চলো বাংলাদেশ, বিশ্বজুড়ে, বিশ্বকাপে... by আনিসুল হক
গণিত
অলিম্পিয়াড কিংবা ভাষা প্রতিযোগের অনুষ্ঠানে সমবেত শিশু-কিশোরদের
উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিই, ‘আচ্ছা বলো তো, ক্রিকেটে তোমরা কোন দলকে
সমর্থন করো? অস্ট্রেলিয়া কে? শ্রীলঙ্কা? ভারত? পাকিস্তান?’ একেকজন একেক
দেশের সমর্থক। তার পরের প্রশ্ন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলে
তোমরা কোন দেশের সমর্থক?’
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে ওঠে, ‘বাংলাদেশ!’
‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলে?’
‘বাংলাদেশ!’
‘পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলে?’
‘বাংলাদেশ!’
আমরা সবাই আমাদের দেশকে খুব ভালোবাসি। আমরা সবাই বাংলাদেশের জয় চাই। দেশপ্রেম এমন একটা জিনিস, এটা জন্মমাত্রই সবারই বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে আমৃত্যু স্পন্দিত হতে থাকে।
আর বাংলাদেশে ক্রিকেটকে, ক্রিকেট দলকে আমরা একটু বেশিই ভালোবাসি। জীবনের নানা ক্ষেত্রে মার খেতে খেতে জয়ের আশায় আমরা লাইফ জ্যাকেটের মতো আঁকড়ে ধরি ক্রিকেটকে। একটা তরুণ জাতি। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সেই জনসংখ্যার আবার বেশির ভাগই তরুণ। বিজয়ের জন্য তৃষিত হয়ে আছে, উন্মুখ হয়ে আছে।
তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিততে চায়। সব ক্ষেত্রেই। তবে সব জায়গায় কি আর জয় আসে? কিন্তু একটা জায়গায় আমরা বিশ্বমানের। তার নাম ক্রিকেট।
ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা আমরা এখনো অর্জন করিনি।
কিন্তু ক্রিকেটে করেছি।
সেসব দিনের কথাও কি ভোলা যায়?
কেনিয়াকে হারানোর সেই আইসিসি কাপ ফাইনাল। পুরো বাংলাদেশ রেডিও শুনছে। আর ১ রান দরকার। শেষ বলে?
শান্তর পায়ে লেগে সেই রান পেয়ে গেল বাংলাদেশ, আমরা জিতে গেলাম, হুররে, পুরো দেশ রাস্তায় নেমে গেল, আমরা আইসিসি চ্যাম্পিয়ন, আমরা বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি। এমনই বাঁধভাঙা উৎসব যে রাস্তায় দুজন জীবনও দিয়ে দিল!
তারপর আমরা গেলাম বিশ্বকাপ খেলতে। ১৯৯৯ সালে, ইংল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ। হারাল পাকিস্তানকে। সেখান থেকে ওডিআই স্ট্যাটাস। আর টেস্ট স্ট্যাটাস।
বিশ্বকাপে কেমন করেছে বাংলাদেশ? একবার খুব খারাপ। ২০০৩ বিশ্বকাপে সব ম্যাচ হেরে এসেছে, এমনকি কানাডা আর কেনিয়ার সঙ্গেও।
একবার বেশ ভালো। ২০০৭ সালে। সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন-প্রত্যাশী ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল আমাদের মুশফিক-সাকিবেরা। ভারত বিদায় নিয়েছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। আমরা হারিয়েছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকাকেও।
২০১১ সালে নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ। ভালোয়-মন্দয় মেশানো ফল। প্রথম খেলায় ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল রান তাড়া করা। জিততে না পারলেও আশা তৈরি হলো। দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। পরের খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। র্যাঙ্কিংয়ে তারা তখন ছিল বাংলাদেশের নিচে। সেই বিপুল প্রত্যাশার চাপে ভেঙে পড়ল বাংলাদেশ। ৫৮ রানেই অলআউট। তারপর? না, আমরা আশা ছাড়িনি—আমরা যারা বাংলাদেশের নাছোড় সমর্থক! আমি নিজেই তো ট্রেনের টিকিট কেটে চললাম চট্টগ্রামে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা। হারি-জিতি, আমরা বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আছি। আহা, সেই খেলায় জয়লাভ করলাম। সেদিন মাঠে সাকিব আল হাসানের চোখে জল চিকচিক করেছিল। জয়লাভ করে তারা উল্লাস না করে পরের ম্যাচের জন্য প্র্যাকটিস করতে শুরু করে দিয়েছিল। মনে করতেই চোখ ভিজে আসছে। আমরা চট্টগ্রামে সমুদ্রতীরের সেই স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসছি। সমস্ত রাজপথ মিছিলে পরিণত হয়েছে। পুরো চট্টগ্রাম আনন্দে নাচছে। পুরো দেশ আনন্দে ভাসছে। তিন ‘ল্যান্ড’কে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। রানিং গড়ে পিছিয়ে থাকায় অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা হলো না।
এবার কেমন করবে বাংলাদেশ?
বলা খুব মুশকিল। বাংলাদেশের জন্য প্রধান দুশ্চিন্তা, খেলাটা অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে। সিমারদের সহায়ক পিচ। বাংলাদেশ দলের প্রধান অস্ত্র স্পিন। এটা উপমহাদেশের সব দলেরই দুর্বলতা আর সবলতা—আমরা ফাস্ট বল খেলতেও অভ্যস্ত নই, আমরা স্পিন ভালো খেলি।
ওয়ার্ম-আপ ম্যাচের সব কটিতেই হেরে বসে আছে টিম। অস্ট্রেলিয়ার দুটি সাধারণ দলের কাছে, আর পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ডের জাতীয় দলের কাছে।
তবু ক্রিকেট হলো অনিশ্চয়তার খেলা। ওই একটা জায়গাতেই ভরসা। আর আমাদের সাকিব আল হাসান অস্ট্রেলিয়ার ক্লাবে টি-টোয়েন্টি খেলতে গিয়ে এক ম্যাচে চারটা উইকেটও পেয়েছেন। কাজেই স্পিন একেবারেই কাজ করবে না, তা না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশের লক্ষ্য এবার কোয়ার্টার ফাইনাল।
কিন্তু বাংলাদেশের বিগ ম্যাচ হলো প্রথমটাই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ওই খেলাটা নিয়েই ভয়ে ভয়ে আছি। এর কারণ, ক্রিকেট মনের খেলা, আর আফগানদের হারানোর কিছু নেই, কাজেই তারা খেলবে ভয়হীন ক্রিকেট। যেটা ২০০৭ সালে বাংলাদেশ খেলেছিল ভারতের বিরুদ্ধে। তবে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিচারে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো দল। আমাদের তামিম, মুমিনুল, সাকিব, মুশফিক, মাশরাফিরা পারবে না, এটা হওয়ার কোনো কারণই নেই। সেই সাহসটা আমরা বাংলাদেশ দলকে দিতে চাই। তোমরা পারো, তোমরা পেরেছ, তোমরা পারবে। তোমরা যোগ্যতর দল। আর তোমাদের সঙ্গে আছে ১৬ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা, শুভকামনা, শুভাশিস, দোয়া। তোমরা তোমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করো। ক্রিকেটীয় চেষ্টা। কোচের পরামর্শমতো অনুশীলন করো আর প্রস্তুতি নাও। ভিডিও দেখে জেনে নাও প্রতিপক্ষের সবলতা আর দুর্বলতার দিক। যতক্ষণ নেটে প্র্যাকটিস করা দরকার করো। যে রকম নিয়মকানুন মানতে হয়, তেমনই মানো। যতটা নির্ভার থাকা যায়, থাকো। নিজেকে উজাড় করে দাও। নিজের সক্ষমতার ২০০ ভাগ দাও। মাথা ঠান্ডা রাখো। কৌশলী হও। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নাও। আর ভয়হীন থাকো। বিশ্বাস রাখো যে জয় তোমাদের আসবেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অলআউট হয়ে ৯ উইকেটে হারার পরেও ইংল্যান্ডকে হারানো গেছে। কাজেই আয়ারল্যান্ডের কাছে প্রস্তুতি ম্যাচে হারলেই জেতার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না।
মনে রেখো, বাংলাদেশের মানুষ সমর্থক হিসেবে পৃথিবীর সেরা। তোমরা হারলেও আমরা বাংলাদেশের সমর্থক, তোমরা জিতলেও আমরা বাংলাদেশের সমর্থক। চলো, বাংলাদেশ। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে বাংলা, আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিজয়যাত্রা!
গ্রামীণফোন আর প্রথম আলো আজ তাই সারা দেশের সব কটা জেলায় আয়োজন করছে ‘চলো বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠান।
ঢাকায় হবে তিনটায়। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। দেশের অন্যান্য জেলায় হবে সাড়ে তিনটায়।
আজ পয়লা ফাল্গুন। বিখ্যাত ঋতুরাজের আগমনের শুভদিন। এমন একটা দিন আমরা উদ্যাপন করতে চাই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য কামনার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
আমরা জানি, দেশের পরিস্থিতি খুব সুবিধার নয়। হরতাল-অবরোধ চলছে। পেট্রলবোমার আতঙ্ক আছে। কবির ভাষায়, প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য, কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
কিন্তু ক্রিকেটই পারে পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ক্রিকেট বাংলাদেশের বেলায় আমাদের মধ্যে আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের জয়।
বাংলাদেশ তো চির অপরাজেয় জাতি। এই কথা আমাদের বেলাতেই বারবার খাটে—জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ২০১৫ সালের ক্যালেন্ডারে এমডিজিতে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এমডিজি বা সহস্রাব্দ লক্ষ্যসমূহ অর্জনে দারুণ ফল করেছে। সময়ের আগেই দারিদ্র্য কমিয়ে ফেলেছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। ৯৭.৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, ঝরে পড়ার হার কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। স্কুলে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের উপস্থিতি বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। পাঁচ বছরের নিচে শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে ৭০ শতাংশ। জন্মের প্রথম মাসে শিশুর মৃত্যু কমেছে লক্ষণীয়ভাবে। শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে এ দেশের সাফল্য পৃথিবীতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মাতৃমৃত্যু কমেছে ৪০ শতাংশ। কমেছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। ৮৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানি পায়। চারজনের তিনজনই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও।
ক্রিকেটেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
আমরা মাশরাফি বাহিনীকে বলি—তোমরা বিজয়ী হও, এই হলো আমাদের শুভ+ইচ্ছা, তোমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করো, এই হলো আমাদের আবেদন, তোমরা হারো-জেতো, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, এই হলো আমাদের অঙ্গীকার। গর্জে ওঠো। জ্বলে ওঠো। চলো বাংলাদেশ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে ওঠে, ‘বাংলাদেশ!’
‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলে?’
‘বাংলাদেশ!’
‘পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা হলে?’
‘বাংলাদেশ!’
আমরা সবাই আমাদের দেশকে খুব ভালোবাসি। আমরা সবাই বাংলাদেশের জয় চাই। দেশপ্রেম এমন একটা জিনিস, এটা জন্মমাত্রই সবারই বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে আমৃত্যু স্পন্দিত হতে থাকে।
আর বাংলাদেশে ক্রিকেটকে, ক্রিকেট দলকে আমরা একটু বেশিই ভালোবাসি। জীবনের নানা ক্ষেত্রে মার খেতে খেতে জয়ের আশায় আমরা লাইফ জ্যাকেটের মতো আঁকড়ে ধরি ক্রিকেটকে। একটা তরুণ জাতি। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সেই জনসংখ্যার আবার বেশির ভাগই তরুণ। বিজয়ের জন্য তৃষিত হয়ে আছে, উন্মুখ হয়ে আছে।
তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিততে চায়। সব ক্ষেত্রেই। তবে সব জায়গায় কি আর জয় আসে? কিন্তু একটা জায়গায় আমরা বিশ্বমানের। তার নাম ক্রিকেট।
ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা আমরা এখনো অর্জন করিনি।
কিন্তু ক্রিকেটে করেছি।
সেসব দিনের কথাও কি ভোলা যায়?
কেনিয়াকে হারানোর সেই আইসিসি কাপ ফাইনাল। পুরো বাংলাদেশ রেডিও শুনছে। আর ১ রান দরকার। শেষ বলে?
শান্তর পায়ে লেগে সেই রান পেয়ে গেল বাংলাদেশ, আমরা জিতে গেলাম, হুররে, পুরো দেশ রাস্তায় নেমে গেল, আমরা আইসিসি চ্যাম্পিয়ন, আমরা বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি। এমনই বাঁধভাঙা উৎসব যে রাস্তায় দুজন জীবনও দিয়ে দিল!
তারপর আমরা গেলাম বিশ্বকাপ খেলতে। ১৯৯৯ সালে, ইংল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ। হারাল পাকিস্তানকে। সেখান থেকে ওডিআই স্ট্যাটাস। আর টেস্ট স্ট্যাটাস।
বিশ্বকাপে কেমন করেছে বাংলাদেশ? একবার খুব খারাপ। ২০০৩ বিশ্বকাপে সব ম্যাচ হেরে এসেছে, এমনকি কানাডা আর কেনিয়ার সঙ্গেও।
একবার বেশ ভালো। ২০০৭ সালে। সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন-প্রত্যাশী ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল আমাদের মুশফিক-সাকিবেরা। ভারত বিদায় নিয়েছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। আমরা হারিয়েছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকাকেও।
২০১১ সালে নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ। ভালোয়-মন্দয় মেশানো ফল। প্রথম খেলায় ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল রান তাড়া করা। জিততে না পারলেও আশা তৈরি হলো। দ্বিতীয় ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। পরের খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। র্যাঙ্কিংয়ে তারা তখন ছিল বাংলাদেশের নিচে। সেই বিপুল প্রত্যাশার চাপে ভেঙে পড়ল বাংলাদেশ। ৫৮ রানেই অলআউট। তারপর? না, আমরা আশা ছাড়িনি—আমরা যারা বাংলাদেশের নাছোড় সমর্থক! আমি নিজেই তো ট্রেনের টিকিট কেটে চললাম চট্টগ্রামে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা। হারি-জিতি, আমরা বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আছি। আহা, সেই খেলায় জয়লাভ করলাম। সেদিন মাঠে সাকিব আল হাসানের চোখে জল চিকচিক করেছিল। জয়লাভ করে তারা উল্লাস না করে পরের ম্যাচের জন্য প্র্যাকটিস করতে শুরু করে দিয়েছিল। মনে করতেই চোখ ভিজে আসছে। আমরা চট্টগ্রামে সমুদ্রতীরের সেই স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসছি। সমস্ত রাজপথ মিছিলে পরিণত হয়েছে। পুরো চট্টগ্রাম আনন্দে নাচছে। পুরো দেশ আনন্দে ভাসছে। তিন ‘ল্যান্ড’কে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। রানিং গড়ে পিছিয়ে থাকায় অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা হলো না।
এবার কেমন করবে বাংলাদেশ?
বলা খুব মুশকিল। বাংলাদেশের জন্য প্রধান দুশ্চিন্তা, খেলাটা অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে। সিমারদের সহায়ক পিচ। বাংলাদেশ দলের প্রধান অস্ত্র স্পিন। এটা উপমহাদেশের সব দলেরই দুর্বলতা আর সবলতা—আমরা ফাস্ট বল খেলতেও অভ্যস্ত নই, আমরা স্পিন ভালো খেলি।
ওয়ার্ম-আপ ম্যাচের সব কটিতেই হেরে বসে আছে টিম। অস্ট্রেলিয়ার দুটি সাধারণ দলের কাছে, আর পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ডের জাতীয় দলের কাছে।
তবু ক্রিকেট হলো অনিশ্চয়তার খেলা। ওই একটা জায়গাতেই ভরসা। আর আমাদের সাকিব আল হাসান অস্ট্রেলিয়ার ক্লাবে টি-টোয়েন্টি খেলতে গিয়ে এক ম্যাচে চারটা উইকেটও পেয়েছেন। কাজেই স্পিন একেবারেই কাজ করবে না, তা না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশের লক্ষ্য এবার কোয়ার্টার ফাইনাল।
কিন্তু বাংলাদেশের বিগ ম্যাচ হলো প্রথমটাই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ওই খেলাটা নিয়েই ভয়ে ভয়ে আছি। এর কারণ, ক্রিকেট মনের খেলা, আর আফগানদের হারানোর কিছু নেই, কাজেই তারা খেলবে ভয়হীন ক্রিকেট। যেটা ২০০৭ সালে বাংলাদেশ খেলেছিল ভারতের বিরুদ্ধে। তবে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিচারে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো দল। আমাদের তামিম, মুমিনুল, সাকিব, মুশফিক, মাশরাফিরা পারবে না, এটা হওয়ার কোনো কারণই নেই। সেই সাহসটা আমরা বাংলাদেশ দলকে দিতে চাই। তোমরা পারো, তোমরা পেরেছ, তোমরা পারবে। তোমরা যোগ্যতর দল। আর তোমাদের সঙ্গে আছে ১৬ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা, শুভকামনা, শুভাশিস, দোয়া। তোমরা তোমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করো। ক্রিকেটীয় চেষ্টা। কোচের পরামর্শমতো অনুশীলন করো আর প্রস্তুতি নাও। ভিডিও দেখে জেনে নাও প্রতিপক্ষের সবলতা আর দুর্বলতার দিক। যতক্ষণ নেটে প্র্যাকটিস করা দরকার করো। যে রকম নিয়মকানুন মানতে হয়, তেমনই মানো। যতটা নির্ভার থাকা যায়, থাকো। নিজেকে উজাড় করে দাও। নিজের সক্ষমতার ২০০ ভাগ দাও। মাথা ঠান্ডা রাখো। কৌশলী হও। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নাও। আর ভয়হীন থাকো। বিশ্বাস রাখো যে জয় তোমাদের আসবেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অলআউট হয়ে ৯ উইকেটে হারার পরেও ইংল্যান্ডকে হারানো গেছে। কাজেই আয়ারল্যান্ডের কাছে প্রস্তুতি ম্যাচে হারলেই জেতার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় না।
মনে রেখো, বাংলাদেশের মানুষ সমর্থক হিসেবে পৃথিবীর সেরা। তোমরা হারলেও আমরা বাংলাদেশের সমর্থক, তোমরা জিতলেও আমরা বাংলাদেশের সমর্থক। চলো, বাংলাদেশ। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে বাংলা, আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিজয়যাত্রা!
গ্রামীণফোন আর প্রথম আলো আজ তাই সারা দেশের সব কটা জেলায় আয়োজন করছে ‘চলো বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠান।
ঢাকায় হবে তিনটায়। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। দেশের অন্যান্য জেলায় হবে সাড়ে তিনটায়।
আজ পয়লা ফাল্গুন। বিখ্যাত ঋতুরাজের আগমনের শুভদিন। এমন একটা দিন আমরা উদ্যাপন করতে চাই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য কামনার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
আমরা জানি, দেশের পরিস্থিতি খুব সুবিধার নয়। হরতাল-অবরোধ চলছে। পেট্রলবোমার আতঙ্ক আছে। কবির ভাষায়, প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য, কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
কিন্তু ক্রিকেটই পারে পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ক্রিকেট বাংলাদেশের বেলায় আমাদের মধ্যে আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের জয়।
বাংলাদেশ তো চির অপরাজেয় জাতি। এই কথা আমাদের বেলাতেই বারবার খাটে—জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ২০১৫ সালের ক্যালেন্ডারে এমডিজিতে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এমডিজি বা সহস্রাব্দ লক্ষ্যসমূহ অর্জনে দারুণ ফল করেছে। সময়ের আগেই দারিদ্র্য কমিয়ে ফেলেছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। ৯৭.৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, ঝরে পড়ার হার কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। স্কুলে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের উপস্থিতি বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। পাঁচ বছরের নিচে শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে ৭০ শতাংশ। জন্মের প্রথম মাসে শিশুর মৃত্যু কমেছে লক্ষণীয়ভাবে। শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে এ দেশের সাফল্য পৃথিবীতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মাতৃমৃত্যু কমেছে ৪০ শতাংশ। কমেছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। ৮৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানি পায়। চারজনের তিনজনই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও।
ক্রিকেটেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
আমরা মাশরাফি বাহিনীকে বলি—তোমরা বিজয়ী হও, এই হলো আমাদের শুভ+ইচ্ছা, তোমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করো, এই হলো আমাদের আবেদন, তোমরা হারো-জেতো, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, এই হলো আমাদের অঙ্গীকার। গর্জে ওঠো। জ্বলে ওঠো। চলো বাংলাদেশ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments