কেন নয় সংলাপ সমঝোতা by জি. মুনীর
গত
বছরের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও নানা বিতর্কে বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র
করে দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই সঙ্কট এখন
পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে বিপুল আকার ধারণ করেছে। সরকার কথিত নিয়ম রক্ষার এ
নির্বাচনের পর সব দলের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত আরেকটি নির্বাচন দেয়ার
প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার গোঁ ধরেছে।
সরকারপক্ষের নেতানেত্রীরা এখন বলছেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫
জানুয়ারির নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছেন। এখন তাকে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য
পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার দল ও
জোটের কথা হচ্ছেÑ ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন
ছিল না। ছিল নির্বাচনের নামে একটি প্রহসন, যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি
আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না। বাকি আসনগুলো সরকারি ১৪ দলীয় জোট
ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নানা নাটকীয়তার
মধ্য দিয়ে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। রওশন এরশাদকে দিয়ে করা হয়েছে
সংসদে এক অদ্ভুত বিরোধী দল, যা সরকারেও আছে বিরোধী দলেও আছে। শুধু বিএনপি
নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে
অগ্রহণযোগ্য মনে করে তা নয়; ১৪ দলীয় সরকারি জোট ছাড়া দেশের বাকি সব
রাজনৈতিক দল ও দলনিরপেক্ষ সুশীলসমাজ তাই মনে করে। আর দেশের বাইরে একমাত্র
ভারত ছাড়া সব দেশ মনে করে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন
ছিল না। তাদের সবার তাগিদ, সব দলের অংশগ্রহণে দ্রুত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য
আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করা। কিন্তু সরকারের ধনুক ভাঙা পণÑ ২০১৯ সালের আগে
আর কোনো নির্বাচন নয়, কোনো সংলাপও নয়। সরকারবিরোধী মহলের আরেকটি দাবি,
একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
সরকারপক্ষের সেখানেও এক কথা, আগামী নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার দলীয় সরকারের
অধীনে। সে নির্বাচনে বিএনপি এলে আসবে, না এলে নেই।
পুরো ২০১৪ সালটা গেছে মোটামুটি আন্দোলনহীন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট একের পর এক আহ্বান জানিয়েই এসেছে, সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচন দিতে ও নির্বাচনের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে, বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধ করতে, মামলা-হামলা বন্ধ করতে। কিন্তু সরকার সে পথে যায়নি। বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ওপর মামলা-হামলা, দমনপীড়ন যথারীতি অব্যাহত থাকে এবং বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ করে বাক্যবাণও অব্যাহত রাখা হয়। ২০১৪ সালের শেষে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ৭ দফা প্রস্তাব দেন। তা-ও সরকারপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে এবং বেগম জিয়াকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। গাজীপুরে তাকে জনসভা করতে দেয়া হয়নি। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় তাকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। মোটামুটি ৩ জানুয়ারি থেকে তিনি তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়। তা এখনো চলমান। অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশ প্রায় অচল। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনীতির চাকা অচল। এরই মধ্যে মানুষ পুড়িয়ে মারা, ক্রসফায়ার এবং সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, ক্রসফায়ার ও মামলা দায়ের সময়ের সাথে জোরদার হচ্ছে। চলছে ক্রসফায়ার ও অপহরণের ঘটনাও। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, বেগম জিয়া সংলাপ-সমঝোতা ছাড়া অন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে অনড়। সরকারপক্ষ বলছে, বেগম জিয়ার সাথে কোনো আলোচনা নয়। দেশে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নেই। আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা। সরকার যে করেই হোক, কঠোর অবস্থান নিয়ে দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনবে।
এমন যখন অবস্থা, তখন সরকার বেগম জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়। অবশ্য ২০ ঘণ্টা পর আবার বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। কাটা রয়েছে ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন নয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার কার্যালয়ের সব লাইনই কেটে দেয়া হবে। এ দিকে ৩১ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে প্রবেশের সময় ছয় মহিলা আইনজীবীকেও আটক করেছে পুলিশ। এ দিকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এক সভা রোববার সংসদ অধিবেশন শেষে জাতীয় সংসদ ভবনের নবম তলায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত সে সভা বসেনি। এ সভায় কী সিদ্ধান্ত হয়, তার ওপর হয়তো সরকারি মনোভাব কিছুটা আঁচ করা যেত।
এখন পর্যন্ত যা মনে হয়, দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। এ ধরনের জাতীয় সঙ্কটময় মুহূর্তে যখন সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধী পক্ষ একমত হতে পারে না, তখন সাধারণত বিবদমান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার পড়ে দেশের মালিক বলে পরিচিত ‘জনগণের’ ওপর। এরই নাম ‘গণভোট’ বা রেফারেন্ডাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত শাসনামলে সংবিধান থেকে একতরফাভাবে সেই ‘গণভোটের’ বিধান বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে জনগণ আজ সে অধিকার হারিয়ে সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধীদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ বসে বসে দেখছে। আর এর আগুনে পুড়ে দেশের সাধারণ মানুষ আজ চরম দুর্ভোগের মুখে। আজকের এই যে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্কট, তারও সৃষ্টি করেছে এই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে দেশের সব দলের তথা তিন জোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাদ দিয়ে।
আসলে গণভোটই বলেন আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনই বলেন, এসব সংবিধান থেকে তাড়ানোর পেছনের একটি নেপথ্য কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অনেক কাজেই জনগণের সমর্থন নেই। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতার পাটাতন সুদীর্ঘ করার চিন্তাই তাদের পেয়ে বসেছে। একই কারণে ৫ জানুয়ারির নিয়ম রক্ষার তথা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি থেকে আওয়ামী লীগ আজ দূরে সরে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
আজ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখে একই কথা, বেগম জিয়া বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। কিন্তু তিনি তো এ দেশে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তো বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যায়নি। এরা আজ বারবার বলছেন, বেগম জিয়া সন্ত্রাসের রানী, জঙ্গিরানী, দুর্নীতিবাজ, তার সন্তানেরা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু দেশের মানুষ তেমনটি মনে করে না। মানুষের ভাবনা ভিন্ন। এর বড় প্রমাণ আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল। আজ অনেকের মুখেই শুনি, তারেক জিয়া পাগলের মতো যা বকছে, তাতে করে বিএনপির জনপ্রিয়তা আজ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তারেক জিয়াকে আরো বেশি বেশি করে কথা বলতে দেয়া উচিত। কারণ, তারেক জিয়া আরো কথা বললে বিএনপির জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠা ছাড়িয়ে ঋণাত্মক কোঠায় গিয়ে পৌঁছবে। আর বিএনপির জনপ্রিয়তা যদি শূন্যের কোঠায় গিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে, তবে একটি দলনিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সরকারের এত ভয় কেন। বেগম জিয়ার দাবি তো একটাই, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেÑ এমন একটি নির্বাচন, যা জনগণের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। সে অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সংলাপ। তাহলে কেন সংলাপে বসতে সরকারপক্ষের এই অনীহা।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বেগম জিয়া ও তার দল-জোট জনবিচ্ছিন্ন নয়। এর দৃশ্যমান প্রমাণ অনেক। যারা তা স্বীকার করতে চান না, তাদের চোখে তা দৃশ্যমান নয়। কারণ, এরা দলান্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা স্পষ্ট দেখতে পান। এরা দেখতে পান সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনে বেগম জিয়ার দলের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয় লাভের বিষয়টি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বেগম জিয়ার জনসভাগুলোতে মানুষের ঢল তারই জনপ্রিয়তার প্রমাণবহ। আর এর সর্বশেষ প্রমাণবহ ঘটনাটি হচ্ছে আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল নামার বিষয়টি। এ দেশের মানুষ যেভাবে আজো স্মরণে আনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার সেই অভূতপূর্ব জনসমাগমের ঐতিহাসিক নামাজে জানাজা, তেমনি আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজাটিই হবে এ দেশের একটি স্মরণীয় জানাজা।
আজ দেশে-বিদেশে চার দিকে একই উচ্চারণÑ দুই নেত্রীর সংলাপ সমঝোতা অভাবের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে। এমনকি বার্ন ইউনিটের এক ভুক্তভোগীর দাবি, দুই নেত্রী সংলাপে বসে এ বিরোধের নিষ্পত্তি করুক। তা না করে তাদের কেন কষ্ট দেয়া হচ্ছে। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতিসঙ্ঘÑ সবার দাবি রাজনৈতিক সংলাপ। বেগম খালেদা জিয়ার দাবিও সংলাপের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে, কোনো সংলাপ নয়। তাদের কথা দাঁড়িয়েছেÑ কঠোর দমনপীড়ন করে যে করেই হোক ২০ দলীয় জোটকে নির্মূল করে দেশে শান্তি আনতে হবে। তাদের মতে, এটাই একমাত্র পথ।
বিবেকবানদের কথাÑ এ পথ ভুল পথ। নীতি-নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সংবিধান কোনো কিছুই এ পথ সমর্থন করে না। জোরজবরদস্তির মধ্য দিয়ে কখনোই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইতিহাসের নানা ঘটনাই এর প্রমাণ বহন করে। অতএব সংলাপ-সমঝোতার পথে হাঁটাই শ্রেয়। যে পথে কল্যাণ আমার আপনার সবার। অতএব কেন নয় সংলাপ-সমঝোতা।
পুরো ২০১৪ সালটা গেছে মোটামুটি আন্দোলনহীন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট একের পর এক আহ্বান জানিয়েই এসেছে, সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচন দিতে ও নির্বাচনের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে, বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধ করতে, মামলা-হামলা বন্ধ করতে। কিন্তু সরকার সে পথে যায়নি। বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের ওপর মামলা-হামলা, দমনপীড়ন যথারীতি অব্যাহত থাকে এবং বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ করে বাক্যবাণও অব্যাহত রাখা হয়। ২০১৪ সালের শেষে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ৭ দফা প্রস্তাব দেন। তা-ও সরকারপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে এবং বেগম জিয়াকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। গাজীপুরে তাকে জনসভা করতে দেয়া হয়নি। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় তাকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। মোটামুটি ৩ জানুয়ারি থেকে তিনি তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়। তা এখনো চলমান। অবরোধ কর্মসূচিতে সারা দেশ প্রায় অচল। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনীতির চাকা অচল। এরই মধ্যে মানুষ পুড়িয়ে মারা, ক্রসফায়ার এবং সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, ক্রসফায়ার ও মামলা দায়ের সময়ের সাথে জোরদার হচ্ছে। চলছে ক্রসফায়ার ও অপহরণের ঘটনাও। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, বেগম জিয়া সংলাপ-সমঝোতা ছাড়া অন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে অনড়। সরকারপক্ষ বলছে, বেগম জিয়ার সাথে কোনো আলোচনা নয়। দেশে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নেই। আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা। সরকার যে করেই হোক, কঠোর অবস্থান নিয়ে দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনবে।
এমন যখন অবস্থা, তখন সরকার বেগম জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়। অবশ্য ২০ ঘণ্টা পর আবার বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। কাটা রয়েছে ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন নয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার কার্যালয়ের সব লাইনই কেটে দেয়া হবে। এ দিকে ৩১ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে প্রবেশের সময় ছয় মহিলা আইনজীবীকেও আটক করেছে পুলিশ। এ দিকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এক সভা রোববার সংসদ অধিবেশন শেষে জাতীয় সংসদ ভবনের নবম তলায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত সে সভা বসেনি। এ সভায় কী সিদ্ধান্ত হয়, তার ওপর হয়তো সরকারি মনোভাব কিছুটা আঁচ করা যেত।
এখন পর্যন্ত যা মনে হয়, দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। এ ধরনের জাতীয় সঙ্কটময় মুহূর্তে যখন সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধী পক্ষ একমত হতে পারে না, তখন সাধারণত বিবদমান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার পড়ে দেশের মালিক বলে পরিচিত ‘জনগণের’ ওপর। এরই নাম ‘গণভোট’ বা রেফারেন্ডাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত শাসনামলে সংবিধান থেকে একতরফাভাবে সেই ‘গণভোটের’ বিধান বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে জনগণ আজ সে অধিকার হারিয়ে সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধীদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ বসে বসে দেখছে। আর এর আগুনে পুড়ে দেশের সাধারণ মানুষ আজ চরম দুর্ভোগের মুখে। আজকের এই যে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্কট, তারও সৃষ্টি করেছে এই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে দেশের সব দলের তথা তিন জোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাদ দিয়ে।
আসলে গণভোটই বলেন আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনই বলেন, এসব সংবিধান থেকে তাড়ানোর পেছনের একটি নেপথ্য কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের অনেক কাজেই জনগণের সমর্থন নেই। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতার পাটাতন সুদীর্ঘ করার চিন্তাই তাদের পেয়ে বসেছে। একই কারণে ৫ জানুয়ারির নিয়ম রক্ষার তথা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি থেকে আওয়ামী লীগ আজ দূরে সরে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
আজ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখে একই কথা, বেগম জিয়া বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। কিন্তু তিনি তো এ দেশে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন তো বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যায়নি। এরা আজ বারবার বলছেন, বেগম জিয়া সন্ত্রাসের রানী, জঙ্গিরানী, দুর্নীতিবাজ, তার সন্তানেরা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু দেশের মানুষ তেমনটি মনে করে না। মানুষের ভাবনা ভিন্ন। এর বড় প্রমাণ আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল। আজ অনেকের মুখেই শুনি, তারেক জিয়া পাগলের মতো যা বকছে, তাতে করে বিএনপির জনপ্রিয়তা আজ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তারেক জিয়াকে আরো বেশি বেশি করে কথা বলতে দেয়া উচিত। কারণ, তারেক জিয়া আরো কথা বললে বিএনপির জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠা ছাড়িয়ে ঋণাত্মক কোঠায় গিয়ে পৌঁছবে। আর বিএনপির জনপ্রিয়তা যদি শূন্যের কোঠায় গিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে, তবে একটি দলনিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সরকারের এত ভয় কেন। বেগম জিয়ার দাবি তো একটাই, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেÑ এমন একটি নির্বাচন, যা জনগণের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। সে অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সংলাপ। তাহলে কেন সংলাপে বসতে সরকারপক্ষের এই অনীহা।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বেগম জিয়া ও তার দল-জোট জনবিচ্ছিন্ন নয়। এর দৃশ্যমান প্রমাণ অনেক। যারা তা স্বীকার করতে চান না, তাদের চোখে তা দৃশ্যমান নয়। কারণ, এরা দলান্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা স্পষ্ট দেখতে পান। এরা দেখতে পান সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনে বেগম জিয়ার দলের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয় লাভের বিষয়টি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বেগম জিয়ার জনসভাগুলোতে মানুষের ঢল তারই জনপ্রিয়তার প্রমাণবহ। আর এর সর্বশেষ প্রমাণবহ ঘটনাটি হচ্ছে আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল নামার বিষয়টি। এ দেশের মানুষ যেভাবে আজো স্মরণে আনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার সেই অভূতপূর্ব জনসমাগমের ঐতিহাসিক নামাজে জানাজা, তেমনি আরাফাত রহমান কোকোর নামাজে জানাজাটিই হবে এ দেশের একটি স্মরণীয় জানাজা।
আজ দেশে-বিদেশে চার দিকে একই উচ্চারণÑ দুই নেত্রীর সংলাপ সমঝোতা অভাবের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে। এমনকি বার্ন ইউনিটের এক ভুক্তভোগীর দাবি, দুই নেত্রী সংলাপে বসে এ বিরোধের নিষ্পত্তি করুক। তা না করে তাদের কেন কষ্ট দেয়া হচ্ছে। দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতিসঙ্ঘÑ সবার দাবি রাজনৈতিক সংলাপ। বেগম খালেদা জিয়ার দাবিও সংলাপের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে, কোনো সংলাপ নয়। তাদের কথা দাঁড়িয়েছেÑ কঠোর দমনপীড়ন করে যে করেই হোক ২০ দলীয় জোটকে নির্মূল করে দেশে শান্তি আনতে হবে। তাদের মতে, এটাই একমাত্র পথ।
বিবেকবানদের কথাÑ এ পথ ভুল পথ। নীতি-নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সংবিধান কোনো কিছুই এ পথ সমর্থন করে না। জোরজবরদস্তির মধ্য দিয়ে কখনোই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইতিহাসের নানা ঘটনাই এর প্রমাণ বহন করে। অতএব সংলাপ-সমঝোতার পথে হাঁটাই শ্রেয়। যে পথে কল্যাণ আমার আপনার সবার। অতএব কেন নয় সংলাপ-সমঝোতা।
No comments