কাঠগড়ায় পুলিশ
চা-দোকানি
বাবুল মাতবর (৫০) সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তাঁর কাছে কেউ আর চাঁদা
চাইতে পারবে না। চাঁদা না পেয়ে কেউ লাথি মেরে জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে দিতে
পারবে না। কারণ, পুড়ে অঙ্গার বাবুল গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন।
বাবুলের ওপর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও পুলিশের তথ্যদাতাদের (সোর্স) বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে মিরপুর ১ নম্বর গুদারাঘাটের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। সংসদে ৩০০ বিধিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছেন একজন সাংসদ।
ভোলা সদর উপজেলার মুন্সিচরের বাবুল মাতবর মিরপুর ১ নম্বরের গুদারাঘাটের ফুটপাতে চায়ের দোকান চালাতেন। গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে শাহ আলী থানার চার পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে তাঁদের সোর্স বাবুলের কাছ চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় বাবুলকে লাথি মেরে কেরোসিন তেলের জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে দেন সোর্স দেলোয়ার। এতে বাবুলের সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় রাত ১১টার দিকে বাবুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে তিনি মারা যান।
গতকাল দুপুরে মিরপুর চিড়িয়াখানা লেকপাড়ের রাস্তার পাশে বাবুলের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সামনে মানুষের ভিড়। দোকানের চালা পুড়ে গেছে। টেবিলের ওপর বালু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। উপস্থিত স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, পুলিশ চলে গেলে এই বালু শরীরে ছিটিয়ে বাবুলের আগুন নেভানো হয়। সেখানে বাবুলের স্ত্রী লাকি বেগম মাটিতে গড়াগড়ি করে বিলাপ করছিলেন।
জানতে চাইলে লাকি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার দুপুর থেকে পুলিশ সোর্সদের লইয়া তিনবার চাঁদা নেতে আসে। দুইবার এসে চাঁদা না পেয়ে বাবুলকে ধইরা নিয়া যেতে চায়। আমার বাধার কারণে তারে নেতে পারেনি। রাত সাড়ে নয়টার দিকে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে (ইন)ফরমার (সোর্স) লইয়া আবার আসে। ফরমার বলে, “এখানে দোকান দিছ কার অর্ডারে। আমাগো টাকা দে।” তহন আমার স্বামী কয়, আমি কর্ম কইরা খাই, তোমাগো কিসের টাকা দিমু। আমার বউ অসুস্থ, টাকার অভাবে হ্যার লইগ্যা ওষুধ কিনতে পারি না। তহন ফরমাররা লাডি দিয়া আমার স্বামীরে মারে। লাথি মাইরা স্টোভের ওপর ফালাইয়া দেয়। আমি বালতি দিয়া হ্যার শরীরের আগুন নিভাইতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পায়ে ধইরা কানলাম। কিন্তু পুলিশ তামশা দেখছিল। চিল্লাইতে চিল্লাইতে রাস্তার মাথা পর্যন্ত গ্যালে পুলিশ ও ফরমার চইল্যা যায়। ততক্ষণে আমার স্বামীর পুরা শরীর পুইড়া গেছে। পরে আশপাশের মানুষ বালি ছিডাইয়া আগুন নিভায়। আগুন ধইরা গ্যালে গায়ের জ্যাকেট, শার্ট-লুঙ্গি ও প্যান্ট সব ছাই অইয়া শরীর পুইড়া যায়। তহন তার পরনে আর কিছু ছেল না।’
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হিরা আক্তার বলেন, চিৎকার শুনে তিনি এসে দেখেন বাবুলের শরীরে আগুন জ্বলছে। বাবুল চিৎকার করছেন এবং মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। তখনো পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের হাতে ওয়াকিটকি সেট ছিল। বাবুল চিৎকার করে বলছিলেন, ‘ওসিকে ফোন করো, আমারে পুড়াইয়া মাইরা ফেলল।’
গতকাল দুপুরে তদন্ত কমিটির পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য নেন। সেখানে ডিএমপি সদর দপ্তরের উপকমিশনার (শৃঙ্খলা) টুটুল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাবে না।’
তবে শেষ পর্যন্ত শাহ আলী থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান খান, নিয়াজ উদ্দীন মোল্লা ও শ্রীধাম চন্দ্র এবং এএসআই দেবেন্দ্র নাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দীন। ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তর ও মিরপুর বিভাগ পৃথক দুটি কমিটি করেছে।
শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহীন মণ্ডল দাবি করেন, চায়ের দোকানের আড়ালে বাবুল গাঁজার ব্যবসা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় চার-পাঁচটির মতো মাদকের মামলা আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম আলোকে বলেছেন, শাহ আলী থানার কিছু পুলিশ সদস্য সোর্স দিয়ে গুদারাঘাটের পারুলসহ আরও কয়েকজনের গাঁজার আখড়া থেকে বখরা নেয়। নিরীহ মানুষকে আটক করে টাকা নেওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। এই থানার সোর্সরা হাতকড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলেও জানান একাধিক ব্যক্তি। বাবুলকে একবার পুলিশ আটক করেছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন। তবে দুই বছর ধরে তিনি চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এর আড়ালে তিনি মাদকের ব্যবসা করতেন কি না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
গতকাল দুপুরে হাসপাতালে বাবুলের মৃত্যুর খবর শুনে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন মেয়ে লাবণী আক্তার ও রোকসানা বেগম এবং পুত্রবধূ মণি আক্তার। লাবণী আক্তার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘কাল আমার বাবা সুস্থ ছিল। পুলিশের কারণে আজ লাশ নিয়া যাইতেছি।’
ছেলে রাজু আহমেদ বিলাপ করে বললেন, ‘সকাল থেকে বাবা কোনো কথা বলতে পারতেছিল না। হঠাৎ কইরা আমারে ডাইকা বলল, আমি আর পাঁচ মিনিট আছি। মুখে একটু পানি দে। ঠোঁট ফাঁক করে পানি মুখে ঢালতে না ঢালতেই মারা যান তিনি।’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাবুলের শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়ে গেছে।
দগ্ধ বাবুলকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর খবর পান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের কাছে প্রশ্ন, এটাই কি জনগণের বন্ধু হওয়ার নিদর্শন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করি, এ ঘটনার মোড় অন্যদিকে নেবেন না।’
মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না হলে তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন। কারণ, পুলিশের স্পর্ধা, বেআইনি কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়েছে। এটা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘যখন চা-বিক্রেতাকে পয়সা না দেওয়ার জন্য মরতে হয়, এ রকম পুলিশ আমাদের দরকার নেই। মানুষের অধিকার রক্ষায় পুলিশ নিয়োজিত, এভাবে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, পুলিশের স্পর্ধা, বেআইনি কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়েছে। এর বিচার রাষ্ট্রকে করতে হবে। কারণ, পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের জন্য এটা লজ্জার। তিনি বলেন, পুলিশের উচিত ছিল অগ্নিদগ্ধ বাবুল মাতবরকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া।
বাবুলের দগ্ধ হওয়ার খবর গতকালই প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় গতকাল সকালে বাবুলের মেয়ে রোকসানা বেগমকে বাদী করে একটি মামলা নেয় পুলিশ। মামলায় সোর্স দেলোয়ারসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে আরও দু-তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি পারুলকে গ্রেপ্তার করেছে।
বাবুলের পুত্রবধূ মণি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশই এজাহার কম্পিউটারে টাইপ করেছে। এরপর তাঁর ননদ রোকসানার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। পড়েও শোনানো হয়নি তাঁদের।
তবে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম শাহীন মণ্ডল বলেন, ‘বাবুলের মেয়ে যে কয়জনের নাম দিয়েছেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছি। তাঁরা যে অভিযোগ করছেন, তা ঠিক নয়।’
সংসদে আলোচনা: মিরপুরে চায়ের দোকানিসহ সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুজন কর্মকর্তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আদাবর থানার পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেছে। পুলিশের কেউ কেউ বলছে, মাছের রাজা ইলিশ আর মানুষের রাজা পুলিশ। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে, পুলিশ বাহিনীর ইমেজ নষ্ট করতে জঘন্য কর্মকাণ্ড করছে কারা? তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’ তিনি এ বিষয়ে ৩০০ বিধিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন।
মিরপুরে লাশ দাফন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বাবুলের লাশ স্বজনেরা মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের এইচ ব্লকের বাসায় নিয়ে যান। এ সময় পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে জানাজা শেষে রাত ১১টার দিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
বাবুলের ওপর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও পুলিশের তথ্যদাতাদের (সোর্স) বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে মিরপুর ১ নম্বর গুদারাঘাটের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। সংসদে ৩০০ বিধিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছেন একজন সাংসদ।
ভোলা সদর উপজেলার মুন্সিচরের বাবুল মাতবর মিরপুর ১ নম্বরের গুদারাঘাটের ফুটপাতে চায়ের দোকান চালাতেন। গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে শাহ আলী থানার চার পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে তাঁদের সোর্স বাবুলের কাছ চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় বাবুলকে লাথি মেরে কেরোসিন তেলের জ্বলন্ত চুলার ওপর ফেলে দেন সোর্স দেলোয়ার। এতে বাবুলের সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় রাত ১১টার দিকে বাবুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে তিনি মারা যান।
গতকাল দুপুরে মিরপুর চিড়িয়াখানা লেকপাড়ের রাস্তার পাশে বাবুলের চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সামনে মানুষের ভিড়। দোকানের চালা পুড়ে গেছে। টেবিলের ওপর বালু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। উপস্থিত স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, পুলিশ চলে গেলে এই বালু শরীরে ছিটিয়ে বাবুলের আগুন নেভানো হয়। সেখানে বাবুলের স্ত্রী লাকি বেগম মাটিতে গড়াগড়ি করে বিলাপ করছিলেন।
জানতে চাইলে লাকি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার দুপুর থেকে পুলিশ সোর্সদের লইয়া তিনবার চাঁদা নেতে আসে। দুইবার এসে চাঁদা না পেয়ে বাবুলকে ধইরা নিয়া যেতে চায়। আমার বাধার কারণে তারে নেতে পারেনি। রাত সাড়ে নয়টার দিকে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে (ইন)ফরমার (সোর্স) লইয়া আবার আসে। ফরমার বলে, “এখানে দোকান দিছ কার অর্ডারে। আমাগো টাকা দে।” তহন আমার স্বামী কয়, আমি কর্ম কইরা খাই, তোমাগো কিসের টাকা দিমু। আমার বউ অসুস্থ, টাকার অভাবে হ্যার লইগ্যা ওষুধ কিনতে পারি না। তহন ফরমাররা লাডি দিয়া আমার স্বামীরে মারে। লাথি মাইরা স্টোভের ওপর ফালাইয়া দেয়। আমি বালতি দিয়া হ্যার শরীরের আগুন নিভাইতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পায়ে ধইরা কানলাম। কিন্তু পুলিশ তামশা দেখছিল। চিল্লাইতে চিল্লাইতে রাস্তার মাথা পর্যন্ত গ্যালে পুলিশ ও ফরমার চইল্যা যায়। ততক্ষণে আমার স্বামীর পুরা শরীর পুইড়া গেছে। পরে আশপাশের মানুষ বালি ছিডাইয়া আগুন নিভায়। আগুন ধইরা গ্যালে গায়ের জ্যাকেট, শার্ট-লুঙ্গি ও প্যান্ট সব ছাই অইয়া শরীর পুইড়া যায়। তহন তার পরনে আর কিছু ছেল না।’
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হিরা আক্তার বলেন, চিৎকার শুনে তিনি এসে দেখেন বাবুলের শরীরে আগুন জ্বলছে। বাবুল চিৎকার করছেন এবং মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। তখনো পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের হাতে ওয়াকিটকি সেট ছিল। বাবুল চিৎকার করে বলছিলেন, ‘ওসিকে ফোন করো, আমারে পুড়াইয়া মাইরা ফেলল।’
গতকাল দুপুরে তদন্ত কমিটির পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য নেন। সেখানে ডিএমপি সদর দপ্তরের উপকমিশনার (শৃঙ্খলা) টুটুল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাবে না।’
তবে শেষ পর্যন্ত শাহ আলী থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান খান, নিয়াজ উদ্দীন মোল্লা ও শ্রীধাম চন্দ্র এবং এএসআই দেবেন্দ্র নাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দীন। ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তর ও মিরপুর বিভাগ পৃথক দুটি কমিটি করেছে।
শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহীন মণ্ডল দাবি করেন, চায়ের দোকানের আড়ালে বাবুল গাঁজার ব্যবসা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় চার-পাঁচটির মতো মাদকের মামলা আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম আলোকে বলেছেন, শাহ আলী থানার কিছু পুলিশ সদস্য সোর্স দিয়ে গুদারাঘাটের পারুলসহ আরও কয়েকজনের গাঁজার আখড়া থেকে বখরা নেয়। নিরীহ মানুষকে আটক করে টাকা নেওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। এই থানার সোর্সরা হাতকড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলেও জানান একাধিক ব্যক্তি। বাবুলকে একবার পুলিশ আটক করেছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন। তবে দুই বছর ধরে তিনি চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এর আড়ালে তিনি মাদকের ব্যবসা করতেন কি না, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
গতকাল দুপুরে হাসপাতালে বাবুলের মৃত্যুর খবর শুনে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন মেয়ে লাবণী আক্তার ও রোকসানা বেগম এবং পুত্রবধূ মণি আক্তার। লাবণী আক্তার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘কাল আমার বাবা সুস্থ ছিল। পুলিশের কারণে আজ লাশ নিয়া যাইতেছি।’
ছেলে রাজু আহমেদ বিলাপ করে বললেন, ‘সকাল থেকে বাবা কোনো কথা বলতে পারতেছিল না। হঠাৎ কইরা আমারে ডাইকা বলল, আমি আর পাঁচ মিনিট আছি। মুখে একটু পানি দে। ঠোঁট ফাঁক করে পানি মুখে ঢালতে না ঢালতেই মারা যান তিনি।’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাবুলের শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়ে গেছে।
দগ্ধ বাবুলকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর খবর পান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের কাছে প্রশ্ন, এটাই কি জনগণের বন্ধু হওয়ার নিদর্শন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করি, এ ঘটনার মোড় অন্যদিকে নেবেন না।’
মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না হলে তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন। কারণ, পুলিশের স্পর্ধা, বেআইনি কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়েছে। এটা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘যখন চা-বিক্রেতাকে পয়সা না দেওয়ার জন্য মরতে হয়, এ রকম পুলিশ আমাদের দরকার নেই। মানুষের অধিকার রক্ষায় পুলিশ নিয়োজিত, এভাবে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, পুলিশের স্পর্ধা, বেআইনি কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়েছে। এর বিচার রাষ্ট্রকে করতে হবে। কারণ, পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের জন্য এটা লজ্জার। তিনি বলেন, পুলিশের উচিত ছিল অগ্নিদগ্ধ বাবুল মাতবরকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া।
বাবুলের দগ্ধ হওয়ার খবর গতকালই প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় গতকাল সকালে বাবুলের মেয়ে রোকসানা বেগমকে বাদী করে একটি মামলা নেয় পুলিশ। মামলায় সোর্স দেলোয়ারসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে আরও দু-তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি পারুলকে গ্রেপ্তার করেছে।
বাবুলের পুত্রবধূ মণি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশই এজাহার কম্পিউটারে টাইপ করেছে। এরপর তাঁর ননদ রোকসানার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। পড়েও শোনানো হয়নি তাঁদের।
তবে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম শাহীন মণ্ডল বলেন, ‘বাবুলের মেয়ে যে কয়জনের নাম দিয়েছেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছি। তাঁরা যে অভিযোগ করছেন, তা ঠিক নয়।’
সংসদে আলোচনা: মিরপুরে চায়ের দোকানিসহ সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুজন কর্মকর্তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আদাবর থানার পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেছে। পুলিশের কেউ কেউ বলছে, মাছের রাজা ইলিশ আর মানুষের রাজা পুলিশ। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে, পুলিশ বাহিনীর ইমেজ নষ্ট করতে জঘন্য কর্মকাণ্ড করছে কারা? তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?’ তিনি এ বিষয়ে ৩০০ বিধিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন।
মিরপুরে লাশ দাফন: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বাবুলের লাশ স্বজনেরা মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের এইচ ব্লকের বাসায় নিয়ে যান। এ সময় পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে জানাজা শেষে রাত ১১টার দিকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
No comments