গাড়ি থামলেই মদের অফার by তোহুর আহমদ
মঙ্গলবার
বিকাল সাড়ে পাঁচটা। রাজধানীর বনানী বাজারের ফুলের দোকানগুলো ঘেঁষে একটি
গাড়ি দাঁড়াতেই গাড়িটি ঘিরে ধরল কয়েকজন যুবক। গাড়ির কাচ নামতেই চালক ও
পেছনের আরোহীর দিকে লেমিনেটিং করা একটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তারা। কিন্তু ওই
যুবকদের অনুমান ছিল ভুল। চালক ও আরোহী গাড়ি থেকে নেমে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে
যুবকদের বকাঝকা করতে শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে অলিগলি দিয়ে
মুহূর্তেই চম্পট দিল ওই যুবকরা।
বনানী বাজারের ব্যবসায়ীরা জানালেন, ওই ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বাজার করতে এসেছেন। কিন্তু এখানকার মদ ব্যবসায়ীরা তার কাছে মদ বিক্রির অফার দেয়। এ কারণে তিনি বিব্রত হয়ে চিৎকার করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, বনানীর প্রায় পুরো এলাকা মদ ব্যবসায়ীদের দখলে। এখানে অন্তত ৮০-৯০ জন হকার ভ্রাম্যমাণ মদের ব্যবসা করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর মদ ব্যবসার গডফাদার কবির ওরফে কবির দালাল বনানী এলাকায় একচেটিয়াভাবে মদের ব্যবসা করছে দীর্ঘদিন ধরে। তার সেকেন্ড ইন কমান্ডের নাম সেলিম ওরফে বাঞ্ছারাম। এই সিন্ডিকেটের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হল- সুলতান, মোজাম্মেল, নান্নু, ফরিদ, আলম, দুলাল, বেলাল, ফারুক, মিজান, মোতাহার ও শাহেদ।
সূত্র জানায়, বনানীবাজার, ফুল মার্কেট, বনানী ১১ নম্বর রোড ও কামাল আতাতুর্ক এভিনিউসহ আশপাশের পুরো এলাকায় তারা ফেরি করে বিদেশী মদ ও বিয়ার বিক্রি করে। বিশেষ করে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই মদ সিন্ডিকেটের প্রধান টার্গেট। জানা গেছে, কবির ও বাঞ্ছারাম সিন্ডিকেটের অন্তত ২০ জন হকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর আশপাশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মদ সাপ্লাই দেয়। সরবরাহ সুবিধার জন্য এ এলাকার কয়েকটি গলিতে চায়ের দোকানের আড়ালে তারা মদের গোডাউনও খুলেছে। জানা যায়, এই সিন্ডিকেট মূলত মোবাইল ফোনেই মদ-বিয়ারের বেচাকেনা করে বেশি। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই চাহিদামতো মদের জোগান চলে যাসে।
বিষয়টি যাচাই করার জন্য বৃহস্পতিবার ৩ বোতল বিদেশী মদের চাহিদা জানিয়ে ফোন করা হয় সিন্ডিকেটের গডফাদার কবিরের মোবাইল ফোনে। তার সঙ্গে কথোপকথন অনেকটা এ রকম ছিল-
যুগান্তর প্রতিবেদক : কবির ভাই বলছেন?
কবির : কে?
যুগান্তর প্রতিবেদক : কবির ভাই, খিলক্ষেত থেকে মিজান (ছদ্মনাম) বলছি। বড় ভাই, তিনটা বোতল লাগত যে। গাড়ি কখন পাঠাব?
কবির : ও মিজান ভাই, চিনছি। অনেকদিন পর ফোন দিলেন যে, মাল কি অন্য জায়গা থাইক্যা নিতাছেন নাকি।
যুগান্তর প্রতিবেদক : নারে ভাই, আসলে দেশে আছিলাম না। এই তো কদিন হয় ফিরছি। এখন কন, গাড়ি কখন পাঠামু।
কবির : সন্ধ্যা সাতটার পর পাঠায়েন। ড্রাইভারকে আমার নাম্বার দিয়া কইয়া দেন বনানীবাজারে আইস্যা যেন একটা ফোন দেয়। আমার লোক গাড়িতে মাল তুইল্লা দিব।
যুগান্তর প্রতিবেদক : টাকা কত পাঠাব?
কবির : মাল কী কী নিবেন?
যুগান্তর প্রতিবেদক : এই ধরেন একটা ব্ল্যাক লেবেল হুইসকি, একটা রেড ওয়াইন আর কিছু বিদেশী বিয়ার দিয়েন।
কবির : ব্ল্যাক লেবেলের দাম পড়বে ৮ হাজার। রেড ওয়াইন ৫ হাজার টাকা। বিয়ারের দাম ৩৫০ কইর্যা দিয়েন।
এভাবেই মোবাইল ফোনে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রি করছে এই চক্র। ফলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে।
তবে বনানী পুলিশের একটি সূত্র এই মদ সিন্ডিকেটের বিষয়ে আরও ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। বনানী থানার এক উপপরিদর্শক যুগান্তরকে বলেন, মদের বড় চালানসহ কবিরের লোকজনকে ধরা কঠিন। কারণ বড় চালান তারা মিয়ানমার দূতাবাসের গাড়িতে করে বহন করে। মদ পাচারের সঙ্গে জড়িত হিসেবে মিয়ানমার দূতাবাসের দুটি গাড়িকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ দুটি গাড়ির নম্বর হল দ-৬৭-০২১ ও দ-৬৭-০১৯। এর একটি সবুজ লুসিডা ব্র্যান্ডের গাড়ি। অন্যটি সোনালি রংয়ের হানড্রেড কার। বনানী থানার ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দিনে অন্তত ১০ বার এ দুটি গাড়িতে মদ চোরাচালান হয়। কিন্তু দূতাবাসের গাড়ি হওয়ার কারণে পুলিশ এই দুটি গাড়িতে তল্লাশি চালাতে পারে না।
বনানী থানার আরেক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুধু গাড়ি নয় কবির সিন্ডিকেটের মদ লুকিয়ে রাখার প্রধান জায়গা হচ্ছে বনানীতে অবস্থিত মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মচারী আবাসিক এলাকা। বিশেষ করে ১, ৭ ও ৯ নম্বর রোডে বসবাসকারী অনেক মিয়ানমার নাগরিকের আবাসিক ফ্ল্যাটকে মদ রাখার গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশী নাগরিকদের বাড়িতে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকার সুযোগে এই কৌশলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কবির সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, ভোলা থেকে এসে প্রথমে রাজধানীতে রিকশা চালাতেন কবির। বনানী এলাকায় রিকশা চালানোর সময় তিনি এই মদ ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত হন। একপর্যায়ে তিনি নিজেই এ এলাকায় মদ ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। কবিরের এই মদ ব্যবসা চলছে অন্তত ১৫ বছর ধরে। এই অবৈধ মদ ব্যবসা করেই কবির এখন কোটিপতি। এখন ঢাকায় তিনি বিলাসবহুল একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। হাল ফ্যাশনের দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে তিনি চলাফেরা করেন। মদ ব্যবসার সুবাদে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলেও তার ওঠাবসা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে কবিরের হয়ে এই ব্যবসার পুরোটাই দেখভাল করছে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সেলিম ওরফে বাঞ্ছারাম। সে নিজেকে র্যাবের সোর্স বলে পরিচয় দেয়।
সম্প্রতি গুলশান থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় গুলশান-২ এলাকার একটি হোটেলে যুগান্তরের এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে বাঞ্ছারামের সঙ্গে তার মদ ব্যবসার বিষয়ে কথা বলতে সক্ষম হয়। তার সঙ্গে আলোচনা ছিল অনেকটা এ রকম :
যুগান্তর প্রতিবেদক : আপনার ব্যবসা কেমন চলছে। ঝামেলা-টামেলা হয় না?
বাঞ্ছারাম : ঝামেলা তো আছেই। তবে টাকা দিলে সব ঠিক।
যুগান্তর প্রতিবেদক : প্রতি মাসে কত টাকা দিতে হয়।
বাঞ্ছারাম : ঠিক নাই। এই ধরেন কোনো মাসে ৩ লাখ দিই। আবার কোনো মাসে ৪ লাখও লাগে।
যুগান্তর প্রতিবেদক : এত টাকা? কারা এত টাকা নেয়?
বাঞ্ছারাম : টাকা নেয় অনেকেই। পুলিশ নেয়, র্যাব নেয়, নারকোটিক্সের লোকজন তো টাকা না পেলে পাগল হয়ে যায়। একেক ইন্সপেক্টর একেকবার আসে। সিপাই পাঠায়। টাকা না দিলে গ্রেফতারের ভয় দেখায়। বলে ব্যবসা বন্ধ কইর্যা দিব।
যুগান্তর প্রতিবেদক : কাকে কত দেন?
বাঞ্ছারাম : এই ধরেন, নারকোটিক্সের ইন্সপেক্টরকে দিই প্রতি মাসে ৭০ হাজার। বনানী থানায় দিতে হয় এক লাখ। সিআইডির এক এএসপি স্যারের ড্রাইভার প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ডিবির টাকা তোলে এসআই এস কবির (সোলায়মান কবির) স্যার। তবে কবির স্যারের টাকার ঠিক নাই। টাকার দরকার হইলেই ফোন দেয়। তখন আমি ডিবিতে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসি। এসবিতেও কিছু টাকা দিতে হয়।
যুগান্তর প্রতিবেদক : এভাবে ঘুষ দেয়ার পরও আপনাদের লাভ থাকে?
বাঞ্ছারাম : তেমন একটা লাভ থাকে না। এই ধরেন খায়াপইরা বাইচ্যা থাকা আর কী।
যুগান্তর প্রতিবেদক : মাসে বেচাকেনা এখন কেমন?
বাঞ্ছারাম : ভাই, আগে ব্যবসাটা ভালো ছিল। এই ধরেন সারাদিনে ২০ লাখ টাকারও বেচাকেনা হইছে। কিন্তু এখন ১০ লাখও নাই। আবার নানা লোকজন ঝামেলা করে। পুলিশের ভয় দেখায়।
যুগান্তর প্রতিবেদক : আপনারা কোথা থেকে মদ আনেন।
বাঞ্ছারাম : যেখানে সুবিধা পাই সেখান থেকেই আনি। তবে গুলশানের এসটিএল (এসটিএল ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস) ও গুলশান ১০৮ নম্বরের ইডিএস (ইস্টার্ন ডিপ্লোমেটিক সাভির্সেস) ওয়্যারহাউস থেকে মাল আনি বেশি।
বাঞ্ছারাম বলেন, মোট ১১টি সংস্থার লোকজনকে মাসোয়ারা দিতে হয়। এই মাসোয়ারা দিয়েই তারা ব্যবসা করে আসছেন। মাঝে মাঝে তাদের কিছুদিনের জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখতে বলা হয়। তখন কিছুদিন তারা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। তখন ব্যবসা বন্ধ থাকে।
বনানী বাজারের ব্যবসায়ীরা জানালেন, ওই ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বাজার করতে এসেছেন। কিন্তু এখানকার মদ ব্যবসায়ীরা তার কাছে মদ বিক্রির অফার দেয়। এ কারণে তিনি বিব্রত হয়ে চিৎকার করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, বনানীর প্রায় পুরো এলাকা মদ ব্যবসায়ীদের দখলে। এখানে অন্তত ৮০-৯০ জন হকার ভ্রাম্যমাণ মদের ব্যবসা করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর মদ ব্যবসার গডফাদার কবির ওরফে কবির দালাল বনানী এলাকায় একচেটিয়াভাবে মদের ব্যবসা করছে দীর্ঘদিন ধরে। তার সেকেন্ড ইন কমান্ডের নাম সেলিম ওরফে বাঞ্ছারাম। এই সিন্ডিকেটের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হল- সুলতান, মোজাম্মেল, নান্নু, ফরিদ, আলম, দুলাল, বেলাল, ফারুক, মিজান, মোতাহার ও শাহেদ।
সূত্র জানায়, বনানীবাজার, ফুল মার্কেট, বনানী ১১ নম্বর রোড ও কামাল আতাতুর্ক এভিনিউসহ আশপাশের পুরো এলাকায় তারা ফেরি করে বিদেশী মদ ও বিয়ার বিক্রি করে। বিশেষ করে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই মদ সিন্ডিকেটের প্রধান টার্গেট। জানা গেছে, কবির ও বাঞ্ছারাম সিন্ডিকেটের অন্তত ২০ জন হকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর আশপাশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মদ সাপ্লাই দেয়। সরবরাহ সুবিধার জন্য এ এলাকার কয়েকটি গলিতে চায়ের দোকানের আড়ালে তারা মদের গোডাউনও খুলেছে। জানা যায়, এই সিন্ডিকেট মূলত মোবাইল ফোনেই মদ-বিয়ারের বেচাকেনা করে বেশি। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই চাহিদামতো মদের জোগান চলে যাসে।
বিষয়টি যাচাই করার জন্য বৃহস্পতিবার ৩ বোতল বিদেশী মদের চাহিদা জানিয়ে ফোন করা হয় সিন্ডিকেটের গডফাদার কবিরের মোবাইল ফোনে। তার সঙ্গে কথোপকথন অনেকটা এ রকম ছিল-
যুগান্তর প্রতিবেদক : কবির ভাই বলছেন?
কবির : কে?
যুগান্তর প্রতিবেদক : কবির ভাই, খিলক্ষেত থেকে মিজান (ছদ্মনাম) বলছি। বড় ভাই, তিনটা বোতল লাগত যে। গাড়ি কখন পাঠাব?
কবির : ও মিজান ভাই, চিনছি। অনেকদিন পর ফোন দিলেন যে, মাল কি অন্য জায়গা থাইক্যা নিতাছেন নাকি।
যুগান্তর প্রতিবেদক : নারে ভাই, আসলে দেশে আছিলাম না। এই তো কদিন হয় ফিরছি। এখন কন, গাড়ি কখন পাঠামু।
কবির : সন্ধ্যা সাতটার পর পাঠায়েন। ড্রাইভারকে আমার নাম্বার দিয়া কইয়া দেন বনানীবাজারে আইস্যা যেন একটা ফোন দেয়। আমার লোক গাড়িতে মাল তুইল্লা দিব।
যুগান্তর প্রতিবেদক : টাকা কত পাঠাব?
কবির : মাল কী কী নিবেন?
যুগান্তর প্রতিবেদক : এই ধরেন একটা ব্ল্যাক লেবেল হুইসকি, একটা রেড ওয়াইন আর কিছু বিদেশী বিয়ার দিয়েন।
কবির : ব্ল্যাক লেবেলের দাম পড়বে ৮ হাজার। রেড ওয়াইন ৫ হাজার টাকা। বিয়ারের দাম ৩৫০ কইর্যা দিয়েন।
এভাবেই মোবাইল ফোনে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রি করছে এই চক্র। ফলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে।
তবে বনানী পুলিশের একটি সূত্র এই মদ সিন্ডিকেটের বিষয়ে আরও ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। বনানী থানার এক উপপরিদর্শক যুগান্তরকে বলেন, মদের বড় চালানসহ কবিরের লোকজনকে ধরা কঠিন। কারণ বড় চালান তারা মিয়ানমার দূতাবাসের গাড়িতে করে বহন করে। মদ পাচারের সঙ্গে জড়িত হিসেবে মিয়ানমার দূতাবাসের দুটি গাড়িকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ দুটি গাড়ির নম্বর হল দ-৬৭-০২১ ও দ-৬৭-০১৯। এর একটি সবুজ লুসিডা ব্র্যান্ডের গাড়ি। অন্যটি সোনালি রংয়ের হানড্রেড কার। বনানী থানার ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দিনে অন্তত ১০ বার এ দুটি গাড়িতে মদ চোরাচালান হয়। কিন্তু দূতাবাসের গাড়ি হওয়ার কারণে পুলিশ এই দুটি গাড়িতে তল্লাশি চালাতে পারে না।
বনানী থানার আরেক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুধু গাড়ি নয় কবির সিন্ডিকেটের মদ লুকিয়ে রাখার প্রধান জায়গা হচ্ছে বনানীতে অবস্থিত মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মচারী আবাসিক এলাকা। বিশেষ করে ১, ৭ ও ৯ নম্বর রোডে বসবাসকারী অনেক মিয়ানমার নাগরিকের আবাসিক ফ্ল্যাটকে মদ রাখার গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশী নাগরিকদের বাড়িতে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকার সুযোগে এই কৌশলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কবির সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, ভোলা থেকে এসে প্রথমে রাজধানীতে রিকশা চালাতেন কবির। বনানী এলাকায় রিকশা চালানোর সময় তিনি এই মদ ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত হন। একপর্যায়ে তিনি নিজেই এ এলাকায় মদ ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। কবিরের এই মদ ব্যবসা চলছে অন্তত ১৫ বছর ধরে। এই অবৈধ মদ ব্যবসা করেই কবির এখন কোটিপতি। এখন ঢাকায় তিনি বিলাসবহুল একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। হাল ফ্যাশনের দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে তিনি চলাফেরা করেন। মদ ব্যবসার সুবাদে সমাজের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলেও তার ওঠাবসা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে কবিরের হয়ে এই ব্যবসার পুরোটাই দেখভাল করছে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সেলিম ওরফে বাঞ্ছারাম। সে নিজেকে র্যাবের সোর্স বলে পরিচয় দেয়।
সম্প্রতি গুলশান থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় গুলশান-২ এলাকার একটি হোটেলে যুগান্তরের এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে বাঞ্ছারামের সঙ্গে তার মদ ব্যবসার বিষয়ে কথা বলতে সক্ষম হয়। তার সঙ্গে আলোচনা ছিল অনেকটা এ রকম :
যুগান্তর প্রতিবেদক : আপনার ব্যবসা কেমন চলছে। ঝামেলা-টামেলা হয় না?
বাঞ্ছারাম : ঝামেলা তো আছেই। তবে টাকা দিলে সব ঠিক।
যুগান্তর প্রতিবেদক : প্রতি মাসে কত টাকা দিতে হয়।
বাঞ্ছারাম : ঠিক নাই। এই ধরেন কোনো মাসে ৩ লাখ দিই। আবার কোনো মাসে ৪ লাখও লাগে।
যুগান্তর প্রতিবেদক : এত টাকা? কারা এত টাকা নেয়?
বাঞ্ছারাম : টাকা নেয় অনেকেই। পুলিশ নেয়, র্যাব নেয়, নারকোটিক্সের লোকজন তো টাকা না পেলে পাগল হয়ে যায়। একেক ইন্সপেক্টর একেকবার আসে। সিপাই পাঠায়। টাকা না দিলে গ্রেফতারের ভয় দেখায়। বলে ব্যবসা বন্ধ কইর্যা দিব।
যুগান্তর প্রতিবেদক : কাকে কত দেন?
বাঞ্ছারাম : এই ধরেন, নারকোটিক্সের ইন্সপেক্টরকে দিই প্রতি মাসে ৭০ হাজার। বনানী থানায় দিতে হয় এক লাখ। সিআইডির এক এএসপি স্যারের ড্রাইভার প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ডিবির টাকা তোলে এসআই এস কবির (সোলায়মান কবির) স্যার। তবে কবির স্যারের টাকার ঠিক নাই। টাকার দরকার হইলেই ফোন দেয়। তখন আমি ডিবিতে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসি। এসবিতেও কিছু টাকা দিতে হয়।
যুগান্তর প্রতিবেদক : এভাবে ঘুষ দেয়ার পরও আপনাদের লাভ থাকে?
বাঞ্ছারাম : তেমন একটা লাভ থাকে না। এই ধরেন খায়াপইরা বাইচ্যা থাকা আর কী।
যুগান্তর প্রতিবেদক : মাসে বেচাকেনা এখন কেমন?
বাঞ্ছারাম : ভাই, আগে ব্যবসাটা ভালো ছিল। এই ধরেন সারাদিনে ২০ লাখ টাকারও বেচাকেনা হইছে। কিন্তু এখন ১০ লাখও নাই। আবার নানা লোকজন ঝামেলা করে। পুলিশের ভয় দেখায়।
যুগান্তর প্রতিবেদক : আপনারা কোথা থেকে মদ আনেন।
বাঞ্ছারাম : যেখানে সুবিধা পাই সেখান থেকেই আনি। তবে গুলশানের এসটিএল (এসটিএল ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস) ও গুলশান ১০৮ নম্বরের ইডিএস (ইস্টার্ন ডিপ্লোমেটিক সাভির্সেস) ওয়্যারহাউস থেকে মাল আনি বেশি।
বাঞ্ছারাম বলেন, মোট ১১টি সংস্থার লোকজনকে মাসোয়ারা দিতে হয়। এই মাসোয়ারা দিয়েই তারা ব্যবসা করে আসছেন। মাঝে মাঝে তাদের কিছুদিনের জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখতে বলা হয়। তখন কিছুদিন তারা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। তখন ব্যবসা বন্ধ থাকে।
No comments