মানবাধিকার কার মাথাব্যথার বিষয়? by মশিউল আলম

বাংলাদেশে দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা মন্তব্য করলে আমাদের সরকারগুলোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয় অত্যন্ত বিরূপ। আঁতে ঘা লাগলে ‘তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা’ কিংবা ‘পিত্তি জ্বলে যাওয়া’ বলতে যা বোঝায়, অতীতে একাধিক সরকারের আমলে আমরা মন্ত্রীদের সে রকম প্রতিক্রিয়া দেখেছি।
কিন্তু কয়েক দিন আগে নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। ৯০টির বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনের ‘বাংলাদেশ’ অধ্যায়ে মন্তব্য করা হয়েছে: ২০১৫ সালে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক দিকে এগিয়ে গেছে; দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত এসেছে; সরকার গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, আদালত অবমাননার অভিযোগ বা অস্পষ্ট আইনের আওতায় তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করেছে; নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ‘গুম’ (ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স), যথেচ্ছ গ্রেপ্তারসহ (আরবিট্র্যারি অ্যারেস্ট) মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন ঘটিয়েছে; যারা এসবের জন্য দায়ী, তাদের ব্যাপারে তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সামান্যই; নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিচারের ঊর্ধ্বে থাকার বা ‘ইমপিউনিটি’ ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে ইত্যাদি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই অভিযোগগুলো নিঃসন্দেহে গুরুতর এবং সরকারের মানমর্যাদার অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু সরকারের তরফে এ বিষয়ে কারও কোনো মন্তব্য-প্রতিক্রিয়ার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অতীতের অভিজ্ঞতার বিচারে এটা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এ বিষয়ে তিনি আপাতত কিছু বলবেন না, পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। কিন্তু তারপরে তিনি বা সরকারের অন্য কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি।
তাহলে কি সরকার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের সব বক্তব্য গ্রহণ করছে? এরপর কি সরকার ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ পথ থেকে সরে এসে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করবে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজের কর্মীদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য তৎপর হবে? এরপর কি ‘গুম’ ও যথেচ্ছ গ্রেপ্তার বন্ধ হবে? নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর যে সদস্যরা ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ইত্যাদি শিরোনামে একই গল্প বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাবেন, তাঁরা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকার, ‘ইমপিউনিটি’ ভোগ করার সুযোগ আর পাবেন না?
নাকি কোনো টুঁ শব্দ না করে, কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নীরবে উপেক্ষা করে যাওয়ার কৌশল এটা? এই নীরবতার মাধ্যমে সরকার কি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে চায় যে আমরা তোমাদের ভ্রুক্ষেপ করি না? তোমাদের নিন্দা-সমালোচনায় আমাদের কিছুই যায়-আসে না?
এ রকমই যদি সরকারের মনোভঙ্গি হতো, সত্যিই যদি আমাদের সরকার বাইরের পুরো পৃথিবীর নিন্দা-সমালোচনা অগ্রাহ্য করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে মাথা উঁচু করে চলতে পারত, তাহলে আমরা খুশি হতাম। কারণ, বিদেশিদের নিন্দা-সমালোচনা আমরাও শুনতে চাই না। তারা যখন আমাদের নিন্দা করে, সেই নিন্দা শুধু সরকারের গায়েই লাগে না, প্রত্যেক নাগরিকেরও গায়ে লাগে, গোটা জাতির গায়ে লাগে। স্বৈরতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু জাতি হিসেবে আমরা বহির্বিশ্বে পরিচিত হতে চাই না।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা-সমালোচনা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার সুযোগ আমাদের নেই। সরকার যদি তা করে, তবে সেই অগ্রাহ্য করাকে মেরুদণ্ড সোজা রেখে মাথা উঁচু করে চলার মতো দেখাবে না। দেখাবে উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে রাখার মতো।
দুই.
আমার দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটা চিত্র যদি আমি পেতে চাই, কার কাছে যাব? কাকে জিজ্ঞাসা করব?
