। এটা কীভাবে দেখবেন?
আনিসুল হক: শুনুন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ওনাদের এই সূচকটা কোথায় ছিল? যখন ইনডেমনিটি ছিল, ১৮ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার বিচার হবে না। তখন সূচক বুঝি খুব হাই ছিল? আর এখন আইনের শাসন সূচক নিম্নমুখী হয়েছে! এই সূচক আমি গ্রহণ করি না। বাংলাদেশেরমানুষ দেখছে, এখানে কী হচ্ছে। আপনারা এটা তুলনা করুন, তখন কি বলার ছিল না যে, এখানে আইনের শাসন নেই। তখন কি তারা তেমন বিবৃতি দিয়েছিল? কখনোই নয়। তারা সমর্থন করেছিল। আজ যখন এসব জঞ্জাল দূর করছি, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, যখন মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে যেকোনো অপরাধ হলে তারা বিচার পাবে, তখন তাঁরা বলেন আইনের শাসন সূচক খুব উচ্চ নয়, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ
আনিসুল হক: ধন্যবাদ।
No comments