বিবিসি বাজার- কাশেম মোল্লার স্মৃতি চির অম্লান থাকুক
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব যেমন মুক্তিপাগল মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও কেউ কেউ সাহসসঞ্চারী কর্মের মাধ্যমে নিজেই ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। তারা মানুষের মধ্যে মুক্তিসংগ্রামের বোধ সৃষ্টি ও হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছেন। ঈশ্বরদীর অজপাড়াগাঁ রূপপুরের কাশেম মোল্লা একাত্তর সালে রক্তঝরা দিনগুলোতে তার ছোট্ট চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষকে বিবিসির রাতের বাংলা সংবাদ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শুনিয়ে জাতীয় গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে নিজের নামটিও যুক্ত করে ফেলেন। কাশেম মোল্লা তখন টগবগে যুবক। তার কাছে ছিল তিন ব্যান্ডের রেডিও। একদিন রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে পেয়ে যান বিবিসির রাতের বাংলা সংবাদ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিবেশনা। এ যেন তখনকার যুবক কাশেম মোল্লার কাছে স্বর্ণের খনির চেয়েও দামি। তিনি মানুষকে ডেকে ডেকে তার দোকানে নিয়ে আসতেন এ দুটি বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শোনানোর জন্য। তখন এসব সংবাদ তারুণ্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণসাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য উজ্জীবিত করত। যারা যুদ্ধে যেতে পারেননি অথচ এ চায়ের দোকানে এসে বাঙালির বীরত্বের কাহিনী এবং হানাদারদের জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার কাহিনী শুনতেন, তাদেরকেও মুক্তি সংগ্রামের এক একজন সৈনিকে পরিণত করে। এই মানুষগুলো কেউ খাবার দিয়ে, কেউ হানাদার ও তাদের দোসরদের ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সংবাদ পেঁৗছে দিয়ে আবার কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার জায়গা করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে পরিণতি পর্যন্ত এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। তাই কাশেম মোল্লা নিজে সরাসরি যুদ্ধ না করেও রণাঙ্গনে বীরত্ব প্রদর্শনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কোনো অংশে কম নন। পাকিস্তানি হানাদাররা নির্যাতন চালিয়ে তার একটি পা খোঁড়া করে দিলেও বিবিসি বাংলা সংবাদ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা থেকে মানুষকে বিরত রাখা যায়নি। একাত্তরে কাশেম মোল্লার দোকানে এসে মুক্তি সংগ্রামের সংবাদ শোনা সাধারণ মানুষের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, লোকমুখে রূপপুর নাম এক সময় বিবিসি বাজার হয়ে উঠে। এভাবে একজন অতি সাধারণ দোকানির কীর্তি তার নামকে আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের সাধারণ নাগরিকদের বীরত্বগাথার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে। অথচ এই মানুষটি এ জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। জীবন সায়াহ্নে এসে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা তিনি পেয়েছিলেন। বিবিসি এই মানুষটির কীর্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে সাহায্য তিনি পাননি। যাই হোক, তাকে আসল সম্মান তো মানুষই দিয়েছে বাজারের নামটি তার কর্মের সমার্থক করে দিয়ে। এভাবে আরও অনেক সাধারণ মানুষের কীর্তি আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্য এনে দিতে কালজয়ী অবদান রেখেছে। কালের অমোঘ নিয়মে কাশেম মোল্লাসহ অনেকেই আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আশা করব যে, রূপপুরের 'বিবিসি বাজার' নামের মধ্যেই তার কীর্তি অম্লান থাকবে।
No comments