বাহাদুর শাহের সমাধি, ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস by সোহরাব হাসান
বাহাদুর
শাহ জাফরের একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি: কী দুর্ভাগ্য জাফরের, যে জমিন সে
ভালোবাসত/ সেই জমিনে তাঁর সমাধির জন্য দুই গজ জায়গা হলো না।
সত্যি, ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের ঠাঁই হয়নি ভারতের মাটিতে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠান। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর সেখানেই তিনি মারা যান।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিমপন তাঁর লাস্ট মোগল (২০০৬) বইয়ে লিখেছেন, ‘সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় তখন বাহাদুর শাহ দিল্লির একটি বাড়িতে ছিলেন। মিরাট থেকে ৩০০ জনের একটি বিদ্রোহী দল এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, যার মধ্যে সিপাহি ও অন্যান্য পেশার মানুষ ছিলেন। তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে বললে তিনি রাজি হন। এরপর বাহাদুর শাহ হয়ে ওঠেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের বিদ্রোহ ও ঐক্যের প্রতীক। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মিরাট ও ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চার মাসের মাথায় ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে এবং তারা কবি ও যুবরাজ মোল্লা ও কামাক্ষা, সুফি ও পণ্ডিত—সবাইকে পাকড়াও করে ফাঁসি দেয়, ধ্বংস করে প্রাসাদ, মসজিদ, ঈদগাহ, বাগান ও ঘরবাড়ি। ২১ সেপ্টেম্বর বাহাদুর শাহ আত্মসমর্পণের পরদিন মেজর উইলিয়াম হাডসন তাঁর দুই পুত্র মির্জা মোগল ও মির্জা খিলজি সুলতানকে গুলি করে হত্যা করেন। অবশ্য কয়েক মাস পর তিনিও লক্ষ্ণৌতে কুর্দি বেগমের হাতে নিহত হন।
১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে বাহাদুর শাহের বিচার শুরু হয় এবং শেষ হয় ৯ মার্চ। আদালত তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করেন। প্রথমে দিল্লি থেকে কলকাতায় এবং কলকাতা থেকে জাহাজে করে তাঁকে ইয়াঙ্গুনে পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জিনাত মহল, দুই পুত্র জওয়ান বখত ও আব্বাস বখত, পুত্রবধূ রওনক জাহান ও এক নাতনি।
ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্ব পাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। তখন এটি ছিল সেনাছাউনি। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র চারটি কক্ষ। সেখানে বাহাদুর শাহকে লেখার কলম ও কাগজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর বাহাদুর শাহ মারা গেলেও নতুন বিদ্রোহের আশঙ্কায় সে খবরটি তখনই জানানো হয়নি। নেলসন ডেভিস ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জানান এক সপ্তাহ পর। দিল্লিতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৫ দিন পর। জীবনের শেষ বেলায় তাঁর তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ডারিস লিখেছেন: আবু জাফর শুক্রবার ভোর পাঁচটায় মারা গেছেন। ওই দিন বিকেল পাঁচটায় তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। একজন মাওলানা তাঁর জানাজা পড়ান। পাঞ্জাব হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জিডি গোমেজ তাঁর বই দ্য লাস্ট মোগল-এ লিখেছেন, তাঁর কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয় এবং ওপরে ঘাসের আচ্ছাদন।
১৮৬৭ সালে বাহাদুর শাহের পরিবারের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ সালের ১৭ জুলাই। দীর্ঘ কারাবাসে জওয়ান বখতের স্ত্রী জামানি বেগম গুরুতর অসুস্থ এবং পরে অন্ধ হয়ে যান। শাহজাদা আব্বাস ইয়াঙ্গুনের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের বংশধরদের কেউ কেউ এখনো ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন।
ভারতীয়রা দীর্ঘদিন বাহাদুর শাহের সমাধি সম্পর্কে কিছু জানতেন না। ১৯০৩ সালে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল প্রথম বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শন করেন। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অযত্নের কারণে সেই সমাধিটি তখন আর চেনা যাচ্ছিল না। ১৯০৫ সালে ইয়াঙ্গুনের মুসলমানরা বাহাদুর শাহের সমাধি চিহ্নিত করার দাবি জানান; ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সমাধির ওপর পাথরখচিত ফলক বসায়, যাতে লেখা ছিল: বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর এর কাছেই মারা গেছেন। স্থানীয় মুসলমানরা বাহাদুর শাহকে ক্ষমতাবান সুফি বাদশাহ হিসেবে সম্মান করেন এবং এখনো তাঁর কাছে দোয়া নিতে আসেন।
উইলিয়াম ডালরিমপনের ভাষায়, বাহাদুর শাহ ছিলেন একজন ক্যালিওগ্রাফার, সুফি, ধর্মতত্ত্ববিদ, মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও আধ্যাত্মিক কবি। খুল্লিয়াতে জাফর নামে তাঁর একটি কবিতার সংকলন আছে। তিনি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সমুন্নত রেখেছিলেন।
ইয়াঙ্গুনের আলো ঝলমল বিশালকায় ইমারতগুলোর মধ্যে এই প্রায় জীর্ণ দোতলা সমাধিটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। সমাধি অঙ্গনে ঢুকতেই বাঁ দিকে বাহাদুর শাহের কয়েকটি আঁকা ছবি ও ফলক চোখে পড়ে, ডান দিকে ছোট্ট অভ্যর্থনা কক্ষ। খোলা চত্বর পার হয়ে কিছুটা সামনে এগোতে বাঁ দিকের কক্ষে তিনটি কবর বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল এবং দুই পুত্র মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা শাহ আব্বাসের। দেয়ালে দুই যুবরাজের মাথায় বাবরি ও টুপি পরা ছবি। তার পাশে ১৮৭২ সালে জিনাত মহলের একমাত্র আলোকচিত্র, বাহাদুর শাহ ও জিনাত মহলের আরবিতে লেখা নিকাহ্নামা, আরেকটি ফলকে বাহাদুর শাহের হাতের লেখার ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই কক্ষে আরও আছে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে শাহ জাফর ও তাঁর দুই পুত্রের ছবি, গায়ে চাদর, নির্লিপ্ত চোখ, পায়ে জুতা, জিনাত মহলের তরুণ বয়সের একটি ছবি, আরেকটি ফলকে শাহ জাফরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ।
নিচের তলায় বাহাদুর শাহের সমাধি, সবুজ গিলাফে ঢাকা, অনেক দিনের পুরোনো। দেয়ালের একটি ছবিতে বাহাদুর শাহকে হুক্কা হাতে শোয়া অবস্থায় দেখা যায়, তাঁর জীবনের শেষ দিনের ছবি। আরেকটি ছবিতে সামরিক আদালতে বিচারের পর তাঁকে সেনা প্রহরায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য; তৃতীয়টিতে দেখলাম তিনি শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিচ্ছেন। সমাধির বাইরে দানবাক্স আছে, ভক্তরা যে যা পারেন সাহায্য করেন। ইয়াঙ্গুনের বাইরে থেকেও মুসলমানরা আসেন বাহাদুর শাহের সমাধি দেখতে। একজন খাদেম বললেন, এটি পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাদানে; সরকার থেকে অর্থ নেওয়া হয় না। মিয়ানমারের মুসলমানরা তাঁকে শুধু শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে দেখে না; দেখেন একজন সুফি ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। অনেকে দরগাহে মানতও করেন। সামনের খোলা চত্বরের দেয়ালে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কয়েকটি আলোকচিত্র। বাংলাদেশের কোনো নেতা এলেও তাঁদের ছবি নেই। বর্তমান সমাধি ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯১ সালে, ভারত সরকারের সহায়তায়। এর দেয়ালে লেখা আছে ‘এই হলটি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত’।
অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে বাহাদুর শাহের সমাধি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে বাহাদুর শাহের সমাধিতে ফুল দিয়েই ‘দিল্লি চলো’ প্রচারণা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ মিয়ানমার পার হয়ে পূর্ব ভারতের ইম্ফল পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী সমাধি পরিদর্শনকালে লিখেছিলেন, যদিও আপনি (বাহাদুর শাহ) ভারতের জমিন পাননি, তবে এখানে পেয়েছেন, আপনার নাম এখনো জীবন্ত। আমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
পরের কিস্তি: মিয়ানমারে এক টুকরো বাংলাদেশ
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
সত্যি, ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের ঠাঁই হয়নি ভারতের মাটিতে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠান। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর সেখানেই তিনি মারা যান।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিমপন তাঁর লাস্ট মোগল (২০০৬) বইয়ে লিখেছেন, ‘সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় তখন বাহাদুর শাহ দিল্লির একটি বাড়িতে ছিলেন। মিরাট থেকে ৩০০ জনের একটি বিদ্রোহী দল এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, যার মধ্যে সিপাহি ও অন্যান্য পেশার মানুষ ছিলেন। তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে বললে তিনি রাজি হন। এরপর বাহাদুর শাহ হয়ে ওঠেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের বিদ্রোহ ও ঐক্যের প্রতীক। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মিরাট ও ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চার মাসের মাথায় ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে এবং তারা কবি ও যুবরাজ মোল্লা ও কামাক্ষা, সুফি ও পণ্ডিত—সবাইকে পাকড়াও করে ফাঁসি দেয়, ধ্বংস করে প্রাসাদ, মসজিদ, ঈদগাহ, বাগান ও ঘরবাড়ি। ২১ সেপ্টেম্বর বাহাদুর শাহ আত্মসমর্পণের পরদিন মেজর উইলিয়াম হাডসন তাঁর দুই পুত্র মির্জা মোগল ও মির্জা খিলজি সুলতানকে গুলি করে হত্যা করেন। অবশ্য কয়েক মাস পর তিনিও লক্ষ্ণৌতে কুর্দি বেগমের হাতে নিহত হন।
১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে বাহাদুর শাহের বিচার শুরু হয় এবং শেষ হয় ৯ মার্চ। আদালত তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করেন। প্রথমে দিল্লি থেকে কলকাতায় এবং কলকাতা থেকে জাহাজে করে তাঁকে ইয়াঙ্গুনে পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী জিনাত মহল, দুই পুত্র জওয়ান বখত ও আব্বাস বখত, পুত্রবধূ রওনক জাহান ও এক নাতনি।
ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্ব পাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। তখন এটি ছিল সেনাছাউনি। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র চারটি কক্ষ। সেখানে বাহাদুর শাহকে লেখার কলম ও কাগজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর বাহাদুর শাহ মারা গেলেও নতুন বিদ্রোহের আশঙ্কায় সে খবরটি তখনই জানানো হয়নি। নেলসন ডেভিস ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জানান এক সপ্তাহ পর। দিল্লিতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৫ দিন পর। জীবনের শেষ বেলায় তাঁর তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ডারিস লিখেছেন: আবু জাফর শুক্রবার ভোর পাঁচটায় মারা গেছেন। ওই দিন বিকেল পাঁচটায় তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। একজন মাওলানা তাঁর জানাজা পড়ান। পাঞ্জাব হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জিডি গোমেজ তাঁর বই দ্য লাস্ট মোগল-এ লিখেছেন, তাঁর কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয় এবং ওপরে ঘাসের আচ্ছাদন।
১৮৬৭ সালে বাহাদুর শাহের পরিবারের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ সালের ১৭ জুলাই। দীর্ঘ কারাবাসে জওয়ান বখতের স্ত্রী জামানি বেগম গুরুতর অসুস্থ এবং পরে অন্ধ হয়ে যান। শাহজাদা আব্বাস ইয়াঙ্গুনের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের বংশধরদের কেউ কেউ এখনো ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন।
ভারতীয়রা দীর্ঘদিন বাহাদুর শাহের সমাধি সম্পর্কে কিছু জানতেন না। ১৯০৩ সালে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল প্রথম বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শন করেন। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অযত্নের কারণে সেই সমাধিটি তখন আর চেনা যাচ্ছিল না। ১৯০৫ সালে ইয়াঙ্গুনের মুসলমানরা বাহাদুর শাহের সমাধি চিহ্নিত করার দাবি জানান; ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সমাধির ওপর পাথরখচিত ফলক বসায়, যাতে লেখা ছিল: বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর এর কাছেই মারা গেছেন। স্থানীয় মুসলমানরা বাহাদুর শাহকে ক্ষমতাবান সুফি বাদশাহ হিসেবে সম্মান করেন এবং এখনো তাঁর কাছে দোয়া নিতে আসেন।
উইলিয়াম ডালরিমপনের ভাষায়, বাহাদুর শাহ ছিলেন একজন ক্যালিওগ্রাফার, সুফি, ধর্মতত্ত্ববিদ, মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও আধ্যাত্মিক কবি। খুল্লিয়াতে জাফর নামে তাঁর একটি কবিতার সংকলন আছে। তিনি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সমুন্নত রেখেছিলেন।
ইয়াঙ্গুনের আলো ঝলমল বিশালকায় ইমারতগুলোর মধ্যে এই প্রায় জীর্ণ দোতলা সমাধিটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। সমাধি অঙ্গনে ঢুকতেই বাঁ দিকে বাহাদুর শাহের কয়েকটি আঁকা ছবি ও ফলক চোখে পড়ে, ডান দিকে ছোট্ট অভ্যর্থনা কক্ষ। খোলা চত্বর পার হয়ে কিছুটা সামনে এগোতে বাঁ দিকের কক্ষে তিনটি কবর বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল এবং দুই পুত্র মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা শাহ আব্বাসের। দেয়ালে দুই যুবরাজের মাথায় বাবরি ও টুপি পরা ছবি। তার পাশে ১৮৭২ সালে জিনাত মহলের একমাত্র আলোকচিত্র, বাহাদুর শাহ ও জিনাত মহলের আরবিতে লেখা নিকাহ্নামা, আরেকটি ফলকে বাহাদুর শাহের হাতের লেখার ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই কক্ষে আরও আছে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে শাহ জাফর ও তাঁর দুই পুত্রের ছবি, গায়ে চাদর, নির্লিপ্ত চোখ, পায়ে জুতা, জিনাত মহলের তরুণ বয়সের একটি ছবি, আরেকটি ফলকে শাহ জাফরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ।
নিচের তলায় বাহাদুর শাহের সমাধি, সবুজ গিলাফে ঢাকা, অনেক দিনের পুরোনো। দেয়ালের একটি ছবিতে বাহাদুর শাহকে হুক্কা হাতে শোয়া অবস্থায় দেখা যায়, তাঁর জীবনের শেষ দিনের ছবি। আরেকটি ছবিতে সামরিক আদালতে বিচারের পর তাঁকে সেনা প্রহরায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য; তৃতীয়টিতে দেখলাম তিনি শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিচ্ছেন। সমাধির বাইরে দানবাক্স আছে, ভক্তরা যে যা পারেন সাহায্য করেন। ইয়াঙ্গুনের বাইরে থেকেও মুসলমানরা আসেন বাহাদুর শাহের সমাধি দেখতে। একজন খাদেম বললেন, এটি পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাদানে; সরকার থেকে অর্থ নেওয়া হয় না। মিয়ানমারের মুসলমানরা তাঁকে শুধু শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে দেখে না; দেখেন একজন সুফি ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। অনেকে দরগাহে মানতও করেন। সামনের খোলা চত্বরের দেয়ালে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কয়েকটি আলোকচিত্র। বাংলাদেশের কোনো নেতা এলেও তাঁদের ছবি নেই। বর্তমান সমাধি ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯১ সালে, ভারত সরকারের সহায়তায়। এর দেয়ালে লেখা আছে ‘এই হলটি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত’।
অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে বাহাদুর শাহের সমাধি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে বাহাদুর শাহের সমাধিতে ফুল দিয়েই ‘দিল্লি চলো’ প্রচারণা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ মিয়ানমার পার হয়ে পূর্ব ভারতের ইম্ফল পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী সমাধি পরিদর্শনকালে লিখেছিলেন, যদিও আপনি (বাহাদুর শাহ) ভারতের জমিন পাননি, তবে এখানে পেয়েছেন, আপনার নাম এখনো জীবন্ত। আমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
পরের কিস্তি: মিয়ানমারে এক টুকরো বাংলাদেশ
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments