আদালত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য কতটা যৌক্তিক? by মিজানুর রহমান খান
কখনো
বিরল সময় আসে যখন এটা ধরা পড়ে যায় যে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের
সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদিও বা দুর্বলভাবে লেখা আছে কিন্তু
নির্বাহী বিভাগ সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা,
বিশেষ করে ক্ষমতার পৃথক্করণে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ থেকে বিচার বিভাগ
পৃথক্করণে তাদের বিশ্বাস ঠুনকো। এবারে তা ঈষৎ মূর্ত হলো ওয়ারেন্ট অব
প্রিসিডেন্সের মতো একটি ‘মামুলি’ বিষয়ে জাতীয় সংসদে দেওয়া
প্রধানমন্ত্রীর তির্যক মন্তব্যে। দুই যুযুধান বড় দল কখনো চায়নি, মূলত
আদালতের রায়ের কারণেই, শক্তিশালী প্রশাসন ক্যাডারের বিস্ফারিত চোখের সামনে
এক-এগারোর সরকারের সময় জবরদস্তি পৃথক্করণ ঘটেছিল। আমাদের অভিজাত
আমলাতন্ত্র এটা মেনে নিতে পারেনি, তথাকথিত ভ্রাম্যমাণ আদালত করে বিচারে ভাগ
বসিয়ে তারা যার বদলা নিয়েছে, নির্বাহী বিভাগের মুখপাত্র হিসেবে
প্রধানমন্ত্রী যেন এত দিনে সেই ধূমায়িত ক্ষোভের কথা জানালেন। অন্তত অনেকের
কাছে এমনটা মনে হতে পারে। এখানে বলে নেওয়া ভালো, এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনোভাবও ভিন্নতর কিছু ভাবার
কারণ নেই। একটি রাষ্ট্র কাকে, কীভাবে, কী মর্যাদায় দেখে, তার একটা
প্রতিফলন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ঘটে। বিষয়টি কিছুটা প্রতীকী হলেও আদতে
এর মধ্যে শাসক ও রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনার ছাপ মেলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স)
বিচারকদের মর্যাদা বাড়িয়ে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় নৈতিকতাবিরোধী।’ গত
২৮ জানুয়ারি সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে
প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত তাঁর দায়মুক্তি বিবেচনায় যথাযথ নয় এমন কিছু
মন্তব্য করেছেন। সংসদ নেতার এ রকম বক্তব্য অনেকের কাছেই অসংগত ও অস্বাভাবিক
ঠেকতে পারে। বিচারিক আদালত হলো বিচারব্যবস্থার প্রাণ। কিন্তু স্বাধীন
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র বরাবরই বিচারকদের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ঠাওরেছে। তাই
আমলাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেতন বাড়াতে গিয়েই জুডিশিয়াল সার্ভিস
অ্যাসোসিয়েশন একদা মাসদার হোসেন মামলার জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই
বেতন-ভাতার সমস্যা আজও ঘুচল না। জেলা জজদের মর্যাদাক্রম নিয়ে আলোচ্য রিট
মামলার উৎপত্তি। একটি উদাহরণ দিই, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে দুই বন্ধু
বের হলেন। একজন পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকলেন।
অন্যজন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিচারক হিসেবে যাত্রা শুরু
করলেন। একজনের সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ সচিব। অন্যজনের সর্বোচ্চ পদ জেলা ও
দায়রা জজ। অথচ ১৯৮১ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস ব্যাচের সদস্যদের এখনো
ডিসিদের সমান মর্যাদায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ’৮৪-র প্রশাসন ক্যাডারের
ব্যাচ থেকেও ইতিমধ্যে সচিব হয়েছেন। ইদানীং যুগ্ম সচিবদের গাড়ি কিনতে
এককালীন ২৫ লাখ টাকা ও প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দিয়েছে
সরকার। জ্যেষ্ঠ জেলা জজরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কারণ, তাঁরা এখনো যুগ্ম
সচিব নন। যদিও শতকরা ২৫ ভাগের বেশি গরিব মানুষের দেশের যুগ্ম সচিবদের ২৫
লাখ টাকা দামের গাড়ির দরকার আছে কি না, সেটা করদাতার মনে বড় প্রশ্ন হওয়া
স্বাভাবিক।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা বাড়ানোর রায় কোনোমতেই সমীচীন নয়। এ ধরনের রায় পক্ষপাতমূলক’, যখন তিনি বলেন, ‘এ রকম হলে যে যেখানে আছে, যার যার মতো করে সুযোগ নেবে। কোনো শৃঙ্খলাই থাকবে না’ তখন আমাদের মনে পড়ে এক-এগারোর পর কী করে জেনারেল পদ এবং ২০১২ সালে প্রায় এক ডজন সিনিয়র সচিবের পদ রাতারাতি সৃষ্টি হতে পেরেছিল। আর এই যে আমাদের বিদ্যমান প্রিসিডেন্স আদেশ, যা তৈরি হয়েছিল ’৮৬-র সেনাশাসনে, সেটা আমলাতন্ত্রের নিজেদের চাপানো রায় ছাড়া আর কী?
প্রধানমন্ত্রী মনে করেন ‘বিচার বিভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে একটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির উপক্রম হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি নিয়মনীতি আছে।’ ২০১০ সালে হাইকোর্টের শুনানিতে অ্যাডভোকেট রব চৌধুরী এই ‘নিয়মনীতির’ যুক্তি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে প্রিসিডেন্স রদবদল করা সরকারের কাজ, আদালতের নয়। হাইকোর্ট পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন, কথা সত্য। কিন্তু সরকারের যে নির্বাহী আদেশ অন্যায্য ও পীড়নমূলক, তার বৈধতা পরখ করতে আদালতের হাত লম্বা।
প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উক্তি হলো, ‘আমাদের সংবিধানে বলা আছে, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।’ না তো, এ কথা সংবিধান বলেনি। এ রকম সরলীকরণ সেই আমলারা করে থাকেন, যাঁরা কখনো পৃথক্করণ মানেননি, কখনো মানবেন না। হাইকোর্টের রায়ে একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়েছিল। আট দফা নির্দেশাবলিতে যদিও জেলা জজ ও সমমর্যাদাসম্পন্ন বিচারকদের চিফস অব স্টাফদের ওপরে স্থান দেওয়ার কথা ছিল। ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের অপারেটিভ অংশে কিন্তু তাই বলে নির্দেশাবলিকে বাধ্যতামূলক করেনি। সেখানে বরং বলা আছে, জেলা জজদের ‘উপযুক্ত মর্যাদা’ দিতে।
গত চার বছর বসে না থেকে সরকার তো ওই গাইডলাইনের আলোকে একটা সমন্বয় করার উদ্যোগ নিতে পারত। ভারত সেই ১৯৭৯ সালে ভারতরত্ন খেতাবপ্রাপ্তদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ওপরে স্থান দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের আমলা বা তদীয় সরকারগুলো কোনো বেসামরিক খেতাবধারী কাউকে জায়গা দেওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। সরকার নিজে নিয়ম মানেনি, যা দীর্ঘকাল আগেই তার করণীয় ছিল, সেটা তো সে করেইনি, বরং উল্টো এখন সরকারপ্রধান আদালতকে দুষছেন। বলছেন, ‘কেউ যদি নিয়ম না মেনে হঠাৎ করে তাদের ইচ্ছামতো একটি ঘোষণা দিয়ে দেয়, তাতে বিশৃঙ্খলা হয়।’ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। আর সেটা ক্ষমতাসীনদের মুখেই এত দিন তারা যথেষ্ট শুনেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় এবং তাতে বর্ণিত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার নির্দেশনা অগ্রাহ্য করা প্রসঙ্গে ‘বিশৃঙ্খলা’ শব্দটি আমরা কখনো শুনতে পাইনি। তবে মনোভাবের কথা যেটা শুরুতে বলেছিলাম, সেটা ‘সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ কথার মধ্যে সুস্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী কর্মচারী নন। বিচারকেরাও কর্মচারী নন। কিন্তু সচিবেরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বিচারপতি মোস্তাফা কামাল মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে গেছেন। বলেছেন, ‘চাকরি সূত্রে বিচারকেরা কর্মচারী নন। কারণ, তাঁরা সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। মন্ত্রী ও সাংসদদের মতো তাঁরাও পাবলিক অফিস হোল্ড করেন।’ অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘আমার অবাক লাগে, কার অবস্থান কোথায়, সেটা সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করা আছে।’
