১০০০ কোটি টাকার পাথর নিয়ে অসহায় ব্যবসায়ীরা by ওয়েছ খছরু
টানা
হরতাল-অবরোধে সিলেটে আটকে আছে অন্তত হাজার কোটি টাকার পাথর। বেকার হয়ে
পড়ছে অর্ধলাখ শ্রমিক। শ’ শ’ কোটি টাকা পুঁজি খাটিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন
ব্যবসায়ীরা। পাথরবাহী যানবাহন চলছে না। রাতে ঝুঁকি নিয়ে যে ট্রাকগুলো চলছে
সেগুলোর চলাচলও কমে আসছে। বিক্রি না হওয়ায় ভারত থেকে এলসি করা পাথর আমদানিও
কমে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকার প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয়
থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়বেন। এ
জন্য দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন পাথর ব্যবসার সঙ্গে
জড়িত একাধিক সংগঠনের নেতারা। দেশের পাথর ব্যবসার অন্যতম জায়গা সিলেট।
সিলেটের ভেলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতে এখন চলছে
ভরা মওসুম। শুষ্ক মওসুমে চারটি কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন ও বিকিকিনি হয়। এর
বাইরে ভোলাগঞ্জ ও তামাবিল শুল্ক বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এলসির মাধ্যমে নিয়ে
আসা হয় পাথর। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাথর ব্যবসা একটি চলমান
প্রক্রিয়া। বেশি পুঁজি খাটিয়ে এই ব্যবসা ধারাবাহিকভাবে চালাতে হয়। কিন্তু
হরতাল-অবরোধের কারণে পাথর বিক্রি হচ্ছে না। এতে করে গত ৩৩ দিনে আটকে আছে
হাজার কোটি টাকার পাথর। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি দেশের
বৃহত্তম পাথর কোয়ারি। এই কোয়ারির পাথর দেশের বেশির ভাগ এলাকার পাথরের
চাহিদা পূরণ করে থাকে। ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর এবং শুল্ক
স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা পাথর দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করা হয়। তারা
জানান, ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে নিয়মিত পাথর উত্তোলন চলছে। একই সঙ্গে এলসি
স্টেশন দিয়ে ভারতীয় পাথর আসছে। মাসে কোয়ারি থেকে শত-কোটি টাকার পাথর
উত্তোলন করা হয়। একই সঙ্গে প্রতি মাসে শত-কোটি টাকার পাথর আমদানি করা হয়।
এসব পাথর উত্তোলন কিংবা আমদানির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বিক্রি করা হয়। কিন্তু
গত জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে পাথর ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর
আমদানি ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আক্তারুজ্জামান নোমান গতকাল বিকালে মানবজমিনকে
জানিয়েছেন, ভোলাগঞ্জে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে ৫শ’ কোটি টাকার পাথর।
কোয়ারি থেকে উত্তোলিত ও আমদানি করা পাথর বিক্রিতে ভাটা পড়ায় এ অবস্থা দেখা
দিয়েছে। তিনি বলেন, পাথর বিক্রি বন্ধ থাকায় ভারত থেকে মালামাল নিয়ে আসাটা
কমে গেছে। আর এলসিও কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে
থাকলেও কোটি কোটি টাকা পুঁজির ব্যবসা নিয়ে ব্যবসায়ীরা দারুণ ক্ষতির মুখে
পড়বেন। চুনাপাথর আমদানিকারক সমিতিরসহ সভাপতি মো. শাহাবউদ্দিন জানিয়েছেন,
প্রতিদিন ভোলাগঞ্জ থেকে শ’ শ’ কোটি টাকার পাথর বিক্রি হতো। পাথর নিতে আসত
হাজার হাজার ট্রাক। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় পাথর বিক্রি হচ্ছে না। একই কথা
জানিয়েছেন, ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আলাউদ্দিন। তিনি
বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে পাথর পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না। রাতের বেলা
কিছুসংখ্যক ট্রাক চলাচল করলেও দিনে চলছে না। এতে করে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির
মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানান তিনি। এদিকে, ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন
স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু উত্তোলিত পাথর বিক্রি কম হওয়ায় দামও কমেছে বলে
জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, ভোলাগঞ্জ থেকে ধোপাগুল পর্যন্ত ৭শ’ থেকে
৮শ’ পাথর ক্রাশার মিল রয়েছে। জানুয়ারি শুরুতে এসব মিল চালু থাকলেও
বিকিকিনি কম থাকায় এখন ক্রাশার বন্ধের উপক্রম। এতে করে কয়েক হাজার শ্রমিক
বেকার হয়ে পড়ছেন। তারা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। চুনাপাথর
আমদানিকারক সমিতির কয়েকজন নেতা গতকাল দাবি করেছেন, শুধু এলসি করা পাথর থেকে
ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন মাসে শত-কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতো। এখন ভারত
থেকে পাথর আমদানি কম হচ্ছে। এতে করে সরকার মাসে অর্ধশত কোটি টাকা রাজস্ব
থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন। একই অবস্থা বিরাজ করছে সিলেটের জাফলং কোয়ারিতে।
ভরা মওসুমে সিলেটের জাফলং কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন চলছে। পাশাপাশি তামাবিল
স্থলবন্দর দিয়ে মাসে শ’ শ’ কোটি টাকার পাথর আমদানি করা হয়। কিন্তু
হরতাল-অবরোধের কারণে পাথর বিকিকিনি কম হওয়ায় অন্তত ৩০০ কোটি টাকার পাথর
অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, রাতের বেলা
কিছুসংখ্যক ট্রাক চললেও দিনে বিক্রি হচ্ছে না। জাফলং স্টোন ক্রাশার মালিক
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন লিপু মানবজমিনকে
জানিয়েছেন, হরতাল অবরোধে সিলেটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পাথর খাত। জাফলং ও
জৈন্তাপুরে কয়েকশ’ স্টোন ক্রাশার রয়েছে। এসব স্টোন ক্রাশারে ভাঙা পাথরের
স্তূপ পড়ে থাকলেও বিক্রি নেই। এতে করে ব্যবসায়ীরা যেমন লোকসানে পড়েছেন
তেমনি প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এভাবে কিছু দিন চললে পাথর
ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে হাহাকার শুরু হবে বলে দাবি করেন তিনি। আর জাফলং
বল্লাঘাট পাথর উত্তোলন শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম
জানিয়েছেন, অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি ভারত
থেকে পাথর আসাও কমে আসবে। এতে করে কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়বেন
ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, এই অবস্থার দ্রুত উত্তোরণ ঘটাতে হবে। সিলেটের
বিছানাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতেও প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর অবিক্রীত
অবস্থায় পড়ে আছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। বিছনাকান্দি পাথর ব্যবসায়ী
নেতা আশরাফ হোসেন গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পাথর ব্যবসা চলমান
প্রক্রিয়া। আগে দিনে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার পাথর বিক্রি হলেও এখন তা কমে
দাঁড়িয়েছে কোটি টাকায়। রাতের বেলা অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চলছে। তিনি
জানান, প্রতিদিন হাজারো ট্রাক গিয়ে ঢুকতো বিছকান্দিতে। এখন দুই থেকে আড়াইশ’
ট্রাক যাচ্ছে। তিনি বলেন, পাথর অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকায় ব্যবসায়ীরা
ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। সিলেটের পুলিশ জানিয়েছিল, পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী
ট্রাক চলাচলে পুলিশ স্কট দেবে। কিন্তু চারটি কোয়ারির পাথর ব্যবসায়ীরা
জানান, কয়েক দিনে অন্তত তিনটি পাথরবোঝাই ট্রাক পেট্রলবোমায় আক্রান্ত হয়েছে।
এ কারণে ভয়ে তটস্থ হয়ে অনেক চালকই পাথর পরিবহন করছেন না।
No comments