উদারতার বিকল্প নেই by কুলদীপ নায়ার
ফারুক
আবদুল্লাহ শ্রীনগর থেকে প্রকাশিত এক উর্দু জার্নালে লিখেছেন, তাঁর মরহুম
পিতা শেখ আবদুল্লাহ এটা জানতে পারলে খুশি হতেন যে কাশ্মীরের তরুণেরা
নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বন্দুক তুলে নিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা
ফারুকের কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোরও একই মনোভঙ্গি ছিল। তিনি কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী ঢুকিয়েছিলেন এই আশায় যে কাশ্মীরিরা ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবি জানাবে। কিন্তু তিনি ভুল প্রমাণিত হন। কাশ্মীরিরা প্রকৃতিগতভাবে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল, ফলে তারা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে ছিল। এই পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের কাশ্মীরিরা নিজেরাই চিহ্নিত করেছিল, তারা তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
শেখ সাহেবকে আমি খুব ভালোভাবে চিনতাম। জরুরি অবস্থার সময় তিন মাস কারাভোগ করে মুক্তি পাওয়ার পর শ্রীনগরে গিয়েছিলাম, শেখ সাহেবের কার্যালয়ে খবর দেওয়ার পর তিনিই প্রথম হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর সেদিনের কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে: ‘আব তুম ভি হাজি হো যাওগে’, অর্থাৎ তুমি তো হাজি হয়ে গেলে। এর মাধ্যমে তিনি জেলখানাকে তীর্থস্থানের সঙ্গে তুলনা করেন।
তিহার জেলে আমার কারাবাসের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন শেখ। ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে শক্ত কথা লেখার কারণে আমার কারাবাস হয়েছিল। আমার ঘটনায় শেখ সাহেবের নিজের কারাবাসের কথাও মনে পড়ে যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁকে তামিলনাড়ুর কোডাইকানাল কারাগারে আটক রেখেছিলেন। তিনি নেহরুর এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে দিল্লিতে এলে নেহরুর বাসাতেই থাকতেন। এমনকি তাঁর কারাভোগের পর তিনি নেহরুর বাসায় যেতেন, কারণ নেহরু এ ঘটনায় নিজের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
যাঁরা নিরন্তর এ কথা বলে যাচ্ছেন যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁরা ভুল এ কারণে যে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া বাকি বিষয়ে কেন্দ্রকে জম্মু ও কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে হলে সেখানকার রাজ্যসভার অনুমতি নিয়েই তা করতে হবে। অন্য কথায় এই অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য একধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, যেটা ভারতের অন্য রাজ্যগুলো করে না। এর পরিণতি হিসেবে শেখ সাহেবকে রাজ্যের সংবিধান সভায় এই প্রস্তাব পাস করাতে হয় যে জম্মু ও কাশ্মীর দ্ব্যর্থহীনভাবে ভারতে যোগ দেবে। সেটা করার আগে পাকিস্তান কেমন রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, তিনি সেটা ঠাহর করার জন্য সাদিক সাহেবকে পাকিস্তানে পাঠান, এই সাদিক সাহেব পরবর্তীকালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
এরপর সাদিক সাহেবের কাছ থেকে পাকিস্তানের হালচাল জানার পর তিনি সময়ক্ষেপণ না করেই ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল হিসেবে তাঁর অন্তরে ছিল বহুত্ববাদের বীজ। যে গণতান্ত্রিক ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, সেই ভারতই তাঁর কাম্য ছিল, অন্যদিকে পাকিস্তান তখন ইসলাম গলাধঃকরণে ব্যস্ত।
সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু-মুসলমান চ্যালেঞ্জ ও পাল্টা চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকলে তার মধ্যে একমাত্র শেখ সাহেবই উদার কণ্ঠস্বর হিসেবে অটল থাকেন। মনে আছে, তিহার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় কারাগারের অন্য বন্দীরা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন শেখ সাহেবকে এই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আহ্বান করি, কারণ দেশের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে।
