অবরোধে নৌপথই ভরসা হতে পারত! by শেখ রোকন
সংসদের
বাইরে থাকা বিরোধীদলীয় জোটের দেশব্যাপী টানা অবরোধ এবং খণ্ড খণ্ড হরতাল
চলাকালে নৌপথে কতটা হামলার ঘটনা ঘটেছে? হতাহত হয়েছেন কতজন? একই সময়ে
সড়কপথে সংঘটিত হামলা ও হতাহতের হিসাব প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ পাওয়া সম্ভব।
বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রতিদিনই সর্বশেষ আপডেট দিচ্ছে পাঠকের জন্য। বুধবার
পর্যন্ত হতাহতের হিসাব দেখা যাক_ 'গত ৬ জানুয়ারি থেকে চলা লাগাতার অবরোধ
সংশ্লিষ্ট ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১ জন। তার আগের দুই দিনে নিহত হয়েছেন আরও
দু'জন। ... এসব হিসাবের বাইরেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে
বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন আরও সাতজন' (সমকাল, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। যদিও
সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই, এই সময়ে আহত হয়েছে এক হাজারের বেশি, নিদ্বর্িধায়
আশঙ্কা করা যায়। অবরোধের এই সময়ে ৪৩৬টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, ভাংচুর
হয়েছে আরও ৪৭৮টি। রেলে নাশকতার হিসাবও কড়ায় গণ্ডায়_ ৯ বার (প্রথম আলো, ৩
ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
বলাই বাহুল্য, অবরোধের এই অসহনীয় কালে অপেক্ষাকৃত সহনীয় নৌপথে হামলা ও হতাহতের হিসাব পাওয়া সহজ নয়। ফলে একেক দিনের পত্রিকা ধরে ধরে খুঁজতে হয়েছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রসূত্রে দেখা যাচ্ছে, অবরোধের দ্বিতীয় দিনে ৭ জানুয়ারি রাতে বরিশাল নদীবন্দরে নোঙর করা এমভি জনতা লঞ্চে আগুন দিয়েছিল 'দুর্বৃত্তরা'। বরিশাল থেকে কালাইয়া অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা লঞ্চটিতে রাত সাড়ে ৮টায় কেরোসিন দিয়ে লঞ্চে আগুন দেওয়া হয়। পরে স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ২০ জানুয়ারি বরিশাল থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন-৭ ও পারাবত-১০ লঞ্চে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পারাবত-১০ লঞ্চের স্টাফ ও যাত্রীরা জানান, লঞ্চটি রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘাট ছাড়ার ১০ মিনিট পরই হঠাৎ করে ১০১ কেবিনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। বিষয়টি দেখতে পেয়ে অন্যান্য যাত্রী ও স্টাফরা ছুটে এসে কেবিনের দরজা তালাবদ্ধ দেখতে পায়। পরে ডুপিল্গকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে আগুন নিভিয়ে ফেলে স্টাফরাই। ওই সময় কেবিনে কেউ না থাকলেও পেট্রোলের বোতল উদ্ধার করা হয়। লঞ্চটি না থামিয়ে ঢাকা চলে যায়। অপরদিকে ঘাট ছাড়ার ১০ মিনিট পর সুন্দরবন-৭ লঞ্চের তৃতীয় তলার ৩১৬ নম্বর কেবিনেও একই পদ্ধতিতে আগুন দেওয়া হয়। পাশের একটি কেবিনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অঘটনের পর লঞ্চটি ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে রাতেই লঞ্চটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
২৪ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের ৬নং পন্টুনে বিকেলে এমভি টিপু-৬ নামে এক যাত্রীবাহী লঞ্চের কেবিনে আগুন দেওয়া হয়। লঞ্চটি পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে সদরঘাট ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই লঞ্চের তৃতীয় তলার সবক'টি কেবিন পুড়ে যায়। অগি্নকাণ্ডের খবর পেয়ে যাত্রীরা সদরঘাট পন্টুনে নেমে যাওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একই দিন বিকেলে বরিশালের গাবখান চ্যানেলে বিআইডবিল্গউটিসির বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি বাঙালির ওপর গাবখান সেতু থেকে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। ঘটনার পরপরই পানির পাম্প চালিয়ে পাইপের মাধ্যমে বোমায় ছড়িয়ে পড়া আগুন নিভিয়ে ফেলে জাহাজ কর্তৃৃপক্ষ।
যদি আমার নিজের চোখ বা সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে গিয়ে না থাকে, তাহলে অবরোধের নৌপথে নাশকতার হিসাব মোটামুটি এ রকম_ ৩০ দিনের মধ্যে ৩ দিন নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে মোট পাঁচটি লঞ্চে_ এমভি জনতা, এমভি সুন্দরবন-৭, এমভি পারাবত-১০, এমভি টিপু-৬ ও এমভি বাঙালি। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সড়কপথে নাশকতার ঘটনার তুলনায় হতাহত কেবল শূন্য নয়, এমভি টিপু ছাড়া অন্য লঞ্চগুলোতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। নৌপথে নাশকতার এই হিসাব দিয়েই পুরো চিত্রায়ন সম্ভব ছিল। কিন্তু ওপরের দুই অনুচ্ছেদে লঞ্চ পাঁচটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
প্রথমত, পাঁচটি লঞ্চের দুটিই বন্দরে বা ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়েছে। অপর দুটি লঞ্চ বরিশাল বন্দর থেকে ছাড়ার কয়েক মিনিটের মাথায় আগুন দৃশ্যমান হয়েছে। এমভি বাঙালিতে যদিও আগুন দেওয়া হয়েছে চলন্ত অবস্থায়, দুর্বৃত্তদের অবস্থান ছিল গাবখান সেতুর ওপরে। তার মানে, সড়কপথে যেমন চলন্ত অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়, নৌপথে সেটা কারিগরিভাবেই সম্ভব নয়। ফলে সিদ্ধান্তে আসা যায়, লঞ্চে যদি তল্লাশি করে যাত্রী তোলা যায়, তাহলে নাশকতার সুযোগ থাকে না। নৌবন্দর বা ঘাটে কিংবা সংলগ্ন সেতুতে যদি প্রহরা বসানো যায়, তাহলে লঞ্চে নাশকতা ঠেকানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, পাঁচটির মধ্যে চারটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যায় বা রাতে। কেবল এমভি বাঙালিতে বিকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। ওই লঞ্চও বরিশাল পেঁৗছতে পেঁৗছতে সন্ধ্যা বা রাত হয়ে যেত, বলাই বাহুল্য। তার মানে বাসে বা সড়কপথের অন্যান্য যানবাহনে যেমন 'দিনে-দুপুরে' বোমা মারা সম্ভব, লঞ্চের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। নদীপথের যে প্রশস্ততা এবং অনেক দূর পর্যন্ত সমান্তরাল নজরদারিতে আনা যায়, তাতে করে সড়কপথের মতো বোমা মেরেই পালানোর বা লুকিয়ে পড়ার সুযোগ নেই দুর্বৃত্তদের। সড়কপথের যানবাহনে অনেক ক্ষেত্রে নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে উঠে নামার সময় বোমা ফাটিয়ে চলে গেছে। লঞ্চের ক্ষেত্রে সেটা কার্যত অসম্ভব।
তৃতীয়ত, লঞ্চের চারপাশেই থাকে আগুনের যম পানি। আগুন দিলেও খুব দ্রুতই ফায়ার সার্ভিস ছাড়াই লঞ্চের নিজস্ব পাম্প ব্যবহার করে আগুন নেভানো সম্ভব। এমভি বাঙালির ক্ষেত্রে সেভাবেই নিজস্ব পাম্প চালিয়ে আগুন নেভানো হয়েছে। এমভি টিপু ছাড়া হামলার শিকার অন্যান্য লঞ্চেও ফায়ার সার্ভিসের দরকার পড়েনি।
এটা স্পষ্ট যে, অবরোধ বা হরতালে নাশকতার যে 'ধ্রুপদী' চিত্র আমরা সড়কপথজুড়ে দেখে থাকি বা শিকারে পরিণত হই, নৌপথে তা কার্যত অচল। সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, সড়কপথের নেটওয়ার্ক যেমন দেশজুড়ে বিস্তৃত, নৌপথ তেমন নয়। এমন নয় যে, আমরা সেই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারিনি। বরং একসময় গোটা দেশে সড়কপথের চেয়ে বহুগুণে বেশি বিস্তৃত ছিল নৌপথ; নিজেরা সেই সৌভাগ্যের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেছি। ১৯৬০ সালে নৌপথ ছিল ১২ হাজার মাইল বা প্রায় কুড়ি হাজার কিলোমিটার। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট হাজার কিলোমিটারের মতো। তার মানে, গত অর্ধশতকে হারিয়ে গেছে ১২ হাজার কিলোমিটারের মতো নৌপথ। কিন্তু এখনও যতটুকু নৌপথ আছে, তা সংরক্ষণ ও সংস্কার করলে অন্তত দেশের বিভাগীয় শহর ও বৃহত্তর জেলা শহরগুলোকে যূথবদ্ধ করা সম্ভব। আর কিছু না হোক 'মহাসড়ক' যেখানে যেখানে বিস্তৃত হয়েছে, সে পর্যন্ত নৌপথে চলাচল তো সম্ভবই।
দুর্ভাগ্যবশত, প্রকৃতির অমূল্য উপহার নৌপথ আমরা ধরে রাখতে পারিনি, পারছি না। সড়কপথে যেখানে প্রতি কিলোমিটারে বিপুল নির্মাণ ও সংস্কার খরচ, নৌপথে সেখানে কেবল প্রয়োজন ছিল নজরদারি ও সংরক্ষণ। তার চেয়েও বড় কথা, একদা প্রধান রুট নৌপথ যে এখনও অন্তত বিকল্প হতে পারে, আমাদের নীতিনির্ধারকরা সেটা ভাবছেনই না! সড়ক ধর্মঘট বা রেল অবরোধের কারণে পায়ে হাঁটা জনতার মিছিল দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হই, যে কোনো মূল্যে 'মোবিলিটি' বজায় রাখার চেষ্টাও চলে। কিন্তু নৌপথও যে দেশের বিপুলসংখ্যক যাত্রীর একমাত্র ভরসা, সেটা আমাদের অনভ্যস্ত চোখে ধরাও পড়ে না।
অবরোধের এই কালে সড়ক ও নৌপথের চিত্র যদি তুলনা করা যায়, তাহলে দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে থাকার পরও আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন থেকে নৌপথ নিয়ে মনোযোগী হতে পারেন বৈকি। সন্দেহ নেই, নদীমাতৃক বাংলাদেশের গোটা নৌপথই যেখানে চরম অব্যবস্থাপনার শিকার, সেখানে এটা সহজ নয়। গত সাড়ে তিন দশকে নৌপথ সংরক্ষণের জন্য কোনো ড্রেজারও কেনা হয়নি। অভ্যন্তরীণ বন্দর ব্যবস্থাপনায় এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। মালপত্র ও যাত্রী হ্যান্ডলিংয়ে এখনও সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নৌপথে নিরাপত্তা ও বেশকিছু নিয়ন্ত্রণমূলক কাজে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এবং বিআইডবিল্গউটিএর মধ্যে চলছে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু আর কিছু না হোক, অবরোধ-হরতালের মতো জনসংকটের সময় বিকল্প হিসেবে নৌপথ ভরসা হতেই পারে। তাতে করে আর যাই হোক, আগুনের লেলিহান শিখায় সাধারণ নাগরিককে প্রাণ দিতে হবে না।
সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
বলাই বাহুল্য, অবরোধের এই অসহনীয় কালে অপেক্ষাকৃত সহনীয় নৌপথে হামলা ও হতাহতের হিসাব পাওয়া সহজ নয়। ফলে একেক দিনের পত্রিকা ধরে ধরে খুঁজতে হয়েছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রসূত্রে দেখা যাচ্ছে, অবরোধের দ্বিতীয় দিনে ৭ জানুয়ারি রাতে বরিশাল নদীবন্দরে নোঙর করা এমভি জনতা লঞ্চে আগুন দিয়েছিল 'দুর্বৃত্তরা'। বরিশাল থেকে কালাইয়া অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা লঞ্চটিতে রাত সাড়ে ৮টায় কেরোসিন দিয়ে লঞ্চে আগুন দেওয়া হয়। পরে স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ২০ জানুয়ারি বরিশাল থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন-৭ ও পারাবত-১০ লঞ্চে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পারাবত-১০ লঞ্চের স্টাফ ও যাত্রীরা জানান, লঞ্চটি রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘাট ছাড়ার ১০ মিনিট পরই হঠাৎ করে ১০১ কেবিনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। বিষয়টি দেখতে পেয়ে অন্যান্য যাত্রী ও স্টাফরা ছুটে এসে কেবিনের দরজা তালাবদ্ধ দেখতে পায়। পরে ডুপিল্গকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে আগুন নিভিয়ে ফেলে স্টাফরাই। ওই সময় কেবিনে কেউ না থাকলেও পেট্রোলের বোতল উদ্ধার করা হয়। লঞ্চটি না থামিয়ে ঢাকা চলে যায়। অপরদিকে ঘাট ছাড়ার ১০ মিনিট পর সুন্দরবন-৭ লঞ্চের তৃতীয় তলার ৩১৬ নম্বর কেবিনেও একই পদ্ধতিতে আগুন দেওয়া হয়। পাশের একটি কেবিনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অঘটনের পর লঞ্চটি ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে রাতেই লঞ্চটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
২৪ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের ৬নং পন্টুনে বিকেলে এমভি টিপু-৬ নামে এক যাত্রীবাহী লঞ্চের কেবিনে আগুন দেওয়া হয়। লঞ্চটি পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে সদরঘাট ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই লঞ্চের তৃতীয় তলার সবক'টি কেবিন পুড়ে যায়। অগি্নকাণ্ডের খবর পেয়ে যাত্রীরা সদরঘাট পন্টুনে নেমে যাওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একই দিন বিকেলে বরিশালের গাবখান চ্যানেলে বিআইডবিল্গউটিসির বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি বাঙালির ওপর গাবখান সেতু থেকে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। ঘটনার পরপরই পানির পাম্প চালিয়ে পাইপের মাধ্যমে বোমায় ছড়িয়ে পড়া আগুন নিভিয়ে ফেলে জাহাজ কর্তৃৃপক্ষ।
যদি আমার নিজের চোখ বা সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে গিয়ে না থাকে, তাহলে অবরোধের নৌপথে নাশকতার হিসাব মোটামুটি এ রকম_ ৩০ দিনের মধ্যে ৩ দিন নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে মোট পাঁচটি লঞ্চে_ এমভি জনতা, এমভি সুন্দরবন-৭, এমভি পারাবত-১০, এমভি টিপু-৬ ও এমভি বাঙালি। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সড়কপথে নাশকতার ঘটনার তুলনায় হতাহত কেবল শূন্য নয়, এমভি টিপু ছাড়া অন্য লঞ্চগুলোতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। নৌপথে নাশকতার এই হিসাব দিয়েই পুরো চিত্রায়ন সম্ভব ছিল। কিন্তু ওপরের দুই অনুচ্ছেদে লঞ্চ পাঁচটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
প্রথমত, পাঁচটি লঞ্চের দুটিই বন্দরে বা ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়েছে। অপর দুটি লঞ্চ বরিশাল বন্দর থেকে ছাড়ার কয়েক মিনিটের মাথায় আগুন দৃশ্যমান হয়েছে। এমভি বাঙালিতে যদিও আগুন দেওয়া হয়েছে চলন্ত অবস্থায়, দুর্বৃত্তদের অবস্থান ছিল গাবখান সেতুর ওপরে। তার মানে, সড়কপথে যেমন চলন্ত অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়, নৌপথে সেটা কারিগরিভাবেই সম্ভব নয়। ফলে সিদ্ধান্তে আসা যায়, লঞ্চে যদি তল্লাশি করে যাত্রী তোলা যায়, তাহলে নাশকতার সুযোগ থাকে না। নৌবন্দর বা ঘাটে কিংবা সংলগ্ন সেতুতে যদি প্রহরা বসানো যায়, তাহলে লঞ্চে নাশকতা ঠেকানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, পাঁচটির মধ্যে চারটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যায় বা রাতে। কেবল এমভি বাঙালিতে বিকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। ওই লঞ্চও বরিশাল পেঁৗছতে পেঁৗছতে সন্ধ্যা বা রাত হয়ে যেত, বলাই বাহুল্য। তার মানে বাসে বা সড়কপথের অন্যান্য যানবাহনে যেমন 'দিনে-দুপুরে' বোমা মারা সম্ভব, লঞ্চের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। নদীপথের যে প্রশস্ততা এবং অনেক দূর পর্যন্ত সমান্তরাল নজরদারিতে আনা যায়, তাতে করে সড়কপথের মতো বোমা মেরেই পালানোর বা লুকিয়ে পড়ার সুযোগ নেই দুর্বৃত্তদের। সড়কপথের যানবাহনে অনেক ক্ষেত্রে নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে উঠে নামার সময় বোমা ফাটিয়ে চলে গেছে। লঞ্চের ক্ষেত্রে সেটা কার্যত অসম্ভব।
তৃতীয়ত, লঞ্চের চারপাশেই থাকে আগুনের যম পানি। আগুন দিলেও খুব দ্রুতই ফায়ার সার্ভিস ছাড়াই লঞ্চের নিজস্ব পাম্প ব্যবহার করে আগুন নেভানো সম্ভব। এমভি বাঙালির ক্ষেত্রে সেভাবেই নিজস্ব পাম্প চালিয়ে আগুন নেভানো হয়েছে। এমভি টিপু ছাড়া হামলার শিকার অন্যান্য লঞ্চেও ফায়ার সার্ভিসের দরকার পড়েনি।
এটা স্পষ্ট যে, অবরোধ বা হরতালে নাশকতার যে 'ধ্রুপদী' চিত্র আমরা সড়কপথজুড়ে দেখে থাকি বা শিকারে পরিণত হই, নৌপথে তা কার্যত অচল। সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, সড়কপথের নেটওয়ার্ক যেমন দেশজুড়ে বিস্তৃত, নৌপথ তেমন নয়। এমন নয় যে, আমরা সেই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারিনি। বরং একসময় গোটা দেশে সড়কপথের চেয়ে বহুগুণে বেশি বিস্তৃত ছিল নৌপথ; নিজেরা সেই সৌভাগ্যের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেছি। ১৯৬০ সালে নৌপথ ছিল ১২ হাজার মাইল বা প্রায় কুড়ি হাজার কিলোমিটার। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট হাজার কিলোমিটারের মতো। তার মানে, গত অর্ধশতকে হারিয়ে গেছে ১২ হাজার কিলোমিটারের মতো নৌপথ। কিন্তু এখনও যতটুকু নৌপথ আছে, তা সংরক্ষণ ও সংস্কার করলে অন্তত দেশের বিভাগীয় শহর ও বৃহত্তর জেলা শহরগুলোকে যূথবদ্ধ করা সম্ভব। আর কিছু না হোক 'মহাসড়ক' যেখানে যেখানে বিস্তৃত হয়েছে, সে পর্যন্ত নৌপথে চলাচল তো সম্ভবই।
দুর্ভাগ্যবশত, প্রকৃতির অমূল্য উপহার নৌপথ আমরা ধরে রাখতে পারিনি, পারছি না। সড়কপথে যেখানে প্রতি কিলোমিটারে বিপুল নির্মাণ ও সংস্কার খরচ, নৌপথে সেখানে কেবল প্রয়োজন ছিল নজরদারি ও সংরক্ষণ। তার চেয়েও বড় কথা, একদা প্রধান রুট নৌপথ যে এখনও অন্তত বিকল্প হতে পারে, আমাদের নীতিনির্ধারকরা সেটা ভাবছেনই না! সড়ক ধর্মঘট বা রেল অবরোধের কারণে পায়ে হাঁটা জনতার মিছিল দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হই, যে কোনো মূল্যে 'মোবিলিটি' বজায় রাখার চেষ্টাও চলে। কিন্তু নৌপথও যে দেশের বিপুলসংখ্যক যাত্রীর একমাত্র ভরসা, সেটা আমাদের অনভ্যস্ত চোখে ধরাও পড়ে না।
অবরোধের এই কালে সড়ক ও নৌপথের চিত্র যদি তুলনা করা যায়, তাহলে দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে থাকার পরও আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন থেকে নৌপথ নিয়ে মনোযোগী হতে পারেন বৈকি। সন্দেহ নেই, নদীমাতৃক বাংলাদেশের গোটা নৌপথই যেখানে চরম অব্যবস্থাপনার শিকার, সেখানে এটা সহজ নয়। গত সাড়ে তিন দশকে নৌপথ সংরক্ষণের জন্য কোনো ড্রেজারও কেনা হয়নি। অভ্যন্তরীণ বন্দর ব্যবস্থাপনায় এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। মালপত্র ও যাত্রী হ্যান্ডলিংয়ে এখনও সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নৌপথে নিরাপত্তা ও বেশকিছু নিয়ন্ত্রণমূলক কাজে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এবং বিআইডবিল্গউটিএর মধ্যে চলছে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু আর কিছু না হোক, অবরোধ-হরতালের মতো জনসংকটের সময় বিকল্প হিসেবে নৌপথ ভরসা হতেই পারে। তাতে করে আর যাই হোক, আগুনের লেলিহান শিখায় সাধারণ নাগরিককে প্রাণ দিতে হবে না।
সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments