নাশকতা মোকাবেলায় দ্বিতীয় ফ্রন্ট অবশ্যই দরকার by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
গত
বৃহস্পতিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) গণজাগরণ মঞ্চের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
উপলক্ষে গণজাগরণ দিবস পালিত হলো। এবারের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ
বদ্ধমুষ্টি উঁচিয়ে শপথ গ্রহণ করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নতুন যুদ্ধ_
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। ঢাকার রাজপথে তারা মিছিল করেছে; দেশের
সর্বত্র সন্ত্রাসকে প্রতিহত করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিএনপি-জামায়াতের
নাশকতামূলক কাজে যখন দেশ জর্জরিত, তখন তার বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের একটা
অংশের মাথা তুলে দাঁড়ানো আশার লক্ষণ।
দু'বছর আগে যে প্রলয়োল্লাসের শক্তি নিয়ে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব, সেই শক্তি এখন অবশ্য তার নেই। কিন্তু মঞ্চের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে এবং তার আবেদনও দেশের তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল অংশের মধ্যে রয়ে গেছে। এটা দেশের মানুষের কাছে ভরসার কথা। আওয়ামী লীগ সরকার যদি গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে ভয়ের চোখে না দেখত এবং মঞ্চের তরুণ নেতৃত্ব যদি প্রথম দিকে নীতিনির্ধারণে কিছু ভুল না করত, তাহলে সরকার ও তরুণ প্রজন্মের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে চূড়ান্ত পরাজয় থেকে মৌলবাদের হিংস্র দানব আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত না এবং বিএনপির কাঁধে চড়ে সারাদেশে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করতেও সক্ষম হতো না।
এটা আমাদের গণতান্ত্রিক শিবিরের বহুবারের পদস্খলন। যখনই তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং গণতন্ত্রবিরোধী চক্রকে চূড়ান্ত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়, ঠিক সেই মুহূর্তে কী এক জাদুযন্ত্রে যেন গণতান্ত্রিক শিবিরে ঐক্য ভেঙে যায়। তারা আত্মঘাতী বিবাদে লিপ্ত হন। ফলে হিংস্র ও ঘাতকচক্র সুযোগ পেয়ে নিজেদের পরাজয় ঠেকায় এবং গণতান্ত্রিক শিবিরের বিজয় সহজেই ছিনিয়ে নেয়। এটা আমরা '৫৪ সালে দেখেছি। '৫৭ সালে (আওয়ামী লীগে ভাঙন ও ন্যাপের জন্ম) দেখেছি। স্বাধীনতার পর '৭৫ সালে দেখেছি। '৯০ সালে দেখেছি এবং এখনও দেখছি।
২০১৩ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া চলার মুহূর্তে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম। এই মঞ্চে নানা দলমতের তরুণদের সমাবেশ ঘটেছিল এবং ছিল যৌথ নেতৃত্ব। ফলে এই মঞ্চের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়তো ছিল। তবু আওয়ামী লীগ সরকারের পরোক্ষ সমর্থন এই মঞ্চের পেছনে ছিল এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগও এই মঞ্চে এসে কাতারবন্দি হয়েছিল। তখন ঢাকায় মহাগণজাগরণের যে সমদ্রোচ্ছ্বাস জেগেছিল, তা অভূতপূর্ব। মনে হয়েছিল, স্বাধীনতা ও মানবতার শত্রুপক্ষ এবার চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে।
কিন্তু তারা পরাজিত হলো না। নিশ্চিহ্ন হওয়া দূরের কথা, মঞ্চের ঐক্য বিভক্তির মুখে দাঁড়াল। ছাত্রলীগ সহসা মঞ্চ থেকে দূরে সরে গেল। পাল্টা মঞ্চ খাড়া করার প্রচেষ্টা শুরু হলো। মঞ্চের নেতৃত্বকে নানা অপবাদ দিয়ে তাদের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করা শুরু হলো। মঞ্চের নেতৃত্বও যে কিছু কিছু ভুল করেননি তা নয়। তারাও আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন এবং এমন কিছু কর্মসূচি নিয়েছেন, যা ছিল স্বাধীনতার শত্রুশিবিরের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার শামিল। গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টি করার জন্য শত্রুশিবিরের চক্রান্ত তো ছিলই। এমনকি দেশের বিগ এনজিওর মুখপাত্রগুলোও নিজেদের স্বার্থে এই চক্রান্তে জড়িত হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে ভয় পেল আর গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বও হয়তো ভাবলেন, আওয়ামী লীগের সর্বগ্রাসী গ্রাস থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া বুঝি প্রয়োজন। এ বুদ্ধিটা কেউ তাদের জুগিয়ে থাকলে কে জুগিয়েছে তা আমি জানি না। সিপিবির নেতারা? ড. কামাল হোসেন অথবা ইউনূস শিবিরের লোকেরা? আমি এবার ঢাকায় থাকার সময় প্রশ্নটা মঞ্চনেতা ডা. ইমরানকে করেছিলাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ড. কামাল হোসেন বা ইউনূস শিবিরের সঙ্গে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি এখনও আওয়ামী লীগকেই মিত্রপক্ষ ভাবেন। স্বাধীনতা ও মানবতার সন্ত্রাসী শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা চান।
তাহলে আওয়ামী লীগ ও গণজাগরণ মঞ্চের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল কেন? যা দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্য ও শক্তি খর্ব করেছে। পাল্টা হেফাজতি অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। সন্দেহ নেই, প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতি অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল বিএনপি ও জামায়াতের নীলনকশা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতা এবং আপসবাদী ভূমিকাও যে তার পেছনে উৎসাহ জুগিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের এই আপসবাদী ভূমিকা এবং পাল্টা গণজাগরণ মঞ্চ খাড়া করার পেছনে উৎসাহদান বিএনপি-জামায়াতকে আবার গত ৬ জানুয়ারির পর পশুশক্তি নিয়ে সন্ত্রাসে নামার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
আমি আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদের ভ্রান্তনীতি সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছি। গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদেরও বলেছি, স্বাধীনতার শত্রু এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ। একইভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সমদূরত্বের অবস্থান নিলে তারা ভুল করবেন। এটা সিপিবির মতো বর্তমানের গণবিচ্ছিন্ন ও তত্ত্বসর্বস্ব দলের নীতি হতে পারে; কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের মতো 'ব্রড চার্চের' নীতি হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো কোনো ভুল কাজের প্রতিবাদ তারা জানাতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান তারা নিতে পারেন না।
বিএনপি-জামায়াত তো গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্য ভাঙার জন্য সতত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরেও একটা কট্টর ডানপন্থি গ্রুপ আছে, মঞ্চের নাম ও কর্মসূচি যাদের কাছে অ্যালার্জি। তাদের গোপন উৎসাহেই পাল্টা মঞ্চ তৈরি হয় এবং মঞ্চের সভা-সমাবেশ নষ্ট করার জন্য এরা চেষ্টা চালায়। বিস্ময়ের কথা এই যে, মঞ্চ যখন স্বাধীনতার শত্রুদের বিরোধিতা করার জন্য সভা-সমাবেশ ডাকে, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থিত বলে কথিত এই গ্রুপগুলোই তাতে বাধা দিতে পাল্টা সমাবেশ ডাকে, মাইক বাজায় এবং নানা উপদ্রব সৃষ্টি করে। এটা আত্মঘাতী নীতি। বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশে যারা বাধা সৃষ্টি করার সাহস দেখায় না বা তাদের সন্ত্রাস রুখতে এগিয়ে যায় না; তারা স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসেই যে শক্তি জোগাচ্ছে তা কি তারা বুঝতে পারে না?
সুখের কথা, এবার ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গণজাগরণ দিবস পালনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সমর্থক গ্রুপ হিসেবে কথিত অথবা পরিচিত দল বা দলগুলো বাধা সষ্টি করার কাজে এগিয়ে আসেনি বা আসতে পারেনি। তাদের পেছনে জনসমর্থনের (নবজাগ্রত তরুণদের) অভাব আছে এবং শেখ হাসিনারও এবার নাকি শক্ত নির্দেশ ছিল, এরা যেন গণজাগরণ দিবসের সমাবেশে উৎপাত সৃষ্টি করতে না যায়। আমার ধারণা, অন্তত শেখ হাসিনা এ কথা উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশকে হিংস্র মৌলবাদের ছোবল থেকে রক্ষা করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে গণজাগরণ মঞ্চ তথা দেশের নবজাগ্রত তারুণ্যের সমর্থন তার দরকার। এরা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ নয়; বরং আওয়ামী লীগের সম্পূরক শক্তি।
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সংগ্রামে যে একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট প্রয়োজন, এ কথা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন গত শতকের ষাটের দশকে ছয় দফার আন্দোলনের সময়। ছয় দফা ঘোষিত হওয়ার পর বাম ছাত্রসমাজ থেকে ১১ দফা দাবি ঘোষিত হয়। তখনও আওয়ামী লীগের ভেতরের একটা কট্টর ডানপন্থি কোটারি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, ১১ দফা হচ্ছে ছয় দফার পাল্টা প্রস্তাব। ছয় দফার আন্দোলনকে নষ্ট করাই এর লক্ষ্য। সুতরাং ১১ দফার দাবিদারদের আগে মোকাবেলা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একমত হননি। তিনি বলেছেন, ১১ দফা হলো ছয় দফার সম্পূরক দাবি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ১১ দফাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান ও বলেন, 'এই ছয় ও ১১ দফার ভিত্তিতে যৌথ আন্দোলন গড়ে উঠবে এবং তা হবে আমাদের দাবি আদায়ের অপরাজেয় শক্তি।' বঙ্গবন্ধুর কথা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। ছয় দফা ও ১১ দফার সম্মিলিত আন্দোলনেই দেশে সামরিক শাসনবিরোধী বিশাল গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল।
বর্তমান বাংলাদেশেও গণজাগরণ মঞ্চকে আওয়ামী লীগের উচিত হবে, স্বাধীনতার শত্রু ও সন্ত্রাস দমনের আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মঞ্চকে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার ব্যাপারে উৎসাহিত করা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সমাবেশে মঞ্চ সারাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত হবে, এই অভিযানে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
ছাত্রলীগ এখনও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বড় ছাত্র প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার ক্রেডিবিলিটি আত্মকলহ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লাইসেন্সবাজির জন্য এখন অনেকটাই নষ্ট। ফলে জনজীবনে আন্দোলন করার আবেদন সে সৃষ্টি করতে পারছে না। গণজাগরণ মঞ্চের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়ে এবং সহায়তা দিয়ে ছাত্রলীগ তার নষ্ট ক্রেডিবিলিটি উদ্ধার করতে পারে। তাতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান আরও শক্তিশালী হবে। বিষয়টি ছাত্রলীগ নেতারা ভেবে দেখুন।
৫ ফেব্রুয়ারির গণজাগরণ দিবসের সমাবেশকে দুই বছর আগের বিশাল সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তুলনা করা উচিতও নয়। তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ এখন নেই। সেই গণঐক্য নেই। অবিরাম ব্যর্থ হরতাল, অবরোধের ডাক এবং অগি্নকাণ্ড ও বোমাবাজি দ্বারা নিরীহ মানুষ হত্যার তাণ্ডবে জনজীবনে একটা ভীতিকর ও বিভ্রান্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু এই প্রতিকূল অবস্থা এবং ভেতরের ও বাইরের নানা বাধা সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্মের সংগ্রামী ভূমিকা যে দমিত হয়নি, গত ৫ তারিখের সমাবেশ তার প্রমাণ। এই সমাবেশ দেশে বিরাজিত ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে একটি সাহস ও আশার আলো।
গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান নীতি ও নেতৃত্ব অপরিবর্তিত থাকলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার কর্মসূচি তারা নিয়েছেন তা জনসমর্থন পাবে এবং সফল হওয়ার পথে অবশ্যই এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বর্তমান সন্ত্রাস দমনে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় হয়নি।' আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। ছিঁচকে সন্ত্রাস যত নৃশংস ও বর্বর হোক, তা দমনে কামান দাগানোর প্রয়োজন নেই। সরকার সন্ত্রাসীদের দমনে আরও কঠোর হোক এবং এই সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য তরুণ প্রজন্মের যে অংশ আজ উন্মুখ ও সক্রিয়, তাদের সহায়তা দিক। গণশত্রু দমনে গণজাগরণই হচ্ছে মোক্ষম দাওয়াই।
লন্ডন, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
দু'বছর আগে যে প্রলয়োল্লাসের শক্তি নিয়ে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব, সেই শক্তি এখন অবশ্য তার নেই। কিন্তু মঞ্চের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে এবং তার আবেদনও দেশের তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল অংশের মধ্যে রয়ে গেছে। এটা দেশের মানুষের কাছে ভরসার কথা। আওয়ামী লীগ সরকার যদি গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে ভয়ের চোখে না দেখত এবং মঞ্চের তরুণ নেতৃত্ব যদি প্রথম দিকে নীতিনির্ধারণে কিছু ভুল না করত, তাহলে সরকার ও তরুণ প্রজন্মের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে চূড়ান্ত পরাজয় থেকে মৌলবাদের হিংস্র দানব আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারত না এবং বিএনপির কাঁধে চড়ে সারাদেশে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করতেও সক্ষম হতো না।
এটা আমাদের গণতান্ত্রিক শিবিরের বহুবারের পদস্খলন। যখনই তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং গণতন্ত্রবিরোধী চক্রকে চূড়ান্ত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়, ঠিক সেই মুহূর্তে কী এক জাদুযন্ত্রে যেন গণতান্ত্রিক শিবিরে ঐক্য ভেঙে যায়। তারা আত্মঘাতী বিবাদে লিপ্ত হন। ফলে হিংস্র ও ঘাতকচক্র সুযোগ পেয়ে নিজেদের পরাজয় ঠেকায় এবং গণতান্ত্রিক শিবিরের বিজয় সহজেই ছিনিয়ে নেয়। এটা আমরা '৫৪ সালে দেখেছি। '৫৭ সালে (আওয়ামী লীগে ভাঙন ও ন্যাপের জন্ম) দেখেছি। স্বাধীনতার পর '৭৫ সালে দেখেছি। '৯০ সালে দেখেছি এবং এখনও দেখছি।
২০১৩ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া চলার মুহূর্তে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম। এই মঞ্চে নানা দলমতের তরুণদের সমাবেশ ঘটেছিল এবং ছিল যৌথ নেতৃত্ব। ফলে এই মঞ্চের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়তো ছিল। তবু আওয়ামী লীগ সরকারের পরোক্ষ সমর্থন এই মঞ্চের পেছনে ছিল এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগও এই মঞ্চে এসে কাতারবন্দি হয়েছিল। তখন ঢাকায় মহাগণজাগরণের যে সমদ্রোচ্ছ্বাস জেগেছিল, তা অভূতপূর্ব। মনে হয়েছিল, স্বাধীনতা ও মানবতার শত্রুপক্ষ এবার চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে।
কিন্তু তারা পরাজিত হলো না। নিশ্চিহ্ন হওয়া দূরের কথা, মঞ্চের ঐক্য বিভক্তির মুখে দাঁড়াল। ছাত্রলীগ সহসা মঞ্চ থেকে দূরে সরে গেল। পাল্টা মঞ্চ খাড়া করার প্রচেষ্টা শুরু হলো। মঞ্চের নেতৃত্বকে নানা অপবাদ দিয়ে তাদের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করা শুরু হলো। মঞ্চের নেতৃত্বও যে কিছু কিছু ভুল করেননি তা নয়। তারাও আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন এবং এমন কিছু কর্মসূচি নিয়েছেন, যা ছিল স্বাধীনতার শত্রুশিবিরের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার শামিল। গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টি করার জন্য শত্রুশিবিরের চক্রান্ত তো ছিলই। এমনকি দেশের বিগ এনজিওর মুখপাত্রগুলোও নিজেদের স্বার্থে এই চক্রান্তে জড়িত হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার গণজাগরণ মঞ্চের জনপ্রিয়তাকে ভয় পেল আর গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বও হয়তো ভাবলেন, আওয়ামী লীগের সর্বগ্রাসী গ্রাস থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া বুঝি প্রয়োজন। এ বুদ্ধিটা কেউ তাদের জুগিয়ে থাকলে কে জুগিয়েছে তা আমি জানি না। সিপিবির নেতারা? ড. কামাল হোসেন অথবা ইউনূস শিবিরের লোকেরা? আমি এবার ঢাকায় থাকার সময় প্রশ্নটা মঞ্চনেতা ডা. ইমরানকে করেছিলাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ড. কামাল হোসেন বা ইউনূস শিবিরের সঙ্গে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি এখনও আওয়ামী লীগকেই মিত্রপক্ষ ভাবেন। স্বাধীনতা ও মানবতার সন্ত্রাসী শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা চান।
তাহলে আওয়ামী লীগ ও গণজাগরণ মঞ্চের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল কেন? যা দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্য ও শক্তি খর্ব করেছে। পাল্টা হেফাজতি অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। সন্দেহ নেই, প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতি অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল বিএনপি ও জামায়াতের নীলনকশা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতা এবং আপসবাদী ভূমিকাও যে তার পেছনে উৎসাহ জুগিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের এই আপসবাদী ভূমিকা এবং পাল্টা গণজাগরণ মঞ্চ খাড়া করার পেছনে উৎসাহদান বিএনপি-জামায়াতকে আবার গত ৬ জানুয়ারির পর পশুশক্তি নিয়ে সন্ত্রাসে নামার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
আমি আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদের ভ্রান্তনীতি সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছি। গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদেরও বলেছি, স্বাধীনতার শত্রু এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ। একইভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সমদূরত্বের অবস্থান নিলে তারা ভুল করবেন। এটা সিপিবির মতো বর্তমানের গণবিচ্ছিন্ন ও তত্ত্বসর্বস্ব দলের নীতি হতে পারে; কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের মতো 'ব্রড চার্চের' নীতি হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো কোনো ভুল কাজের প্রতিবাদ তারা জানাতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান তারা নিতে পারেন না।
বিএনপি-জামায়াত তো গণজাগরণ মঞ্চের ঐক্য ভাঙার জন্য সতত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরেও একটা কট্টর ডানপন্থি গ্রুপ আছে, মঞ্চের নাম ও কর্মসূচি যাদের কাছে অ্যালার্জি। তাদের গোপন উৎসাহেই পাল্টা মঞ্চ তৈরি হয় এবং মঞ্চের সভা-সমাবেশ নষ্ট করার জন্য এরা চেষ্টা চালায়। বিস্ময়ের কথা এই যে, মঞ্চ যখন স্বাধীনতার শত্রুদের বিরোধিতা করার জন্য সভা-সমাবেশ ডাকে, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থিত বলে কথিত এই গ্রুপগুলোই তাতে বাধা দিতে পাল্টা সমাবেশ ডাকে, মাইক বাজায় এবং নানা উপদ্রব সৃষ্টি করে। এটা আত্মঘাতী নীতি। বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশে যারা বাধা সৃষ্টি করার সাহস দেখায় না বা তাদের সন্ত্রাস রুখতে এগিয়ে যায় না; তারা স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসেই যে শক্তি জোগাচ্ছে তা কি তারা বুঝতে পারে না?
সুখের কথা, এবার ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গণজাগরণ দিবস পালনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সমর্থক গ্রুপ হিসেবে কথিত অথবা পরিচিত দল বা দলগুলো বাধা সষ্টি করার কাজে এগিয়ে আসেনি বা আসতে পারেনি। তাদের পেছনে জনসমর্থনের (নবজাগ্রত তরুণদের) অভাব আছে এবং শেখ হাসিনারও এবার নাকি শক্ত নির্দেশ ছিল, এরা যেন গণজাগরণ দিবসের সমাবেশে উৎপাত সৃষ্টি করতে না যায়। আমার ধারণা, অন্তত শেখ হাসিনা এ কথা উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশকে হিংস্র মৌলবাদের ছোবল থেকে রক্ষা করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে গণজাগরণ মঞ্চ তথা দেশের নবজাগ্রত তারুণ্যের সমর্থন তার দরকার। এরা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ নয়; বরং আওয়ামী লীগের সম্পূরক শক্তি।
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সংগ্রামে যে একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট প্রয়োজন, এ কথা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন গত শতকের ষাটের দশকে ছয় দফার আন্দোলনের সময়। ছয় দফা ঘোষিত হওয়ার পর বাম ছাত্রসমাজ থেকে ১১ দফা দাবি ঘোষিত হয়। তখনও আওয়ামী লীগের ভেতরের একটা কট্টর ডানপন্থি কোটারি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, ১১ দফা হচ্ছে ছয় দফার পাল্টা প্রস্তাব। ছয় দফার আন্দোলনকে নষ্ট করাই এর লক্ষ্য। সুতরাং ১১ দফার দাবিদারদের আগে মোকাবেলা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একমত হননি। তিনি বলেছেন, ১১ দফা হলো ছয় দফার সম্পূরক দাবি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ১১ দফাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান ও বলেন, 'এই ছয় ও ১১ দফার ভিত্তিতে যৌথ আন্দোলন গড়ে উঠবে এবং তা হবে আমাদের দাবি আদায়ের অপরাজেয় শক্তি।' বঙ্গবন্ধুর কথা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। ছয় দফা ও ১১ দফার সম্মিলিত আন্দোলনেই দেশে সামরিক শাসনবিরোধী বিশাল গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল।
বর্তমান বাংলাদেশেও গণজাগরণ মঞ্চকে আওয়ামী লীগের উচিত হবে, স্বাধীনতার শত্রু ও সন্ত্রাস দমনের আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মঞ্চকে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার ব্যাপারে উৎসাহিত করা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সমাবেশে মঞ্চ সারাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত হবে, এই অভিযানে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
ছাত্রলীগ এখনও দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বড় ছাত্র প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার ক্রেডিবিলিটি আত্মকলহ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লাইসেন্সবাজির জন্য এখন অনেকটাই নষ্ট। ফলে জনজীবনে আন্দোলন করার আবেদন সে সৃষ্টি করতে পারছে না। গণজাগরণ মঞ্চের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়ে এবং সহায়তা দিয়ে ছাত্রলীগ তার নষ্ট ক্রেডিবিলিটি উদ্ধার করতে পারে। তাতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান আরও শক্তিশালী হবে। বিষয়টি ছাত্রলীগ নেতারা ভেবে দেখুন।
৫ ফেব্রুয়ারির গণজাগরণ দিবসের সমাবেশকে দুই বছর আগের বিশাল সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তুলনা করা উচিতও নয়। তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ এখন নেই। সেই গণঐক্য নেই। অবিরাম ব্যর্থ হরতাল, অবরোধের ডাক এবং অগি্নকাণ্ড ও বোমাবাজি দ্বারা নিরীহ মানুষ হত্যার তাণ্ডবে জনজীবনে একটা ভীতিকর ও বিভ্রান্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু এই প্রতিকূল অবস্থা এবং ভেতরের ও বাইরের নানা বাধা সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্মের সংগ্রামী ভূমিকা যে দমিত হয়নি, গত ৫ তারিখের সমাবেশ তার প্রমাণ। এই সমাবেশ দেশে বিরাজিত ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে একটি সাহস ও আশার আলো।
গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান নীতি ও নেতৃত্ব অপরিবর্তিত থাকলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার কর্মসূচি তারা নিয়েছেন তা জনসমর্থন পাবে এবং সফল হওয়ার পথে অবশ্যই এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বর্তমান সন্ত্রাস দমনে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় হয়নি।' আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। ছিঁচকে সন্ত্রাস যত নৃশংস ও বর্বর হোক, তা দমনে কামান দাগানোর প্রয়োজন নেই। সরকার সন্ত্রাসীদের দমনে আরও কঠোর হোক এবং এই সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য তরুণ প্রজন্মের যে অংশ আজ উন্মুখ ও সক্রিয়, তাদের সহায়তা দিক। গণশত্রু দমনে গণজাগরণই হচ্ছে মোক্ষম দাওয়াই।
লন্ডন, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার
No comments