শ্রীনগরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জরুরি অবস্থার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন, এই বিবৃতির পেছনে আমার হাত রয়েছে। কিন্তু যাঁরা জরুরি অবস্থার সময় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, এই বিবৃতির কারণে তাঁরা নৈতিক শক্তি লাভ করেন। পুরো জাতিই তখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে সময় কারও কথা বলার সাহস ছিল না, সবাই ছিল ভীত। জাতি সঠিক ও বেঠিকের এবং নৈতিক ও অনৈতিকের মধ্যে পার্থক্য করতে ভুলে গিয়েছিল।
শেখ সাহেব যখন কথা বলতেন, তখন সারা জাতিই তাঁর কথা শুনত, কারণ তাঁর কথা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে যেত। এই প্রক্রিয়ায় তিনি জনগণের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি কখনোই রাজ্য ও রাজনীতির সংকীর্ণতার মধ্যে ঢোকেননি। লোকে তাঁকে বড় নেতাই বলে মনে করতেন। ফলে তিনি যখন কথা বলতেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোও তাঁর কথা শুনত।
ফারুক আবদুল্লাহ বরং শেখকে কাশ্মীরের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করে তাঁকে ক্ষুদ্র করেছেন। তিনি নয়াদিল্লিকে এ কথা বলে তিরস্কার করতে পারতেন যে তারা কাশ্মীরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার কারণে সেখানকার তরুণদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছে, তারা নিজেদের অঙ্গীকার রাখতে পারেনি: কেন্দ্রের হাতে মাত্র তিনটি বিষয় থাকবে—প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ। আর অন্যগুলো থাকবে রাজ্যের হাতে।
ফারুক আবদুল্লাহ আগে যা বলেছিলেন, সেটা বরং গঠনমূলক ছিল। তিনি বলেছিলেন, ভারতের উচিত নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে নেওয়া আর ইসলামাবাদকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর অন্তর্ভুক্ত করে নিতে দেওয়া, যেটা এ মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে রয়েছে। ফারুক নিজের মাথায় পেরেক ঠুকেছেন, কারণ ভারত ও পাকিস্তান প্রায়ই এই নিয়ন্ত্রণরেখার লঙ্ঘন নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়।
সে তাদের আকাঙ্ক্ষা বা কৌশল যা-ই হোক না কেন, উভয় পক্ষকেই এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে নিয়ন্ত্রণরেখাই হলো আন্তর্জাতিক সীমানা। ভারত ও পাকিস্তান নিজে থেকে এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এ পর্যন্ত দুবার যুদ্ধ করেছে। তাদের হাতে এখন পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, ফলে তারা আর যুদ্ধ করতে পারে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাঠানকোট হামলার পরে ভারতীয়দের ভীতি লাঘব করে ভালো কাজই করেছেন। তিনি আরও তত্ত্বতালাশ করছেন। কারণ ভারত তাঁকে যেসব তথ্য দিয়েছে, সেগুলোই যথেষ্ট নয়। তিনি মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত মাসউদ আজহারকে কারাবন্দী করেও ভালো করেছেন।
একই সঙ্গে দেশ দুটির পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এই হামলার পর বাতিল না হয়ে পুনর্নির্ধারিত হয়েছে, হামলার পর যেটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। নওয়াজ যে চাপের মুখে কাজ করছেন, নয়াদিল্লি তা বুঝতে পেরেছে। কারণ পাকিস্তানে শেষ কথাটা বলে সেনাবাহিনী। দেশটির সেনাপ্রধানের গুরুত্ব কতটা তা বোঝা যায় দুটি ঘটনা থেকে, নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইরান ও সৌদি আরবে নিয়ে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান যে বৈঠকেই থাকেন, নওয়াজ তাঁকে নিজের সমমর্যাদা দেন, এটা আমাকে দুঃখ দেয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ট্র্যাজেডি