ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে ঢালাও বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না -বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া by মেহেদী হাসান
ইসলামি
ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ফ্রড বা প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং সুদ ও রিবা
এক জিনিস নয় বলে অর্থমন্ত্রী সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে তীব্র
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যাংকিং বিশেষ করে শরিয়াভিত্তিক
ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞরা জানিয়েছেন ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা
অবশ্যই ফ্রড বা প্রতারণামূলক নয়। প্রচলিত শোষণমূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থার
বিপরীতে এটি একটি কল্যাণধর্মী ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং সে কারণেই সারা বিশ্বে
দ্রুত এ ব্যবস্থা স্বীকৃতি লাভ করেছে। আর সুদ এবং রিবা এক জিনিস নয় বলে
অর্থমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাও গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ জাতীয় বক্তব্য
কুরআনবিরোধী। বিশেষজ্ঞদের মতে ইসলাম ব্যাংকিং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতারণা
করছে তা নির্দিষ্ট করে না বলে পুুরো ব্যবস্থাকে প্রতারণা বলা গ্রহণযোগ্য
হতে পারে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। অর্থমন্ত্রী কেন এটা বললেন তা বুঝতে পারছি না। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা কোন দৃষ্টিতে ফ্রড বা প্রতারণামূলক তা নির্দিষ্ট করে বললে ভালো হতো। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে ফ্রড বা প্রতারণা করছে তা নির্দিষ্ট করে না বলে পুরো ব্যবস্থাটাকে ঢালাওভাবে ফ্রড বা প্রতারণা বলাটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রচলিত অনেক ব্যাংকেও অনেক ধরনের প্রতারণা আছে। ইসলামি ব্যাংকিং খাত বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নিয়মনীতি মেনেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা ইসলামের কতগুলো মূলনীতি মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যেসব ইসলামি ব্যাংকিং আছে তারাও ইসলামের মূলনীতির আলোকেই কাজ করছে। কাজেই ইসলামি ব্যাংকিং কোন ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতারণা করছে তা নির্দিষ্ট করে বলা উচিত। আমি মনে করি এটা অর্থমন্ত্রীর একটি সুইপিং কমেন্ট। এটা যুক্তিসঙ্গত কোনো কথা নয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইসলামি ব্যাংকিং এখন যেটা করছে সেটা সুদও নয় রিবাও নয়।
রিবা এবং সুদ এক জিনিস নয় অর্থমন্ত্রীর এ দাবি বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে অনেক বইপুস্তক আছে। আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। রিবা আসলেই কল্যাণবিরোধী একটা ব্যবস্থা ছিল। এটা মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিত।
শাহ আব্দুল হান্নান
সাবেক ব্যাংকিং সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ সবাই ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারাও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে। ১০-১২ বছর আগে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল মুসিলম বিশ্ব থেকে পাশ্চাত্যের কী কী জিনিস বর্তমানে নেয়ার আছে সে বিষয়ে। তাতে তারা উল্লেখ করেছে মুসলিম বিশ্ব থেকে তারা বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিতে পারে।
শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, ইসলামি ব্যাংকিং হল উত্তম ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং এটা সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত। বর্তমান বিশ্বে প্রায়ই যে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেউলিয়া হয়ে যায় সেভাবে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আক্রান্ত হয় না। কারণ ইসলামি ব্যাংকিং হলো কল্যাণধর্মী ব্যাংকিং ব্যবস্থা। তিনি বলেন, সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে অর্থনৈতিক মন্দা ছড়িয়ে পড়ে কয়েক বছর আগে তাতেও দেখা গেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। পথে বসেছে লাখ লাখ মানুষ।
শাহ আব্দুল হান্নানের মতে ইসলামি ব্যাংকিং কোনো প্রতারণা নয়; বরং এটা ইসলামের অনুসরণ। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বিপরীতে এটা একটি ভালো ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, রাসূল সা:-এর সময় দুই ধরনের সুদ ছিল। যেমন কেউ পাঁচ দিনার দিয়ে ছয় দিনার আদায় করত আবার কেউ এক মণ খেজুর দিয়ে দেড় মণ আদায় করত। জাহেলিয়াতের সময় থেকে এটা চালু ছিল এবং এ দুইটিই সুদ। রাসূল সা: এ দুই ধরনের সুদকেই হারাম করেছেন। ‘সুদ সমাজ অর্থনীতি’ নামক বইয়ে রাসূলের সময়কার সুদ বিষয়ে কমপক্ষে ১০০টি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, জাহেলিয়াতের সময় থেকে রাসূলের সময় পর্যন্ত যে সুদ ব্যবস্থা চালু ছিল তাতে যা দেয়া হতো তার চেয়ে বাড়তি আদায় করা হতো। সে কারণে সেটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে যে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদ নামে যা চালু আছে এটি হচ্ছে তাই যা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। বেশি নেয়া যাবে না। বেশি নেয়া যাবে শুধু ব্যবসার মাধ্যমে। বিশ্বে এমন কোনো আলেম নেই যারা বলেছে টাকা বেশি নিলে তা সুদ হবে না। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বর্তমান সুদকে রিবা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছে। সুদের কারণেই অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফতুর হয়ে যাচ্ছে। কারণ সুদ ব্যবস্থায় ব্যবসা মার খেলে বা লোকসান হলে তারা আর ব্যাংকের মূলধন এবং সুদ পরিশোধ করতে পারে না।
সৈয়দ কামালউদ্দিন জাফরী
সেন্ট্রাল শরিয়া কাউন্সিল ফর ইসলামিক ব্যাংকস ইন বাংলাদেশের সদস্য সৈয়দ কামালউদ্দিন জাফরী বলেন, সুদ এবং রিবা একই জিনিস। কুরআনে রিবা শব্দ এসেছে। রিবা শব্দটা আরবি। আর সুদ শব্দটা ফারসি। সুদের বাংলা করা হয়েছে লাভ।
কুরআনে যে রিবাকে হারাম করা হয়েছে সেই রিবা এবং বর্তমানে চালু থাকা সুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রিবা খারাপ আর সুদ ভালো এমন ভাবা এবং এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ফ্রড আখ্যায়িত করা বিষয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা নেই বোঝা গেল। তাই তিনি এমন কথা বললেন। কুরআনে যখন আল্লাহ বললেন, তোমরা সুদ ছেড়ে দাও তখন কাফেররা বলল সুদ এবং ক্রয় বিক্রয় তো একই জিনিস। কিন্তু আল্লাহ ব্যবসায় এবং ক্রয়-বিক্রয়কে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম। সুদ নিষিদ্ধের জবাবে কাফেররা যেমন জবাব দিয়েছিল অর্থমন্ত্রীও তেমনিভাবে বলে দিলেন রিবা আর সুদ এক জিনিস নয়। সুদ তার দৃষ্টিতে মানবিক। অথচ আল্লাহ একে করেছেন হারাম।
প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের প্রফেসর মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ৫০ বছর ধরে সারা বিশ্বে চলছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বিশ্বের অনেক মুসলিম অমুসিলম গবেষক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর গবেষণা এবং পড়াশুনা করছেন। বর্তমানে সুদের যে শোষণ এবং অন্যায় ব্যবসা চলছে তার বিকল্প কিছু বের করার জন্যই তারা এসব গবেষণা এবং পড়াশুনা করছেন ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে। এটা যদি ফ্রড এবং প্রতারণামূলক একটি ব্যবস্থা হত তাহলে তারা এর ওপর পড়াশুনা এবং গবেষণা করতেন না।
অর্থমন্ত্রীর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে এবং সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের কথা বলাটা কোনো দায়িত্বসুলভ কাজ নয়। তার এ কথায় অনেকে হয়ত কষ্ট পাবেন কিন্তু এতে কোনো সমস্যা হবে না তাদের। বর্তমানে আটটি ইসলামী ব্যাংক দেশে চালু আছে এবং তিনিও সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংক নামে একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছেন। ইসলামি ব্যাংক ফ্রড হলে তিনি এ অনুমোদন দিলেন কেন।
সুদ এবং রিবা বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সুদ ইহুদি ধর্মেও নিষিদ্ধ ছিল। ইহুদিরাই চালু করেছে এ সুদ ব্যবস্থা। পবিত্র কুরআনে সুদ বিষয়ে রিবা শব্দ ব্যবহার করেছেন আল্লাহ। ইহুদিরা কুরআনের রিবা শব্দের অনুবাদ করেছে ‘ইউজুরি’। রিবাকে তারা চক্রবৃদ্ধির সুদ ধরে নিয়েছে। ইউজুরি এবং ইন্টারেস্টকে তারা আলাদা করার চেষ্টা করেছে। ইহুদিদের মতে রিবা নিষিদ্ধ কিন্তু বর্তমানে যে সুদ চালু আছে এটা খারাপ নয়। দুই ধরনের সুদের ধারণা ইহুদিরা চালু করেছে এবং অর্থমন্ত্রী সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন বুঝে হোক আর না বুঝে হোক।
প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইহুদিরা সুদও খেতে চায় এবং ধার্মিকও থাকতে চায়। সে কারণেই তারা দুই ধরনের সুদের ধারণার জন্ম দিয়েছে। যারা সুদের সাথে জড়িত তারাই নরম সুদ আর কড়া সুদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। কারণ যারা সুদ খায় তারা জানে এটা খারাপ কাজ। তাই তারা এ দুই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে। কুরআনে শুধু রিবা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নরম সুদ কড়া সুদ বলতে কিছু নেই।
মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইসলামের মূলনীতি হলো যা হারাম তার বেশিও যেমন হারাম কমও তেমনি হারাম। যেমন মদ হারাম। এখন কেউ যদি বলে বিয়ার অতটা কড়া মদ নয় যেমনটা কড়া ভদকা বা শ্যাম্পেইন। তাই বিয়ার খাওয়া হারাম নয় এ ফতোয়া চলবে না। ইসলামে কোনো কিছু হারাম হয় তার বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিমাণ বা মাত্রাগত পার্থক্যের ভিত্তিতে নয়।
তাই প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলামের মতে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য কুরআন হাদিস এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠিত মতের বিরোধী।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। অর্থমন্ত্রী কেন এটা বললেন তা বুঝতে পারছি না। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা কোন দৃষ্টিতে ফ্রড বা প্রতারণামূলক তা নির্দিষ্ট করে বললে ভালো হতো। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে ফ্রড বা প্রতারণা করছে তা নির্দিষ্ট করে না বলে পুরো ব্যবস্থাটাকে ঢালাওভাবে ফ্রড বা প্রতারণা বলাটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রচলিত অনেক ব্যাংকেও অনেক ধরনের প্রতারণা আছে। ইসলামি ব্যাংকিং খাত বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নিয়মনীতি মেনেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা ইসলামের কতগুলো মূলনীতি মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যেসব ইসলামি ব্যাংকিং আছে তারাও ইসলামের মূলনীতির আলোকেই কাজ করছে। কাজেই ইসলামি ব্যাংকিং কোন ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতারণা করছে তা নির্দিষ্ট করে বলা উচিত। আমি মনে করি এটা অর্থমন্ত্রীর একটি সুইপিং কমেন্ট। এটা যুক্তিসঙ্গত কোনো কথা নয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইসলামি ব্যাংকিং এখন যেটা করছে সেটা সুদও নয় রিবাও নয়।
রিবা এবং সুদ এক জিনিস নয় অর্থমন্ত্রীর এ দাবি বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে অনেক বইপুস্তক আছে। আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। রিবা আসলেই কল্যাণবিরোধী একটা ব্যবস্থা ছিল। এটা মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিত।
শাহ আব্দুল হান্নান
সাবেক ব্যাংকিং সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ সবাই ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারাও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে। ১০-১২ বছর আগে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল মুসিলম বিশ্ব থেকে পাশ্চাত্যের কী কী জিনিস বর্তমানে নেয়ার আছে সে বিষয়ে। তাতে তারা উল্লেখ করেছে মুসলিম বিশ্ব থেকে তারা বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিতে পারে।
শাহ আব্দুল হান্নান বলেন, ইসলামি ব্যাংকিং হল উত্তম ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং এটা সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত। বর্তমান বিশ্বে প্রায়ই যে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেউলিয়া হয়ে যায় সেভাবে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আক্রান্ত হয় না। কারণ ইসলামি ব্যাংকিং হলো কল্যাণধর্মী ব্যাংকিং ব্যবস্থা। তিনি বলেন, সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে অর্থনৈতিক মন্দা ছড়িয়ে পড়ে কয়েক বছর আগে তাতেও দেখা গেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। পথে বসেছে লাখ লাখ মানুষ।
শাহ আব্দুল হান্নানের মতে ইসলামি ব্যাংকিং কোনো প্রতারণা নয়; বরং এটা ইসলামের অনুসরণ। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বিপরীতে এটা একটি ভালো ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, রাসূল সা:-এর সময় দুই ধরনের সুদ ছিল। যেমন কেউ পাঁচ দিনার দিয়ে ছয় দিনার আদায় করত আবার কেউ এক মণ খেজুর দিয়ে দেড় মণ আদায় করত। জাহেলিয়াতের সময় থেকে এটা চালু ছিল এবং এ দুইটিই সুদ। রাসূল সা: এ দুই ধরনের সুদকেই হারাম করেছেন। ‘সুদ সমাজ অর্থনীতি’ নামক বইয়ে রাসূলের সময়কার সুদ বিষয়ে কমপক্ষে ১০০টি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, জাহেলিয়াতের সময় থেকে রাসূলের সময় পর্যন্ত যে সুদ ব্যবস্থা চালু ছিল তাতে যা দেয়া হতো তার চেয়ে বাড়তি আদায় করা হতো। সে কারণে সেটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে যে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদ নামে যা চালু আছে এটি হচ্ছে তাই যা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। বেশি নেয়া যাবে না। বেশি নেয়া যাবে শুধু ব্যবসার মাধ্যমে। বিশ্বে এমন কোনো আলেম নেই যারা বলেছে টাকা বেশি নিলে তা সুদ হবে না। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বর্তমান সুদকে রিবা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছে। সুদের কারণেই অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফতুর হয়ে যাচ্ছে। কারণ সুদ ব্যবস্থায় ব্যবসা মার খেলে বা লোকসান হলে তারা আর ব্যাংকের মূলধন এবং সুদ পরিশোধ করতে পারে না।
সৈয়দ কামালউদ্দিন জাফরী
সেন্ট্রাল শরিয়া কাউন্সিল ফর ইসলামিক ব্যাংকস ইন বাংলাদেশের সদস্য সৈয়দ কামালউদ্দিন জাফরী বলেন, সুদ এবং রিবা একই জিনিস। কুরআনে রিবা শব্দ এসেছে। রিবা শব্দটা আরবি। আর সুদ শব্দটা ফারসি। সুদের বাংলা করা হয়েছে লাভ।
কুরআনে যে রিবাকে হারাম করা হয়েছে সেই রিবা এবং বর্তমানে চালু থাকা সুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রিবা খারাপ আর সুদ ভালো এমন ভাবা এবং এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ফ্রড আখ্যায়িত করা বিষয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা নেই বোঝা গেল। তাই তিনি এমন কথা বললেন। কুরআনে যখন আল্লাহ বললেন, তোমরা সুদ ছেড়ে দাও তখন কাফেররা বলল সুদ এবং ক্রয় বিক্রয় তো একই জিনিস। কিন্তু আল্লাহ ব্যবসায় এবং ক্রয়-বিক্রয়কে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম। সুদ নিষিদ্ধের জবাবে কাফেররা যেমন জবাব দিয়েছিল অর্থমন্ত্রীও তেমনিভাবে বলে দিলেন রিবা আর সুদ এক জিনিস নয়। সুদ তার দৃষ্টিতে মানবিক। অথচ আল্লাহ একে করেছেন হারাম।
প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের প্রফেসর মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ৫০ বছর ধরে সারা বিশ্বে চলছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বিশ্বের অনেক মুসলিম অমুসিলম গবেষক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর গবেষণা এবং পড়াশুনা করছেন। বর্তমানে সুদের যে শোষণ এবং অন্যায় ব্যবসা চলছে তার বিকল্প কিছু বের করার জন্যই তারা এসব গবেষণা এবং পড়াশুনা করছেন ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে। এটা যদি ফ্রড এবং প্রতারণামূলক একটি ব্যবস্থা হত তাহলে তারা এর ওপর পড়াশুনা এবং গবেষণা করতেন না।
অর্থমন্ত্রীর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে এবং সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের কথা বলাটা কোনো দায়িত্বসুলভ কাজ নয়। তার এ কথায় অনেকে হয়ত কষ্ট পাবেন কিন্তু এতে কোনো সমস্যা হবে না তাদের। বর্তমানে আটটি ইসলামী ব্যাংক দেশে চালু আছে এবং তিনিও সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংক নামে একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছেন। ইসলামি ব্যাংক ফ্রড হলে তিনি এ অনুমোদন দিলেন কেন।
সুদ এবং রিবা বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সুদ ইহুদি ধর্মেও নিষিদ্ধ ছিল। ইহুদিরাই চালু করেছে এ সুদ ব্যবস্থা। পবিত্র কুরআনে সুদ বিষয়ে রিবা শব্দ ব্যবহার করেছেন আল্লাহ। ইহুদিরা কুরআনের রিবা শব্দের অনুবাদ করেছে ‘ইউজুরি’। রিবাকে তারা চক্রবৃদ্ধির সুদ ধরে নিয়েছে। ইউজুরি এবং ইন্টারেস্টকে তারা আলাদা করার চেষ্টা করেছে। ইহুদিদের মতে রিবা নিষিদ্ধ কিন্তু বর্তমানে যে সুদ চালু আছে এটা খারাপ নয়। দুই ধরনের সুদের ধারণা ইহুদিরা চালু করেছে এবং অর্থমন্ত্রী সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন বুঝে হোক আর না বুঝে হোক।
প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইহুদিরা সুদও খেতে চায় এবং ধার্মিকও থাকতে চায়। সে কারণেই তারা দুই ধরনের সুদের ধারণার জন্ম দিয়েছে। যারা সুদের সাথে জড়িত তারাই নরম সুদ আর কড়া সুদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। কারণ যারা সুদ খায় তারা জানে এটা খারাপ কাজ। তাই তারা এ দুই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে। কুরআনে শুধু রিবা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নরম সুদ কড়া সুদ বলতে কিছু নেই।
মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইসলামের মূলনীতি হলো যা হারাম তার বেশিও যেমন হারাম কমও তেমনি হারাম। যেমন মদ হারাম। এখন কেউ যদি বলে বিয়ার অতটা কড়া মদ নয় যেমনটা কড়া ভদকা বা শ্যাম্পেইন। তাই বিয়ার খাওয়া হারাম নয় এ ফতোয়া চলবে না। ইসলামে কোনো কিছু হারাম হয় তার বৈশিষ্ট্যের কারণে পরিমাণ বা মাত্রাগত পার্থক্যের ভিত্তিতে নয়।
তাই প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলামের মতে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য কুরআন হাদিস এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠিত মতের বিরোধী।
No comments