নারী লাঞ্ছনা- রাষ্ট্রের জবাবদিহি by সালমা খান
ঘরে-বাইরে
কোথাও নারী নিরাপদ নয়। একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের দ্বারাও
নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে নারী নিগ্রহ নিয়ে লিখেছেন নারী
নেত্রী সালমা খান
পয়লা বৈশাখে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, যেখানে তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে প্রকাশ্যে নারী নিগ্রহের ঘটনাকে ধিক্কার দিয়ে অনেক সমালোচনার টেবিল মুখর হয়েছে, দেশব্যাপী নারী সংগঠনগুলো অব্যাহত প্রতিবাদ মিছিল ও মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধনের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে দেশের বৃহত্তর সমাজে এর তেমন প্রভাব পড়ছে না। পুরুষশাসিত সমাজ যে এখেনা যৌন হয়রানি ও নারীর শ্লীলতাহানিকে ‘ছোট্ট একটু দুষ্টামি’ মনে করে তা আবার প্রমাণিত হলো যখন দেখি তথাকথিত কিছু পুরুষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাজধানীর জনবহুল এলাকা থেকে সন্ধ্যারাতে (রাত নয়টা) একজন তরুণীকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করতে দ্বিধা করে না। মাত্র দিন দশেক আগে নারায়ণগঞ্জে এক নারী পোশাককর্মী কাজের পর বাড়ি ফিরতে বাসে উঠে ক্লান্তিবশত একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন। এর আগেও ময়মনসিংহ, সাভার ও মানিকগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা ঘটে (সূত্র: প্রথম আলো)। সাধারণ নারীর নিরাপত্তাই যেখানে উদ্বেগের বিষয়, সে ক্ষেত্রে কর্মজীবী নারী, যাঁদের কাজ শেষে গণপরিবহন ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প নেই, তঁাদের জন্য রাষ্ট্র কি সুরক্ষা দেবে? উপর্যুপরি এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অপরাধী ধরা না পড়ায় অথবা বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে অপরাধীরা কতখানি বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
পৃথিবীর সব সভ্য দেশে ট্যাক্সিসহ সব গণপরিবহনে ড্রাইভারের সিটের পেছনে গাড়ির নম্বর ও ড্রাইভারের ছবিসহ আইডি ঝুলিয়ে রাখার নিয়ম আছে, যাতে করে যাত্রী চালক ও পরিবহনটিকে শনাক্ত করতে পারে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির কাজ এটি এবং অবিলম্বে সব সরকারি, বেসরকারি বাস, সিএনজি ইত্যাদিতে এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া আইনত চালু করা হোক। এ ছাড়া প্রতি বাসস্ট্যান্ড ও সড়কসমূহের যেখানে কারখানা, দোকান ইত্যাদি অবস্থিত, সেখানে আলো জোরদারকরণ ও মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হোক।
বিগত চার দশকে মানব উন্নয়ন সূচকে আমাদের অভাবনীয় উন্নতি যা একদিকে আমাদের দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং বাংলাদেশকে সহস্রাব্দ লক্ষ্যে পৌঁছাতেও সহায়ক হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি এ দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীর উচ্চহারে অংশগ্রহণ। এই অর্জনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উজ্জ্বল উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়।
বিবিএসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিক বেশি, বর্তমানে দেশে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন, আর নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২১ লাখ ১২ হাজার ৮৩০ জন। তা সত্ত্বেও শ্রমজীবী নারী ন্যূনতম নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। ঘরে–বাইরে কোথাও নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। নারীর প্রতি সহিংসতা–সংক্রান্ত বিবিএস কর্তৃক প্রথম জাতীয় জরিপে (২০১৪) দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ নারী নিজ গৃহে স্বামী দ্বারা মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তাই বলা যায় এ দেশের পুরুষেরা নারী নির্যাতনের প্রথম শিক্ষাটা পায় পারিবারিক প্রথা থেকে, যেটা পরবর্তী জীবনে সে ধারণ করে সামাজিক ও গণজীবনে।
সব দেশেই রকমভেদে নারী নির্যাতনের শিকার হয়, কিন্তু উন্নত বিশ্বে পরিবারে লিঙ্গ-সমতার সংস্কৃতি থাকায় বৃহত্তর জীবনে শিক্ষার মাধ্যমে পরিশীলিত একটি লিঙ্গসম্পর্ক নারী পুরুষের মধ্যে বিরাজ করে, যা নারী নির্যাতন হ্রাসে সহায়ক হয়। নারী নির্যাতন তখন বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত হয়। উপরন্তু আইন সেখানে প্রকৃতই নিজের গতিতে চলে—দল-মত-ব্যক্তিনির্বিশেষে অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কর্তৃপক্ষ তৎপর থাকে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে আমাদের অচিরেই নারী নির্যাতন নিরসনের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি উদারমনস্ক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক ভিত্তি হলো পরিশীলিত সমমর্যাদাভিত্তিক লিঙ্গসম্পর্ক। আমাদের পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিচর্চা ও আইনি কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে প্রতি ক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
দেরিতে হলেও সম্প্রতি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা তৎপর হয়েছে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী লাঞ্ছনার বিচার হয়েছে, পয়লা বৈশাখের ঘটনার কিছু অপরাধী শনাক্তকরণ হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে বাসে পোশাককর্মীকে ধর্ষণকারী একজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
আমরা আশা করব, পুলিশি তৎপরতায় মাইক্রোবাসে তরুণী ধর্ষণকারীদেরও অচিরে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। নারীর চলাফেরার পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে ক্ষেত্রে আসুন, সব নারী-পুরুষ মিলে আমরা অব্যাহত গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করি এবং সমাজের প্রতি স্তরে নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ–সমতার সংস্কৃতি চালু করি।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারী নেত্রী।
পয়লা বৈশাখে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, যেখানে তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে প্রকাশ্যে নারী নিগ্রহের ঘটনাকে ধিক্কার দিয়ে অনেক সমালোচনার টেবিল মুখর হয়েছে, দেশব্যাপী নারী সংগঠনগুলো অব্যাহত প্রতিবাদ মিছিল ও মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধনের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে দেশের বৃহত্তর সমাজে এর তেমন প্রভাব পড়ছে না। পুরুষশাসিত সমাজ যে এখেনা যৌন হয়রানি ও নারীর শ্লীলতাহানিকে ‘ছোট্ট একটু দুষ্টামি’ মনে করে তা আবার প্রমাণিত হলো যখন দেখি তথাকথিত কিছু পুরুষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাজধানীর জনবহুল এলাকা থেকে সন্ধ্যারাতে (রাত নয়টা) একজন তরুণীকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করতে দ্বিধা করে না। মাত্র দিন দশেক আগে নারায়ণগঞ্জে এক নারী পোশাককর্মী কাজের পর বাড়ি ফিরতে বাসে উঠে ক্লান্তিবশত একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন। এর আগেও ময়মনসিংহ, সাভার ও মানিকগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা ঘটে (সূত্র: প্রথম আলো)। সাধারণ নারীর নিরাপত্তাই যেখানে উদ্বেগের বিষয়, সে ক্ষেত্রে কর্মজীবী নারী, যাঁদের কাজ শেষে গণপরিবহন ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প নেই, তঁাদের জন্য রাষ্ট্র কি সুরক্ষা দেবে? উপর্যুপরি এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অপরাধী ধরা না পড়ায় অথবা বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে অপরাধীরা কতখানি বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
পৃথিবীর সব সভ্য দেশে ট্যাক্সিসহ সব গণপরিবহনে ড্রাইভারের সিটের পেছনে গাড়ির নম্বর ও ড্রাইভারের ছবিসহ আইডি ঝুলিয়ে রাখার নিয়ম আছে, যাতে করে যাত্রী চালক ও পরিবহনটিকে শনাক্ত করতে পারে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির কাজ এটি এবং অবিলম্বে সব সরকারি, বেসরকারি বাস, সিএনজি ইত্যাদিতে এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া আইনত চালু করা হোক। এ ছাড়া প্রতি বাসস্ট্যান্ড ও সড়কসমূহের যেখানে কারখানা, দোকান ইত্যাদি অবস্থিত, সেখানে আলো জোরদারকরণ ও মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হোক।
বিগত চার দশকে মানব উন্নয়ন সূচকে আমাদের অভাবনীয় উন্নতি যা একদিকে আমাদের দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং বাংলাদেশকে সহস্রাব্দ লক্ষ্যে পৌঁছাতেও সহায়ক হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি এ দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীর উচ্চহারে অংশগ্রহণ। এই অর্জনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উজ্জ্বল উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়।
বিবিএসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিক বেশি, বর্তমানে দেশে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন, আর নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২১ লাখ ১২ হাজার ৮৩০ জন। তা সত্ত্বেও শ্রমজীবী নারী ন্যূনতম নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। ঘরে–বাইরে কোথাও নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। নারীর প্রতি সহিংসতা–সংক্রান্ত বিবিএস কর্তৃক প্রথম জাতীয় জরিপে (২০১৪) দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ নারী নিজ গৃহে স্বামী দ্বারা মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তাই বলা যায় এ দেশের পুরুষেরা নারী নির্যাতনের প্রথম শিক্ষাটা পায় পারিবারিক প্রথা থেকে, যেটা পরবর্তী জীবনে সে ধারণ করে সামাজিক ও গণজীবনে।
সব দেশেই রকমভেদে নারী নির্যাতনের শিকার হয়, কিন্তু উন্নত বিশ্বে পরিবারে লিঙ্গ-সমতার সংস্কৃতি থাকায় বৃহত্তর জীবনে শিক্ষার মাধ্যমে পরিশীলিত একটি লিঙ্গসম্পর্ক নারী পুরুষের মধ্যে বিরাজ করে, যা নারী নির্যাতন হ্রাসে সহায়ক হয়। নারী নির্যাতন তখন বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত হয়। উপরন্তু আইন সেখানে প্রকৃতই নিজের গতিতে চলে—দল-মত-ব্যক্তিনির্বিশেষে অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কর্তৃপক্ষ তৎপর থাকে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে আমাদের অচিরেই নারী নির্যাতন নিরসনের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি উদারমনস্ক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক ভিত্তি হলো পরিশীলিত সমমর্যাদাভিত্তিক লিঙ্গসম্পর্ক। আমাদের পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতিচর্চা ও আইনি কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে প্রতি ক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
দেরিতে হলেও সম্প্রতি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা তৎপর হয়েছে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী লাঞ্ছনার বিচার হয়েছে, পয়লা বৈশাখের ঘটনার কিছু অপরাধী শনাক্তকরণ হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে বাসে পোশাককর্মীকে ধর্ষণকারী একজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
আমরা আশা করব, পুলিশি তৎপরতায় মাইক্রোবাসে তরুণী ধর্ষণকারীদেরও অচিরে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। নারীর চলাফেরার পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে ক্ষেত্রে আসুন, সব নারী-পুরুষ মিলে আমরা অব্যাহত গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করি এবং সমাজের প্রতি স্তরে নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ–সমতার সংস্কৃতি চালু করি।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারী নেত্রী।
No comments