২৮ এপ্রিলের ভোট মডেল by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
নির্বাচন
নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেকের ধারণা ছিল, আমরা জিয়াউর রহমান ও এরশাদের
অসুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতি পেছনে ফেলে ক্রমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে
এগোচ্ছিলাম। ১৯৭৩-এর আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অনিয়মও আমরা ভুলে যেতে
চাই। ’৯০-এর পরে বেশ কিছু ভালো নির্বাচনের দৃষ্টান্ত আমরা ইতিমধ্যে স্থাপন
করেছি। ২০০৮ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা সবাই স্মরণ করেন। শুধু স্মরণ
করতে চান না তখন কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় ছিল না। নির্বাচন কমিশন
স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। সেই অবস্থা এখন আর নেই।
‘সুষ্ঠু ভোট’ ও ‘ভোটাধিকার’ বলে শুধু বক্তৃতা দিলে কাজ হবে না। সুষ্ঠু ভোট ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো কৌশলের কথা এখন থেকে ভাবতে হবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে, এরপর উপজেলা নির্বাচনের শেষ দিকের কয়েকটি পর্বে, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রহসনের পর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে কি আর আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে? নেই। কারণ, এই তিন সিটি নির্বাচন কোনো সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন ছিল না। তিন সিটিতেই যদি বিএনপি জয়লাভ করত, তাহলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন ক্ষতি হতো না। আমাদের ধারণা, একটি মেয়র পদেও বিএনপিকে জিততে না দেওয়ার কারণ নৈতিক পরাজয়ের ঝুঁকি। তখন পেট্রলবোমার কার্ডটি সরকার আর আরাম করে খেলতে পারত না। কাজেই ভোট-সন্ত্রাস ছাড়া সরকারের বিকল্প ছিল না।
সরকার নিজের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে সুষ্ঠু ভোট সংস্কৃতি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, জনগণের ভোটাধিকার ইত্যাদির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তাতে অবশ্য সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। বর্তমান সরকার মিডিয়াকে পাত্তা দেয় না, জাতিসংঘকে পাত্তা দেয় না, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রায় কাউকেই পাত্তা দেয় না। কারণ কী? এই সরকার পাঁচ বছরের জন্য ‘নির্বাচিত’ বলে একটি সরকারি গেজেটে বলা হয়েছে। এটাই সরকারের একমাত্র শক্তি। বলা বাহুল্য, এই শক্তিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের ধারণা, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়াই একটি দলের প্রধান শক্তি। আর কোনো কিছু তার প্রয়োজন নেই। একবার সরকার গঠন করতে পারলে বাকি সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, কিছু মিডিয়া ও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি সরকারের কাছে অবনত হয়ে থাকে। এটাই আমাদের ঐতিহ্য ও বাস্তবতা। এসব সত্ত্বেও অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, সংগঠন, মিডিয়া সরকারের নানা সমালোচনা করবে। এতে সরকারের কিছুই যায় আসে না। জাতিসংঘ, আমেরিকা, অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনা গায়ে না মাখলেই হলো। কথায় বলে, ‘যার দু’কান কাটা তার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই’। বর্তমান সরকার সে রকম একটা মডেল উপহার দিয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য দলের সরকারও তা ব্যবহার করতে পারবে।
সিটি করপোরেশনের মতো নির্বাচনেও সরকার, সরকারি দল, অঙ্গ দল কী সন্ত্রাস করতে পারে, তা সবাই দেখেছেন। নির্বাচন কমিশনকেও দেখেছেন। এখন ভাবুন, ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনের যে নির্বাচন হবে, তা কেমন হবে?
এ দেশের নির্বাচন ইস্যুতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সরকারি দলের সমর্থকেরা বারবার বলেছেন, ‘অতীতে বিএনপি আমলেও (২০০১) ভোট-সন্ত্রাস হয়েছে।’ কে অস্বীকার করছে? কিন্তু আমরা তো ২০০১-এর কালো অধ্যায় পেরিয়ে ২০০৮-এ সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি। ২০১৪-তে তো ২০০৮-এর চেয়েও উন্নত মানের নির্বাচন হওয়ার কথা। ২০০৮-এর চেয়েও কড়া নির্বাচন কমিশন দেখার কথা। তা কি হয়েছে?