প্রথমেই মনে আসে সরকারের কথা। সরকার নাগরিকদের জানাবে, এই হলো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। আগের চেয়ে তা ভালো হয়েছে, না আরও খারাপ হয়েছে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সেটাও জানাবে সরকারই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকার তা করে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলির তথ্য-উপাত্ত থাকে বলে ধারণা করি। কিন্তু তারা সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করে না। সাংবাদিকেরা চাইলে তা সব সময় দেয়ও না। তথ্য অধিকার আইন নামে আমাদের যে একটা আইন আছে, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভবত সে কথা ভুলে গেছে। ওই আইনে বলে দেওয়া হয়েছে, সরকারি সব কর্তৃপক্ষ, এমনকি বেসরকারি যেসব সংস্থা রাষ্ট্রীয় অর্থ পায়, তাদেরও সময়ে সময়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তথ্য অধিকার আইন যদি সত্যিই কার্যকর হতো, তাহলে আমরা র্যাব কিংবা পুলিশ বিভাগ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে পেয়ে যেতাম ২০১৫ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনে অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের মধ্যে আমরা দেখতে পেতাম, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের দ্বারা কী পরিস্থিতিতে কতজন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে, নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেছে কতজন, কতজন নিখোঁজ বা গুম হয়ে গেছে।
অথবা জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলো যদি সক্রিয়ভাবে কাজ করত, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারত।
মানবাধিকার কমিশন নামে আমাদের একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে; উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন আধা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সভ্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিবছরের শুরুতে আগের বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তসহ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি কমিশনের পর্যবেক্ষণ, সমালোচনা, পরামর্শ, সুপারিশ ইত্যাদিও থাকে। আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন আছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তি বা তাদের পরিবারগুলো কমিশনের কাছে যেসব অভিযোগ করেছে, সেসব অভিযোগের একটা ছক অবশ্য সেখানে আছে। কিন্তু ভুক্তভোগী সবাই মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ করে না; ফলে তাদের প্রাপ্ত অভিযোগের মোট যোগফলও বাস্তব পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে পারে না।
সরকারি ও রাষ্ট্রীয় তরফে যখন তথ্য-উপাত্তের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হয় না, তখন বিকল্প হয় বেসরকারি উৎস। এ দেশের দুটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার সূত্রের ওপরই আমরা প্রধানত নির্ভরশীল: আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকার। তারা তাদের সীমিত লোকবল ও অর্থবল দিয়ে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং বছর শেষে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অবশ্য এ কাজে তারা আবার নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমের ওপর। বিশেষত জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব খবর প্রকাশিত হয়, সেগুলো সংকলিত করে তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ের হিসাব দাঁড় করায়। তাদের এসব হিসাব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ব্যবহার করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদনেও আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটির মনগড়া চিত্র নয়; বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে গত এক বছরে পরিস্ফুট বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। আরও বিশদ তথ্য-উপাত্ত আছে এদেশীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে, সংবাদপত্রগুলোর পাতায় পাতায়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের দ্বারা নাগরিকদের প্রাণহানি। এই সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণহানির সংখ্যা বছরে বছরে বেড়ে চলেছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, এসব নিষ্ঠুর বেআইনি কাজ এখন র্যাবের তুলনায় বেশি ঘটছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হাতে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০১৩ সালে র্যাব সদস্যদের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২৪ আর পুলিশ সদস্যদের হাতে ছিল ১৭। ২০১৪ সালে র্যাব ৩৬ আর পুলিশ ৬৮! ২০১৫ সালে র্যাব ৪১, পুলিশ ৬৪। ক্রসফায়ারে মোট প্রাণহানির সংখ্যাও প্রতিবছর বেড়েছে: ২০১৩ সালে ৪২, ২০১৪ সালে ১২৭, ২০১৫ সালে ১২৮। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যদের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণহানির কথা আগে শোনা যায়নি। দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে ডিবি পুলিশের সদস্যদের হাতেও ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে ডিবির ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৯ জন; ২০১৫ সালে ১৩ জন। ‘ক্রসফায়ার’ ছাড়াও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, গ্রেপ্তারের আগে গুলি করে হত্যা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ না পাওয়া, খুবই কম ক্ষেত্রে মৃতদেহ উদ্ধার—এ ধরনের ঘটনাও বেড়েছে।
বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ, যার সংবিধান আছে, অপরাধ দমন করা ও সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য অনেক কঠোর আইন আছে, সক্রিয় আদালত আছে, অনেকগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আছে, বিশেষ আদালত আছে; পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি আছে। অর্থাৎ, আইনের শাসন দ্বারা দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন যদি বছরের পর বছর এভাবে ঘটেই চলে, তাহলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত: আমরা কী করছি? আমার দেশের জনগণের মানবাধিকার আসলে কার মাথাব্যথার বিষয়? বিদেশিদের?
না। এটা প্রথমত ও প্রধানত আমাদের সরকারেরই মাথাব্যথার বিষয়, সংবিধান যাকে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে, যে সরকার ও যার বাহিনীগুলো চলে জনগণের করের টাকায়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.