আরব বসন্ত: বিপ্লব শেষ হয়নি by কামাল গাবালা
২৫
জানুয়ারি বিপ্লবের চতুর্থ বার্ষিকীতে মনটা খুব ভার। আকাশে-বাতাসে বিষণ্নতা
ভেসে রয়েছে, যার মূল সুর হচ্ছে রক্ত, বিভাজন, মতানৈক্য ও বিষাদ। না, সেটা
শুধু সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের মৃত্যুতে বিপ্লবের বার্ষিকী
উদ্যাপন বাতিল করার কারণে নয় বা সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের দুই
ছেলেকেই আদালতের সিদ্ধান্তে ছেড়ে দেওয়ার কারণে নয়, মিসরীয় নাগরিকের মধ্যেই
এই দিবসের গুরুত্ব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বাড়ছে, সে কারণেও বটে। মিসরীয়রা
তর্কে মেতে উঠেছে, ২৫ জানুয়ারি দিনটি আসলে কী: বিপ্লব-বিদ্রোহ, নাকি
ষড়যন্ত্র—অনেকে যা দাবি করে থাকে।
কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার। ২০১৫ সালের এই ২৫ জানুয়ারিতে মিসরীয় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সহিংস প্রতিবাদকারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে ২৩ জন মারা যায় আর ৯৭ জন আহত হয়, সরকারি তথ্যমতে।
আরও বিয়োগান্ত ব্যাপার হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাহীন সিনাই উপদ্বীপেও ২৫ জানুয়ারির পরে ৩০ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন।
মিসরীয়রা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক রিচার্ড স্পেন্সার। যেসব আরব দেশে তথাকথিত আরব বসন্ত হয়েছে, সেখানকার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ-বিষয়ক এক নিবন্ধে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৩ জানুয়ারি তা ছাপা হয়। এই নিবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে: ‘আরব বসন্তের বিপর্যয়কর বিজয়’। এতে বলা হয়েছে:
‘ট্র্যাজেডি শব্দটির অধিক ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আরব বসন্তের জন্য এটা যথাযথই মনে হয়। বিমান ধ্বংস, ভূমিকম্প, মারাত্মক অসুস্থতা—এগুলো সবই দুঃখজনক, বিপর্যয়করও বটে। কিন্তু তার মধ্যে গ্রিক নাটকের উপাদানের কিছু অভাব রয়েছে—দর্শক নিজের মুখে হাত রেখে নীরবে নিজের মধ্যে অভিনেতার প্রতি চিৎকার করে বলছে: এটা কোরো না, আক্ষেপ করবে।’
রিচার্ড স্পেন্সার বলেন, ‘রোববার আমরা হোসনি মোবারকের উৎখাতের লক্ষ্যে সংঘটিত প্রথম উন্মুক্ত প্রতিবাদের চতুর্থ বার্ষিকী উদ্যাপন করলাম। এরপর পার হওয়া প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে প্রতিবাদকারী, সরকার ও রাজনৈতিক আন্দোলন জড়িয়ে আছে। পশ্চিমা ও অন্য নেতাদের বারবার বলা হয়েছে, তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে—তার পরও সেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।’
স্পেন্সার আরও বলেন, আরব বসন্তে টালমাটাল হওয়া দেশগুলোর মধ্যে মিসরই কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে সেটা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও কারাগারে আরও হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষের বিনিময়ে অর্জিত। সিরিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ হওয়ার আগে লাখো মানুষ মারা পড়বে এবং নিপীড়নের শিকার হবে। আর লিবিয়া তো ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, ফেডারেলিস্ট ও অন্য নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। ইয়েমেনে শিয়া জঙ্গিরা (হুতি) প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘেরাও করে রয়েছে, আর বাকি দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে আল-কায়েদা।
বিদেশি বিশ্লেষকেরা এ বিষয়ে যা বলছেন, তা এক বিন্দুতে মিলে যাচ্ছে। স্পেন্সার বলেন, ২৫ জানুয়ারি এই বার্ষিকীর বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু মানুষ এটা পালন করবে, নীরবে। মিসরের বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই এখন কারাগারে। অনেকেই মারা গেছেন। আর মিসরের পার্টি ও অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বিপ্লব বার্ষিকী উদ্যাপন করা ঠিক হবে, নাকি প্রতিবাদ করা উচিত?
এদিকে সরকার দেশজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। সরকার দাবি করছে, সন্ত্রাসবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার মিত্ররা ২৫ জানুয়ারি বিশৃঙ্খলা, অন্তর্ঘাত ও সহিংসতা ঘটানোর হুমকি দিয়েছিল। ফলে তাহরির স্কয়ারে ঢোকার মুখে ট্যাংক বসানো হয়, এর প্রতিটি প্রবেশপথেই সশস্ত্র গাড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
মিসরীয়দের মধ্যে যতই বিতর্ক থাকুক, সময় আসবে, যেদিন মিসরীয়রা যথাযথভাবে এই বিপ্লব উদ্যাপন করবে; তা এই বিপ্লবকে ছিনতাই করার যতই অপচেষ্টা ও নেতৃস্থানীয় তরুণদের গালাগাল করা হোক না কেন।
‘২৫ জানুয়ারি...বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি’—শিরোনামে সাংবাদিকতা সিন্ডিকেটের সাবেক প্রধান মাকরাম মোহামেদ আহমেদ বলেন, অধিকাংশ মিসরীয় বিশ্বাস করে, ২৫ জানুয়ারির ঘটনা জনপ্রিয় বিদ্রোহের তরিকায় পড়ে, তবে এর কোনো নেতৃত্ব ও সুনির্দিষ্ট পথ ছিল না। খুব নগণ্যসংখ্যক মানুষ মনে করে, এই বিপ্লব সম্পদসম, যা ব্রাদারহুডের ষড়যন্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আর নেতৃস্থানীয় তরুণেরা হাজারো দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে।
মাকরাম আরও বলেন, মিসরের স্বার্থেই ২৫ জানুয়ারি সংঘটিত হয়েছে। এটা মানুষকে বদলে দিয়েছে, নিপীড়ন চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। এর ফলে দ্বিতীয় বিপ্লবের পথ তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদরহুডের শাসন শেষ হয়েছে। তিন বছরে দুই প্রেসিডেন্টের বিচার হয়েছে। ‘গণতন্ত্রই সমাধান’—এই স্লোগান সামনে রেখে মিসর সংস্কারের পথে হেঁটেছে।
২৫ জানুয়ারি বিপ্লব যে অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকেছে, তার শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল, তার অর্জনগুলো এতে প্রতিভাত হচ্ছে। বছরজুড়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন হয়েছে। মিসরীয় নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং একজন সর্বজনীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে, যিনি শুধু কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করেন না। এই কর্মসূচির তৃতীয় দিক বাস্তবায়নে আগামী মার্চে সংসদীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। আর দেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত স্থিতাবস্থা ফিরে এসেছে, মোবারকের পতনের পর সব নেতার ভুল, বাড়তি কথা ও অপরাধ সত্ত্বেও।
পর্যবেক্ষকেরা বলেন, তিউনিসিয়ার অবস্থা মিসরের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের অবস্থা গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ার মতো হয়নি বা আলী আবদুল্লাহ সালেহর পতনের পর ইয়েমেনের মতো হয়নি। আর ওদিকে সিরিয়া গৃহযুদ্ধের কারণে রক্তগঙ্গায় ভাসছে।
পর্যবেক্ষকেরা এ ভেবে বিস্মিত হন যে তিউনিসিয়া কীভাবে সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার হলো আর মিসরকে কেন এত দাম দিতে হচ্ছে।
উত্তরটা এ রকম: তিউনিসিয়ার বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। সেখানে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে খুব কম। একই সময়ে মিসর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে এক অন্ধকার সময় পার করেছে। তারার মিসরকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে এর চরিত্রই বদলে দিতে চেয়েছে। ফলে মানুষ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত হয়, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ে। স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে নিরাপত্তা বাহিনী তার লাঠি নিয়ে নামে, যেটা অনেকটা প্রবাদের পর্যায়েই চলে গেছে।
ওদিকে লিবিয়ায় দুই সরকারের শাসন চলছে। তাদের কেউ কাউকে স্বীকৃতি দেয় না। আর সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আর ইয়েমেনের বেশির ভাগ জায়গা সশস্ত্র হুতিদের দখলে চলে গেছে। পুরো দেশটিই সশস্ত্র লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে।
আরব বসন্ত নামক বিপ্লবের অভিঘাতে ২০১৫ সালটি আরব দেশের মানুষের জন্য নাটকীয়তা, দুর্ভাগ্যজনক প্রত্যাশা ও বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে। একতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য কী মূল্য দিতে হয়, তা শুধু আল্লাহই জানেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার। ২০১৫ সালের এই ২৫ জানুয়ারিতে মিসরীয় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সহিংস প্রতিবাদকারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে ২৩ জন মারা যায় আর ৯৭ জন আহত হয়, সরকারি তথ্যমতে।
আরও বিয়োগান্ত ব্যাপার হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাহীন সিনাই উপদ্বীপেও ২৫ জানুয়ারির পরে ৩০ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন।
মিসরীয়রা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক রিচার্ড স্পেন্সার। যেসব আরব দেশে তথাকথিত আরব বসন্ত হয়েছে, সেখানকার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ-বিষয়ক এক নিবন্ধে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৩ জানুয়ারি তা ছাপা হয়। এই নিবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে: ‘আরব বসন্তের বিপর্যয়কর বিজয়’। এতে বলা হয়েছে:
‘ট্র্যাজেডি শব্দটির অধিক ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আরব বসন্তের জন্য এটা যথাযথই মনে হয়। বিমান ধ্বংস, ভূমিকম্প, মারাত্মক অসুস্থতা—এগুলো সবই দুঃখজনক, বিপর্যয়করও বটে। কিন্তু তার মধ্যে গ্রিক নাটকের উপাদানের কিছু অভাব রয়েছে—দর্শক নিজের মুখে হাত রেখে নীরবে নিজের মধ্যে অভিনেতার প্রতি চিৎকার করে বলছে: এটা কোরো না, আক্ষেপ করবে।’
রিচার্ড স্পেন্সার বলেন, ‘রোববার আমরা হোসনি মোবারকের উৎখাতের লক্ষ্যে সংঘটিত প্রথম উন্মুক্ত প্রতিবাদের চতুর্থ বার্ষিকী উদ্যাপন করলাম। এরপর পার হওয়া প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে প্রতিবাদকারী, সরকার ও রাজনৈতিক আন্দোলন জড়িয়ে আছে। পশ্চিমা ও অন্য নেতাদের বারবার বলা হয়েছে, তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে—তার পরও সেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।’
স্পেন্সার আরও বলেন, আরব বসন্তে টালমাটাল হওয়া দেশগুলোর মধ্যে মিসরই কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে সেটা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও কারাগারে আরও হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষের বিনিময়ে অর্জিত। সিরিয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ হওয়ার আগে লাখো মানুষ মারা পড়বে এবং নিপীড়নের শিকার হবে। আর লিবিয়া তো ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, ফেডারেলিস্ট ও অন্য নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। ইয়েমেনে শিয়া জঙ্গিরা (হুতি) প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘেরাও করে রয়েছে, আর বাকি দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে আল-কায়েদা।
বিদেশি বিশ্লেষকেরা এ বিষয়ে যা বলছেন, তা এক বিন্দুতে মিলে যাচ্ছে। স্পেন্সার বলেন, ২৫ জানুয়ারি এই বার্ষিকীর বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু মানুষ এটা পালন করবে, নীরবে। মিসরের বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই এখন কারাগারে। অনেকেই মারা গেছেন। আর মিসরের পার্টি ও অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বিপ্লব বার্ষিকী উদ্যাপন করা ঠিক হবে, নাকি প্রতিবাদ করা উচিত?
এদিকে সরকার দেশজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। সরকার দাবি করছে, সন্ত্রাসবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার মিত্ররা ২৫ জানুয়ারি বিশৃঙ্খলা, অন্তর্ঘাত ও সহিংসতা ঘটানোর হুমকি দিয়েছিল। ফলে তাহরির স্কয়ারে ঢোকার মুখে ট্যাংক বসানো হয়, এর প্রতিটি প্রবেশপথেই সশস্ত্র গাড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
মিসরীয়দের মধ্যে যতই বিতর্ক থাকুক, সময় আসবে, যেদিন মিসরীয়রা যথাযথভাবে এই বিপ্লব উদ্যাপন করবে; তা এই বিপ্লবকে ছিনতাই করার যতই অপচেষ্টা ও নেতৃস্থানীয় তরুণদের গালাগাল করা হোক না কেন।
‘২৫ জানুয়ারি...বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি’—শিরোনামে সাংবাদিকতা সিন্ডিকেটের সাবেক প্রধান মাকরাম মোহামেদ আহমেদ বলেন, অধিকাংশ মিসরীয় বিশ্বাস করে, ২৫ জানুয়ারির ঘটনা জনপ্রিয় বিদ্রোহের তরিকায় পড়ে, তবে এর কোনো নেতৃত্ব ও সুনির্দিষ্ট পথ ছিল না। খুব নগণ্যসংখ্যক মানুষ মনে করে, এই বিপ্লব সম্পদসম, যা ব্রাদারহুডের ষড়যন্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আর নেতৃস্থানীয় তরুণেরা হাজারো দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে।
মাকরাম আরও বলেন, মিসরের স্বার্থেই ২৫ জানুয়ারি সংঘটিত হয়েছে। এটা মানুষকে বদলে দিয়েছে, নিপীড়ন চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। এর ফলে দ্বিতীয় বিপ্লবের পথ তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদরহুডের শাসন শেষ হয়েছে। তিন বছরে দুই প্রেসিডেন্টের বিচার হয়েছে। ‘গণতন্ত্রই সমাধান’—এই স্লোগান সামনে রেখে মিসর সংস্কারের পথে হেঁটেছে।
২৫ জানুয়ারি বিপ্লব যে অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকেছে, তার শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল, তার অর্জনগুলো এতে প্রতিভাত হচ্ছে। বছরজুড়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন হয়েছে। মিসরীয় নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং একজন সর্বজনীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে, যিনি শুধু কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করেন না। এই কর্মসূচির তৃতীয় দিক বাস্তবায়নে আগামী মার্চে সংসদীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। আর দেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত স্থিতাবস্থা ফিরে এসেছে, মোবারকের পতনের পর সব নেতার ভুল, বাড়তি কথা ও অপরাধ সত্ত্বেও।
পর্যবেক্ষকেরা বলেন, তিউনিসিয়ার অবস্থা মিসরের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের অবস্থা গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ার মতো হয়নি বা আলী আবদুল্লাহ সালেহর পতনের পর ইয়েমেনের মতো হয়নি। আর ওদিকে সিরিয়া গৃহযুদ্ধের কারণে রক্তগঙ্গায় ভাসছে।
পর্যবেক্ষকেরা এ ভেবে বিস্মিত হন যে তিউনিসিয়া কীভাবে সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার হলো আর মিসরকে কেন এত দাম দিতে হচ্ছে।
উত্তরটা এ রকম: তিউনিসিয়ার বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। সেখানে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে খুব কম। একই সময়ে মিসর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে এক অন্ধকার সময় পার করেছে। তারার মিসরকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে এর চরিত্রই বদলে দিতে চেয়েছে। ফলে মানুষ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত হয়, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ে। স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে নিরাপত্তা বাহিনী তার লাঠি নিয়ে নামে, যেটা অনেকটা প্রবাদের পর্যায়েই চলে গেছে।
ওদিকে লিবিয়ায় দুই সরকারের শাসন চলছে। তাদের কেউ কাউকে স্বীকৃতি দেয় না। আর সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আর ইয়েমেনের বেশির ভাগ জায়গা সশস্ত্র হুতিদের দখলে চলে গেছে। পুরো দেশটিই সশস্ত্র লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে।
আরব বসন্ত নামক বিপ্লবের অভিঘাতে ২০১৫ সালটি আরব দেশের মানুষের জন্য নাটকীয়তা, দুর্ভাগ্যজনক প্রত্যাশা ও বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে। একতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য কী মূল্য দিতে হয়, তা শুধু আল্লাহই জানেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
No comments