সংলাপের বিকল্প নেই -ঐক্য প্রক্রিয়ার গোলটেবিলে নাগরিক সমাজ
দেশের
চলমান সঙ্কটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
সঙ্কটের সমাধানে সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। বলেছেন, একটি স্বাধীন ও
গণতান্ত্রিক দেশে সংলাপ ছাড়া সঙ্কট নিরসনের কোন বিকল্প নেই। সংলাপ হতে হবে
দেশের সকল সক্রিয় রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষের কার্যকর
অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশে একদল আরেক দলকে নির্মূল করতে
চায়। কিন্তু তা কখনও হবে না। কেউ কাউকে নির্মূল করতে পারবে না। নাগরিক
সমাজের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বলেছেন, দেশের অভিভাবক হিসেবে প্রেসিডেন্ট
এগিয়ে আসতে পারেন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তিন থেকে পাঁচজন নাগরিকের কমিটি
করে দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংলাপের প্রক্রিয়া শুরু করার পক্ষেও মত
আসে।
গতকাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ক গোলটেবিলে বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সঞ্চালনায় প্রথম পর্বের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। আর দ্বিতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা। অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। বৈঠকে বেশকিছু প্রস্তাব রাখেন আলোচকরা। আয়োজকরা জানান, কিছুদিনের মধ্যে আরেকটি বৈঠক করে এসব প্রস্তাবনা দুই নেত্রীর কাছে পাঠানো হবে। এতে সাড়া না পেলে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের শরণাপন্ন হবেন তারা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’- শীর্ষক প্রস্তাবে বলেন, দেশে আজ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সঙ্কট উত্তরণের মাধ্যমে জনগণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী। আলোচনায় অংশ নেন, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সিএম শফি সামি, রাশেদা কে. চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডাকসু’র সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবাইয়াত ফেরদৌস প্রমুখ।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের চলমান সঙ্কটে আমরা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। এই সঙ্কট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নিয়মের মধ্য থেকেই তা করতে হবে। এই তাগিদ থেকে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, বাঙালি অসাধারণ জাতি। একাত্তরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জাতির সামনে এখন চ্যালেঞ্জ। ১৬ কোটি মানুষ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না এটা ঠিক না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ম্যান্ডেলা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন। রুগ্ণ রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের মানুষের পরিচয় দিতে হবে।
ড. আকবর আলি খান বলেন, দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল একে-অপরকে নির্মূলে মেতে উঠেছে। তারা সম্পূর্ন অবাস্তবতার ওপর নির্ভর করে লড়াই চালাচ্ছেন। কেউ কাউকে নির্মূল করতে পারবেন না। যে অবস্থা চলছে তা থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য আগে দু’দলের রাজনীতিবিদদের গালিগালাজ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দুই রাজনীতিক জোট একে-অপরকে যে ভাষায় কথা বলছে তাতে মনে হয় না তারা একসঙ্গে বসতে পারবে। এরজন্য তিনি অন্তত এক সপ্তাহ গালিগালাজ বন্ধ করার আহ্বান করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, যেভাবে সব পেশার লোক দলীয়করণ হচ্ছে তাতে সুশীল সমাজ বলে কিছু নেই। বতর্মানে সুশীল সমাজ অ-সুশীল হয়ে গেছে। কোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি চাকরিজীবী সব খানেই যারা সুশীল হিসেবে কাজ করবে তারাই দলীয় হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সুশীল সমাজ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই আগে সুশীল সমাজের রাজনীতিকরণ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনীতিবিদরেই ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য তৃণমূল থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই পরিস্থিতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তা করতে না পারলে পরণতি আরও ভয়ানক হবে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত কি হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে আশাবাদী এ কারণে যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে সে জাতি পথ হারাবে না।
এম. হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনীতিবিদদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এখানে ম্যান্ডেলার কথা বলা হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে ম্যান্ডেলার মতো কোন নেতা নেই। তিনি বলেন, সংলাপের জন্য দুই দলকে বাধ্য করতে হবে। নাগরিক সমাজকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে সোচ্চার ও একমত হতে হবে।
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, এদেশের ভোটাররা সুযোগ পেলে দুই তৃতীয়াংশকে এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনতে পারে। কিন্তু তাদের তো সেই সুযোগ দেয়া হয় না। তিনি বলেন, বিনাশী বিভাজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিভাজন নেই। আমরা শান্তি চাই। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সহিংসতা দিয়ে সহিংসতা প্রতিরোধ করা যায় না। প্রতিপক্ষকে এখন শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সব ধরনের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। এতে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখছে? তিনি বলেন, দলীয় রাজনীতির খপ্পরে পড়ে সিভিলিয়ানরা আনসিভিলিয়ান হয়ে যাচ্ছে। তাই বর্তমানের সঙ্কট সমাধান রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে।
ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট হয়। এরপর সেনাশাসন আসে। সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একই অবস্থা চলে আসছে। ক্ষমতা হস্তান্তর সব সময় একই প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না। তার মানে এ প্রক্রিয়া শুদ্ধ নয়। এতে গলদ আছে। যতদিন এ প্রক্রিয়া শুদ্ধ হচ্ছে না ততদিন এ সমস্যা থেকেই যাবে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এ নিয়ে কোন কাজ করেন না। একটা নির্বাচন দিয়ে এর সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সমাধান দাবি করেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রের মৌলিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন থাকতে হবে বলে জানান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, ইসি, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিচার ব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এগুলোকে রাজনীতিকরণ করা যাবে না। সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আলোচনার জন্য দুই দলকেই বারবার বেছে নেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনে দেখেছি দুই দলকে ভোটাররা এক তৃতীয়াংশ করে ভোট দেয়। বাকি ভোট পান অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দল যদি রাজনীতিতে সুযোগ না পান তাহলে অসম্পূর্ণতা থাকে।
বিকল্প ধারার মহাসচিব এমএ মান্নান বলেন, বর্তমানের আন্দোলন ১৯৯৬ সালের অসহযোগ আন্দোলনের মতো। তবে ডাইমেনশন পরিবর্তন হয়েছে। এতে নতুন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা ভয়াবহ ও নিন্দনীয়। এর স্থায়ী সমাধান লাগবে। যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই ক্ষমতা স্থায়ী করতে চায়। আসলে ক্ষমতার পালাবদল হয় তবে সঙ্কটের সমাধান হয় না। এজন্য তিনি সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন।
আ স ম রব বলেন, আজকের যে জাতীয় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা রাজনৈতিক। এটা অস্ত্র দিয়ে, মানুষ হত্যা করে এর সমাধান সম্ভব না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে- রাষ্ট্র শুধুমাত্র দুই দলের। ২০৪১ সাল পর্যন্ত একদল ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলবো এজন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। পুরো দেশ জ্বলছে, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না। জাতীয় সংলাপ মানে শুধু দুই দল সংলাপে থাকবেন- তা হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে ১৬ কোটি মানুষের আস্থা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। সংবিধানকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করতে হলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুমতি নিতে হয়। এটা সংবিধানে আছে। ক্ষমতার জন্য দেশটাকে জাহান্নামে রূপান্তরিত করেছে। বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছে বলেই সরকার জনগণকে ভয় পায়। ক্ষমতায় থাকলে সবাই সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আর ক্ষমতার বাইরে গেলে সহিংসতা করেন। পাঁচ সদস্যের নাগরিক কমিটি করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সংলাপ হতে হবে। সেটা হবে জাতীয় সংলাপ। বল সরকারের কোর্টে। কারণ সাংবিধানিক ক্ষমতা বিরোধী জোটের হাতে নাই। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর গ্যারান্টি পাওয়ার অধিকার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কি এমন সমস্যা হলো যে, তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করতে হলো। বল প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক তিনি প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সমস্যা সমাধানে তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সঙ্কটের এমনভাবে সমাধান করতে হবে যেন কোন পক্ষই সুবিধা বঞ্চিত না হন। খালেদা জিয়াকে অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বাদ দিয়ে যেসব নেতা গ্রেপ্তার রয়েছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। সংলাপ চলাকালীন বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বিক্ষোভ করা যাবে না। আমাদের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা নাই এ কথা ঠিক না। আমাদের মধ্যে ড. ইউনূস ও রেহমান সোবহানের মতো মানুষ আছেন। তিনি আরও বলেন, সংলাপ ছাড়া কোন গুলি, কোন বোমা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। জনগণের শক্তি বড় শক্তি। মান্না আরও বলেন, বর্তমান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্কটের কারণে। বিরোধী জোট অবরোধ প্রত্যাহার করলে সরকার যদি সংলাপ আয়োজন না করে সে গ্যারান্টি পাচ্ছে না।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, রাজনীতির নামে বর্তমানে বলি খেলা চলছে। অনেকে রাজনীতিবিদদের গালাগালি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- তাদের নেতৃত্ব ছাড়া জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব না। বাংলাদেশ ইস্যুতে মধ্যস্থতা প্রয়োজন ওবামা ও মোদির। বর্তমান সঙ্কটের বীজ পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে পুলিশি ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে।
সাবেক অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, বিরোধী জোটকে পেট্রলবোমা মারা বন্ধ করতে হবে। আর সরকারকে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এডভোকেট সুব্রত রায় চৌধুরী বলেন, প্রশাসনে সর্বত্র দলীয়করণ হয়েছে। দলবাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে রোল মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সিএম শফি সামি বলেন, দেশে বিনাশী ও বিভাজনের রাজনীতি চলছে। গণতন্ত্র মানেই সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা। ভিন্ন মতাদর্শের হলেও তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে। সাধারণ মানুষ কেন মরবে। তারা তো রাজনীতি করে না। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। লোকজন আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাদের অভিযোগগুলো খণ্ডনে প্রয়োজন। ভারতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। আর বাংলাদেশে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবে। যে জাতি মাত্র চার দশক আগে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল সেই জাতি সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এক হতে পারবে না এটা অবিশ্বাস্য। রাজনীতিক বিভাজন অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেজা কিবরিয়া বলেন, আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ জনগণ শাসন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে রাষ্ট্র অকার্যকর হওয়ার ভয় থাকে। বর্তমানে যে সঙ্কট চলছে এর প্রভাব অর্থনীতির ওপর আগামী দুই বছর পর্যন্ত থাকবে। সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু দমনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব না। দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের সঙ্কট ও সমস্যা ভিন্নধর্মী। এর সমাধানও ভিন্নধর্মী হবে। ইতিহাসের বাঁক বদল হয়েছে বলেই আমরা এই জায়গায় এসেছি। সেই ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এই মুহূর্তে দেশে রাজনীতি বলতে কিছু দেখছি না। রাজনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজনীতিবিদদের সুবচনে ঘাটতি রয়েছে। দৈব কিছু না ঘটলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপ করবে না। সুতরাং দু’টি বিবাদমান পক্ষ সমাধানে আসতে না পারলে তৃতীয় পক্ষকে ভূমিকা রাখতে হয়। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সুশীল সমাজের রাজনৈতিক দর্শন থাকতে পারে তবে তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য নেই। এই সমাবেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নাগরিকদের মধ্য থেকে ৩-৫ জনের একটি কমিটি করতে হবে। সেই কমিটি দুই পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে নাম চাইবে। তারা তৃতীয় পক্ষে একটি সংলাপ করবে। পরোক্ষ সংলাপের আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ বলেন, সমস্যার উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করলে চলবে না। এর মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। সমস্যার সমাধান এমনভাবে করতে হবে দু’পক্ষই যেন কিছু অর্জন করে।
শাহদীন মালিক বলেন, আদালতের কাজ হলো- আইনি বিতর্কের সমাধান দেয়া। আইনি বিতর্কের সমাধান করা। ইদানিংকালে আদালত রাজনৈতিক ব্যাপারে সুরাহা করার চেষ্টা করছে। এতে দেশের কল্যাণ হয় না। একটি রায়ের পর থেকে এ সঙ্কট শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে কোন ব্যাপারে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে গেলে সেটা আইনের ব্যাপার না রাজনৈতিক ব্যাপার- সেটি ভেবে দেখা দরকার।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে অদ্ভুত এক বিতর্ক চলছে। সরকার বলছে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। আরেকদল বলছে দেশে স্বাভাবিক আন্দোলন চলছে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের কাছে এটা অস্বাভাবিক। যারা দায়িত্বে থেকে অস্বাভাবিক অবস্থার কথা স্বীকার করে না তাদের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব না। যে দল যত অনিষ্ট করতে পারে সে দল তত মূল্যায়ন পায়। কিন্তু আন্দোলন করার জন্য মানুষকে কাছে টেনে নিতে হয়। বিএনপি’র উচিত তাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া যেন তারা পেট্রলবোমা হামলাকারীদের ধরিয়ে দেয়।
রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, অনেকে বলেন- দেশে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বিভাজনের মধ্যে আমি কোন দোষ দেখি না। গণতন্ত্রে চিন্তা ও মতাদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সহনশীলতা থাকতে হবে। বর্তমান প্রেসিডেন্টকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব না। এতে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। কারণ আমাদের চিন্তায় দৈন্যতা রয়েছে।
সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, সমস্যা ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্যেই আবতির্ত হচ্ছে। এর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা দরকার। জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার পরিবর্তন করে আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
গতকাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ক গোলটেবিলে বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সঞ্চালনায় প্রথম পর্বের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। আর দ্বিতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা। অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। বৈঠকে বেশকিছু প্রস্তাব রাখেন আলোচকরা। আয়োজকরা জানান, কিছুদিনের মধ্যে আরেকটি বৈঠক করে এসব প্রস্তাবনা দুই নেত্রীর কাছে পাঠানো হবে। এতে সাড়া না পেলে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের শরণাপন্ন হবেন তারা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’- শীর্ষক প্রস্তাবে বলেন, দেশে আজ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সঙ্কট উত্তরণের মাধ্যমে জনগণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে আগ্রহী। আলোচনায় অংশ নেন, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সিএম শফি সামি, রাশেদা কে. চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডাকসু’র সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবাইয়াত ফেরদৌস প্রমুখ।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের চলমান সঙ্কটে আমরা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। এই সঙ্কট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নিয়মের মধ্য থেকেই তা করতে হবে। এই তাগিদ থেকে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, বাঙালি অসাধারণ জাতি। একাত্তরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জাতির সামনে এখন চ্যালেঞ্জ। ১৬ কোটি মানুষ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না এটা ঠিক না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের ম্যান্ডেলা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন। রুগ্ণ রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের মানুষের পরিচয় দিতে হবে।
ড. আকবর আলি খান বলেন, দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল একে-অপরকে নির্মূলে মেতে উঠেছে। তারা সম্পূর্ন অবাস্তবতার ওপর নির্ভর করে লড়াই চালাচ্ছেন। কেউ কাউকে নির্মূল করতে পারবেন না। যে অবস্থা চলছে তা থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য আগে দু’দলের রাজনীতিবিদদের গালিগালাজ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দুই রাজনীতিক জোট একে-অপরকে যে ভাষায় কথা বলছে তাতে মনে হয় না তারা একসঙ্গে বসতে পারবে। এরজন্য তিনি অন্তত এক সপ্তাহ গালিগালাজ বন্ধ করার আহ্বান করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, যেভাবে সব পেশার লোক দলীয়করণ হচ্ছে তাতে সুশীল সমাজ বলে কিছু নেই। বতর্মানে সুশীল সমাজ অ-সুশীল হয়ে গেছে। কোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি চাকরিজীবী সব খানেই যারা সুশীল হিসেবে কাজ করবে তারাই দলীয় হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সুশীল সমাজ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই আগে সুশীল সমাজের রাজনীতিকরণ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনীতিবিদরেই ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য তৃণমূল থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই পরিস্থিতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তা করতে না পারলে পরণতি আরও ভয়ানক হবে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত কি হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে আশাবাদী এ কারণে যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে সে জাতি পথ হারাবে না।
এম. হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনীতিবিদদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এখানে ম্যান্ডেলার কথা বলা হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে ম্যান্ডেলার মতো কোন নেতা নেই। তিনি বলেন, সংলাপের জন্য দুই দলকে বাধ্য করতে হবে। নাগরিক সমাজকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে সোচ্চার ও একমত হতে হবে।
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, এদেশের ভোটাররা সুযোগ পেলে দুই তৃতীয়াংশকে এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনতে পারে। কিন্তু তাদের তো সেই সুযোগ দেয়া হয় না। তিনি বলেন, বিনাশী বিভাজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিভাজন নেই। আমরা শান্তি চাই। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সহিংসতা দিয়ে সহিংসতা প্রতিরোধ করা যায় না। প্রতিপক্ষকে এখন শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সব ধরনের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। এতে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখছে? তিনি বলেন, দলীয় রাজনীতির খপ্পরে পড়ে সিভিলিয়ানরা আনসিভিলিয়ান হয়ে যাচ্ছে। তাই বর্তমানের সঙ্কট সমাধান রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে।
ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট হয়। এরপর সেনাশাসন আসে। সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একই অবস্থা চলে আসছে। ক্ষমতা হস্তান্তর সব সময় একই প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না। তার মানে এ প্রক্রিয়া শুদ্ধ নয়। এতে গলদ আছে। যতদিন এ প্রক্রিয়া শুদ্ধ হচ্ছে না ততদিন এ সমস্যা থেকেই যাবে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এ নিয়ে কোন কাজ করেন না। একটা নির্বাচন দিয়ে এর সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সমাধান দাবি করেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রের মৌলিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন থাকতে হবে বলে জানান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, ইসি, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিচার ব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এগুলোকে রাজনীতিকরণ করা যাবে না। সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আলোচনার জন্য দুই দলকেই বারবার বেছে নেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনে দেখেছি দুই দলকে ভোটাররা এক তৃতীয়াংশ করে ভোট দেয়। বাকি ভোট পান অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দল যদি রাজনীতিতে সুযোগ না পান তাহলে অসম্পূর্ণতা থাকে।
বিকল্প ধারার মহাসচিব এমএ মান্নান বলেন, বর্তমানের আন্দোলন ১৯৯৬ সালের অসহযোগ আন্দোলনের মতো। তবে ডাইমেনশন পরিবর্তন হয়েছে। এতে নতুন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা ভয়াবহ ও নিন্দনীয়। এর স্থায়ী সমাধান লাগবে। যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই ক্ষমতা স্থায়ী করতে চায়। আসলে ক্ষমতার পালাবদল হয় তবে সঙ্কটের সমাধান হয় না। এজন্য তিনি সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন।
আ স ম রব বলেন, আজকের যে জাতীয় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা রাজনৈতিক। এটা অস্ত্র দিয়ে, মানুষ হত্যা করে এর সমাধান সম্ভব না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে- রাষ্ট্র শুধুমাত্র দুই দলের। ২০৪১ সাল পর্যন্ত একদল ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলবো এজন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। পুরো দেশ জ্বলছে, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না। জাতীয় সংলাপ মানে শুধু দুই দল সংলাপে থাকবেন- তা হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে ১৬ কোটি মানুষের আস্থা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। সংবিধানকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করতে হলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুমতি নিতে হয়। এটা সংবিধানে আছে। ক্ষমতার জন্য দেশটাকে জাহান্নামে রূপান্তরিত করেছে। বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছে বলেই সরকার জনগণকে ভয় পায়। ক্ষমতায় থাকলে সবাই সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আর ক্ষমতার বাইরে গেলে সহিংসতা করেন। পাঁচ সদস্যের নাগরিক কমিটি করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সংলাপ হতে হবে। সেটা হবে জাতীয় সংলাপ। বল সরকারের কোর্টে। কারণ সাংবিধানিক ক্ষমতা বিরোধী জোটের হাতে নাই। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর গ্যারান্টি পাওয়ার অধিকার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কি এমন সমস্যা হলো যে, তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করতে হলো। বল প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক তিনি প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সমস্যা সমাধানে তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সঙ্কটের এমনভাবে সমাধান করতে হবে যেন কোন পক্ষই সুবিধা বঞ্চিত না হন। খালেদা জিয়াকে অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বাদ দিয়ে যেসব নেতা গ্রেপ্তার রয়েছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। সংলাপ চলাকালীন বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বিক্ষোভ করা যাবে না। আমাদের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা নাই এ কথা ঠিক না। আমাদের মধ্যে ড. ইউনূস ও রেহমান সোবহানের মতো মানুষ আছেন। তিনি আরও বলেন, সংলাপ ছাড়া কোন গুলি, কোন বোমা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। জনগণের শক্তি বড় শক্তি। মান্না আরও বলেন, বর্তমান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্কটের কারণে। বিরোধী জোট অবরোধ প্রত্যাহার করলে সরকার যদি সংলাপ আয়োজন না করে সে গ্যারান্টি পাচ্ছে না।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, রাজনীতির নামে বর্তমানে বলি খেলা চলছে। অনেকে রাজনীতিবিদদের গালাগালি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- তাদের নেতৃত্ব ছাড়া জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব না। বাংলাদেশ ইস্যুতে মধ্যস্থতা প্রয়োজন ওবামা ও মোদির। বর্তমান সঙ্কটের বীজ পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে পুলিশি ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে।
সাবেক অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, বিরোধী জোটকে পেট্রলবোমা মারা বন্ধ করতে হবে। আর সরকারকে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এডভোকেট সুব্রত রায় চৌধুরী বলেন, প্রশাসনে সর্বত্র দলীয়করণ হয়েছে। দলবাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে রোল মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সিএম শফি সামি বলেন, দেশে বিনাশী ও বিভাজনের রাজনীতি চলছে। গণতন্ত্র মানেই সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা। ভিন্ন মতাদর্শের হলেও তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে। সাধারণ মানুষ কেন মরবে। তারা তো রাজনীতি করে না। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। লোকজন আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাদের অভিযোগগুলো খণ্ডনে প্রয়োজন। ভারতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। আর বাংলাদেশে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবে। যে জাতি মাত্র চার দশক আগে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল সেই জাতি সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এক হতে পারবে না এটা অবিশ্বাস্য। রাজনীতিক বিভাজন অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা ধ্বংস করে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেজা কিবরিয়া বলেন, আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ জনগণ শাসন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে রাষ্ট্র অকার্যকর হওয়ার ভয় থাকে। বর্তমানে যে সঙ্কট চলছে এর প্রভাব অর্থনীতির ওপর আগামী দুই বছর পর্যন্ত থাকবে। সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু দমনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব না। দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের সঙ্কট ও সমস্যা ভিন্নধর্মী। এর সমাধানও ভিন্নধর্মী হবে। ইতিহাসের বাঁক বদল হয়েছে বলেই আমরা এই জায়গায় এসেছি। সেই ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এই মুহূর্তে দেশে রাজনীতি বলতে কিছু দেখছি না। রাজনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজনীতিবিদদের সুবচনে ঘাটতি রয়েছে। দৈব কিছু না ঘটলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপ করবে না। সুতরাং দু’টি বিবাদমান পক্ষ সমাধানে আসতে না পারলে তৃতীয় পক্ষকে ভূমিকা রাখতে হয়। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সুশীল সমাজের রাজনৈতিক দর্শন থাকতে পারে তবে তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য নেই। এই সমাবেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নাগরিকদের মধ্য থেকে ৩-৫ জনের একটি কমিটি করতে হবে। সেই কমিটি দুই পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে নাম চাইবে। তারা তৃতীয় পক্ষে একটি সংলাপ করবে। পরোক্ষ সংলাপের আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ্উদ্দিন আহমেদ বলেন, সমস্যার উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করলে চলবে না। এর মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। সমস্যার সমাধান এমনভাবে করতে হবে দু’পক্ষই যেন কিছু অর্জন করে।
শাহদীন মালিক বলেন, আদালতের কাজ হলো- আইনি বিতর্কের সমাধান দেয়া। আইনি বিতর্কের সমাধান করা। ইদানিংকালে আদালত রাজনৈতিক ব্যাপারে সুরাহা করার চেষ্টা করছে। এতে দেশের কল্যাণ হয় না। একটি রায়ের পর থেকে এ সঙ্কট শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে কোন ব্যাপারে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে গেলে সেটা আইনের ব্যাপার না রাজনৈতিক ব্যাপার- সেটি ভেবে দেখা দরকার।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে অদ্ভুত এক বিতর্ক চলছে। সরকার বলছে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। আরেকদল বলছে দেশে স্বাভাবিক আন্দোলন চলছে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের কাছে এটা অস্বাভাবিক। যারা দায়িত্বে থেকে অস্বাভাবিক অবস্থার কথা স্বীকার করে না তাদের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব না। যে দল যত অনিষ্ট করতে পারে সে দল তত মূল্যায়ন পায়। কিন্তু আন্দোলন করার জন্য মানুষকে কাছে টেনে নিতে হয়। বিএনপি’র উচিত তাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া যেন তারা পেট্রলবোমা হামলাকারীদের ধরিয়ে দেয়।
রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, অনেকে বলেন- দেশে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বিভাজনের মধ্যে আমি কোন দোষ দেখি না। গণতন্ত্রে চিন্তা ও মতাদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সহনশীলতা থাকতে হবে। বর্তমান প্রেসিডেন্টকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব না। এতে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। কারণ আমাদের চিন্তায় দৈন্যতা রয়েছে।
সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, সমস্যা ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্যেই আবতির্ত হচ্ছে। এর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা দরকার। জনপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার পরিবর্তন করে আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা চালু করা দরকার।
No comments