'মায়ের কাছে যাব' by ইকবাল হোসেন ও উজ্জল চক্রবর্ত্তী
'মা
তুমি কোথায়, আমি তোমার কাছে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাও মা। আমার সারা শরীর
জ্বলছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওরা আমাকে তোমার কাছে যেতে দিচ্ছে না
মা।' রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি
বিভাগের বিছানায় যন্ত্রণায় চিৎকার করে কথাগুলো বলছিল তানজিলা (১৩)। গত
শুক্রবার রাতে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের তুলসীঘাট এলাকায় বাসে দুর্বৃত্তদের
ছোড়া পেট্রোল বোমায় তার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। একই ঘটনায় তার বাবা-মা
ও ভাইও দগ্ধ হয়। গতকাল শনিবার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন
অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন তার মা সোনাভান বেগম ও ভাই সুজন মিয়া। পেট্রোল
বোমার আগুনে তাদের শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। মা-ভাইয়ের মৃত্যুর খবর
এখনও জানানো হয়নি তাকে। স্ত্রী-ছেলেকে হারিয়ে একটু পরপরই কেঁদে উঠছেন
তানজিলার বাবা তারা মিয়া (৪২)। গাইবান্ধায় শুক্রবার রাতে ঢাকাগামী নাপু
এন্টারপ্রাইজের বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন
মা-ছেলেসহ ৭ জন।
নিহতরা হলেন- সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কালীর খামার গ্রামের খয়বর হোসেন দুলুর ছেলে রিকশাচালক সৈয়দ আলী (৪২), একই উপজেলার পশ্চিম চ িপুর গ্রামের সাইফ মিয়ার মেয়ে হালিমা বেওয়া (৪১), চণ্ডীপুর গ্রামের শাজাহান আলীর ছেলে সুমন মিয়া (২২), খামার গ্রামের বলরাম দাসের মেয়ে শিল্পী দাস (৭), তারা মিয়ার শিশুপুত্র সুজন মিয়া (১০), স্ত্রী সোনাভান (৩৮) এবং সাজু মিয়া। ওই ঘটনায় ৪০ জন দগ্ধ হন। গুরুতর দগ্ধ যে ২২ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাসের যাত্রীরা জানান, ৪২ আসনের হলেও বাসে প্রায় ৭০ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষ। যাদের মধ্যে দিনমজুর ও রিকশাচালকই বেশি। কাজের সন্ধানে তারা ঢাকা যাচ্ছিলেন।
ময়নাতদন্তের পর গতকাল শনিবার বিকেলে সৈয়দ আলী, হালিমা বেওয়া, সুমন মিয়া ও শিল্পী দাসের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনায় ৬০-৭০ জনকে আসামি করে গাইবান্ধা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন এএসআই সফিউর রহমান। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সদর থানার ওসি আহমেদ রাজিউর জানান, অবরোধকারীরা রাতের আঁধারে ঢাকাগামী বাসটিতে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পেঁৗছে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত বলেন, আপাতত নিহতদের জন্য ২০ হাজার ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
এদিকে শুক্রবার রাতের হতাহতের শোক না কাটতেই গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মহেশপুর ব্র্যাক মোড় এলাকায় পণ্যবাহী দুটি ট্রাকে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। এতে ট্রাক দুটির সামনের অংশ পুড়ে গেলেও কেউ আহত হননি। স্থানীয়রা জানায়, রংপুর থেকে ভুট্টা নিয়ে দুটি ট্রাক বগুড়া যাচ্ছিল। সকালে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পলাশবাড়ী উপজেলার মহেশপুর ব্র্যাক মোড় এলাকায় পেঁৗছলে ট্রাক দুটি অবরোধকারীদের কবলে পড়ে। এ সময় তারা ট্রাক দুটি থামিয়ে ড্রাইভার-হেলপারকে মারধর করে নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ট্রাক দুটির সামনের অংশ পুড়ে যায়।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তানজিলার পাশের বিছানায় চিকিৎসাধীন গার্মেন্টকর্মী তারা মিয়া জানান, তিনি ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। স্ত্রী সোনাভান বাসাবাড়িতে এবং বড় দুই ছেলে সুলতান ও বড় মেয়ে তাপসী বেগমও কাজ করত গার্মেন্টে। এক মাস আগে স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর এলাকায় গ্রামের বাড়িতে আসেন। হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকায় ফিরতে পারছিলেন না।
তিনি বলেন, জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শুক্রবার রাতে নাপু এন্টারপ্রাইজের বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। স্ত্রী সোনাভান, মেয়ে তানজিলা ও ছেলে সুজন ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ ঢিল মারার শব্দ পান তিনি। মুহূর্তের মধ্যে বাসে আগুন ধরে যেতে দেখেন। তিনি জানালা ভেঙে আগে সন্তানদের, পরে স্ত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে দেন। ততক্ষণে স্ত্রী ও ছেলের শরীর পুড়ে যায়। দগ্ধ অন্যদের সঙ্গে তাদের নিয়ে আসা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শনিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্ত্রী ও ছেলে মারা যায়। এসব বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা মিয়া।
তিনি বলেন, এখন আর আমার বেঁচে থেকে কী লাভ। আমি আর বাঁচতে চাই না। আক্ষেপ করে তারা মিয়া বলেন, আমরা তো রাজনীতি করি না, কাজ করে খাই। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না। তাহলে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে এভাবে পুড়িয়ে মারা হলো কেন? মানুষ হত্যার রাজনীতি যারা করেন তাদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুরের মোতালেব মিয়ার স্ত্রীসহ তিন ছেলেমেয়ের সংসার। ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা মোতালেবের স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা। কিন্তু বাড়ি থেকে ঢাকা ফেরার পথে এখন পেট্রোল বোমায় পুড়ছে তার স্বপ্ন। একই উপজেলার শান্তারাম গ্রামের জাহাঙ্গীর মিয়া ঢাকায় রিকশা চালান। সংসারে স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। বোমায় দগ্ধ হয়ে তিনি হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সুন্দরগঞ্জের কোচাগাড়ি এলাকার নজরুল ইসলামও ঢাকায় রিকশা চালান। পেট্রোল বোমায় তিনিও ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন সাজু মিয়া। দগ্ধ হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। ঢাকায় রিকশা চালানো জাহাঙ্গীরেরও একই অবস্থা। তার অবস্থা দেখে স্ত্রী নাহিদা ও ছেলে লিমন নির্বাক। ঢাকায় রিকশা চালানো রফিকুলও পুড়েছেন আগুনে। গাইবান্ধার কামাগাতি এলাকার কায়ছার মানিকগঞ্জ যাচ্ছিলেন জমিতে কাজ করতে। ১৩ বছরের বিজয় চন্দ্র আত্মীয়ের সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছিল। তারাও দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চণ্ডীপুরের বদিউজ্জামান বিজিবিতে চাকরি করেন। ছুটি শেষে ঢাকার পিলখানায় বিজিবি হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন। তিনি বাস থেকে নামতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন। তিনি জানান, পুলিশি পাহারায় ১৩টি বাস একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে। বাসটি ছিল ৩ নম্বরে। তুলসীঘাট এলাকায় এলেই বাসের মাঝামাঝিতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ১৯ জন। এর মধ্যে ৭ জন বার্ন ইউনিটে, অবজারভেশনে ৯ জন, সার্জারি বিভাগে ২ জন, অর্থোপেডিক বিভাগে একজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া, আবুল কালাম আজাদ, সুজন মিয়া এবং মোতালেব মিয়া। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. আবু হানিফ জানান, শুক্র ও শনিবার দুদিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২ জনকে পাঠানো হয়। বর্তমানে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দু'জনের অবস্থা উন্নতির দিকে। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।
মর্মান্তিক এ ঘটনার পর সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে গাইবান্ধায় আসেন। এ ছাড়া ডেপুটি স্পিকারসহ হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, বিভাগীয় কমিশনার দিলোয়ার বখত, ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি হুমায়ুন কবির, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. এহছানে এলাহী, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা পরে সন্ত্রাস নির্মূলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে এক জরুরি সভা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন- সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কালীর খামার গ্রামের খয়বর হোসেন দুলুর ছেলে রিকশাচালক সৈয়দ আলী (৪২), একই উপজেলার পশ্চিম চ িপুর গ্রামের সাইফ মিয়ার মেয়ে হালিমা বেওয়া (৪১), চণ্ডীপুর গ্রামের শাজাহান আলীর ছেলে সুমন মিয়া (২২), খামার গ্রামের বলরাম দাসের মেয়ে শিল্পী দাস (৭), তারা মিয়ার শিশুপুত্র সুজন মিয়া (১০), স্ত্রী সোনাভান (৩৮) এবং সাজু মিয়া। ওই ঘটনায় ৪০ জন দগ্ধ হন। গুরুতর দগ্ধ যে ২২ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাসের যাত্রীরা জানান, ৪২ আসনের হলেও বাসে প্রায় ৭০ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষ। যাদের মধ্যে দিনমজুর ও রিকশাচালকই বেশি। কাজের সন্ধানে তারা ঢাকা যাচ্ছিলেন।
ময়নাতদন্তের পর গতকাল শনিবার বিকেলে সৈয়দ আলী, হালিমা বেওয়া, সুমন মিয়া ও শিল্পী দাসের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনায় ৬০-৭০ জনকে আসামি করে গাইবান্ধা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন এএসআই সফিউর রহমান। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সদর থানার ওসি আহমেদ রাজিউর জানান, অবরোধকারীরা রাতের আঁধারে ঢাকাগামী বাসটিতে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পেঁৗছে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত বলেন, আপাতত নিহতদের জন্য ২০ হাজার ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
এদিকে শুক্রবার রাতের হতাহতের শোক না কাটতেই গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মহেশপুর ব্র্যাক মোড় এলাকায় পণ্যবাহী দুটি ট্রাকে আগুন দিয়েছে অবরোধকারীরা। এতে ট্রাক দুটির সামনের অংশ পুড়ে গেলেও কেউ আহত হননি। স্থানীয়রা জানায়, রংপুর থেকে ভুট্টা নিয়ে দুটি ট্রাক বগুড়া যাচ্ছিল। সকালে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পলাশবাড়ী উপজেলার মহেশপুর ব্র্যাক মোড় এলাকায় পেঁৗছলে ট্রাক দুটি অবরোধকারীদের কবলে পড়ে। এ সময় তারা ট্রাক দুটি থামিয়ে ড্রাইভার-হেলপারকে মারধর করে নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ট্রাক দুটির সামনের অংশ পুড়ে যায়।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তানজিলার পাশের বিছানায় চিকিৎসাধীন গার্মেন্টকর্মী তারা মিয়া জানান, তিনি ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। স্ত্রী সোনাভান বাসাবাড়িতে এবং বড় দুই ছেলে সুলতান ও বড় মেয়ে তাপসী বেগমও কাজ করত গার্মেন্টে। এক মাস আগে স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর এলাকায় গ্রামের বাড়িতে আসেন। হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকায় ফিরতে পারছিলেন না।
তিনি বলেন, জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শুক্রবার রাতে নাপু এন্টারপ্রাইজের বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। স্ত্রী সোনাভান, মেয়ে তানজিলা ও ছেলে সুজন ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ ঢিল মারার শব্দ পান তিনি। মুহূর্তের মধ্যে বাসে আগুন ধরে যেতে দেখেন। তিনি জানালা ভেঙে আগে সন্তানদের, পরে স্ত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে দেন। ততক্ষণে স্ত্রী ও ছেলের শরীর পুড়ে যায়। দগ্ধ অন্যদের সঙ্গে তাদের নিয়ে আসা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শনিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্ত্রী ও ছেলে মারা যায়। এসব বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা মিয়া।
তিনি বলেন, এখন আর আমার বেঁচে থেকে কী লাভ। আমি আর বাঁচতে চাই না। আক্ষেপ করে তারা মিয়া বলেন, আমরা তো রাজনীতি করি না, কাজ করে খাই। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না। তাহলে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে এভাবে পুড়িয়ে মারা হলো কেন? মানুষ হত্যার রাজনীতি যারা করেন তাদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুরের মোতালেব মিয়ার স্ত্রীসহ তিন ছেলেমেয়ের সংসার। ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা মোতালেবের স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা। কিন্তু বাড়ি থেকে ঢাকা ফেরার পথে এখন পেট্রোল বোমায় পুড়ছে তার স্বপ্ন। একই উপজেলার শান্তারাম গ্রামের জাহাঙ্গীর মিয়া ঢাকায় রিকশা চালান। সংসারে স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। বোমায় দগ্ধ হয়ে তিনি হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সুন্দরগঞ্জের কোচাগাড়ি এলাকার নজরুল ইসলামও ঢাকায় রিকশা চালান। পেট্রোল বোমায় তিনিও ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন সাজু মিয়া। দগ্ধ হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। ঢাকায় রিকশা চালানো জাহাঙ্গীরেরও একই অবস্থা। তার অবস্থা দেখে স্ত্রী নাহিদা ও ছেলে লিমন নির্বাক। ঢাকায় রিকশা চালানো রফিকুলও পুড়েছেন আগুনে। গাইবান্ধার কামাগাতি এলাকার কায়ছার মানিকগঞ্জ যাচ্ছিলেন জমিতে কাজ করতে। ১৩ বছরের বিজয় চন্দ্র আত্মীয়ের সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছিল। তারাও দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চণ্ডীপুরের বদিউজ্জামান বিজিবিতে চাকরি করেন। ছুটি শেষে ঢাকার পিলখানায় বিজিবি হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন। তিনি বাস থেকে নামতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন। তিনি জানান, পুলিশি পাহারায় ১৩টি বাস একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে। বাসটি ছিল ৩ নম্বরে। তুলসীঘাট এলাকায় এলেই বাসের মাঝামাঝিতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ১৯ জন। এর মধ্যে ৭ জন বার্ন ইউনিটে, অবজারভেশনে ৯ জন, সার্জারি বিভাগে ২ জন, অর্থোপেডিক বিভাগে একজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মিয়া, আবুল কালাম আজাদ, সুজন মিয়া এবং মোতালেব মিয়া। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. আবু হানিফ জানান, শুক্র ও শনিবার দুদিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২ জনকে পাঠানো হয়। বর্তমানে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দু'জনের অবস্থা উন্নতির দিকে। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।
মর্মান্তিক এ ঘটনার পর সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে গাইবান্ধায় আসেন। এ ছাড়া ডেপুটি স্পিকারসহ হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, বিভাগীয় কমিশনার দিলোয়ার বখত, ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি হুমায়ুন কবির, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. এহছানে এলাহী, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা পরে সন্ত্রাস নির্মূলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে এক জরুরি সভা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
No comments