৪৪ বছরের দুঃসহ নীরবতা by পুষ্পেন চৌধুরী
হাতে ঝাড়ু, পরনে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পোশাক। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত রত্না চক্রবর্তীকে জীবন আজ টেনে এনেছে কঠিন সংগ্রামেl প্রথম আলো |
কথাগুলো
গোপনই থাকত, কিন্তু পারলেন না রত্না চক্রবর্তী। স্বামী বাদল চক্রবর্তীর
দুই দফা স্ট্রোক হয়েছে। ছেলেমেয়েরা যে যার সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
তাই নীরবতা ভাঙতেই হলো তাঁকে। তাই শেষমেশ সরকারের সহায়তা চাইতে গিয়ে
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তুলে ধরলেন তিনি।
গত ২২ এপ্রিল লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সহায়তা চেয়ে দরখাস্ত দিতে গিয়েছিলেন রত্না চক্রবর্তী। জানালেন, নগরের আফমি প্লাজা বিপণিবিতানে এখন ঝাড়ুদারের কাজ করেন তিনি। অথচ লোহাগাড়া সুখছড়ি গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ায় সচ্ছল-সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবার নাম যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ভাইবোনসহ পরিবারের সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি আজ। একাত্তর সালে দোহাজারি সেনা ক্যাম্পের সামনে থেকে অচেতন অবস্থায় যে লোকটি তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন সেই বাদল চক্রবর্তীকেই বিয়ে করেছিলেন পরে। পরিবার চেয়েছিল তাঁকে ভারতে পাঠাতে। কিন্তু রাজি হননি তিনি। পরিবারের সদস্যরা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রত্নার। বর্তমানে নগরের দেওয়ান বাজারের ডিসি রোডের ভরাপুকুরপাড় এলাকায় পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তাঁর স্বামী। স্ট্রোকের পর বিছানায় পড়ে আছেন। চার ছেলেমেয়ে সবাই বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। তাই সংসার চালাতে তাঁকে ঝাড়ুদারের কাজ নিতে হয়েছে।
এত দিন পর নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরছেন কেন জানতে চাইলে রত্না চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর দুই মাস ধরে ঘরভাড়া দিতে পারি নাই। আমাদের ঘরের ভেতর রেখে বাড়িওয়ালা তালা বন্ধ করে রেখেছিল একবার। আমার স্বামী বাদল চক্রবর্তী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছি শুনেও শ্বশুরবাড়ির সবার অমতে আমাকে বিয়ে করে আশ্রয় দিয়েছেন। আজ তিনি খুবই অসুস্থ। তাঁর ওষুধের টাকা জোগাড় করতে আফমি প্লাজায় সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের চাকরি নিয়েছি। যদিও এতে তাঁর ঋণ শোধ হবে না।’
ডেটলাইন ১৯৭১: ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রত্না চক্রবর্তী। লোহাগাড়ার সুখছড়ি গ্রামটিতে যে হঠাৎ করেই প্রলয় নেমেছিল সেদিন। কেবল রত্না নন একই বিবরণ দেন সুখছড়ির বাসিন্দা আবদুস সোবাহান, মুক্তিযোদ্ধা রফিক দিদার, বিধবা হিরণ বালা দাশ ও চাঁপালী দাশ। তাঁদের দেওয়া বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল দিনের বেলায় হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা জনৈক স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় ব্রাহ্মণপাড়া, রাজবাড়ী ও কলাউজানে অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় ব্রাহ্মণপাড়ার হিন্দু পরিবারের লোকজন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। লুকিয়ে থাকা সাত ব্যক্তিকে বের করে এনে গুলি করে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন পুলিন বিহারী দাশ, হিমাংশু বিমল দাশ, রণজিত দত্ত, দুলাল দাশ ও উপেন্দ্র লাল দাশ। আহত হয়ে পরে মারা যান নলিনী রঞ্জন দাশ ও তেজেন্দ্র লাল দাশ। হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময় ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকা ১৫ বছরের রত্না চক্রবর্তীকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। প্রায় এক মাস দোহাজারী ক্যাম্পে বন্দী থাকেন রত্না। তাঁর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। একপর্যায়ে তাঁকে মৃত ভেবে ক্যাম্পের বাইরে ফেলে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সময় দোহাজারী সেতুর পাশে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় খঁুজে পায় পথচারী বাদল চক্রবর্তী।
কী হয়েছিল সেদিন? অসুস্থ বাদল চক্রবর্তী ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তবু বললেন সেই দুঃসহ দিনের কথা। একাত্তরের জুন মাসের কোনো এক দিন তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে দোহাজারি বাজার দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। সেনা ক্যাম্পের সামনে এক তরুণীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যান। বন্ধুসহ ধরাধরি করে অচেতন মেয়েটিকে নিয়ে যান পাশের এক পল্লি চিকিৎসকের কাছে। ওই চিকিৎসক তাঁর চেম্বারে পাঁচ-ছয় দিন রেখে মেয়েটির চিকিৎসা চালান। খানিকটা সুস্থ হলে মেয়েটি জানান, তিনি সুখছড়ির রত্না চক্রবর্তী। ওই ক্যাম্পে আরও ১৫-২০ জন নারীকে তাঁর মতোই নির্যাতিত হতে দেখেছেন তিনি। হামলা হওয়ার পর সুখছড়ির বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই রত্নার বাড়ি ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। বদল তখন তাঁকে ২০ কিলোমিটার দূরে খাগারিয়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নলুয়ায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। দেশ স্বাধীন হলে বাদল রত্নাকে তাঁর বাড়ি পেঁৗছে দেন। রত্নার আত্মীয়স্বজন সব জেনে তাঁকে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু রাজি হন না রত্না। পরিবারের অমতে বিয়ে করেন বাদল চক্রবর্তীকেই।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফিজনূর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রত্না চক্রবর্তীর আবেদন পাওয়ার পর সরেজমিনে সুখছড়ি গ্রামে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন নিজ কুলের কেউই আর এ দেশে নেই। কিন্তু এ দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না রত্না। প্রশ্ন করলে বলেন, যে দেশের জন্য তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে, সে দেশ ছেড়ে কেন যাবেন তিনি?
গত ২২ এপ্রিল লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সহায়তা চেয়ে দরখাস্ত দিতে গিয়েছিলেন রত্না চক্রবর্তী। জানালেন, নগরের আফমি প্লাজা বিপণিবিতানে এখন ঝাড়ুদারের কাজ করেন তিনি। অথচ লোহাগাড়া সুখছড়ি গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ায় সচ্ছল-সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবার নাম যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ভাইবোনসহ পরিবারের সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি আজ। একাত্তর সালে দোহাজারি সেনা ক্যাম্পের সামনে থেকে অচেতন অবস্থায় যে লোকটি তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন সেই বাদল চক্রবর্তীকেই বিয়ে করেছিলেন পরে। পরিবার চেয়েছিল তাঁকে ভারতে পাঠাতে। কিন্তু রাজি হননি তিনি। পরিবারের সদস্যরা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রত্নার। বর্তমানে নগরের দেওয়ান বাজারের ডিসি রোডের ভরাপুকুরপাড় এলাকায় পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তাঁর স্বামী। স্ট্রোকের পর বিছানায় পড়ে আছেন। চার ছেলেমেয়ে সবাই বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। তাই সংসার চালাতে তাঁকে ঝাড়ুদারের কাজ নিতে হয়েছে।
এত দিন পর নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরছেন কেন জানতে চাইলে রত্না চক্রবর্তী বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর দুই মাস ধরে ঘরভাড়া দিতে পারি নাই। আমাদের ঘরের ভেতর রেখে বাড়িওয়ালা তালা বন্ধ করে রেখেছিল একবার। আমার স্বামী বাদল চক্রবর্তী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছি শুনেও শ্বশুরবাড়ির সবার অমতে আমাকে বিয়ে করে আশ্রয় দিয়েছেন। আজ তিনি খুবই অসুস্থ। তাঁর ওষুধের টাকা জোগাড় করতে আফমি প্লাজায় সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের চাকরি নিয়েছি। যদিও এতে তাঁর ঋণ শোধ হবে না।’
ডেটলাইন ১৯৭১: ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রত্না চক্রবর্তী। লোহাগাড়ার সুখছড়ি গ্রামটিতে যে হঠাৎ করেই প্রলয় নেমেছিল সেদিন। কেবল রত্না নন একই বিবরণ দেন সুখছড়ির বাসিন্দা আবদুস সোবাহান, মুক্তিযোদ্ধা রফিক দিদার, বিধবা হিরণ বালা দাশ ও চাঁপালী দাশ। তাঁদের দেওয়া বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল দিনের বেলায় হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা জনৈক স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় ব্রাহ্মণপাড়া, রাজবাড়ী ও কলাউজানে অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় ব্রাহ্মণপাড়ার হিন্দু পরিবারের লোকজন ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। লুকিয়ে থাকা সাত ব্যক্তিকে বের করে এনে গুলি করে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন পুলিন বিহারী দাশ, হিমাংশু বিমল দাশ, রণজিত দত্ত, দুলাল দাশ ও উপেন্দ্র লাল দাশ। আহত হয়ে পরে মারা যান নলিনী রঞ্জন দাশ ও তেজেন্দ্র লাল দাশ। হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময় ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকা ১৫ বছরের রত্না চক্রবর্তীকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। প্রায় এক মাস দোহাজারী ক্যাম্পে বন্দী থাকেন রত্না। তাঁর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। একপর্যায়ে তাঁকে মৃত ভেবে ক্যাম্পের বাইরে ফেলে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সময় দোহাজারী সেতুর পাশে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় খঁুজে পায় পথচারী বাদল চক্রবর্তী।
কী হয়েছিল সেদিন? অসুস্থ বাদল চক্রবর্তী ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তবু বললেন সেই দুঃসহ দিনের কথা। একাত্তরের জুন মাসের কোনো এক দিন তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে দোহাজারি বাজার দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। সেনা ক্যাম্পের সামনে এক তরুণীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যান। বন্ধুসহ ধরাধরি করে অচেতন মেয়েটিকে নিয়ে যান পাশের এক পল্লি চিকিৎসকের কাছে। ওই চিকিৎসক তাঁর চেম্বারে পাঁচ-ছয় দিন রেখে মেয়েটির চিকিৎসা চালান। খানিকটা সুস্থ হলে মেয়েটি জানান, তিনি সুখছড়ির রত্না চক্রবর্তী। ওই ক্যাম্পে আরও ১৫-২০ জন নারীকে তাঁর মতোই নির্যাতিত হতে দেখেছেন তিনি। হামলা হওয়ার পর সুখছড়ির বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই রত্নার বাড়ি ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। বদল তখন তাঁকে ২০ কিলোমিটার দূরে খাগারিয়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর নলুয়ায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। দেশ স্বাধীন হলে বাদল রত্নাকে তাঁর বাড়ি পেঁৗছে দেন। রত্নার আত্মীয়স্বজন সব জেনে তাঁকে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু রাজি হন না রত্না। পরিবারের অমতে বিয়ে করেন বাদল চক্রবর্তীকেই।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফিজনূর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রত্না চক্রবর্তীর আবেদন পাওয়ার পর সরেজমিনে সুখছড়ি গ্রামে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন নিজ কুলের কেউই আর এ দেশে নেই। কিন্তু এ দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না রত্না। প্রশ্ন করলে বলেন, যে দেশের জন্য তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে, সে দেশ ছেড়ে কেন যাবেন তিনি?
No comments