হচ্ছে, সেসব দেশে সেনাবাহিনী একবার সরকারের অংশীদার হয়ে গেলে তারা আর ব্যারাকে ফিরে যায় না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোরও একই মনোভঙ্গি ছিল। তিনি কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী ঢুকিয়েছিলেন এই আশায় যে কাশ্মীরিরা ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবি জানাবে। কিন্তু তিনি ভুল প্রমাণিত হন। কাশ্মীরিরা প্রকৃতিগতভাবে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিল, ফলে তারা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে ছিল। এই পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের কাশ্মীরিরা নিজেরাই চিহ্নিত করেছিল, তারা তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
শেখ সাহেবকে আমি খুব ভালোভাবে চিনতাম। জরুরি অবস্থার সময় তিন মাস কারাভোগ করে মুক্তি পাওয়ার পর শ্রীনগরে গিয়েছিলাম, শেখ সাহেবের কার্যালয়ে খবর দেওয়ার পর তিনিই প্রথম হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর সেদিনের কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে: ‘আব তুম ভি হাজি হো যাওগে’, অর্থাৎ তুমি তো হাজি হয়ে গেলে। এর মাধ্যমে তিনি জেলখানাকে তীর্থস্থানের সঙ্গে তুলনা করেন।
তিহার জেলে আমার কারাবাসের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন শেখ। ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে শক্ত কথা লেখার কারণে আমার কারাবাস হয়েছিল। আমার ঘটনায় শেখ সাহেবের নিজের কারাবাসের কথাও মনে পড়ে যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁকে তামিলনাড়ুর কোডাইকানাল কারাগারে আটক রেখেছিলেন। তিনি নেহরুর এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে দিল্লিতে এলে নেহরুর বাসাতেই থাকতেন। এমনকি তাঁর কারাভোগের পর তিনি নেহরুর বাসায় যেতেন, কারণ নেহরু এ ঘটনায় নিজের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
যাঁরা নিরন্তর এ কথা বলে যাচ্ছেন যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁরা ভুল এ কারণে যে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া বাকি বিষয়ে কেন্দ্রকে জম্মু ও কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে হলে সেখানকার রাজ্যসভার অনুমতি নিয়েই তা করতে হবে। অন্য কথায় এই অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য একধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, যেটা ভারতের অন্য রাজ্যগুলো করে না। এর পরিণতি হিসেবে শেখ সাহেবকে রাজ্যের সংবিধান সভায় এই প্রস্তাব পাস করাতে হয় যে জম্মু ও কাশ্মীর দ্ব্যর্থহীনভাবে ভারতে যোগ দেবে। সেটা করার আগে পাকিস্তান কেমন রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, তিনি সেটা ঠাহর করার জন্য সাদিক সাহেবকে পাকিস্তানে পাঠান, এই সাদিক সাহেব পরবর্তীকালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
এরপর সাদিক সাহেবের কাছ থেকে পাকিস্তানের হালচাল জানার পর তিনি সময়ক্ষেপণ না করেই ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল হিসেবে তাঁর অন্তরে ছিল বহুত্ববাদের বীজ। যে গণতান্ত্রিক ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, সেই ভারতই তাঁর কাম্য ছিল, অন্যদিকে পাকিস্তান তখন ইসলাম গলাধঃকরণে ব্যস্ত।
সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু-মুসলমান চ্যালেঞ্জ ও পাল্টা চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকলে তার মধ্যে একমাত্র শেখ সাহেবই উদার কণ্ঠস্বর হিসেবে অটল থাকেন। মনে আছে, তিহার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় কারাগারের অন্য বন্দীরা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন শেখ সাহেবকে এই জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আহ্বান করি, কারণ দেশের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে।
শ্রীনগরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জরুরি অবস্থার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন, এই বিবৃতির পেছনে আমার হাত রয়েছে। কিন্তু যাঁরা জরুরি অবস্থার সময় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, এই বিবৃতির কারণে তাঁরা নৈতিক শক্তি লাভ করেন। পুরো জাতিই তখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে সময় কারও কথা বলার সাহস ছিল না, সবাই ছিল ভীত। জাতি সঠিক ও বেঠিকের এবং নৈতিক ও অনৈতিকের মধ্যে পার্থক্য করতে ভুলে গিয়েছিল।
শেখ সাহেব যখন কথা বলতেন, তখন সারা জাতিই তাঁর কথা শুনত, কারণ তাঁর কথা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে যেত। এই প্রক্রিয়ায় তিনি জনগণের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি কখনোই রাজ্য ও রাজনীতির সংকীর্ণতার মধ্যে ঢোকেননি। লোকে তাঁকে বড় নেতাই বলে মনে করতেন। ফলে তিনি যখন কথা বলতেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোও তাঁর কথা শুনত।
ফারুক আবদুল্লাহ বরং শেখকে কাশ্মীরের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করে তাঁকে ক্ষুদ্র করেছেন। তিনি নয়াদিল্লিকে এ কথা বলে তিরস্কার করতে পারতেন যে তারা কাশ্মীরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার কারণে সেখানকার তরুণদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছে, তারা নিজেদের অঙ্গীকার রাখতে পারেনি: কেন্দ্রের হাতে মাত্র তিনটি বিষয় থাকবে—প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ। আর অন্যগুলো থাকবে রাজ্যের হাতে।
ফারুক আবদুল্লাহ আগে যা বলেছিলেন, সেটা বরং গঠনমূলক ছিল। তিনি বলেছিলেন, ভারতের উচিত নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে নেওয়া আর ইসলামাবাদকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর অন্তর্ভুক্ত করে নিতে দেওয়া, যেটা এ মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে রয়েছে। ফারুক নিজের মাথায় পেরেক ঠুকেছেন, কারণ ভারত ও পাকিস্তান প্রায়ই এই নিয়ন্ত্রণরেখার লঙ্ঘন নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়।
সে তাদের আকাঙ্ক্ষা বা কৌশল যা-ই হোক না কেন, উভয় পক্ষকেই এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে নিয়ন্ত্রণরেখাই হলো আন্তর্জাতিক সীমানা। ভারত ও পাকিস্তান নিজে থেকে এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এ পর্যন্ত দুবার যুদ্ধ করেছে। তাদের হাতে এখন পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, ফলে তারা আর যুদ্ধ করতে পারে না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাঠানকোট হামলার পরে ভারতীয়দের ভীতি লাঘব করে ভালো কাজই করেছেন। তিনি আরও তত্ত্বতালাশ করছেন। কারণ ভারত তাঁকে যেসব তথ্য দিয়েছে, সেগুলোই যথেষ্ট নয়। তিনি মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত মাসউদ আজহারকে কারাবন্দী করেও ভালো করেছেন।
একই সঙ্গে দেশ দুটির পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এই হামলার পর বাতিল না হয়ে পুনর্নির্ধারিত হয়েছে, হামলার পর যেটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। নওয়াজ যে চাপের মুখে কাজ করছেন, নয়াদিল্লি তা বুঝতে পেরেছে। কারণ পাকিস্তানে শেষ কথাটা বলে সেনাবাহিনী। দেশটির সেনাপ্রধানের গুরুত্ব কতটা তা বোঝা যায় দুটি ঘটনা থেকে, নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইরান ও সৌদি আরবে নিয়ে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান যে বৈঠকেই থাকেন, নওয়াজ তাঁকে নিজের সমমর্যাদা দেন, এটা আমাকে দুঃখ দেয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ট্র্যাজেডি হচ্ছে, সেসব দেশে সেনাবাহিনী একবার সরকারের অংশীদার হয়ে গেলে তারা আর ব্যারাকে ফিরে যায় না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
No comments