সবাই আশা করেছিল ২৮ এপ্রিল একটি সুন্দর ভোট হবে। কিন্তু সবার চোখের সামনে, মিডিয়ার সামনে, কিছু টিভি চ্যানেলের লাইভ কভারেজের সামনে এমন সব ঘটনা ঘটে গেল, যা শুধু অপ্রত্যাশিত নয়, অকল্পনীয়ও বটে। মনে হলো, আমরা জিয়া, এরশাদ জমানায় আবার ফিরে যাচ্ছি। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বাতিলে আওয়ামী লীগের এত উৎসাহ কেন, তা আরও স্পষ্ট হলো জনগণের সামনে। ‘নির্বাচন কমিশন’ যদি আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন হয়, তাহলে এ রকম নির্বাচন করেও যে জয়ী হওয়া কোনো বাধা নয়, এটা সরকার জানে। তা ছাড়া, এই সরকার তো বেশি বিদেশি, জাতিসংঘ কারও সমালোচনাই তোয়াক্কা করে না। দু’কান কাটা হলে যা হয়।
২৮ এপ্রিলের ভোট মডেলটি বিরোধী দলের জন্য খুব ভয়ংকর। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী কর্মকর্তা, আনসার, পুলিশ সবার সহযোগিতায় (ব্যতিক্রম ছাড়া) এ রকম ভোট-সন্ত্রাস হলে সেখানে তারা কী করতে পারে? সিটি নির্বাচনের মতো স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনেই যদি সরকারি দল এ রকম ভোট–সন্ত্রাস করে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনে সরকার, সরকারি দল ও অন্যরা কী করতে পারে, তা এখন থেকে বিরোধী দলকে ভাবতে হবে। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত সবকিছু সুন্দর, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশেই হয়তো হবে। যেমন ২৮ এপ্রিলের ভোটে হয়েছে। কিন্তু ভোটের দিন কী হবে, তা আগাম কেউ ভাবতে পারেনি। তবে এবার ভাবতে পারবে। যত ভোট–সন্ত্রাসই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশন যদি তা আমলে না নেয় (যেমন এবার হয়েছে) তাহলে বিরোধী দলের কিছুই করার থাকবে না। যত বেশি ভোট–সন্ত্রাস হবে, তত দ্রুত ফলাফলের গেজেট ছাপা হবে। কারণ, সরকারি দলের দরকার ওই গেজেট। বাকি সব বাকির খাতায়। ‘নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল’ নামে একটি স্তর আছে বটে, তবে তা দিয়ে কোনো দল বা প্রার্থী অতীতে সুবিচার পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কাজেই সরকারি দল ভোট-সন্ত্রাস করলে বিরোধী দলের জেতার কোনো সুযোগই নেই। বিরোধী দল পাল্টা ভোট-সন্ত্রাস করতে চাইলেও সুবিধা করতে পারবে না। এ রকম অবস্থায় শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ ভোটার (যার এক বড় অংশ নারী) আর ভোট দিতে যাবে না। জাল ভোটের বাক্স ভর্তি করার সুযোগ এতে আরও বেড়ে যাবে। যেমনটি ২৮ এপ্রিল হয়েছে।
কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে বিরোধী দলকে ২৮ এপ্রিলের ভোট অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংসদ নির্বাচন ক্ষমতা বদলের নির্বাচন। বর্তমান সরকার তাদের আমলে যা যা করেছে, তাতে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তারা কোনোভাবেই নিতে পারবে না। কাজেই বর্তমান সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত (পরোক্ষভাবে) আগামী সংসদ নির্বাচন ২৮ এপ্রিলের ভোট প্রহসনের চেয়ে আরও ভয়ংকর কিছু হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। প্রত্যেক ভোটার যেন তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। জনগণ চায় একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। যারা প্রত্যেক দল বা প্রার্থীর প্রতি একই আচরণ করবে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে আমরা তা পাচ্ছি না। যথারীতি ভোটের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু একে ভোট বলা চলে না। অথচ এই দেশেই ২০০৮ সালে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তাহলে ২০১৫ সালে আমরা তা পারছি না কেন?
