২৫শে মার্চেই ইন্দিরা সীমান্ত খোলার নির্দেশ দেন by প্রণব মুখার্জি
সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা...
(পঞ্চম কিস্তি)
জেনারেল
ইয়াহিয়া খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসন এবং
প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির নির্বাচন ঘোষণা করলেন। জনসংখ্যার আঞ্চলিক অনুপাতে
৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২ আসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। বাকি ১৩৮ আসন ছিল পশ্চিম
পাকিস্তানের। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬২টি আসনের মধ্যে
১৬০টি আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করলো। তারা প্রাদেশিক
নির্বাচনেও ভাল করলো, পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেল।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের শর্ত পূরণ করতে হলে মুজিবুরকেই সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হয়। কিন্তু ওই যুক্তি বাস্তবে কঠোর বিরোধিতার সম্মুখীন হলো। ইয়াহিয়া খান যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করবেন। পাকিস্তানি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, সেনাবাহিনীর সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ এবং দৃঢ় কায়েমি স্বার্থ (সেনাবাহিনী, শিল্পপতি এবং উচ্চপর্যায়ের আমলাতন্ত্রের) রক্ষার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেয়া হয়নি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ৮০ ভাগের বেশি আসন লাভ করেছেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী বৃহত্তম দলের মধ্যে প্যারিটি বা সমতা চাইলেন। আর এভাবেই গণতন্ত্রের পয়লা শর্ত অগ্রাহ্য হলো। ১৯৭১ সালের ২৭শে জানুয়ারি ভুট্টো এই প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় এলেন। এবং মুজিবের সঙ্গে পরবর্তী তিন ধরে এক আলোচনায় বসলেন। আলোচনা ব্যর্থ হলো। ভুট্টো তখন দাবি করলেন যে, পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট উভয় অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তার মানে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে বাতিল করে দিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিবিরোধী শক্তিশালী লবির চাপে ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। এবং ওই অধিবেশন স্থগিত করতে না করতেই পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।
৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আবেদন জানালেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রাম।... তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি এবং আরো দেব। আমরা স্বাধীন হব ইনশাআল্লাহ।’
৭ই মার্চ থেকে মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকারের সঙ্গে পূর্ণ অসহযোগিতার ডাক দিল। ৭ থেকে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত দুটি সরকার ছিল। আইনগতভাবে একটি ‘ডি জুরে’ সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াহিয়া খান। আর ডি ফ্যাক্টো বা কার্যত সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন মুজিবুর রহমান। এবারে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর মতোই অচলাবস্থা নিরসনে মুজিবুর রহমানর সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকা সফরে গেলেন। কিন্তু সামরিক জান্তা, যারা পাকিস্তানি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র, মুজিবুর রহমানের দাবি মেনে নিতে তাদের কোন ইচ্ছাই ছিল না। আলোচনার নামে ১৬ থেকে ২৪শে মার্চ সময়ের মধ্যে তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও গোলাবারুদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনার কাজে ব্যয় করল।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঘোষণা দিলেন যে, মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওই রাত নয়টা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর হামলা চালালো। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে আক্রমণ করল। মুজিবুর রহমান তার আসন্ন গ্রেপ্তার আঁচ করতে পেরে একই রাতে ঘোষণা দিলেন যে:
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা যে যেখানেই থাকুন সর্বশক্তি শক্তি দিয়ে দখলদার বাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার সেনাবাহিনীর শেষ সৈনিককে বহিষ্কার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে নেবেন।’
এই ঘোষণা বেতার, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে দেয়া হলো। ২৫-২৬ মার্চের রাত দেড়টায় মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলো এবং তাকে ঢাকার সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে নিয়ে যাওয়ার আগের তিনদিন তাকে সেখানেই অন্তরীণ রাখা হয়। ইয়াহিয়া খান ২৬শে মার্চে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মুজিবের নিন্দা করেন।
১০ই এপ্রিলে মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে (অনুপস্থিতিতে) একটি প্রবাসী সরকার ঘোষণা করা হলো। এবং পূর্ব পাকিস্তানের কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে এটি মুজিবনগর হিসেবে পরিচিত হয়) ১৭ই এপ্রিল বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
পরবর্তী মাসগুলোতে রক্তপিপাসুদের নৃশংসতা, গণহত্যা, নির্বিচারে ধর্ষণ চলল, যার পরিণতিতে প্রথমে এক কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেন এবং তারা সংলগ্ন ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নিলেন এবং পরে তা একটি বীরোচিত, একটি সফল, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে রূপ নিল। পাক-ভারত ১৩ দিনের যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯১ হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও সৈন্যসহ ভারত-বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।
আমাদের অনেকেই তখনকার ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ প্রতিবেশী ভারতের রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিতে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, আর তাদের অসহায়ত্ব এবং বহুমুখী দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার শিকার হওয়া আমাদের জনগণের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে।
পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিক্রিয়া হওয়ার বহুবিধ বিষয় ছিল, যার মধ্যে কেবল ১৯৭১ সালের মার্চের সাধারণ নির্বাচনে ‘ইন্দিরা ঢেউ’ এর কারণে ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত আলোচিত বিজয় ছিল না।
‘নেহরুর আমল থেকে দলের অভ্যন্তরে এবং বিরোধী দলের অবাধ্য ব্যক্তিদের মোকাবিলা করতে এরকম একজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আর দেখা যায়নি এবং ক্ষমতার বলয় বিশেষ করে ১৯৭১ সালের আঞ্চলিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে বিদেশ নীতিতে করণীয় নির্ধারণে মিসেস গান্ধী তার পিতার মতোই একজন সুদক্ষ এবং খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম নেতার পরিচয় দেন’ ( রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, ওয়ার এন্ড সেসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া এন্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, নিউ দিল্লি, ১৯৯০)।
উপরন্তু মানবাধিকার রক্ষায় পাশে দাঁড়াতে ভারতের ইতিহাস ছিল। ১৯৪৯ সালের গোড়াতেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘যেখানে স্বাধীনতা বিপন্ন কিংবা বিচার হুমকির মুখে কিংবা যেখানে আগ্রাসন জায়গা করে নিয়েছে, সেখানে আমরা নিরপেক্ষ থাকতে পারি না এবং পারব না।’ ইন্দিরা গান্ধী সেই পথ অনুসরণ করলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতের সমর্থনের হস্ত প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে তিনি বিনা দ্বিধায় পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর দর্শনকে বাস্তবে রূপায়ণ করলেন।
অন্য যে কারণটি বেশি জরুরি ছিল তা হল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর আশ্রয় গ্রহণ করা।
‘ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক হিসেব নিকেশে অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে দেখাটা বড় হয়ে উঠল। ... উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে লাখ লাখ মানুষের আশ্রয় দান তাদের শিবিরগুলো নির্মাণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণের সরকারি প্রাক্কলন ভারতের সম্পদের তুলনায় ছিল অতি বৃহৎ। কারণ তা উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য নির্ধারিত বাজেট বরাদ্দে এবং দেশের কষ্টার্জিত উদ্বৃত্ত গমের প্রতি তা একটা বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছিল।’ (রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, ওয়ার এন্ড সেসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া এন্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, নিউ দিল্লি, ১৯৯০)
তবে অর্থনৈতিক ফ্যাক্টর ভারতের একমাত্র উদ্বেগের কারণ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে ভারত সরকারের জন্য ভিন্ন ধরনের একটি সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। উভয় রাজ্যে বিশেষ করে ত্রিপুরায় আকস্মিকভাবে বিশ থেকে ত্রিশ লাখ উদ্বাস্তু প্রবেশ করার ফলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ জটিল উপজাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতি হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এর ফলে উপজাতি ও অ-উপজাতীয় যে জনসংখ্যা রাজ্যে ছিল, তা এখন উপজাতিদের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। আর এটাই তুলনামূলক শান্ত এলাকায় নতুন ইস্যু ও সমস্যার উদ্ভব ঘটার শংকা তৈরি করে। (রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, প্রাগুক্ত)
ইন্দিরা গান্ধী আগ্রহের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ২৫শে মার্চে তিনি এক আদেশ জারি করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত খুলে রাখতে হবে, যাতে উদ্বাস্তুরা নিরাপদে ভারতে প্রবেশ করতে পারেন। কেবল তাই নয়, তিনি আরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের ভারতে বরণ করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। ৩০শে মার্চে ইন্দিরা গান্ধী উভয় কক্ষে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর একটি রেজুলেশন উত্থাপন করেন এবং সেখানে তিনি ভারত সরকারের ভূমিকা কি হবে সে বিষয়ে একটি রূপরেখা দেন।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের শর্ত পূরণ করতে হলে মুজিবুরকেই সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হয়। কিন্তু ওই যুক্তি বাস্তবে কঠোর বিরোধিতার সম্মুখীন হলো। ইয়াহিয়া খান যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করবেন। পাকিস্তানি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, সেনাবাহিনীর সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ এবং দৃঢ় কায়েমি স্বার্থ (সেনাবাহিনী, শিল্পপতি এবং উচ্চপর্যায়ের আমলাতন্ত্রের) রক্ষার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেয়া হয়নি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ৮০ ভাগের বেশি আসন লাভ করেছেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী বৃহত্তম দলের মধ্যে প্যারিটি বা সমতা চাইলেন। আর এভাবেই গণতন্ত্রের পয়লা শর্ত অগ্রাহ্য হলো। ১৯৭১ সালের ২৭শে জানুয়ারি ভুট্টো এই প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় এলেন। এবং মুজিবের সঙ্গে পরবর্তী তিন ধরে এক আলোচনায় বসলেন। আলোচনা ব্যর্থ হলো। ভুট্টো তখন দাবি করলেন যে, পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট উভয় অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তার মানে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে বাতিল করে দিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিবিরোধী শক্তিশালী লবির চাপে ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। এবং ওই অধিবেশন স্থগিত করতে না করতেই পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।
৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আবেদন জানালেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রাম।... তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি এবং আরো দেব। আমরা স্বাধীন হব ইনশাআল্লাহ।’
৭ই মার্চ থেকে মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকারের সঙ্গে পূর্ণ অসহযোগিতার ডাক দিল। ৭ থেকে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত দুটি সরকার ছিল। আইনগতভাবে একটি ‘ডি জুরে’ সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াহিয়া খান। আর ডি ফ্যাক্টো বা কার্যত সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন মুজিবুর রহমান। এবারে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর মতোই অচলাবস্থা নিরসনে মুজিবুর রহমানর সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকা সফরে গেলেন। কিন্তু সামরিক জান্তা, যারা পাকিস্তানি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র, মুজিবুর রহমানের দাবি মেনে নিতে তাদের কোন ইচ্ছাই ছিল না। আলোচনার নামে ১৬ থেকে ২৪শে মার্চ সময়ের মধ্যে তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও গোলাবারুদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনার কাজে ব্যয় করল।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঘোষণা দিলেন যে, মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওই রাত নয়টা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর হামলা চালালো। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে আক্রমণ করল। মুজিবুর রহমান তার আসন্ন গ্রেপ্তার আঁচ করতে পেরে একই রাতে ঘোষণা দিলেন যে:
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা যে যেখানেই থাকুন সর্বশক্তি শক্তি দিয়ে দখলদার বাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার সেনাবাহিনীর শেষ সৈনিককে বহিষ্কার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে নেবেন।’
এই ঘোষণা বেতার, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে দেয়া হলো। ২৫-২৬ মার্চের রাত দেড়টায় মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলো এবং তাকে ঢাকার সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে নিয়ে যাওয়ার আগের তিনদিন তাকে সেখানেই অন্তরীণ রাখা হয়। ইয়াহিয়া খান ২৬শে মার্চে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মুজিবের নিন্দা করেন।
১০ই এপ্রিলে মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে (অনুপস্থিতিতে) একটি প্রবাসী সরকার ঘোষণা করা হলো। এবং পূর্ব পাকিস্তানের কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (পরে এটি মুজিবনগর হিসেবে পরিচিত হয়) ১৭ই এপ্রিল বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
পরবর্তী মাসগুলোতে রক্তপিপাসুদের নৃশংসতা, গণহত্যা, নির্বিচারে ধর্ষণ চলল, যার পরিণতিতে প্রথমে এক কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলেন এবং তারা সংলগ্ন ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নিলেন এবং পরে তা একটি বীরোচিত, একটি সফল, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে রূপ নিল। পাক-ভারত ১৩ দিনের যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯১ হাজারের বেশি কর্মকর্তা ও সৈন্যসহ ভারত-বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।
আমাদের অনেকেই তখনকার ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ প্রতিবেশী ভারতের রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিতে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, আর তাদের অসহায়ত্ব এবং বহুমুখী দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার শিকার হওয়া আমাদের জনগণের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে।
পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিক্রিয়া হওয়ার বহুবিধ বিষয় ছিল, যার মধ্যে কেবল ১৯৭১ সালের মার্চের সাধারণ নির্বাচনে ‘ইন্দিরা ঢেউ’ এর কারণে ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত আলোচিত বিজয় ছিল না।
‘নেহরুর আমল থেকে দলের অভ্যন্তরে এবং বিরোধী দলের অবাধ্য ব্যক্তিদের মোকাবিলা করতে এরকম একজন শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আর দেখা যায়নি এবং ক্ষমতার বলয় বিশেষ করে ১৯৭১ সালের আঞ্চলিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে বিদেশ নীতিতে করণীয় নির্ধারণে মিসেস গান্ধী তার পিতার মতোই একজন সুদক্ষ এবং খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম নেতার পরিচয় দেন’ ( রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, ওয়ার এন্ড সেসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া এন্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, নিউ দিল্লি, ১৯৯০)।
উপরন্তু মানবাধিকার রক্ষায় পাশে দাঁড়াতে ভারতের ইতিহাস ছিল। ১৯৪৯ সালের গোড়াতেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘যেখানে স্বাধীনতা বিপন্ন কিংবা বিচার হুমকির মুখে কিংবা যেখানে আগ্রাসন জায়গা করে নিয়েছে, সেখানে আমরা নিরপেক্ষ থাকতে পারি না এবং পারব না।’ ইন্দিরা গান্ধী সেই পথ অনুসরণ করলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতের সমর্থনের হস্ত প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে তিনি বিনা দ্বিধায় পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর দর্শনকে বাস্তবে রূপায়ণ করলেন।
অন্য যে কারণটি বেশি জরুরি ছিল তা হল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর আশ্রয় গ্রহণ করা।
‘ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক হিসেব নিকেশে অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে দেখাটা বড় হয়ে উঠল। ... উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে লাখ লাখ মানুষের আশ্রয় দান তাদের শিবিরগুলো নির্মাণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণের সরকারি প্রাক্কলন ভারতের সম্পদের তুলনায় ছিল অতি বৃহৎ। কারণ তা উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য নির্ধারিত বাজেট বরাদ্দে এবং দেশের কষ্টার্জিত উদ্বৃত্ত গমের প্রতি তা একটা বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছিল।’ (রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, ওয়ার এন্ড সেসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া এন্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, নিউ দিল্লি, ১৯৯০)
তবে অর্থনৈতিক ফ্যাক্টর ভারতের একমাত্র উদ্বেগের কারণ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে ভারত সরকারের জন্য ভিন্ন ধরনের একটি সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। উভয় রাজ্যে বিশেষ করে ত্রিপুরায় আকস্মিকভাবে বিশ থেকে ত্রিশ লাখ উদ্বাস্তু প্রবেশ করার ফলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ জটিল উপজাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতি হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এর ফলে উপজাতি ও অ-উপজাতীয় যে জনসংখ্যা রাজ্যে ছিল, তা এখন উপজাতিদের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। আর এটাই তুলনামূলক শান্ত এলাকায় নতুন ইস্যু ও সমস্যার উদ্ভব ঘটার শংকা তৈরি করে। (রিচার্ড সিসন ও লি রোজ, প্রাগুক্ত)
ইন্দিরা গান্ধী আগ্রহের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ২৫শে মার্চে তিনি এক আদেশ জারি করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত খুলে রাখতে হবে, যাতে উদ্বাস্তুরা নিরাপদে ভারতে প্রবেশ করতে পারেন। কেবল তাই নয়, তিনি আরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের ভারতে বরণ করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। ৩০শে মার্চে ইন্দিরা গান্ধী উভয় কক্ষে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর একটি রেজুলেশন উত্থাপন করেন এবং সেখানে তিনি ভারত সরকারের ভূমিকা কি হবে সে বিষয়ে একটি রূপরেখা দেন।
(সম্প্রতি
ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ
নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স
প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ:
দি মেকিং অব বাংলাদেশ’ এর অবিকল তরজমা)
No comments