‘হামার গায়ের আগুনে আলু পুড়ে খায়’ by তুহিন ওয়াদুদ

‘রশিদুলের মাও ভিক (ভিক্ষা) করি খায়। রশিদুলের কাজ-কাম নাই জন্যে আমাক কয়, “তোর গাড়িতে আমাকে হেলপার করি সাথে নে। দুই দিন থাকি খাবার নাই।” সেই জন্যে রশিদুলকে ট্রাকের হেলপার করি নিয়া রংপুর গেইছলাম। রংপুর থাকি ফেরার পথে রাইত দেড়টার সময় দিনাজপুরের কাছে পেট্রলবোমা মারে। সম্পূর্ণ শরীর তার পুড়ে গেছল। তারপর তো মরি গেল। ওকে তো তার মাও-ছাওয়ার কাছে পৌঁছে দিবার পারলাম না।’ শনিবার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায় শুয়ে অর্ধদগ্ধ আনিস ড্রাইভার এ কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন তাঁর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁর সামনের বিছানায় বিবর্ণ ট্রাক ড্রাইভার মো. রফিকুল ইসলাম। অবরোধ জেনেও কেন গাড়ি চালিয়েছেন? জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, ‘আমার না যেয়ে কোনো উপায়ই ছিল না। আমি মারা গেলেও আমাকে গাড়ি চালানোই লাগত। আমার মেয়ে চট্টগ্রামে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ে। মেয়ের পড়ার টাকার জন্য গাড়ি চালাইতে গিয়ে যদি মারাও যাইতাম, তাও আমরা কোনো দুঃখ নাই।’ এই কথাগুলো বলার সময়ে তাঁরও অগ্নিদগ্ধ গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইজতেমা থেকে আসা এক যাত্রী। তিনি পুড়ে মারা গেছেন। দেশের অচলাবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তো রাজনীতি করি না। আওয়ামী লীগও না বিএনপিও না। আমরা গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা পেটনীতির মধ্যে আছি। সেটাতেও তো শান্তি নাই।’ রিকশাচালক আসাদুল। রংপুরের বদরগঞ্জে বাড়ি। এলাকায় কাজ নেই। পরিবারে ছয় সদস্য। উপায়ন্তর না দেখে রওনা দিয়েছিলেন ঢাকার উদ্দেশে, রিকশা চালানোর জন্য। বগুড়ার কাছাকাছি পথেই আসাদুলের আশা দগ্ধীভূত হয়। এখন চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন আনিস ড্রাইভারের পাশের বেডে। তাঁর পুড়ে যাওয়া শরীরের দিকে তাকানো যায় না। তাঁর চোখে-মুখে হতাশা, বাঁচা-মরার ভীতি। ডানে-বাঁয়ে না ফিরে সোজা হয়ে ধীরে ধীরে অসহায় কণ্ঠে একটু একটু কথা বলতে পারেন। তাঁর পাশে আর একটি বিছানায় আর এক ড্রাইভার। মুখমণ্ডলের সবটুকুই পুড়ে গেছে। মধ্যবয়সী এক নারী তাঁকে সকরুণ কণ্ঠে বলছেন, ‘বাবা কথা কন, কথা কন।’ দগ্ধমুখে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন ড্রাইভার। আর একটি বেডে শুয়ে আছেন বাসের হেলপার স্বপন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘রাজনীতি করা নেতারা হামার গায়ের আগুনে আলু পুড়ে খায়।’ সেখানে আরও অনেকেই অবরোধ-হরতালে দগ্ধীভূত হয়ে চিকিৎসাধীন।
শ্রমজীবী মানুষই হচ্ছে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড, যাঁরা কোনো দিন কাউকে ঠকাননি। ভূমির মালিক, পোশাক কারখানার মালিক এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তবু তাঁরা বলেননি কৃষি উৎপাদনে যাব না, পোশাক উৎপাদন করব না। সোনালি স্বপ্ন বন্যায় ডুবে যায়, শেষ আশ্রয় বন্যায় ভেঙে যায়, নিজেরা পুড়ে যান তাজরীন পোশাক কারখানায়, চাপা পড়ে মারা যান রানা প্লাজায়। হরতাল-অবরোধ দগ্ধীভূত হন। তবু তাঁদের ছুটতেই হয়। অবরোধে গাড়ি ঠিকমতো চলছে না বলে কৃষকেরা রবিশস্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে অবরোধ। আগুনে পুড়ে মরা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। টিভির সামনে বসলে মন বিষণ্ন হয়, পত্রিকার পাতা পাতায় বিষাদের বীজ, কোথাও কোনো আলো নেই। বন্ধুদের আড্ডায়ও শোকসংলাপ। এক বন্ধু মন ভার করে বলছিলেন, ‘পেট ভরে ভালো করে খেলে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করে। সেই সব শ্রমিক-দিনমজুরের কথা মনে আসে, যাঁরা অবরোধে কাজের সন্ধান করতে পারেননি। তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা খেতে পেরেছেন কি না কে জানে!’ এই কথা শুনে কয়েক দিন আগে এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথোপকথনের কিছুটা অংশ মনে পড়ে। বৃদ্ধ চাচা বলছিলেন, ‘এই তো বিশ-পঁচিশ বছর আগোত হামরা তিন বেলা খাবার পাই নাই, সন্ধ্যাবেলা বাড়ি বাড়ি বউগুলা কাঁদত, ছাওয়ার খাওয়ার অভাবে।’ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে—রংপুরের মানুষের ভাগ্য কি আবার ওই পরিণতির দিকে যাচ্ছে? কুড়িগ্রামের এক বৃদ্ধ রিকশাচালক বলছিলেন, ‘সারা দিন খাটলে এক শ-দেড় শ টাকার বেশি কামাই হয় না। লোনের কিস্তি কী দিয়া দেই, চাউল কিনি কী দিয়া। এক ঘণ্টা ধরি বসি আছি, ভাড়া নাই। অবরোধ না থাকতে সারা দিন খাটলে তিন-চার শ টাকা পাওয়া যাইত।’ নিম্নবিত্ত-বিত্তহীনদের মধ্যে এনজিগুলো ক্ষুদ্রঋণের নামে জমজমাট সুদের বাণিজ্য করে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরও কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ব্র্যাকের এক কর্মী বলছিলেন, ‘কিস্তি ওঠানোয় ডিসেম্বরের চেয়ে জানুয়ারির রেজাল্ট খারাপ।’
ব্যবসায়ীদের অবস্থাও করুণ। প্রাইম মেডিকেলের একজন কর্মকর্তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর পার্টটাইম চাকরি চেয়ে অনুরোধ করতে ফোন করেছিলাম। তাঁকে বলছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সৃষ্ট অচলাবস্থায় অনেক শিক্ষার্থীকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বাড়ি যেতে হয়েছে। যে দুজনের জন্য অনুরোধ করছি, একটা কর্মসংস্থান না হলে তাদেরও লেখাপড়া ছাড়তে হবে। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘দেশের যে অবস্থা, তাতে করে লোক ছাঁটাই করা লাগবে মনে হয়। এভাবে দেশ চলতে থাকলে ব্যবসা চলবে না।’
রংপুর সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী ‘ঈগল আই’-এর মালিক মেরাজুল মোহসিন বলছিলেন, ‘কোনো কোনো দিন কোনো কোনো দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয় না। নিজেদের জমানো টাকা ভাঙিয়ে খেতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে।’ দেশের জনজীবন বিপন্ন করার প্রতিবাদে এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করার দাবিতে শান্তিকামী মানুষের সংগঠন ‘জাগো রংপুর’ রংপুর শহরে প্রায় ছয় কিলোমিটার মানববন্ধন করেছে। সংগঠনের সদস্যসচিব চিকিৎসক সৈয়দ মামুনুর রহমান ‘জাগো রংপুর’-এর সভায় বলছিলেন, ‘আমরা সামান্য হলেও রংপুরবাসীর মনে আশার সঞ্চার করতে পেরেছি।’ সভায় অনেকেই বলছিলেন দেশব্যাপী এ রকম কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
অবরোধ আহ্বানকারীর বাসার প্রধান ফটক পার হতে পারেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দূর থেকে তাঁর কাছে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা কি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব? যাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ মারার ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন হলে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন—এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে বিপর্যস্ত জনজীবন, তার দায় নিতে হবে উভয় জোটকেই।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.