শেখ হাসিনা আশার একটি জায়গা রেখেছেন। বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ কীভাবে চলে, সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।’ একজন জ্যেষ্ঠ সচিব আমাকে বলেছেন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে জেলা জজদের একটু ওপরে তুলে (কারও মতে পৃথক প্রিসিডেন্স করে দিয়ে) দিয়ে একটা আপসের কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও অবগত ছিলেন। পরে তা এগোয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আইনমন্ত্রী আলোচনা করছেন। সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ ভারতে ৬ নম্বর ক্রমিকে প্রধান বিচারপতির নাম আগে ও পরে স্পিকার আছেন। বাংলাদেশেও আগে তা-ই ছিল। এখন নেই কেন? পাকিস্তানের মতো আগে স্পিকার ও পরে প্রধান বিচারপতি না লিখলে কী ক্ষতি? ভারত ও পাকিস্তান দুটোই ফেডারেল সরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সে জেলা জজ নেই, পাকিস্তানে আছে। ভারতীয় রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সের আলোকেই পৃথক আদেশ জারি করে থাকে। তবে রাজ্যগুলো কেন্দ্র থেকে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মোদির গুজরাটে দেখলাম, প্রিন্সিপাল জজ (জ্যেষ্ঠতম জেলা জজ) রাজ্যসচিবের এবং জেলা ও দায়রা জজ যুগ্ম সচিবের সমান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সে ফেডারেল সচিব বেশ ওপরে। তবে লক্ষণীয়, এর ২৪ নম্বর ক্রমিকে জেলা ও দায়রা জজ আর ২৬ নম্বর ক্রমিকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের নিচে ডিসিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দুটি দেশের অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য বিচার্য যে, ‘জেলা জজের মর্যাদা যদি সচিবের সমান হয়, তাহলে উচ্চ আদালতে যাঁরা আছেন, তাঁরা কোন মর্যাদায় যাবেন? যেতে যেতে তো মনে হয় তাঁরা রাষ্ট্রপতির ওপরেই চলে যাবেন।’
বিচারকদের বেতন-ভাতা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান আমাদের মাসদার হোসেন মামলার আদিতে নিয়ে গেছে। আগেই বলেছি, দুই দলই কখনো পৃথক্করণ চায়নি, চায় না। কারণ, আমলা দিয়ে দেশ শাসন কিংবা গদি সামলানোর প্রয়োজন এতটাই তীব্র যে নীতি–আদর্শ বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের কথিতমতে বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আলাদা একটি পে–কমিশন করে বেতন বাড়িয়ে নিয়েছিল। সেটা নিয়েও নানা রকমের সমস্যা হয়েছিল। পরে আমরা বসে মিটমাট করে একটা জায়গায় গিয়েছি।’ আসল সত্যটা হলো এই যে ১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায় হলে আওয়ামী লীগ প্রমাদ গুনেছিল। রায় মতে, তারা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ও পে–কমিশন গঠন করতেই চায়নি। সে কারণে তারা এর বিরুদ্ধে রিভিউ করেছিল। কিন্তু তাতে তারা ১৮ জুন, ২০০১ হেরে যায়। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পে–কমিশন যাও বা হলো, তার সুপারিশ তারা মানছে না।
শেষ করব প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভরসা রেখেই। পে–কমিশনে বীতশ্রদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের গত আমলে প্রশ্নের জবাবে আমাকে বলেছিলেন, বিচারকদের বেতন-ভাতা জানতে তিনি একটি দলকে ভারত পাঠিয়েছেন খোঁজ নিতে। আশা করব তিনি তাঁর সেই মিশনের ফলাফল জাতিকে অবহিত করবেন। বিচারকদের বেতন-ভাতা ভারত ও পাকিস্তানেও বহুগুণ বেশি। অধিকতর যোগ্যদের বিচারক করতে চাইলে এ পথে যেতে হবে। বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ হতে পারে না। বিভিন্ন দেশ কীভাবে চলে, সেটা অবশ্যই আমাদের সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
mrkhanbd@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা বাড়ানোর রায় কোনোমতেই সমীচীন নয়। এ ধরনের রায় পক্ষপাতমূলক’, যখন তিনি বলেন, ‘এ রকম হলে যে যেখানে আছে, যার যার মতো করে সুযোগ নেবে। কোনো শৃঙ্খলাই থাকবে না’ তখন আমাদের মনে পড়ে এক-এগারোর পর কী করে জেনারেল পদ এবং ২০১২ সালে প্রায় এক ডজন সিনিয়র সচিবের পদ রাতারাতি সৃষ্টি হতে পেরেছিল। আর এই যে আমাদের বিদ্যমান প্রিসিডেন্স আদেশ, যা তৈরি হয়েছিল ’৮৬-র সেনাশাসনে, সেটা আমলাতন্ত্রের নিজেদের চাপানো রায় ছাড়া আর কী?
প্রধানমন্ত্রী মনে করেন ‘বিচার বিভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে একটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির উপক্রম হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি নিয়মনীতি আছে।’ ২০১০ সালে হাইকোর্টের শুনানিতে অ্যাডভোকেট রব চৌধুরী এই ‘নিয়মনীতির’ যুক্তি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে প্রিসিডেন্স রদবদল করা সরকারের কাজ, আদালতের নয়। হাইকোর্ট পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন, কথা সত্য। কিন্তু সরকারের যে নির্বাহী আদেশ অন্যায্য ও পীড়নমূলক, তার বৈধতা পরখ করতে আদালতের হাত লম্বা।
প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উক্তি হলো, ‘আমাদের সংবিধানে বলা আছে, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।’ না তো, এ কথা সংবিধান বলেনি। এ রকম সরলীকরণ সেই আমলারা করে থাকেন, যাঁরা কখনো পৃথক্করণ মানেননি, কখনো মানবেন না। হাইকোর্টের রায়ে একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়েছিল। আট দফা নির্দেশাবলিতে যদিও জেলা জজ ও সমমর্যাদাসম্পন্ন বিচারকদের চিফস অব স্টাফদের ওপরে স্থান দেওয়ার কথা ছিল। ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের অপারেটিভ অংশে কিন্তু তাই বলে নির্দেশাবলিকে বাধ্যতামূলক করেনি। সেখানে বরং বলা আছে, জেলা জজদের ‘উপযুক্ত মর্যাদা’ দিতে।
গত চার বছর বসে না থেকে সরকার তো ওই গাইডলাইনের আলোকে একটা সমন্বয় করার উদ্যোগ নিতে পারত। ভারত সেই ১৯৭৯ সালে ভারতরত্ন খেতাবপ্রাপ্তদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ওপরে স্থান দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের আমলা বা তদীয় সরকারগুলো কোনো বেসামরিক খেতাবধারী কাউকে জায়গা দেওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। সরকার নিজে নিয়ম মানেনি, যা দীর্ঘকাল আগেই তার করণীয় ছিল, সেটা তো সে করেইনি, বরং উল্টো এখন সরকারপ্রধান আদালতকে দুষছেন। বলছেন, ‘কেউ যদি নিয়ম না মেনে হঠাৎ করে তাদের ইচ্ছামতো একটি ঘোষণা দিয়ে দেয়, তাতে বিশৃঙ্খলা হয়।’ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। আর সেটা ক্ষমতাসীনদের মুখেই এত দিন তারা যথেষ্ট শুনেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় এবং তাতে বর্ণিত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার নির্দেশনা অগ্রাহ্য করা প্রসঙ্গে ‘বিশৃঙ্খলা’ শব্দটি আমরা কখনো শুনতে পাইনি। তবে মনোভাবের কথা যেটা শুরুতে বলেছিলাম, সেটা ‘সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ কথার মধ্যে সুস্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী কর্মচারী নন। বিচারকেরাও কর্মচারী নন। কিন্তু সচিবেরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বিচারপতি মোস্তাফা কামাল মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে গেছেন। বলেছেন, ‘চাকরি সূত্রে বিচারকেরা কর্মচারী নন। কারণ, তাঁরা সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। মন্ত্রী ও সাংসদদের মতো তাঁরাও পাবলিক অফিস হোল্ড করেন।’ অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘আমার অবাক লাগে, কার অবস্থান কোথায়, সেটা সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করা আছে।’
শেখ হাসিনা আশার একটি জায়গা রেখেছেন। বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ কীভাবে চলে, সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।’ একজন জ্যেষ্ঠ সচিব আমাকে বলেছেন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে জেলা জজদের একটু ওপরে তুলে (কারও মতে পৃথক প্রিসিডেন্স করে দিয়ে) দিয়ে একটা আপসের কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও অবগত ছিলেন। পরে তা এগোয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আইনমন্ত্রী আলোচনা করছেন। সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ ভারতে ৬ নম্বর ক্রমিকে প্রধান বিচারপতির নাম আগে ও পরে স্পিকার আছেন। বাংলাদেশেও আগে তা-ই ছিল। এখন নেই কেন? পাকিস্তানের মতো আগে স্পিকার ও পরে প্রধান বিচারপতি না লিখলে কী ক্ষতি? ভারত ও পাকিস্তান দুটোই ফেডারেল সরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সে জেলা জজ নেই, পাকিস্তানে আছে। ভারতীয় রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সের আলোকেই পৃথক আদেশ জারি করে থাকে। তবে রাজ্যগুলো কেন্দ্র থেকে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মোদির গুজরাটে দেখলাম, প্রিন্সিপাল জজ (জ্যেষ্ঠতম জেলা জজ) রাজ্যসচিবের এবং জেলা ও দায়রা জজ যুগ্ম সচিবের সমান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রিসিডেন্সে ফেডারেল সচিব বেশ ওপরে। তবে লক্ষণীয়, এর ২৪ নম্বর ক্রমিকে জেলা ও দায়রা জজ আর ২৬ নম্বর ক্রমিকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের নিচে ডিসিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দুটি দেশের অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য বিচার্য যে, ‘জেলা জজের মর্যাদা যদি সচিবের সমান হয়, তাহলে উচ্চ আদালতে যাঁরা আছেন, তাঁরা কোন মর্যাদায় যাবেন? যেতে যেতে তো মনে হয় তাঁরা রাষ্ট্রপতির ওপরেই চলে যাবেন।’
বিচারকদের বেতন-ভাতা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান আমাদের মাসদার হোসেন মামলার আদিতে নিয়ে গেছে। আগেই বলেছি, দুই দলই কখনো পৃথক্করণ চায়নি, চায় না। কারণ, আমলা দিয়ে দেশ শাসন কিংবা গদি সামলানোর প্রয়োজন এতটাই তীব্র যে নীতি–আদর্শ বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের কথিতমতে বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আলাদা একটি পে–কমিশন করে বেতন বাড়িয়ে নিয়েছিল। সেটা নিয়েও নানা রকমের সমস্যা হয়েছিল। পরে আমরা বসে মিটমাট করে একটা জায়গায় গিয়েছি।’ আসল সত্যটা হলো এই যে ১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায় হলে আওয়ামী লীগ প্রমাদ গুনেছিল। রায় মতে, তারা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ও পে–কমিশন গঠন করতেই চায়নি। সে কারণে তারা এর বিরুদ্ধে রিভিউ করেছিল। কিন্তু তাতে তারা ১৮ জুন, ২০০১ হেরে যায়। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পে–কমিশন যাও বা হলো, তার সুপারিশ তারা মানছে না।
শেষ করব প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভরসা রেখেই। পে–কমিশনে বীতশ্রদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের গত আমলে প্রশ্নের জবাবে আমাকে বলেছিলেন, বিচারকদের বেতন-ভাতা জানতে তিনি একটি দলকে ভারত পাঠিয়েছেন খোঁজ নিতে। আশা করব তিনি তাঁর সেই মিশনের ফলাফল জাতিকে অবহিত করবেন। বিচারকদের বেতন-ভাতা ভারত ও পাকিস্তানেও বহুগুণ বেশি। অধিকতর যোগ্যদের বিচারক করতে চাইলে এ পথে যেতে হবে। বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ হতে পারে না। বিভিন্ন দেশ কীভাবে চলে, সেটা অবশ্যই আমাদের সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments