একটি মৃত্যু, একজন নেতা ও দেশের সঙ্কট by মীযানুল করীম
২৭
জানুয়ারি, মঙ্গলবার। বিকেল সাড়ে ৪টা প্রায় বাজে। মিনিবাসে যাচ্ছিলাম
মতিঝিল থেকে ফার্মগেটের দিকে। তখনো দৈনিক বাংলা মোড় কিছু দূরে। দেখি,
মতিঝিলের ফুটপাথ ধরে লোকজন দলে দলে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। অনেকেরই মাথায়
টুপি। ঈদ বা জুমার বড় জামাতে যোগ দিতে মুসল্লিরা যেমন ছুটে যান, তেমন
দৃশ্য। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে পশ্চিমে তাকাতেই যা দেখলাম, তা অকল্পনীয় ও
অবিস্মরণীয়। ‘জনসমুদ্র’ বলতে যা বোঝায় এর বাস্তব চিত্র। হাজার নয়, লাখো
মানুষ। সবাই এসেছেন আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় শামিল হতে। আমাদের
মিনিবাসটি ডানে মোড় নিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হলো। ফকিরাপুলের সে ভিআইপি
সড়কেও দেখা গেল, মানুষ ছুটে আসছে জানাজায় যোগ দিতে। জানাজার নির্ধারিত
স্থান বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট। অথচ সেখান থেকে বহু দূরে দৈনিক বাংলা
মোড়ও লোকারণ্য। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় নেতা, রাজনীতির মহানায়কের জানাজা
হয়েছে। আর কারো বেলায় এমন অবিশ্বাস্য জনসমাগম ঘটেছে কি? শহীদ রাষ্ট্রপতি
জিয়াউর রহমানের জানাজা হয়েছিল মানিক মিয়া এভিনিউতে। সেটা ছিল দেশের ইতিহাসে
রেকর্ড সৃষ্টিকারী জানাজা সমাবেশ। তিনি জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি থাকাকালে নৃশংস
হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তার ছেলে কোকো তো ফুল, হাফ অথবা
কোয়ার্টার, কোনো কিসিমের মন্ত্রী কিংবা বড় মাঝারি পাতি নেতাও ছিলেন না। বরং
ক্ষমতাসীন মহলের নিরন্তর প্রচারণা মতে, কোকো এক মহা অপরাধী এবং ফেরার
আসামি। তার জানাজায় এত মানুষ কেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছে? দেখা
গেছে, তাদের বুকে বেদনা, মুখে আফসোস, চোখে অশ্রু। অনেকেই বলবেন, ভাগ্যহত
অরাজনৈতিক মানুষটিকে রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি দেয়ার পরিণতি হচ্ছে, অসংখ্য
মানুষের দোয়া ও সহানুভূতি লাভের সৌভাগ্য।
টিভিতে এই জানাজার বিশাল সমাবেশ দেখে এক নাগরিক উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘এটা দেখে তো সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে।’ শুনে আরেকজন শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ‘তা হলে না জানি কী ঘটে।’
এটা মাথা খারাপ বা ভালো হওয়ার বিষয় নয়। উপলব্ধি করতে হবে, কেন এত মানুষ এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কোকোর জানাজায় এসে যোগ দিলো। এর কারণ ও তাৎপর্য কি নিছক রাজনৈতিক, না আরো কিছু কারণ আছে? যে কোকো সরকারের দৃষ্টিতে ক্রিমিন্যাল, সে মানুষটি জনতার চোখে ভিকটিম বলে বিশ্বাস করার হেতুটা কী, এর যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
রবিঠাকুর বলেছেন, ‘যদি মৃত্যু না থাকিত, জগতের সেখানকার যাহা তাহা চিরকাল সেইখানেই যদি অবিকৃতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিত, তবে জগৎটা একটা চিরস্থায়ী সমাধি মন্দিরের মতো অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত বন্ধ হইয়া রহিত। মৃত্যুর অভাবে কোনো বিষয়ে কোথাও দাঁড়ি দিবার জো থাকিত না।’
অবশ্য, এই কথাগুলো জ্ঞানগর্ভ ও সুললিত হলেও এসব ভারী শব্দমালা শোনার পরও সন্তানহারা মা, ভাইহারা ভাইবোন, স্বজনহারা আপনজনদের ব্যথিত হৃদয় দুঃখের ভারে ভারীই হয়ে থাকবে। কবির শেষ কথাটি প্রণিধানযোগ্য। মৃত্যু মানুষের জীবনে ঠিকই মর্মান্তিক দাঁড়ি টেনে দেয়। কিন্তু সেটা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক। কোকোর মৃত্যুর বেলায়ও তা সত্য, তার আত্মীয়পরিজনসহ অসংখ্য মর্মব্যথী মানুষের ক্ষেত্রে।
কোকোর নামাজে জানাজা হলো মঙ্গলবার। পরদিন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম লক্ষ করার মতো। বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব পত্রিকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই দলীয় বা আদর্শিকভাবে বর্তমান সরকারের সমর্থক। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি শিরোনামÑ ইত্তেফাক ও ইনকিলাব : কোকোর জানাজায় মানুষের ঢল, মানবজমিন : কোকোর জানাজায় লাখো মানুষের আহাজারি, সংগ্রাম : জানাজায় লাখো মানুষের ঢল, বাংলাদেশ প্রতিদিন : জানাজায় জনস্রোত, নয়া দিগন্ত : কোকোর জানাজায় জনসমুদ্র, প্রথম আলো : কোকোর জানাজায় বিপুল উপস্থিতি, যুগান্তর : কোকোর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল।
বাংলাদেশ প্রতিদিন ও কালের কণ্ঠ একই মালিকানাধীন পত্রিকা। কিন্তু কোকোকে নিয়ে নিউজ ট্রিটমেন্টের পার্থক্য রয়েছে, যা তাৎপর্যপূর্ণ। জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির কথা এড়িয়ে কালের কণ্ঠে শিরোনাম দেয়া হলোÑ ‘বনানী কবরস্থানে কোকোকে দাফন।’ শিরোনামটি সাধারণ হলেও মিডিয়ার মতিগতির দিক থেকে এটি অসাধারণ। সরকার সমর্থক আরো একটি পত্রিকা শিরোনামে জানাজার বিশাল সমাবেশের কথা সচেতনভাবেই পরিহার করেছে। ইংরেজি দু’টি পত্রিকা ডেইলি স্টার ও নিউ এজ গুরুত্বহীনভাবে সাদামাটা হেডিং করেছে। এটা দেখে যে কেউ ভাববেন, তাদের কাছে লাখ লাখ মানুষের জানাজায় যোগদানের রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ার তুলনায় একটি গোরস্তানে কাউকে দাফন করা অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। সাংবাদিকতার সর্বস্বীকৃত নিউজ সেন্স প্রদর্শনের মতো কমন সেন্সটুকুও এত নামীদামি, প্রভাবশালী পত্রিকার দায়িত্বশীলদের নেইÑ এটা কি কেউ বিশ্বাস করবেন? তা হলে আসল ব্যাপারটা কী? অনেকের মাঝে এ বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে যে, কোকোকে যারা ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ’ ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে রঞ্জিত-অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরেছিলেন, তারাই ‘এত বড় এক ক্রিমিনাল’কে শেষ বিদায় জানাতে কয়েক লাখ মানুষের ছুটে আসাকে গুরুত্বহীন করে দেখিয়েছেন ইচ্ছা করেই। কারণ, মানুষমাত্রেরই বিরক্তি, ক্ষোভ, হতাশা, লজ্জা ইত্যাদি থাকে।
একটি কাণ্ড দেখে কোকোর জন্য সমব্যথী অনেকেই দুঃখের হাসি হাসতে পারেন। তা হলো, একটি পত্রিকায় ভেতরে জানাজার একাংশের ছবি ছাপা হয়েছে। তা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন, কয়েক লাখ মানুষ এ নামাজে জানাজায় শামিল হয়েছেন। কিন্তু কোকো, তার মা-ভাই এবং তাদের দল ও জোটের প্রতি বরাবর খড়গহস্ত এবং তাদের ত্রুটি অšে¦ষণে সিদ্ধহস্ত, এই সংবাদপত্রের ছবির নিচে ক্যাপশন ছিল, কোকোর জানাজায় অংশ নিয়েছেন ‘হাজার মানুষ’। ঢাকার এক মহিলা ছবিটি দেখেই অবাক হয়ে বললেন, “দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আর এরা লিখেছে মাত্র ‘হাজার’ মানুষ।” অতীতে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী নাকি হাজারের বেশি গুনতে পারত না। বাঙালিদের ওরকম মনে করা হয়েছে কি না, কে জানে।
মিডিয়ার একটি অংশের এসব সূক্ষ্ম কারসাজির চেয়ে অনেক বেশি ন্যক্কারজনক, অমানবিক ও লজ্জাকর হচ্ছে ভিআইপিদের কারো কারো স্থূল পরিহাস। কোকোর দাফনের পরদিনই যে অমৃতবচন তাদের মুখমোবারক থেকে নিঃসৃত হয়েছে, এতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির হীনতা আর রুচির দীনতাই প্রকট হয়ে ওঠে। কোকো ফেরেশতা নন। মানবিক দোষত্রুটি তার থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কারো সমালোচনা করতে হলেও স্থানকালপাত্র বিবেচনা করাই কাণ্ডজ্ঞানের দাবি। প্রবাসে সন্তানের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শোকাতুরা মাকে তীব্র বিদ্রƒপ করা এবং সেই সন্তানকে নেশাখোর বলা নিঃসন্দেহে চরম অসৌজন্য। এ ধরনের মানসিকতা দেশের রাজনীতিকে আরো অসুস্থ এবং বিদ্যমান সঙ্ঘাত আরো তীব্রই শুধু করতে পারে।
বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক তার কলামে লিখেছেন, ২৪ জানুয়ারি দুপুরে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আরাফাত রহমান কোকো ইন্তেকাল করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে বেগম জিয়ার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। গেটটি খোলা হয়নি, পারস্পরিক সাক্ষাৎ হয়নি। ঘটনাটিকে অনেক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিশ্লেষণ করা যায়। বিতর্কিত ও অবিতর্কিত একাধিক কারণের প্রেক্ষাপটেই এরূপ হয়েছিল বলে সমঝদার ব্যক্তিরা মনে করেন। ২৫ জানুয়ারি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
মওদুদ বলেছেন, সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে সৌজন্য দেখানো যেত। অর্থাৎ, সেখানে উপস্থিত দায়িত্বশীলেরা তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রীর আগমনে কী করা উচিত, সে ব্যাপারে। যা হোক, যদি ধরেও নেয়া হয় যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সে দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ, আর তা সম্ভব না হলে তাকে একনজর দেখার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল, তবুও এ বিষয়কে কারো দলীয় রাজনীতির পুঁজি করা উচিত নয়। আওয়ামী লীগ তার স্বভাব মোতাবেক সে দিনের ঘটনাকে প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করতে একটুও দেরি করেনি। বরং এর অতি ব্যবহার হয়ে আসছে কয়েক দিন ধরে।
গুলশানে বিএনপি কার্যালয়ে দুই নেত্রীর দেখা হলেই যে, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা হয়ে যেত কিংবা সংলাপ হয়ে উঠত অনিবার্য, তা নয়। তবে সত্য কথা হলো, কোকোর মৃত্যুতে শোকাহত মা, বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার ঘোষণা শুনে মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। সে প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত কতটুকু, তা বিবেচ্য ছিল না। উত্তপ্ত, উদ্বেগজনক ও ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির মাঝে দুই নেত্রীর সাক্ষাৎসম্ভাবনা মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে, যদিও তা ক্ষণিকের। সাধারণ মানুষই শুধু নয়, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মতো বহু বিশিষ্টজনই সে দিন ভালো কিছু আশা করেছিলেন। অবশ্য শোকে নিমজ্জিত বেগম জিয়া নিদ্রিত না থাকলেও তিনি কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় তখন থাকতেন কি না, এটাও বিবেচনা করা উচিত।
দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা। মতিঝিলের সদর রাস্তার পাশে, বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ডের পশ্চিমে ফুটপাথে বসে আছেন কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম। উপাধি ‘বঙ্গবীর’ও। দেখলাম, তিনি বসে আছেন চাদর বিছিয়ে। মাথায় টুপি, গলায় গামছা। সাথে জনাপাঁচেক নেতা। সামনে পেতে রাখা বেশ ক’টি চেয়ারে লোকজন বসা। গামছা কারো গলায়, কারো বাঁধা। দুই নেত্রীকে সংলাপ বা আলোচনায় বসানোর দাবিতে কাদের সিদ্দিকী সেখানে অবস্থান নিয়েছেন আগের দিন বিকেল থেকে। তখন আসার সময় দেখেছি, ফুটপাথের ওপর কাপড় দিয়ে খানিকটা জায়গা ঘিরে রাখা। কাছে পুলিশ কৌতূহলী মানুষের ভিড় সরিয়ে দিচ্ছে। শনিবার দেখলাম, মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ কাদের সিদ্দিকীর পাশে বসা।
কাদের সিদ্দিকীর দাবির মূল কথাÑ ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশ বাঁচাতে আলোচনায় বসুন।’ আর ‘মাননীয় বেগম খালেদা জিয়া, মানুষ বাঁচাতে অবরোধ প্রত্যাহার করুন।’ কিছু স্টিকারে লেখা দেখা গেল, ‘আমাদের দাবি একটাই/শান্তিতে বাঁচতে চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় একই পথে ফেরার সময়ে দেখেছি, কাদের সিদ্দিকী একই জায়গায় চাদর মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এমন সময় একজন এসে তার সাথে হাত মিলিয়ে আলাপ করলেন। সারা দিনই কিছু মানুষ সেখানে রয়েছেন। কর্মীরা কিছুক্ষণ পর পর স্লোগান দিচ্ছেন।
স্মর্তব্য, কাদের সিদ্দিকী যেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। প্রায় ৪২ বছর আগে জায়গাটার কাছেই দলীয় অফিসে অনশন কর্মসূচি পালন করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কাকতালীয় হচ্ছে, ভাসানী ও সিদ্দিকী, দু’জনই টাঙ্গাইলের। ’৭৩-এ ক্ষমতায় ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। এখন তার মেয়ে শেখ হাসিনা।
যা হোক, শুধু কাদের সিদ্দিকী ননÑ অনেকেরই দাবি হচ্ছে, অবিলম্বে সংলাপে বসুন। অবশ্য সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষকে এক নিক্তিতে মাপার ব্যাপারে আপত্তি তুলবেন অনেকে। কারণ, বিরাজমান সঙ্কটের জন্য কে বেশি দায়ী, এ নিয়ে সরকার সমর্থক ও বিরোধী দলের অবস্থান উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। তবে এটা সবাইকে মানতে হবে, ককটেল কিংবা কালো আইন, বোমা কিংবা বাগাড়ম্বর সমাধান দেবে না। গ্রেফতার, রিমান্ড, ক্রসফায়ার, বোমা, আগুন মিলিয়ে জনগণের দম বন্ধ হয়ে আসছে। Violence begets violence বুঝতে হবেÑ কারণ দূর না হলে প্রতিক্রিয়া বন্ধ হয় না। মূল রোগের চিকিৎসা ছাড়া কেবল উপসর্গের চিকিৎসা রুগ্ন রাজনীতিকে সুস্থ করতে পারে না। জেদাজেদি সঙ্ঘাত বাড়াবে। অপর দিকে, সংলাপ তা কমাবে। জাতির স্বার্থে ত্যাগ ও সমঝোতার নাম পরাজয় নয়। গোঁয়ারগোবিন্দ বড়জোর পরিবার চালাতে পারে। একটি দেশ চালাতে দৃঢ়তার সাথে নমনীয়তাও থাকতে হয়। এটা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই অংশ।
পাদটীকা : কয়েক দিন আগে টিভির একটি চ্যানেলে টকশো চলছিল। নেত্রী টকশোর টক-মিষ্টি ঝাল বক্তাদের নিশিকুটুম্বের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু তার দলেরও অনেকেই টকশোর দাওয়াত পেলেই হুমড়ি খেয়ে ছুটে আসেন। সে দিন সে দলের একজন অত্যন্ত দাপুটে ও সরব নেতা অনেক বড় বড় কথা বলছিলেন। হঠাৎ বিজ্ঞাপনের বিরতি। একটি রিরোলিং মিলের এ বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে, তাদের তৈরি করা রডের বিশেষ গুণ হলোÑ ‘সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা এবং ভূমিকম্প সহনশীলতা।’ তেমনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন, সংসদ, সরকার ইত্যাদি সব কিছুর থাকা চাই ‘সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় All inclusive. সেই সাথে সরকারের থাকতে হয় ভিন্নমতের প্রতি এমন সহিষ্ণুতা যে, দেশে রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মাঝেও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
টকশোর সে রাজনৈতিক বক্তা কি বিজ্ঞাপনটির ভাষার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন?
টিভিতে এই জানাজার বিশাল সমাবেশ দেখে এক নাগরিক উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘এটা দেখে তো সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে।’ শুনে আরেকজন শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ‘তা হলে না জানি কী ঘটে।’
এটা মাথা খারাপ বা ভালো হওয়ার বিষয় নয়। উপলব্ধি করতে হবে, কেন এত মানুষ এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কোকোর জানাজায় এসে যোগ দিলো। এর কারণ ও তাৎপর্য কি নিছক রাজনৈতিক, না আরো কিছু কারণ আছে? যে কোকো সরকারের দৃষ্টিতে ক্রিমিন্যাল, সে মানুষটি জনতার চোখে ভিকটিম বলে বিশ্বাস করার হেতুটা কী, এর যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
রবিঠাকুর বলেছেন, ‘যদি মৃত্যু না থাকিত, জগতের সেখানকার যাহা তাহা চিরকাল সেইখানেই যদি অবিকৃতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিত, তবে জগৎটা একটা চিরস্থায়ী সমাধি মন্দিরের মতো অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত বন্ধ হইয়া রহিত। মৃত্যুর অভাবে কোনো বিষয়ে কোথাও দাঁড়ি দিবার জো থাকিত না।’
অবশ্য, এই কথাগুলো জ্ঞানগর্ভ ও সুললিত হলেও এসব ভারী শব্দমালা শোনার পরও সন্তানহারা মা, ভাইহারা ভাইবোন, স্বজনহারা আপনজনদের ব্যথিত হৃদয় দুঃখের ভারে ভারীই হয়ে থাকবে। কবির শেষ কথাটি প্রণিধানযোগ্য। মৃত্যু মানুষের জীবনে ঠিকই মর্মান্তিক দাঁড়ি টেনে দেয়। কিন্তু সেটা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক। কোকোর মৃত্যুর বেলায়ও তা সত্য, তার আত্মীয়পরিজনসহ অসংখ্য মর্মব্যথী মানুষের ক্ষেত্রে।
কোকোর নামাজে জানাজা হলো মঙ্গলবার। পরদিন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম লক্ষ করার মতো। বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব পত্রিকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই দলীয় বা আদর্শিকভাবে বর্তমান সরকারের সমর্থক। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি শিরোনামÑ ইত্তেফাক ও ইনকিলাব : কোকোর জানাজায় মানুষের ঢল, মানবজমিন : কোকোর জানাজায় লাখো মানুষের আহাজারি, সংগ্রাম : জানাজায় লাখো মানুষের ঢল, বাংলাদেশ প্রতিদিন : জানাজায় জনস্রোত, নয়া দিগন্ত : কোকোর জানাজায় জনসমুদ্র, প্রথম আলো : কোকোর জানাজায় বিপুল উপস্থিতি, যুগান্তর : কোকোর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল।
বাংলাদেশ প্রতিদিন ও কালের কণ্ঠ একই মালিকানাধীন পত্রিকা। কিন্তু কোকোকে নিয়ে নিউজ ট্রিটমেন্টের পার্থক্য রয়েছে, যা তাৎপর্যপূর্ণ। জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির কথা এড়িয়ে কালের কণ্ঠে শিরোনাম দেয়া হলোÑ ‘বনানী কবরস্থানে কোকোকে দাফন।’ শিরোনামটি সাধারণ হলেও মিডিয়ার মতিগতির দিক থেকে এটি অসাধারণ। সরকার সমর্থক আরো একটি পত্রিকা শিরোনামে জানাজার বিশাল সমাবেশের কথা সচেতনভাবেই পরিহার করেছে। ইংরেজি দু’টি পত্রিকা ডেইলি স্টার ও নিউ এজ গুরুত্বহীনভাবে সাদামাটা হেডিং করেছে। এটা দেখে যে কেউ ভাববেন, তাদের কাছে লাখ লাখ মানুষের জানাজায় যোগদানের রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ার তুলনায় একটি গোরস্তানে কাউকে দাফন করা অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। সাংবাদিকতার সর্বস্বীকৃত নিউজ সেন্স প্রদর্শনের মতো কমন সেন্সটুকুও এত নামীদামি, প্রভাবশালী পত্রিকার দায়িত্বশীলদের নেইÑ এটা কি কেউ বিশ্বাস করবেন? তা হলে আসল ব্যাপারটা কী? অনেকের মাঝে এ বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে যে, কোকোকে যারা ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ’ ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে রঞ্জিত-অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরেছিলেন, তারাই ‘এত বড় এক ক্রিমিনাল’কে শেষ বিদায় জানাতে কয়েক লাখ মানুষের ছুটে আসাকে গুরুত্বহীন করে দেখিয়েছেন ইচ্ছা করেই। কারণ, মানুষমাত্রেরই বিরক্তি, ক্ষোভ, হতাশা, লজ্জা ইত্যাদি থাকে।
একটি কাণ্ড দেখে কোকোর জন্য সমব্যথী অনেকেই দুঃখের হাসি হাসতে পারেন। তা হলো, একটি পত্রিকায় ভেতরে জানাজার একাংশের ছবি ছাপা হয়েছে। তা দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন, কয়েক লাখ মানুষ এ নামাজে জানাজায় শামিল হয়েছেন। কিন্তু কোকো, তার মা-ভাই এবং তাদের দল ও জোটের প্রতি বরাবর খড়গহস্ত এবং তাদের ত্রুটি অšে¦ষণে সিদ্ধহস্ত, এই সংবাদপত্রের ছবির নিচে ক্যাপশন ছিল, কোকোর জানাজায় অংশ নিয়েছেন ‘হাজার মানুষ’। ঢাকার এক মহিলা ছবিটি দেখেই অবাক হয়ে বললেন, “দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আর এরা লিখেছে মাত্র ‘হাজার’ মানুষ।” অতীতে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী নাকি হাজারের বেশি গুনতে পারত না। বাঙালিদের ওরকম মনে করা হয়েছে কি না, কে জানে।
মিডিয়ার একটি অংশের এসব সূক্ষ্ম কারসাজির চেয়ে অনেক বেশি ন্যক্কারজনক, অমানবিক ও লজ্জাকর হচ্ছে ভিআইপিদের কারো কারো স্থূল পরিহাস। কোকোর দাফনের পরদিনই যে অমৃতবচন তাদের মুখমোবারক থেকে নিঃসৃত হয়েছে, এতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির হীনতা আর রুচির দীনতাই প্রকট হয়ে ওঠে। কোকো ফেরেশতা নন। মানবিক দোষত্রুটি তার থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে কারো সমালোচনা করতে হলেও স্থানকালপাত্র বিবেচনা করাই কাণ্ডজ্ঞানের দাবি। প্রবাসে সন্তানের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শোকাতুরা মাকে তীব্র বিদ্রƒপ করা এবং সেই সন্তানকে নেশাখোর বলা নিঃসন্দেহে চরম অসৌজন্য। এ ধরনের মানসিকতা দেশের রাজনীতিকে আরো অসুস্থ এবং বিদ্যমান সঙ্ঘাত আরো তীব্রই শুধু করতে পারে।
বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক তার কলামে লিখেছেন, ২৪ জানুয়ারি দুপুরে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আরাফাত রহমান কোকো ইন্তেকাল করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে বেগম জিয়ার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। গেটটি খোলা হয়নি, পারস্পরিক সাক্ষাৎ হয়নি। ঘটনাটিকে অনেক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিশ্লেষণ করা যায়। বিতর্কিত ও অবিতর্কিত একাধিক কারণের প্রেক্ষাপটেই এরূপ হয়েছিল বলে সমঝদার ব্যক্তিরা মনে করেন। ২৫ জানুয়ারি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
মওদুদ বলেছেন, সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে সৌজন্য দেখানো যেত। অর্থাৎ, সেখানে উপস্থিত দায়িত্বশীলেরা তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রীর আগমনে কী করা উচিত, সে ব্যাপারে। যা হোক, যদি ধরেও নেয়া হয় যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সে দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ, আর তা সম্ভব না হলে তাকে একনজর দেখার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল, তবুও এ বিষয়কে কারো দলীয় রাজনীতির পুঁজি করা উচিত নয়। আওয়ামী লীগ তার স্বভাব মোতাবেক সে দিনের ঘটনাকে প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করতে একটুও দেরি করেনি। বরং এর অতি ব্যবহার হয়ে আসছে কয়েক দিন ধরে।
গুলশানে বিএনপি কার্যালয়ে দুই নেত্রীর দেখা হলেই যে, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা হয়ে যেত কিংবা সংলাপ হয়ে উঠত অনিবার্য, তা নয়। তবে সত্য কথা হলো, কোকোর মৃত্যুতে শোকাহত মা, বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার ঘোষণা শুনে মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। সে প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত কতটুকু, তা বিবেচ্য ছিল না। উত্তপ্ত, উদ্বেগজনক ও ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির মাঝে দুই নেত্রীর সাক্ষাৎসম্ভাবনা মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে, যদিও তা ক্ষণিকের। সাধারণ মানুষই শুধু নয়, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মতো বহু বিশিষ্টজনই সে দিন ভালো কিছু আশা করেছিলেন। অবশ্য শোকে নিমজ্জিত বেগম জিয়া নিদ্রিত না থাকলেও তিনি কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় তখন থাকতেন কি না, এটাও বিবেচনা করা উচিত।
দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা। মতিঝিলের সদর রাস্তার পাশে, বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ডের পশ্চিমে ফুটপাথে বসে আছেন কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম। উপাধি ‘বঙ্গবীর’ও। দেখলাম, তিনি বসে আছেন চাদর বিছিয়ে। মাথায় টুপি, গলায় গামছা। সাথে জনাপাঁচেক নেতা। সামনে পেতে রাখা বেশ ক’টি চেয়ারে লোকজন বসা। গামছা কারো গলায়, কারো বাঁধা। দুই নেত্রীকে সংলাপ বা আলোচনায় বসানোর দাবিতে কাদের সিদ্দিকী সেখানে অবস্থান নিয়েছেন আগের দিন বিকেল থেকে। তখন আসার সময় দেখেছি, ফুটপাথের ওপর কাপড় দিয়ে খানিকটা জায়গা ঘিরে রাখা। কাছে পুলিশ কৌতূহলী মানুষের ভিড় সরিয়ে দিচ্ছে। শনিবার দেখলাম, মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ কাদের সিদ্দিকীর পাশে বসা।
কাদের সিদ্দিকীর দাবির মূল কথাÑ ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশ বাঁচাতে আলোচনায় বসুন।’ আর ‘মাননীয় বেগম খালেদা জিয়া, মানুষ বাঁচাতে অবরোধ প্রত্যাহার করুন।’ কিছু স্টিকারে লেখা দেখা গেল, ‘আমাদের দাবি একটাই/শান্তিতে বাঁচতে চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় একই পথে ফেরার সময়ে দেখেছি, কাদের সিদ্দিকী একই জায়গায় চাদর মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এমন সময় একজন এসে তার সাথে হাত মিলিয়ে আলাপ করলেন। সারা দিনই কিছু মানুষ সেখানে রয়েছেন। কর্মীরা কিছুক্ষণ পর পর স্লোগান দিচ্ছেন।
স্মর্তব্য, কাদের সিদ্দিকী যেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। প্রায় ৪২ বছর আগে জায়গাটার কাছেই দলীয় অফিসে অনশন কর্মসূচি পালন করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কাকতালীয় হচ্ছে, ভাসানী ও সিদ্দিকী, দু’জনই টাঙ্গাইলের। ’৭৩-এ ক্ষমতায় ছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। এখন তার মেয়ে শেখ হাসিনা।
যা হোক, শুধু কাদের সিদ্দিকী ননÑ অনেকেরই দাবি হচ্ছে, অবিলম্বে সংলাপে বসুন। অবশ্য সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষকে এক নিক্তিতে মাপার ব্যাপারে আপত্তি তুলবেন অনেকে। কারণ, বিরাজমান সঙ্কটের জন্য কে বেশি দায়ী, এ নিয়ে সরকার সমর্থক ও বিরোধী দলের অবস্থান উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে। তবে এটা সবাইকে মানতে হবে, ককটেল কিংবা কালো আইন, বোমা কিংবা বাগাড়ম্বর সমাধান দেবে না। গ্রেফতার, রিমান্ড, ক্রসফায়ার, বোমা, আগুন মিলিয়ে জনগণের দম বন্ধ হয়ে আসছে। Violence begets violence বুঝতে হবেÑ কারণ দূর না হলে প্রতিক্রিয়া বন্ধ হয় না। মূল রোগের চিকিৎসা ছাড়া কেবল উপসর্গের চিকিৎসা রুগ্ন রাজনীতিকে সুস্থ করতে পারে না। জেদাজেদি সঙ্ঘাত বাড়াবে। অপর দিকে, সংলাপ তা কমাবে। জাতির স্বার্থে ত্যাগ ও সমঝোতার নাম পরাজয় নয়। গোঁয়ারগোবিন্দ বড়জোর পরিবার চালাতে পারে। একটি দেশ চালাতে দৃঢ়তার সাথে নমনীয়তাও থাকতে হয়। এটা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই অংশ।
পাদটীকা : কয়েক দিন আগে টিভির একটি চ্যানেলে টকশো চলছিল। নেত্রী টকশোর টক-মিষ্টি ঝাল বক্তাদের নিশিকুটুম্বের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু তার দলেরও অনেকেই টকশোর দাওয়াত পেলেই হুমড়ি খেয়ে ছুটে আসেন। সে দিন সে দলের একজন অত্যন্ত দাপুটে ও সরব নেতা অনেক বড় বড় কথা বলছিলেন। হঠাৎ বিজ্ঞাপনের বিরতি। একটি রিরোলিং মিলের এ বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে, তাদের তৈরি করা রডের বিশেষ গুণ হলোÑ ‘সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা এবং ভূমিকম্প সহনশীলতা।’ তেমনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন, সংসদ, সরকার ইত্যাদি সব কিছুর থাকা চাই ‘সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটাকে বলা হয় All inclusive. সেই সাথে সরকারের থাকতে হয় ভিন্নমতের প্রতি এমন সহিষ্ণুতা যে, দেশে রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মাঝেও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
টকশোর সে রাজনৈতিক বক্তা কি বিজ্ঞাপনটির ভাষার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন?
No comments