সাগরে হারিয়ে যাওয়া সাব্বির ইন্দোনেশিয়ার আশ্রয় শিবিরে! by উৎপল রায়
২০১৪
সালের ১৪ই এপ্রিল। বাংলা বর্ষবরণের জন্য প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন
গিয়েছিলেন ঢাকার আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সাব্বির
আহমেদ (২৪)। সঙ্গে ছিলেন তার আরও কজন বন্ধু। সবার মধ্যে ছিল তারুণ্যের
বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। কিন্তু সেই বর্ষবরণ উদযাপন ছিল তাদের জন্য বিভীষিকাময়।
বর্ষবরণের দিন সবাই নেমেছিলেন সাগরে। তাদের উচ্ছ্বাস যেন বাঁধ মানছিল না।
একসময় সাগরে সাঁতার কাটতে নেমে একে একে হারিয়ে যান সাব্বিরসহ বেশ কজন। এর
মধ্যে চারজনের লাশ স্থানীয় কোস্টগার্ড ও জেলেদের সহায়তায় উদ্ধার করা হলেও
হারিয়ে যান সাব্বির ও উদয় নামে দুজন। এক বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। সাব্বির
ফিরে আসেননি বাবা-মায়ের বুকে। কিন্তু একটি ছবি আবারও আশার আলো জ্বালিয়েছে
সাব্বিরের বাবা মো. হাসানুর রহমান ও মা সেলিনা বেগমের বুকে। গত ১১ই মে
দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে মাতাং
রায়া গ্রামের একটি আশ্রয় শিবিরে আচেহ উপকূল থেকে উদ্ধার করা বাংলাদেশী ও
রোহিঙ্গাদের একটি ছবি ছাপা হয়। ছবির তথ্য অনুযায়ী ১০ই মে ভোরে আচেহ উপকূলে
দুটি নৌকায় আটকে পড়া ৪৬৯ বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাকে এ আশ্রয়কেন্দ্রে এনে রাখা
হয়। ছবিতে দেখা যায়, লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে হাত দুটি বুকের ওপর গুটিয়ে চটে
শুয়ে আছেন আনুমানিক ২৫ বছরের এক যুবক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সামনের
দিকে। চোখ দুটি ঢুকে গেছে কোঠরে। বেরিয়ে আছে কণ্ঠার হার। পা দুটিও
শীর্ণকায়। গায়ের রং হয়ে গেছে মিশমিশে কালো। যুবকটি কত দিনের অভুক্ত ও
অসুস্থ তা তার শরীর দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। ১১ই মে বিভিন্ন জাতীয়
দৈনিকে প্রকাশিত ছবিটি দেখেই আঁতকে ওঠেন সাব্বিরের বাবা হাসানুর রহমান ও মা
সেলিনা হোসেন। পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন তারা। ছুটে যান সংশ্লিষ্ট পত্রিকা
অফিসে। জানান তাদের অব্যক্ত কথা। এ ছেলেই যে তাদের হারিয়ে যাওয়া সাব্বির তা
নিশ্চিত করেন তারা। পত্রিকা অফিস থেকে জানানো হয় এটি এএফপির তোলা ছবি।
তাদের নিজস্ব ছবি নয়। হাসানুর রহমান এরপর ছুটে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
যোগাযোগ করেন এএফপির সঙ্গে। ছবির মানুষটি যে সাব্বির সে বিষয়েও তিনি
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। কর্মকর্তাদের
পরামর্শে এ বিষয়ে আবেদন করেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনরা
বলেছেন, তারা এ বিষয়ে খোঁজ নিতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু আবেদন দাখিলের দুই
সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে পরিবারকে কিছুই
জানানো হয়নি। তবে আশা ছাড়ছেন না পুত্রশোকে কাতর হওয়া হাসানুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন ছেলেকে ফিরে পেতে যে কোন কিছু বিসর্জন
