নিহত ও নিখোঁজ হাজারো আয়লানের দায় by ফারুক ওয়াসিফ

তুরস্কের উপকূলে ভেসে আসা সিরীয় শরণার্থী শিশু
আয়লান কুর্দির লাশ এক মানবিক প্রশ্ন
বিক্রি হবে, শিশুর জুতা, সম্পূর্ণ আনকোরা। কেনা হয়েছিল, কিন্তু পরানোর আগেই মরে গেছে, এমন এক শিশুর শোকে থরথর ছয়টি শব্দ: For sale, Baby shoes, Never worn! লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। সিরীয় যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত ১০ হাজার শিশু। শরণার্থী হতে গিয়ে হারিয়ে গেছে আরও ১০ হাজার। এই ট্র্যাজেডি ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব?
তুরস্কের সমুদ্রতীরে সিরীয় শিশু আয়লানের মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য মনে আছে? ওর পায়েও ছিল এক জোড়া কালো জুতা। সেগুলোও কি পুরোনো জিনিসের দোকানে বিক্রির জন্য উঠেছিল? এক যুদ্ধেই নিহত ১০ হাজার, নিখোঁজ ১০ হাজার শিশুর দায় কেমন করে শোধ করবে পৃথিবী? আরও যুদ্ধ চালাবে, নাকি যুদ্ধবাজদের ছুড়ে ফেলবে সেই সাগরে, যেখানে শিশুরা ডুবে মরছে প্রতিনিয়ত। আয়লানের পরেও আরও আরও শিশুর লাশ ভেসে আসছে তুরস্কের সাগরতীরে। গত শনিবারও ডুবে মারা গেছে ৩৯ জন। আবারও সৈকতে পড়ে থেকেছে শিশুর লাশ, আর তাদের খেলনা পুতুল। ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি লিখে সাড়া জাগিয়েছিলেন মার্কিন সাহিত্যিক হেমিংওয়ে। এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ জেলের পরাজিত না হওয়ার জেদের গল্প উজ্জীবিত করেছিল পাঠকদের। বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো লিখতেন আরেক উপন্যাস, যার নাম হতো ‘চিলড্রেন অ্যান্ড দ্য সি অব টাইরানি’: ‘নির্মমতার সমুদ্র ও শিশুরা’। সম্প্রতি চীনা শিল্পী আই ওয়েইওয়েই আয়লান যেখানে নিথর পড়ে ছিল, সেখানেও ওর মতো শুয়ে থেকে প্রতিবাদ করেছেন।
তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে ভেসে উঠেছিল সিরিয়ার শরণার্থী শিশু আইলান
জাতিসংঘ জানাচ্ছে, সিরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের ১০ হাজারই শিশু। ওদিকে আরও আরও বোমা, বিমান, সৈন্য নামছে যুদ্ধের ময়দানে। খুব, খুব ব্যবসা হচ্ছে অস্ত্র কোম্পানির। ‘সভ্যতা’ নামক রূপকথায় বিশ্বাস টলে যাচ্ছে। শরণার্থীরা সীমান্তে সীমান্তে আশ্রয়ের তালাশ করছে। কেউ আশ্রয় পাচ্ছে, কেউ আটক হচ্ছে কারাগারে। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাবে গত বছর ২৭ হাজার শিশু অভিভাবকহীন অবস্থায় ইউরোপে আসে। যুদ্ধে তারা অভিভাবক হারিয়েছে অথবা তাদের যুদ্ধভূমির বাইরে পাঠিয়ে আশ্বস্ত থাকতে চেয়েছে তাদেরই নিরুপায় পিতামাতা। এদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার জনকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুলিশ সংস্থা ইউরোপোল। তাদের আশঙ্কা, ইউরোপের পাচার চক্র এদের অনেককেই দাস ও যৌনপণ্য হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছে।
শরণার্থীদের আসা শুরু হলো আর সক্রিয় হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। পাচারের জন্য বিশাল অবকাঠামো ও লোকবল খাড়া হয়ে গেল। অনেক লাভ এই ব্যবসায়। বলকান যুদ্ধের পরও পূর্ব ইউরোপের হাজার হাজার শিশু ও তরুণী শরণার্থীকে পতিতাবৃত্তি ও দাসত্বের জালে আটকানো হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধের পরও এই সর্বনাশা জাল হাজার হাজার নারী ও শিশুকে বাগে পেয়ে আটকে ফেলে। সেই চক্রই এখন টার্গেট করছে মধ্যপ্রাচ্যের নারী ও শিশুদের।
যুদ্ধে কারও সর্বনাশ কারও পৌষ মাস। কানাডীয় রাজনৈতিক তাত্ত্বিক নওমি ক্লেইন তাঁর দ্য শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম (২০০৭) বইয়ে এই করুণ কঠিন বাস্তবতা উদোম করে দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, নিওলিবারেল মুক্তবাজার অর্থনীতি যেকোনো সংকটকেই কাজে লাগায়। প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয়কে ব্যবহার করে তারা সম্পদ ও ক্ষমতার আরও কেন্দ্রীভবন ঘটায়। ইরাক যুদ্ধ এর নিকটতম উদাহরণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্যের মূল ভূমিতে কোনো যুদ্ধ না হলেও বাকি দুনিয়ার প্রায় সব যুদ্ধ ও গণহত্যায় তারা কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল। বাংলাদেশেও মার্কিন-সমর্থিত পাকিস্তানি গণহত্যা হয়েছিল। কত শিশু সে সময় নিহত, নিখোঁজ ও পঙ্গু হয়েছিল দেশের ভেতরে ও শরণার্থীশিবিরে, সেই হিসাব কি জাতিসংঘ কোনো দিন করবে? কত হাজার যুদ্ধশিশু মৃত্যু অথবা পাচারের শিকার হয়েছিল, তার খোঁজ কি আমরাই রাখি? আমরা সভ্যতার সেই পারের বাসিন্দা, যেখানে সবই কম। আমরা বড় কেবল পরিসংখ্যানে: শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান, না খাওয়া ও রোগে ভোগা জীবনের টলায়মানতার পরিসংখ্যান। এ রকম শুকনো পরিসংখ্যানের মধ্যেই হারিয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার লাখো শিশু। মধ্যযুগেও কি এত শিশুর অপমৃত্যু ঘটেছিল?
সিরীয় যুদ্ধের দায় অবশ্যই প্রথমত সে দেশের রাজনীতিকদের। তাঁদের বোঝা উচিত ছিল, অগণতান্ত্রিক শাসন বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ ডেকে আনে। ইরানে একধরনের গণতন্ত্র আছে বলে সে দেশে যুদ্ধ ও গৃহবিবাদ চাপিয়ে দেওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, এই দায় পরাশক্তিগুলোর, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মরণখেলার। পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, পাশ্চাত্য একমুখী নয়। গ্রিক দেবতা জানুসের মতো তার এক মুখে আলো, অন্য মুখে অন্ধকার। যখন সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো সিরিয়া ও ইয়েমেনে শরণার্থী সৃষ্টি করছে, তখন কিন্তু তুরস্ক ও জার্মানি এগিয়ে এসেছে তাদের আশ্রয় দিতে। নিখোঁজ ১০ হাজার শিশুর খোঁজার দায়িত্বও তো তারাই নিতে চাইছে। গত সপ্তাহে ব্রিটেনের সরকার সিরিয়া ও অন্য সংঘাত-অঞ্চলের আরও একাকী শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। সুইডেনের মতো দেশ মুখ ফেরাচ্ছে যখন, তখন গ্রিস এখনো হাত বাড়িয়ে আছে। তাই সঠিকভাবেই এবারের শান্তির নোবেল পুরস্কার তাদের দেওয়ার দাবি উঠেছে।
যেকোনো সংঘাত শেষ পর্যন্ত শিশুদের আঘাত করে। জীবন যদিওবা বাঁচে, তারা হারায় তাদের নিষ্পাপ শৈশব, হারায় স্বজন। এ এমন এক দুনিয়া, যখন নাকি শিশু-কিশোরদেরই যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। পাকিস্তানের মালালার কথা আমরা জানি। সে দেশেরই আরেক কিশোরী নাবিলা। মার্কিন ড্রোন হামলায় স্বজন হারানোর ক্ষতি সে ভুলতে পারেনি। বিচার চাইতে সে এমনকি মার্কিন সিনেটের সামনেও হাজির হয়েছে। নাবিলার মতো আরও এক মেয়ে ছিল। জাপানের হিরোশিমার কিশোরী সাদাকো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার পারমাণবিক বোমায় তার শহর ধ্বংস হয়ে গেল। ধুঁকে ধুঁকে সে বেঁচে ছিল আরও কিছুদিন। হাসপাতালে শুয়ে থাকতে থাকতে সে চাইল সহস্র কাগজের সারস বানাতে। ওর বিশ্বাস, তা হলে বুঝি তার মনের শুদ্ধ এক ইচ্ছা পূরণ হবে। সাদাকো চেয়েছিল, পৃথিবীর আর কোনো শিশুর অপমৃত্যু যেন না হয়। কিন্তু হাজার পূর্ণ হওয়ার আগেই সাদাকো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে। আর তার গল্প জাগিয়ে দেয় জাপানের শিশুদের। তারা হাজার হাজার কাগজের সারস বানাল, গান রচিত হলো সাদাকোকে নিয়ে। সেই থেকে সাদা সারস শান্তির প্রতীক। সাদাকোর অন্তিম ইচ্ছা যে পূরণ হয়নি, দুনিয়ার নিখোঁজ, নিহত ও নির্যাতিত শিশুরাই তা জানিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে যুদ্ধ নেই বহু বছর। কিন্তু শিশুহত্যা কি থেমেছে? এই সপ্তাহেও শিশুদের অপহরণ করে হত্যার কতগুলো সংবাদ এসেছে পত্রিকায়! কবি আবুল হাসানের কথাই কি তবে সত্য হবে? ‘আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম/ আমি শিশু হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!/ ভ্রূণহত্যা! সেতো আরও সাংঘাতিক, আমি জানতাম হে অর্জুন/ মানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!’
মানুষের সন্তানের অপমৃত্যুই সত্য হতে পারে না! সাদাকোর গান আমাদের সেটাই বলে যায়:
‘আমি এসে দাঁড়াই প্রতিটি দরজায়
আমার নীরব হেঁটে চলা শোনে না কেউ
করাঘাত করি আমি দোরে দোরে, শোনে না কেউ
ওগো আমি যে মৃত, আমি যে মৃত!’
গানটি বলে এমন এক শিশুর কথা, যার আর চকলেট দরকার নেই, দরকার নেই খেলনা বা দুধের—কারণ সে মৃত। সে ডেকে যায়:
‘যাতে সারা পৃথিবীর শিশুরা
ছুটোছুটি করে, গান গায় আর হাসে।’
আমরাও গেেয় যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের গান: ‘যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে’; সেই বিশ্ব কি ভুলে থাকবে তার অসহায় শিশুদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.