সামিহাদের জন্য প্রার্থনা by হারুন উর রশীদ

আমার বন্ধু সম্পা। ওর প্রথম সন্তান সামিহা। সামিহা বড় হয়েছে, শাড়িও পরে। আর এই সামিহাকে নিয়ে সম্পার অনেক স্বপ্ন, অনেক গল্প, আকাশছোঁয়া আশা। গত কয়েক মাস ধরে যে কোনো আলাপের মাঝেই সম্পা ওর মেয়ের কথা বলত। বলত টেনশনের কথা। দোয়া চাইত। দোয়া চাইত স্বপ্ন পূরণের।
শুক্রবার সম্পা ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। 'আমার বড় মেয়ে সামিহা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।' শুধু আমি নই, আরও অনেকে সামিহার জন্য দোয়া করেছেন। কমেন্ট করেছেন। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেছেন।
পোস্টে সম্পা তার মেয়ের একটি ছবিও জুড়ে দিয়েছে। লাল শাড়ি পরা। চোখে তার দূর আকাশের স্বপ্ন।
কিন্তু হায়! একই দিনে কয়েক ঘণ্টা পর আরও একটি খবর এলো অজ্ঞাত স্থান থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। আগে জানানো হয়েছিল, এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও 'শান্তিপূর্ণ' অবরোধ চলবে। এবার জানানো হলো, রোববার থেকে ২০ দলের ৭২ ঘণ্টার 'শান্তিপূর্ণ' হরতাল।
আমাকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল সম্পা। জানাল, হরতালের কথা শুনে ওর মেয়ে সামিহা কাঁদছে। কারণ সোমবার থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনটি ৭২ ঘণ্টা হরতালের মধ্যেই পড়েছে। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, অবরোধের মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষা চলবে। এবার কী হবে?
সম্পা বারবার জানতে চায়, হরতাল কি হবে? পরীক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত কি কোনো ছাড় দেবে না? না দিলে আমার মেয়ের কান্না তো থামবে না।
আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, দোয়া করি তোর সামিহার জন্য। প্রার্থনা করি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সবার কান্না যেন থামে।
সোমবার থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর। আমি জানি, সম্পার মেয়ের এই কান্না ১৫ লাখ শিশুর কান্না। ওরা জানে না, ওদের কী অপরাধ। ওরা কেন পরীক্ষা নিয়ে আতঙ্কে থাকবে? কেন ওদের পরীক্ষা নিয়ে থাকবে সংকট, কেনইবা ওদের জীবনে নেমে আসবে অনিশ্চয়তা?
জানি জবাব আসবে। টক শোতে কেউ কেউ নিরপেক্ষতার ভান করে যার যার দলের পক্ষে কৌশলে অবস্থান নেবেন। আর হরতাল যারা ডেকেছেন তারা 'গণতন্ত্রের' জন্য আরও একটু কষ্ট স্বীকার করতে বলবেন। হরতালবিরোধীরা হুঙ্কার ছাড়বেন। হরতালের দিন হরতালবিরোধী মিছিলে রাজপথ কাঁপাবেন।
কিন্তু তাতে সম্পার মেয়ে সামিহার কী লাভ! কী উপকার হবে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর! আর তাদের পরিবারের সদস্য, মা-বাবা কী বলে সন্তানকে বোঝাবেন।
২.
এই টানা অবরোধ-হরতাল আর বিপরীতে সরকারের কঠোর অবস্থান_ এর মাঝখানে কারা? মাঝখানে সামিহার মতো শিশুরা, বার্ন ইউনিটের ঝলসানো মুখ, বোমায় দগ্ধ কঙ্কাল আর আমার মতো সাধারণ মানুষ।
প্রাচীনকালে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো। সম্মুখ সমরে সেনাপতিরা নিহত হতেন। সৈনিকরা সামনা-সামনি যুদ্ধ করতেন। হয় জয়, নয় মৃত্যু। সাধারণ প্রজারা থাকতেন যুদ্ধের বাইরে। নিরাপদ দূরত্বে। মসনদ দখলের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকে সহিংসতার বলি হতে হতো না। প্রার্থনা করি সেই যুগ যেন আবার ফিরে আসে। প্রার্থনা করি সেই যুদ্ধ যেন আবার চালু হয়। তাহলে সামিহারা এর শিকার না হয়ে 'যুদ্ধ' উপভোগ করতে পারবে। কেউ হয়তো আমাকে বলবেন, আপনি কি বর্বর মধ্যযুগে ফিরে যেতে চান? কেউ হয়তো বলবেন, গণতন্ত্র ছেড়ে রাজতন্ত্র! এত পেছন দিকে হাঁটা। হয়তো তাই। তবে আমার জবাব, সেই যুগে শিশু সামিহারা কাঁদত না। বার্ন ইউনিটে ট্রাকের হেলপার সালাহউদ্দিনের স্ত্রীর স্বপ্ন মমি হতো না।
এ কেমন যুগ? যে যুগে মানুষ পোড়ে, মন পোড়ে না! সামিহা কাঁদে, তবুও কাঁদে না বড় নেতার 'বড়' মন। প্রার্থনা করি এমন এক সময়ের, যখন সামিহারা হাসবে আর তারা কাঁদবেন। সামিহার লাল শাড়ি পরা দূর আকাশের স্বপ্ন ফিকে হবে না। সেটা যদি মধ্যযুগ হয়, আমি তা-ই চাই।
সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.