তামাক চাষে বিপন্ন পরিবেশ by রাজীব নূর ও পুলিন বিহারী চাকমা
পল্লী
চিকিৎসক মো. হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে আলাপ হলো রাঙামাটির বরকল উপজেলার
ভূষণছড়া বাজারে। গত ১৫ বছর ধরে পাহাড়ি এই জনপদে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন
তিনি। এতকাল ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ সাধারণ কিছু রোগে
আক্রান্ত রোগীর দেখা পেতেন তিনি। শ্বাসকষ্টের রোগী ছিল একেবারে নগণ্য।
ক্যান্সারে আক্রান্ত কারোর দেখা মেলেনি। বছর তিনেক হলো প্রায় প্রতিদিনই
শ্বাসকষ্টের রোগী পাচ্ছেন, কয়েকদিন পর পর ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীও আসছেন।
ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের ধারণা, তামাক চাষের ফলে রোগবালাই বাড়ছে। তারা জানান, গত দু-তিন বছরের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে ভূষণছড়া গ্রামের আইয়ুব আলী মুন্সি ও এরাবুনিয়া গ্রামের ডুলু মোল্লা মারা গেছেন। বড়কুড়াদিয়া গ্রামের সুলতান পিসি, ভূষণছড়া গ্রামের আইয়ুব আলী ও দক্ষিণ কলাবুনিয়া গ্রামের মোহাম্মদ ওসমান (৪৮) ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডবি্লউবিবি) ট্রাস্ট পরিচালিত তামাক চাষ নিয়ে গবেষণায় জানা যায়, কাঁচা তামাকপাতা নাড়াচাড়া এবং জমিতে প্রচুর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে কৃষকরা স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কাঁচা তামাকপাতা থেকে গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামে এক ধরনের রোগের শিকার হন তারা। এর ফলে মাথা ঘোরা, বমি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসকষ্ট হয়।
তামাক উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, তামাক পাতা উৎপাদন এ দেশে নতুন না, তবে তা ছিল সাধারণভাবে পানের সঙ্গে খাওয়ার জন্য কিংবা হুঁকা, বিড়ির জন্য তামাক উৎপাদন করা হতো। রংপুর জেলায় ১৯৬৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে তামাক উৎপাদন শুরু হয়। রংপুরে জমির উর্বরতা কমে যাওয়া এবং তামাকপাতা পোড়াবার জন্য জ্বালানি কাঠের অসুবিধা দেখা দেওয়ায় প্রথমে তামাক চাষ শুরু হয় পদ্মা নদীর চরের উর্বর অঞ্চল কুষ্টিয়া জেলায়। কুষ্টিয়া থেকে আশপাশের জেলায় জ্বালানি কাঠের স্বল্পতার কারণে ১৯৮৪ সালের দিকে একেবারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান জেলায় তামাক চাষ বিস্তৃত হয়।
বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে সেখানে তামাক চাষ পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেড়েছে। গত বছর বান্দরবানে দুই হাজার ৮১৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে তামাক চাষ হচ্ছে দুই হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে। খাগড়াছড়িতে গত বছর এক হাজার ৩০ হেক্টর ফসলি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, চলতি মৌসুমে ৮০৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। রাঙামাটি জেলায় ২৫০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়।
তবে সরকারিভাবে পাওয়া এই পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি জমিতে তামাক চাষ হয় বলে দাবি করেন খাড়াছড়ির দীঘিনালায় পরিবেশ আন্দোলনকারী ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি পলাশ বড়ূয়া। মূলত বেশি মুনাফার আশাতেই চাষিরা তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
বছর পাঁচেক আগেও নিজের জমি ও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সবজি চাষ করতেন ভূষণছড়ার চাষি রুহুল আমিন। তার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে উপজেলা ও জেলা সদরের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রথম বছর দুয়েক লাভের মুখ দেখলেও পরে বরকলের বাইরে সবজি পাঠাতে না পারায় লোকসান গুনতে হয়েছে তাকে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে সবজি চাষ বাদ দিয়ে বর্তমানে ঝুঁকে পড়েছেন তামাক চাষে। চাষি রুহুল আমিন এ বছর নিজের এবং অন্যের জমি ভাড়া করে মোট ১৫ একর জায়গাতে তামাক চাষ করছেন।
পার্বত্য অঞ্চলে তামাকপাতা চাষের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি), ঢাকা টোব্যাকো ও আকিজ টোব্যাকো নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো বিএটি। তারা চাষিদের তামাক চাষের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতি বছর পার্বত্য জেলাগুলোতে উৎপাদিত তামাকপাতার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫০ হাজার বেল। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাষিরা প্রতি হেক্টর জমিতে সাধারণত ৭০ বেল (এক বেল সমান ৪০ কেজি) পরিমাণ তামাকপাতা উৎপন্ন করে থাকেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে ১০ লাখ ৫০ হাজার বেল তামাক চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৫ হাজার হেক্টর জমি।
তোনদুল নামে পরিচিত তামাক পোড়ানোর চুলি্লতে ৭০ বেল তামাক পোড়াতে সাধারণত চার টন জ্বালানি কাঠ লাগে। এর মানে প্রতিবছর ১০ লাখ ৫০ হাজার তামাক পাতা প্রস্তুতের কাজে পোড়াতে হচ্ছে ৬০ হাজার টন জ্বলানি কাঠ।
বাংলাদেশে বন উজাড়ের এক-তৃতীয়াংশের জন্যই তামাক চাষকে দায়ী করা হয়েছে পাথ কানাডা নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়। বর্তমানে হেলথ ব্রিজ নামে পরিচিত পাথ কানাডার 'ট্যোবাকো অ্যান্ড পোভারটি :অবজারভেশন্স ফ্রম ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ' শীর্ষক ওই গবেষণার অন্যতম গবেষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের কর্মী আমিনুল ইসলাম সুজন। ওই গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ বন উজাড় করা হয়, তার ৩০ শতাংশই হয় এই তামাক চাষের কারণে। তামাক চাষের কারণে বন ধ্বংসের বার্ষিক হারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া (৪৫ শতাংশ) ও উরুগুয়ে (৪০ শতাংশ)।
ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের ধারণা, তামাক চাষের ফলে রোগবালাই বাড়ছে। তারা জানান, গত দু-তিন বছরের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তদের মধ্যে ভূষণছড়া গ্রামের আইয়ুব আলী মুন্সি ও এরাবুনিয়া গ্রামের ডুলু মোল্লা মারা গেছেন। বড়কুড়াদিয়া গ্রামের সুলতান পিসি, ভূষণছড়া গ্রামের আইয়ুব আলী ও দক্ষিণ কলাবুনিয়া গ্রামের মোহাম্মদ ওসমান (৪৮) ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডবি্লউবিবি) ট্রাস্ট পরিচালিত তামাক চাষ নিয়ে গবেষণায় জানা যায়, কাঁচা তামাকপাতা নাড়াচাড়া এবং জমিতে প্রচুর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে কৃষকরা স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কাঁচা তামাকপাতা থেকে গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামে এক ধরনের রোগের শিকার হন তারা। এর ফলে মাথা ঘোরা, বমি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসকষ্ট হয়।
তামাক উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণা থেকে জানা যায়, তামাক পাতা উৎপাদন এ দেশে নতুন না, তবে তা ছিল সাধারণভাবে পানের সঙ্গে খাওয়ার জন্য কিংবা হুঁকা, বিড়ির জন্য তামাক উৎপাদন করা হতো। রংপুর জেলায় ১৯৬৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে তামাক উৎপাদন শুরু হয়। রংপুরে জমির উর্বরতা কমে যাওয়া এবং তামাকপাতা পোড়াবার জন্য জ্বালানি কাঠের অসুবিধা দেখা দেওয়ায় প্রথমে তামাক চাষ শুরু হয় পদ্মা নদীর চরের উর্বর অঞ্চল কুষ্টিয়া জেলায়। কুষ্টিয়া থেকে আশপাশের জেলায় জ্বালানি কাঠের স্বল্পতার কারণে ১৯৮৪ সালের দিকে একেবারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান জেলায় তামাক চাষ বিস্তৃত হয়।
বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে সেখানে তামাক চাষ পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেড়েছে। গত বছর বান্দরবানে দুই হাজার ৮১৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে তামাক চাষ হচ্ছে দুই হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে। খাগড়াছড়িতে গত বছর এক হাজার ৩০ হেক্টর ফসলি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, চলতি মৌসুমে ৮০৪ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। রাঙামাটি জেলায় ২৫০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়।
তবে সরকারিভাবে পাওয়া এই পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি জমিতে তামাক চাষ হয় বলে দাবি করেন খাড়াছড়ির দীঘিনালায় পরিবেশ আন্দোলনকারী ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি পলাশ বড়ূয়া। মূলত বেশি মুনাফার আশাতেই চাষিরা তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
বছর পাঁচেক আগেও নিজের জমি ও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সবজি চাষ করতেন ভূষণছড়ার চাষি রুহুল আমিন। তার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে উপজেলা ও জেলা সদরের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। প্রথম বছর দুয়েক লাভের মুখ দেখলেও পরে বরকলের বাইরে সবজি পাঠাতে না পারায় লোকসান গুনতে হয়েছে তাকে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে সবজি চাষ বাদ দিয়ে বর্তমানে ঝুঁকে পড়েছেন তামাক চাষে। চাষি রুহুল আমিন এ বছর নিজের এবং অন্যের জমি ভাড়া করে মোট ১৫ একর জায়গাতে তামাক চাষ করছেন।
পার্বত্য অঞ্চলে তামাকপাতা চাষের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি), ঢাকা টোব্যাকো ও আকিজ টোব্যাকো নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো বিএটি। তারা চাষিদের তামাক চাষের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতি বছর পার্বত্য জেলাগুলোতে উৎপাদিত তামাকপাতার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫০ হাজার বেল। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাষিরা প্রতি হেক্টর জমিতে সাধারণত ৭০ বেল (এক বেল সমান ৪০ কেজি) পরিমাণ তামাকপাতা উৎপন্ন করে থাকেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে ১০ লাখ ৫০ হাজার বেল তামাক চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৫ হাজার হেক্টর জমি।
তোনদুল নামে পরিচিত তামাক পোড়ানোর চুলি্লতে ৭০ বেল তামাক পোড়াতে সাধারণত চার টন জ্বালানি কাঠ লাগে। এর মানে প্রতিবছর ১০ লাখ ৫০ হাজার তামাক পাতা প্রস্তুতের কাজে পোড়াতে হচ্ছে ৬০ হাজার টন জ্বলানি কাঠ।
বাংলাদেশে বন উজাড়ের এক-তৃতীয়াংশের জন্যই তামাক চাষকে দায়ী করা হয়েছে পাথ কানাডা নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়। বর্তমানে হেলথ ব্রিজ নামে পরিচিত পাথ কানাডার 'ট্যোবাকো অ্যান্ড পোভারটি :অবজারভেশন্স ফ্রম ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ' শীর্ষক ওই গবেষণার অন্যতম গবেষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের কর্মী আমিনুল ইসলাম সুজন। ওই গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ বন উজাড় করা হয়, তার ৩০ শতাংশই হয় এই তামাক চাষের কারণে। তামাক চাষের কারণে বন ধ্বংসের বার্ষিক হারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া (৪৫ শতাংশ) ও উরুগুয়ে (৪০ শতাংশ)।
No comments