দিতে রাজি আছেন তিনি। কিছুই চান না, শুধু তার সাব্বিরকে ফিরে পেতে চান।
ছবিটি দেখার পর সাব্বিরের বাবা-মা বলছেন, এ আমাদের সন্তান সাব্বির। কোন
মা-বাবাই তার সন্তানকে চিনতে ভুল করেন না। আমরাও করছি না। সাব্বিরকে দেখে
আমরা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছি। অভুক্ত থাকায় তার শরীর শুকিয়ে গেছে। গতকাল
রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ২ নম্বর সড়কের ১৫১ নম্বর বাসার
দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, হাসানুর রহমান ও সেলিনা হোসেন ছেলে
সাব্বিরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কখন তাদের আদরের সাব্বির তাদের কোলে ফিরে
আসবে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পুত্র হারানোর কি দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের ভোগ
করতে হচ্ছে, তাও বলছেন তারা চোখের জলে। তাদের বিশ্বাস, পত্রিকায় এএফপির
তোলা এ ছবিটিই তাদের প্রিয় সন্তানের। সাব্বিরের বাবা পরিকল্পনা
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে অবসরে) জানান, ১১ই মে অন্তত তিনটি
জাতীয় দৈনিকে এ ছবিটি ছাপা হয়। তখনই তাকে সাব্বির বলে আমরা শনাক্ত করি। এর
মধ্যে কোন ভুল নেই। নিজের সন্তানকে চিনতে পারে না পৃথিবীতে এমন বাবা-মা
নেই। আমরা শতভাগ নিশ্চিত, এটিই আমাদের সাগরে হারিয়ে যাওয়া সাব্বির। তিনি
বলেন, ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় গিয়েছি। ইন্দোনেশিয়ান অ্যাম্বেসির সঙ্গেও
যোগাযোগ করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও ধরনা দিচ্ছি। কিন্তু কেউ আমাকে
আশ্বস্ত করতে পারছে না। বাংলাদেশে অবস্থানরত এএফপি সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে
যোগাযোগ করছেন। সরকারের সংশ্লিষ্টরা যদি একটু আন্তরিক হন তাহলে আমাদের
হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে আমরা ফিরে পেতে পারি। এজন্য সরকার, ইন্দোনেশিয়ার সরকার
ও বিশেষ করে যারা এ ছবিটি তুলেছিলেন তাদের সহযোগিতা চাই আমরা। মা সেলিনা
হোসেন বলেন, প্রতিদিনই শুনছি সাগরে কতজনই ভেসে বেড়াচ্ছেন। কতজনকে উদ্বার
করা হচ্ছে। এদের অনেকেই সাগরে হারিয়েছিলেন। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়েছে।
আমার ছেলেও তো সাগরে হারিয়েছিল। হয়তো জলদস্যুদের খপ্পরে পড়েছিল। নয়তো কেউ
তাকে অপহরণ করেছিল। অথবা জেলেরা তাকে উদ্ধার করে উপকূলের কোথাও নামিয়ে
দিয়েছে। এমনটি হতে পারে না? আমি বিশ্বাস করি এ ছেলেটিই আমার হারিয়ে যাওয়া
সাব্বির। আমি আবারও আমার বুকের মানিককে বুকে টেনে নিতে চাই। তিনি বলেন, যে
মা তার সন্তানকে আল্লাহর হাতে সপে দেয়, সেই সন্তানকে আল্লাহতাআলা মায়ের বুক
থেকে কেড়ে নেন না। সেলিনা হোসেন আরও বলেন, একমাত্র মা-ই বোঝেন সন্তান
হারানোর কি যন্ত্রণা! এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি চোখের পাতা এক করতে পারি
না। সারাক্ষণ ছেলের স্মৃতি হাতড়াই। আল্লাহতাআলা হয়তো আমার দিকে মুখ
ফিরিয়েছেন। এখন আমি ছেলেকে ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চাই। আমার
দৃঢ় বিশ্বাস, আমার সন্তান আমার কোলে ফিরে আসবে।
No comments