জনগণ সবচেয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। এখন জনগণকে ভাবতে হবে কী পদক্ষেপ নিলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রকৃত ভোটের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ২৮ এপ্রিলের ভোট ‘সাফল্য’ আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। এই মডেল তারা ভবিষ্যতেও প্রয়োগ করতে পারে। কাজেই বিরোধী দল, সাধারণ ভোটার ও মিডিয়া—সবাইকে এখন থেকে ভাবতে হবে কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে সরকার, সরকারি দল এ রকম ভোট-সন্ত্রাস করতে সাহস করবে না। মনে রাখতে হবে, আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই নির্বাচনে তারা যেকোনো মূল্যে জিততে চাইবে। কাজেই ‘সুষ্ঠু ভোট’ ও ‘ভোটাধিকার’ বলে শুধু বক্তৃতা দিলে কাজ হবে না। সুষ্ঠু ভোট ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো কৌশলের কথা এখন থেকে ভাবতে হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
‘সুষ্ঠু ভোট’ ও ‘ভোটাধিকার’ বলে শুধু বক্তৃতা দিলে কাজ হবে না। সুষ্ঠু ভোট ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো কৌশলের কথা এখন থেকে ভাবতে হবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে, এরপর উপজেলা নির্বাচনের শেষ দিকের কয়েকটি পর্বে, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রহসনের পর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে কি আর আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে? নেই। কারণ, এই তিন সিটি নির্বাচন কোনো সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন ছিল না। তিন সিটিতেই যদি বিএনপি জয়লাভ করত, তাহলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন ক্ষতি হতো না। আমাদের ধারণা, একটি মেয়র পদেও বিএনপিকে জিততে না দেওয়ার কারণ নৈতিক পরাজয়ের ঝুঁকি। তখন পেট্রলবোমার কার্ডটি সরকার আর আরাম করে খেলতে পারত না। কাজেই ভোট-সন্ত্রাস ছাড়া সরকারের বিকল্প ছিল না।
সরকার নিজের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে সুষ্ঠু ভোট সংস্কৃতি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, জনগণের ভোটাধিকার ইত্যাদির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তাতে অবশ্য সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। বর্তমান সরকার মিডিয়াকে পাত্তা দেয় না, জাতিসংঘকে পাত্তা দেয় না, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রায় কাউকেই পাত্তা দেয় না। কারণ কী? এই সরকার পাঁচ বছরের জন্য ‘নির্বাচিত’ বলে একটি সরকারি গেজেটে বলা হয়েছে। এটাই সরকারের একমাত্র শক্তি। বলা বাহুল্য, এই শক্তিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের ধারণা, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়াই একটি দলের প্রধান শক্তি। আর কোনো কিছু তার প্রয়োজন নেই। একবার সরকার গঠন করতে পারলে বাকি সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, কিছু মিডিয়া ও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি সরকারের কাছে অবনত হয়ে থাকে। এটাই আমাদের ঐতিহ্য ও বাস্তবতা। এসব সত্ত্বেও অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, সংগঠন, মিডিয়া সরকারের নানা সমালোচনা করবে। এতে সরকারের কিছুই যায় আসে না। জাতিসংঘ, আমেরিকা, অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনা গায়ে না মাখলেই হলো। কথায় বলে, ‘যার দু’কান কাটা তার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই’। বর্তমান সরকার সে রকম একটা মডেল উপহার দিয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য দলের সরকারও তা ব্যবহার করতে পারবে।
সিটি করপোরেশনের মতো নির্বাচনেও সরকার, সরকারি দল, অঙ্গ দল কী সন্ত্রাস করতে পারে, তা সবাই দেখেছেন। নির্বাচন কমিশনকেও দেখেছেন। এখন ভাবুন, ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনের যে নির্বাচন হবে, তা কেমন হবে?
এ দেশের নির্বাচন ইস্যুতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সরকারি দলের সমর্থকেরা বারবার বলেছেন, ‘অতীতে বিএনপি আমলেও (২০০১) ভোট-সন্ত্রাস হয়েছে।’ কে অস্বীকার করছে? কিন্তু আমরা তো ২০০১-এর কালো অধ্যায় পেরিয়ে ২০০৮-এ সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি। ২০১৪-তে তো ২০০৮-এর চেয়েও উন্নত মানের নির্বাচন হওয়ার কথা। ২০০৮-এর চেয়েও কড়া নির্বাচন কমিশন দেখার কথা। তা কি হয়েছে?
সবাই আশা করেছিল ২৮ এপ্রিল একটি সুন্দর ভোট হবে। কিন্তু সবার চোখের সামনে, মিডিয়ার সামনে, কিছু টিভি চ্যানেলের লাইভ কভারেজের সামনে এমন সব ঘটনা ঘটে গেল, যা শুধু অপ্রত্যাশিত নয়, অকল্পনীয়ও বটে। মনে হলো, আমরা জিয়া, এরশাদ জমানায় আবার ফিরে যাচ্ছি। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বাতিলে আওয়ামী লীগের এত উৎসাহ কেন, তা আরও স্পষ্ট হলো জনগণের সামনে। ‘নির্বাচন কমিশন’ যদি আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন হয়, তাহলে এ রকম নির্বাচন করেও যে জয়ী হওয়া কোনো বাধা নয়, এটা সরকার জানে। তা ছাড়া, এই সরকার তো বেশি বিদেশি, জাতিসংঘ কারও সমালোচনাই তোয়াক্কা করে না। দু’কান কাটা হলে যা হয়।
২৮ এপ্রিলের ভোট মডেলটি বিরোধী দলের জন্য খুব ভয়ংকর। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী কর্মকর্তা, আনসার, পুলিশ সবার সহযোগিতায় (ব্যতিক্রম ছাড়া) এ রকম ভোট-সন্ত্রাস হলে সেখানে তারা কী করতে পারে? সিটি নির্বাচনের মতো স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনেই যদি সরকারি দল এ রকম ভোট–সন্ত্রাস করে, তাহলে সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনে সরকার, সরকারি দল ও অন্যরা কী করতে পারে, তা এখন থেকে বিরোধী দলকে ভাবতে হবে। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত সবকিছু সুন্দর, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশেই হয়তো হবে। যেমন ২৮ এপ্রিলের ভোটে হয়েছে। কিন্তু ভোটের দিন কী হবে, তা আগাম কেউ ভাবতে পারেনি। তবে এবার ভাবতে পারবে। যত ভোট–সন্ত্রাসই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশন যদি তা আমলে না নেয় (যেমন এবার হয়েছে) তাহলে বিরোধী দলের কিছুই করার থাকবে না। যত বেশি ভোট–সন্ত্রাস হবে, তত দ্রুত ফলাফলের গেজেট ছাপা হবে। কারণ, সরকারি দলের দরকার ওই গেজেট। বাকি সব বাকির খাতায়। ‘নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল’ নামে একটি স্তর আছে বটে, তবে তা দিয়ে কোনো দল বা প্রার্থী অতীতে সুবিচার পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কাজেই সরকারি দল ভোট-সন্ত্রাস করলে বিরোধী দলের জেতার কোনো সুযোগই নেই। বিরোধী দল পাল্টা ভোট-সন্ত্রাস করতে চাইলেও সুবিধা করতে পারবে না। এ রকম অবস্থায় শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ ভোটার (যার এক বড় অংশ নারী) আর ভোট দিতে যাবে না। জাল ভোটের বাক্স ভর্তি করার সুযোগ এতে আরও বেড়ে যাবে। যেমনটি ২৮ এপ্রিল হয়েছে।
কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে বিরোধী দলকে ২৮ এপ্রিলের ভোট অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংসদ নির্বাচন ক্ষমতা বদলের নির্বাচন। বর্তমান সরকার তাদের আমলে যা যা করেছে, তাতে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তারা কোনোভাবেই নিতে পারবে না। কাজেই বর্তমান সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত (পরোক্ষভাবে) আগামী সংসদ নির্বাচন ২৮ এপ্রিলের ভোট প্রহসনের চেয়ে আরও ভয়ংকর কিছু হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। প্রত্যেক ভোটার যেন তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। জনগণ চায় একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। যারা প্রত্যেক দল বা প্রার্থীর প্রতি একই আচরণ করবে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে আমরা তা পাচ্ছি না। যথারীতি ভোটের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু একে ভোট বলা চলে না। অথচ এই দেশেই ২০০৮ সালে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তাহলে ২০১৫ সালে আমরা তা পারছি না কেন?
জনগণ সবচেয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। এখন জনগণকে ভাবতে হবে কী পদক্ষেপ নিলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রকৃত ভোটের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ২৮ এপ্রিলের ভোট ‘সাফল্য’ আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। এই মডেল তারা ভবিষ্যতেও প্রয়োগ করতে পারে। কাজেই বিরোধী দল, সাধারণ ভোটার ও মিডিয়া—সবাইকে এখন থেকে ভাবতে হবে কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে সরকার, সরকারি দল এ রকম ভোট-সন্ত্রাস করতে সাহস করবে না। মনে রাখতে হবে, আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই নির্বাচনে তারা যেকোনো মূল্যে জিততে চাইবে। কাজেই ‘সুষ্ঠু ভোট’ ও ‘ভোটাধিকার’ বলে শুধু বক্তৃতা দিলে কাজ হবে না। সুষ্ঠু ভোট ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কোনো কৌশলের কথা এখন থেকে ভাবতে হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments