যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ফেব্রুয়ারি
এলেই ফাল্গুনপূর্ব স্নিগ্ধ শীতে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিবিজড়িত পঞ্চাশের
দশকের ঢাকার কথা মনে পড়ে। সেই পঞ্চাশে আমাদের শৈশবের ঢাকার জীবন এবং ভাষা
আন্দোলনের অভিঘাত বাঙালির জীবনে কত গভীর ছিল, তা একালের মানুষকে বোঝাতে
পারব না। বোঝাতে পারব না বিশেষ করে তাঁদের, যাঁরা কেডস ও দুই ইঞ্চি হিল
জুতা পরে চিপস অথবা চিনাবাদাম চিবোতে চিবোতে শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দেন
বা পায়চারি করেন। তাঁদেরও বোঝাতে পারব না, যাঁরা একুশের চেতনা ও একাত্তরের
চেতনা বলেই সগর্বে টেবিল চাপড়ান বা বক্তৃতার মঞ্চে পদাঘাত করেন। তাঁরা
অনেক সুখী ও সমৃদ্ধ। একুশের ধারাবাহিকতায় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা
তাঁদের উপহার দিয়েছে বহু কিছু, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে একুশের চেতনা।
জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ তাঁদের উপহার দিয়েছে বিঘা বিঘা জমি, ব্যাংক-বিমা,
কলকারখানা, বিপুল ব্যাংকঋণ, শেষ মডেলের বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি, তাঁরা ঘুরছেন
ইবনে বতুতা বা মার্কো পোলোর মতো বিশ্বব্যাপী দুর্বার গতিতে। তাঁদের
কাছে সেই একুশ বা পঞ্চাশের দশকের ঢাকার স্মৃতির মূল্য নেই। যদিও এই
বঙ্গভূমিতেই শুধু স্মৃতিচারণা করে কিস্তিমাত করা সম্ভব। একুশে ও একাত্তর
নিয়ে স্মৃতিচারণা করেই অনেকে নায়কোচিত ভাবমূর্তি অর্জন করেছেন।
বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনই প্রথম সবচেয়ে সফল আন্দোলন। ওই আন্দোলন সফল না হলে পরবর্তী আর কোনো আন্দোলনেরই সুযোগ থাকত না।
একুশের চেতনা একুশ শতকে চূর্ণ হয়ে গেলেও চার শ বছর আগে সৈয়দ সুলতানের মধ্যে ছিল ষোলো আনা। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা ষোড়শ শতকের সাধক কবি সৈয়দ সুলতান বলে গেছেন:
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষ হয় তার অমূল্য রতন।
প্রভু নিরঞ্জন আমাদের বাংলা ভাষা মুখে দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এই ভাষা যে আমাদের অমূল্য রতন, তা ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রতিদিন যাঁরা কিন্ডারগার্টেনে ছুটছেন কিংবা কেতাব বগলে নিয়ে যারা মাদ্রাসায় যাচ্ছে, তাদের বোঝাতে যাওয়া বাতুলতামাত্র। এখনকার মতো উৎকৃষ্ট ও উন্নতমানের ইংরেজি ও আরবি-উর্দুর শিক্ষাব্যবস্থা ১৮৬১ সালে প্রচলিত থাকলে জোড়াসাঁকোর দেবেন ঠাকুরের অতগুলো ছেলেমেয়ের কারও পক্ষেই জিপিএ-ফাইভ পাওয়া সম্ভব হতো না। একালের অতিসৃজনশীল টিকচিহ্নের পরীক্ষাপদ্ধতি থাকলে মহর্ষির ছোট ছেলেটি দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক না হয়ে ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানির হিসাবের খেরো খাতার লেখক হতেন। একটি উন্নত জাতি একটি উন্নত ভাষার জন্ম দেয় না, একটি উন্নত ভাষাই পারে একটি উন্নত জাতি সৃষ্টি করতে।
মাতৃভাষার জন্য বাংলার সাধারণ ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের ভালোবাসার যে নজিরবিহীন বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে তেমনটি লক্ষ করা যায়নি। নতুন প্রজন্ম যাঁদের বয়স ছিল ২৫-এর নিচে, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁরাই আপসহীন ভূমিকা রাখেন একুশে ফেব্রুয়ারি ও তার পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় পর্যন্ত।
ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এক জিনিস। সেটা একটি দালিলিক ব্যাপার। সেটার খুবই প্রয়োজন। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার জীবন দিয়েছেন সে জন্য। আমাদের ছাত্র-যুবক-সৈনিকেরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য লড়াই করেছেন। ভাষাকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব তাঁদের ছিল না। ভাষাকে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব বিদ্বৎসমাজের। বাংলার উন্নতির জন্য, বাংলাকে উচ্চশিক্ষার বাহন করতে উচ্চশিক্ষিতদের রফিক-বরকতদের মতো জীবন উৎসর্গের ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, জোরালো উদ্যোগ ও সদিচ্ছাই ছিল যথেষ্ট।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পরিস্থিতি আমার স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সেদিনের ঢাকার কথা শুনেছি আমার এক ভাই বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ আমীর-উল মূল্কের কাছে। তিনি সেদিন ঢাকায় ছিলেন আন্তজেলা স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। পরবর্তী একুশে ফেব্রুয়ারির আমি প্রত্যক্ষদর্শী। রাস্তায় অত মানুষ আমি আমার জীবনে আগে তো নয়ই পরেও—একাত্তরের ৭ মার্চ ছাড়া—আর কোনো দিন দেখিনি।
বাড়ির গরুর এক-দেড় সের দুধ খাই। পদ্মার তাজা মাছ। ঘি ও খাঁটি ছানার মিষ্টান্ন। কিন্তু গায়ে লাগে না। হাড়জিরজিরে ভাব। সেকালে দু–এক থানায় একজনও এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন না। ডাক্তার দেখাতে আব্বা নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়। উঠেছিলাম টিপু সুলতান রোডে আমার মায়ের খালুর বাড়িতে। তাঁর বাড়ির কয়েকটি বাড়ি পরেই ছিল ডাক্তার এম এন নন্দীর চেম্বার। সবারই প্রিয় ডাক্তার। দারুণ হাতযশ। তাঁর প্রেসক্রিপশন করা কিছু কৃমির বড়ি ও কয়েক শিশি ওষুধে মাস দুয়েকের মধ্যে নাদুসনুদুস বালকে পরিণতি হই। পরে ষাটের দশকে ডা. নন্দী আমার অতি শ্রদ্ধাভাজনে পরিণত হন। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভাইয়েরা ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিক।
কোনো পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। তেপ্পান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকার দৃশ্য এখন কসম করে বর্ণনা করলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আগের দিনের ঢাকার সঙ্গে পরের দিনের ঢাকার বিন্দুমাত্র মিল নেই। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারির ঢাকা আর একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকা একেবারেই দুই ঢাকা। দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এমনকি পাড়ার মুদিদোকানেরও ঝাঁপ বন্ধ। ঠাটারীবাজার ছিল জনমানবশূন্য। বাস, মোটরগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি তো দূরের কথা রাস্তায় একটি রিকশা পর্যন্ত ছিল না। সেদিন চড়েনি কেউ সাইকেলে। আমার জামায়ও কেউ একজন কালো ব্যাজ সেঁটে দিয়েছিল আলপিন দিয়ে। নবাবপুর রোডের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম খুব সকালে। হাজার হাজার মানুষ খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে মেডিকেল কলেজ অথবা আজিমপুর কবরস্থানের দিকে। পিনপতন নীরবতা। কারও মুখে টুঁ শব্দ নেই। ঠেলাঠেলি নেই। সারিবদ্ধভাবে সবাই হাঁটছে। এখনকার কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও অমন শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায় না। খণ্ড খণ্ড মিছিলের সামনে থেকে হঠাৎ হঠাৎ একটিই আওয়াজ: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। শহীদ স্মৃতি অমর হোক প্রভৃতি।
অপরাহ্ণে আরমানিটোলা মাঠে জনসভায় আব্বা গিয়েছিলেন আমাকে বাসায় রেখে। তাঁর কাছে গল্প শুনেছি, কলকাতায়ও নাকি তিনি কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের জনসভায় অত লোক দেখেননি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং স্বেচ্ছাচারী শাসকদের প্রতি মানুষের ঘৃণার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ সেদিন এবং, পরে শুনেছি, চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে ঢাকায় ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় হয়েছিল, ধারণা করি, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই।
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্বাজাত্যবোধের মাস ফেব্রুয়ারি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই দোকান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হতো। তার পরও যদি কোথাও কোনো ইংরেজিতে লেখা নামফলক স্বেচ্ছাসেবকদের চোখে পড়ত, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর আলকাতরা লেপে দেওয়া হতো। গাড়ির নম্বরপ্লেট ফেব্রুয়ারিতে বাংলা লিখে সাঁটানো হতো।
যাঁরা জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া দেখেছেন, তাঁদের খটকা লাগবে ওটা কোন শহীদ মিনার এলাকা। শহীদ মিনারও অন্য রকম। শহীদ মিনারের সামনের গাছপালা অন্য রকম। পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর কম বয়সী পাঠকদের জন্য বলছি, স্বাধীনতার আগের মূল শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি বাহিনী ২৬ মার্চের দুদিন পর গুঁড়িয়ে দেয়। শুধু যে বাঙালিদের ওপর তাদের আক্রোশ ছিল তা-ই নয়, ভয়ংকর আক্রোশ ছিল বাঙালির শহীদ মিনারের ওপর। কারণ সেটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের শুধু হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছে শহীদ মিনারকেও। স্বাধীনতার পরে বাহাত্তরে শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। বর্তমান অবস্থা হয় এরশাদ সরকারের সময়।
আমাদের পরিবারে আমার আব্বাসহ লেখক ও কবিযশোপ্রার্থী ছিলেন কেউ কেউ। আব্বা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাইদের সঙ্গে লালবাগের বাসা থেকে শহীদ মিনার এলাকায় যেতাম। ওই এলাকার প্রতি একটি মোহ ছিল। পঞ্চাশের দশকে শহীদ মিনারের পেছনে মেডিকেলের দেয়াল ঘেঁষে ছিল কয়েকটি বইয়ের দোকান। আমাদের পরিবারে বইয়ের ক্রেতা ও পাঠক ছিলেন অনেকেই। জগন্নাথ হল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ও শহীদ মিনারের চৌরাস্তা থেকে বকশীবাজারের দিকে যে রাস্তা গেছে, সেখানে বাঁ দিকে ছিল মোহাম্মদ সুলতানের বইদোকান পুঁথিপত্র। হাসান হাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলন, যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়েছিল, যেকোনোভাবে আব্বা এক কপি জোগাড় করেছিলেন। মূল কপিটি বাংলাদেশে শুধু আমার কাছেই আছে।
পঞ্চাশের দশকে শহীদ মিনার ও নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি ছিল রোমাঞ্চকর। ওখান থেকেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্বান বের হচ্ছেন। নতুন নতুন বুদ্ধিজীবী তৈরি হচ্ছেন। দেশের লেখক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা প্রভৃতি এই জায়গাটি থেকেই বের হচ্ছেন। দশ-পনেরো বছর পর তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের। ওই এলাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যও ছিল অপরূপ। কত বড় বড় গাছ। এপ্রিলে দাউ দাউ করত কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া, জুন-জুলাইতে জারুলের স্নিগ্ধ বেগুনি ফুল। পুকুর ছিল কয়েকটি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনের রাস্তার উল্টো দিকে, এখন যেখানে ব্যাংক ও বুয়েটের ভবন, সেখানেও ছিল জলাধার। সব হলেই পুকুর ছিল। ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুটিয়ে গোসল করতেন ছাত্ররা। আজিমপুর এলাকার আমাদের বন্ধুরাও এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত ওই পুকুরে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পেছনেও ছিল সলিমুল্লাহ হলের পুকুর।
পঞ্চাশের আমাদের কৈশোর এবং ষাটের যৌবন থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। তার কোনো কিছুই আর ফিরে পাব না। কিন্তু হারাবে না শুধু স্মৃতি।
ইউরোপকে বাদ দিলেও জাতিরাষ্ট্র তুরস্কে তুর্কি ভাষায় উচ্চশিক্ষা থেকে সবকিছু চলে। ইরানে ফার্সি ছাড়া আর সব অচল। থাইল্যান্ডে থাই ভাষা, কিছু চায়নিজ। থাই ভাষার চেয়ে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ। বাঙালি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, কিন্তু জাতীয় জীবনে মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
বায়ান্নর পর থেকে সেকালের শিক্ষাবিদেরা যদি উপযুক্ত উদ্যোগ নিতেন, তাহলে জীবনের সব স্তরেই যে বাংলা চালু হতো তা-ই নয়, উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হতো বাংলা। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী দুই দশকেই রুশ, জার্মান প্রভৃতি ভাষার সমকক্ষ হয়ে উঠত বাংলা। তা যে হতো তাতে সন্দেহ নেই, কারণ বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন মনীষী বাংলা ভাষাকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। তার ওপর ইমারত তৈরি কঠিন নয়।
পৃথিবীর সবার কাছেই তার মাতৃভাষা প্রিয়, কিন্তু সব ভাষাই ‘অমূল্য রতন’ নয়। পৃথিবীর যে অল্প সংখ্যক ভাষা অমূল্য রতন, তাদের একটি বাংলা ভাষা। যার সম্পর্কে কবি বলেছেন: মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনই প্রথম সবচেয়ে সফল আন্দোলন। ওই আন্দোলন সফল না হলে পরবর্তী আর কোনো আন্দোলনেরই সুযোগ থাকত না।
একুশের চেতনা একুশ শতকে চূর্ণ হয়ে গেলেও চার শ বছর আগে সৈয়দ সুলতানের মধ্যে ছিল ষোলো আনা। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা ষোড়শ শতকের সাধক কবি সৈয়দ সুলতান বলে গেছেন:
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষ হয় তার অমূল্য রতন।
প্রভু নিরঞ্জন আমাদের বাংলা ভাষা মুখে দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এই ভাষা যে আমাদের অমূল্য রতন, তা ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রতিদিন যাঁরা কিন্ডারগার্টেনে ছুটছেন কিংবা কেতাব বগলে নিয়ে যারা মাদ্রাসায় যাচ্ছে, তাদের বোঝাতে যাওয়া বাতুলতামাত্র। এখনকার মতো উৎকৃষ্ট ও উন্নতমানের ইংরেজি ও আরবি-উর্দুর শিক্ষাব্যবস্থা ১৮৬১ সালে প্রচলিত থাকলে জোড়াসাঁকোর দেবেন ঠাকুরের অতগুলো ছেলেমেয়ের কারও পক্ষেই জিপিএ-ফাইভ পাওয়া সম্ভব হতো না। একালের অতিসৃজনশীল টিকচিহ্নের পরীক্ষাপদ্ধতি থাকলে মহর্ষির ছোট ছেলেটি দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক না হয়ে ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানির হিসাবের খেরো খাতার লেখক হতেন। একটি উন্নত জাতি একটি উন্নত ভাষার জন্ম দেয় না, একটি উন্নত ভাষাই পারে একটি উন্নত জাতি সৃষ্টি করতে।
মাতৃভাষার জন্য বাংলার সাধারণ ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের ভালোবাসার যে নজিরবিহীন বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে তেমনটি লক্ষ করা যায়নি। নতুন প্রজন্ম যাঁদের বয়স ছিল ২৫-এর নিচে, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁরাই আপসহীন ভূমিকা রাখেন একুশে ফেব্রুয়ারি ও তার পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় পর্যন্ত।
ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এক জিনিস। সেটা একটি দালিলিক ব্যাপার। সেটার খুবই প্রয়োজন। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার জীবন দিয়েছেন সে জন্য। আমাদের ছাত্র-যুবক-সৈনিকেরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য লড়াই করেছেন। ভাষাকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব তাঁদের ছিল না। ভাষাকে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব বিদ্বৎসমাজের। বাংলার উন্নতির জন্য, বাংলাকে উচ্চশিক্ষার বাহন করতে উচ্চশিক্ষিতদের রফিক-বরকতদের মতো জীবন উৎসর্গের ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না, জোরালো উদ্যোগ ও সদিচ্ছাই ছিল যথেষ্ট।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পরিস্থিতি আমার স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সেদিনের ঢাকার কথা শুনেছি আমার এক ভাই বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ আমীর-উল মূল্কের কাছে। তিনি সেদিন ঢাকায় ছিলেন আন্তজেলা স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। পরবর্তী একুশে ফেব্রুয়ারির আমি প্রত্যক্ষদর্শী। রাস্তায় অত মানুষ আমি আমার জীবনে আগে তো নয়ই পরেও—একাত্তরের ৭ মার্চ ছাড়া—আর কোনো দিন দেখিনি।
বাড়ির গরুর এক-দেড় সের দুধ খাই। পদ্মার তাজা মাছ। ঘি ও খাঁটি ছানার মিষ্টান্ন। কিন্তু গায়ে লাগে না। হাড়জিরজিরে ভাব। সেকালে দু–এক থানায় একজনও এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন না। ডাক্তার দেখাতে আব্বা নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়। উঠেছিলাম টিপু সুলতান রোডে আমার মায়ের খালুর বাড়িতে। তাঁর বাড়ির কয়েকটি বাড়ি পরেই ছিল ডাক্তার এম এন নন্দীর চেম্বার। সবারই প্রিয় ডাক্তার। দারুণ হাতযশ। তাঁর প্রেসক্রিপশন করা কিছু কৃমির বড়ি ও কয়েক শিশি ওষুধে মাস দুয়েকের মধ্যে নাদুসনুদুস বালকে পরিণতি হই। পরে ষাটের দশকে ডা. নন্দী আমার অতি শ্রদ্ধাভাজনে পরিণত হন। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভাইয়েরা ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিক।
কোনো পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার মতো বয়স তখন আমার ছিল না। তেপ্পান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকার দৃশ্য এখন কসম করে বর্ণনা করলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আগের দিনের ঢাকার সঙ্গে পরের দিনের ঢাকার বিন্দুমাত্র মিল নেই। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারির ঢাকা আর একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকা একেবারেই দুই ঢাকা। দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এমনকি পাড়ার মুদিদোকানেরও ঝাঁপ বন্ধ। ঠাটারীবাজার ছিল জনমানবশূন্য। বাস, মোটরগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি তো দূরের কথা রাস্তায় একটি রিকশা পর্যন্ত ছিল না। সেদিন চড়েনি কেউ সাইকেলে। আমার জামায়ও কেউ একজন কালো ব্যাজ সেঁটে দিয়েছিল আলপিন দিয়ে। নবাবপুর রোডের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম খুব সকালে। হাজার হাজার মানুষ খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে মেডিকেল কলেজ অথবা আজিমপুর কবরস্থানের দিকে। পিনপতন নীরবতা। কারও মুখে টুঁ শব্দ নেই। ঠেলাঠেলি নেই। সারিবদ্ধভাবে সবাই হাঁটছে। এখনকার কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও অমন শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায় না। খণ্ড খণ্ড মিছিলের সামনে থেকে হঠাৎ হঠাৎ একটিই আওয়াজ: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। শহীদ স্মৃতি অমর হোক প্রভৃতি।
অপরাহ্ণে আরমানিটোলা মাঠে জনসভায় আব্বা গিয়েছিলেন আমাকে বাসায় রেখে। তাঁর কাছে গল্প শুনেছি, কলকাতায়ও নাকি তিনি কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের জনসভায় অত লোক দেখেননি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং স্বেচ্ছাচারী শাসকদের প্রতি মানুষের ঘৃণার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ সেদিন এবং, পরে শুনেছি, চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে ঢাকায় ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় হয়েছিল, ধারণা করি, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই।
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্বাজাত্যবোধের মাস ফেব্রুয়ারি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই দোকান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হতো। তার পরও যদি কোথাও কোনো ইংরেজিতে লেখা নামফলক স্বেচ্ছাসেবকদের চোখে পড়ত, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর আলকাতরা লেপে দেওয়া হতো। গাড়ির নম্বরপ্লেট ফেব্রুয়ারিতে বাংলা লিখে সাঁটানো হতো।
যাঁরা জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া দেখেছেন, তাঁদের খটকা লাগবে ওটা কোন শহীদ মিনার এলাকা। শহীদ মিনারও অন্য রকম। শহীদ মিনারের সামনের গাছপালা অন্য রকম। পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর কম বয়সী পাঠকদের জন্য বলছি, স্বাধীনতার আগের মূল শহীদ মিনারটি পাকিস্তানি বাহিনী ২৬ মার্চের দুদিন পর গুঁড়িয়ে দেয়। শুধু যে বাঙালিদের ওপর তাদের আক্রোশ ছিল তা-ই নয়, ভয়ংকর আক্রোশ ছিল বাঙালির শহীদ মিনারের ওপর। কারণ সেটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের শুধু হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছে শহীদ মিনারকেও। স্বাধীনতার পরে বাহাত্তরে শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। বর্তমান অবস্থা হয় এরশাদ সরকারের সময়।
আমাদের পরিবারে আমার আব্বাসহ লেখক ও কবিযশোপ্রার্থী ছিলেন কেউ কেউ। আব্বা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাইদের সঙ্গে লালবাগের বাসা থেকে শহীদ মিনার এলাকায় যেতাম। ওই এলাকার প্রতি একটি মোহ ছিল। পঞ্চাশের দশকে শহীদ মিনারের পেছনে মেডিকেলের দেয়াল ঘেঁষে ছিল কয়েকটি বইয়ের দোকান। আমাদের পরিবারে বইয়ের ক্রেতা ও পাঠক ছিলেন অনেকেই। জগন্নাথ হল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ও শহীদ মিনারের চৌরাস্তা থেকে বকশীবাজারের দিকে যে রাস্তা গেছে, সেখানে বাঁ দিকে ছিল মোহাম্মদ সুলতানের বইদোকান পুঁথিপত্র। হাসান হাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলন, যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়েছিল, যেকোনোভাবে আব্বা এক কপি জোগাড় করেছিলেন। মূল কপিটি বাংলাদেশে শুধু আমার কাছেই আছে।
পঞ্চাশের দশকে শহীদ মিনার ও নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি ছিল রোমাঞ্চকর। ওখান থেকেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্বান বের হচ্ছেন। নতুন নতুন বুদ্ধিজীবী তৈরি হচ্ছেন। দেশের লেখক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা প্রভৃতি এই জায়গাটি থেকেই বের হচ্ছেন। দশ-পনেরো বছর পর তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের। ওই এলাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যও ছিল অপরূপ। কত বড় বড় গাছ। এপ্রিলে দাউ দাউ করত কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া, জুন-জুলাইতে জারুলের স্নিগ্ধ বেগুনি ফুল। পুকুর ছিল কয়েকটি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনের রাস্তার উল্টো দিকে, এখন যেখানে ব্যাংক ও বুয়েটের ভবন, সেখানেও ছিল জলাধার। সব হলেই পুকুর ছিল। ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুটিয়ে গোসল করতেন ছাত্ররা। আজিমপুর এলাকার আমাদের বন্ধুরাও এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত ওই পুকুরে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পেছনেও ছিল সলিমুল্লাহ হলের পুকুর।
পঞ্চাশের আমাদের কৈশোর এবং ষাটের যৌবন থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। তার কোনো কিছুই আর ফিরে পাব না। কিন্তু হারাবে না শুধু স্মৃতি।
ইউরোপকে বাদ দিলেও জাতিরাষ্ট্র তুরস্কে তুর্কি ভাষায় উচ্চশিক্ষা থেকে সবকিছু চলে। ইরানে ফার্সি ছাড়া আর সব অচল। থাইল্যান্ডে থাই ভাষা, কিছু চায়নিজ। থাই ভাষার চেয়ে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ। বাঙালি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, কিন্তু জাতীয় জীবনে মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
বায়ান্নর পর থেকে সেকালের শিক্ষাবিদেরা যদি উপযুক্ত উদ্যোগ নিতেন, তাহলে জীবনের সব স্তরেই যে বাংলা চালু হতো তা-ই নয়, উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হতো বাংলা। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী দুই দশকেই রুশ, জার্মান প্রভৃতি ভাষার সমকক্ষ হয়ে উঠত বাংলা। তা যে হতো তাতে সন্দেহ নেই, কারণ বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন মনীষী বাংলা ভাষাকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। তার ওপর ইমারত তৈরি কঠিন নয়।
পৃথিবীর সবার কাছেই তার মাতৃভাষা প্রিয়, কিন্তু সব ভাষাই ‘অমূল্য রতন’ নয়। পৃথিবীর যে অল্প সংখ্যক ভাষা অমূল্য রতন, তাদের একটি বাংলা ভাষা। যার সম্পর্কে কবি বলেছেন: মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments