ছাড় দিতে হবে দুই পক্ষকেই by মইনুল ইসলাম
বিএনপির
নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এবং ক্ষণে ক্ষণে
হরতালের কর্মসূচি প্রায় ৩৭ দিন অতিক্রম করলেও সংকটের আশু সমাধানের
সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দুই পক্ষই এখনো তাদের অবস্থানে অনড় বলা চলে।
বেগম জিয়া তাঁর কার্যালয়ে নিজেকে অবরুদ্ধ রাখার নাটক অব্যাহত রেখে
আপসহীনভাবে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ চালিয়ে যাচ্ছেন, আরও বহুদিন
চালিয়ে যেতে তেমন বেগ পেতে হবে না। যেভাবে দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ও সড়কে
জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার এবং গুটি কয়েক ভাড়াটে বোমাবাজকে
ব্যবহার করে প্রতিদিনের রুটিন হিসেবে কয়েকটি পেট্রলবোমা বা ককটেল ছুড়ে এই
তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে, তাতে আরও বহুদিন
অনায়াসে বেগম জিয়া ও তারেক রহমান এহেন আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারবেন।
শুধু পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষের মৃত্যুর মিছিলে
প্রতিদিন দু-চার-দশজনের নাম যুক্ত হতে থাকবে আর বিভিন্ন ডিগ্রির মারাত্মক
অর্ধদগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বীভৎস অবয়বের আহত মানুষের
অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরানোর দৃশ্য দেখে জনগণের অসহায় আহাজারি দিনে দিনে
বাড়তে থাকবে। আন্দোলনের নামে জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই বর্বরতার কাছে
নতি স্বীকার করে সরকারের পদত্যাগের বালখিল্য দাবি যে শেখ হাসিনা মেনে নিতে
পারেন না, সেটা সুস্থ মস্তিষ্কের যে কারোরই বোঝার কথা। ওটা ক্ষমতাসীন জোটের
জন্য জবরদস্তির কাছে আত্মসমর্পণের শামিল হবে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানও
সেটা বোঝেন। কিন্তু তাঁদের আসল মকসুদ হচ্ছে দেশকে ক্রমশ অচল করে দিয়ে,
অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে এবং নিহত-আহত শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে
বিপর্যস্ত করে দিয়ে তৃতীয় পক্ষের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপট রচনা
করা। সংকট যতই দীর্ঘায়িত হবে, ততই অর্থনীতি পর্যুদস্ত হওয়ার আলামতগুলো
গুরুতর আকার ধারণ করবে এবং এর ফলে জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার
আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে। তখন তৃতীয় পক্ষের ক্ষমতা গ্রহণের একটা বাতাবরণ
সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এটাই মাতা-পুত্রের মূল হিসাব-নিকাশ বলে
মনে হচ্ছে।
উপরন্তু, সংকট জিইয়ে রাখা গেলে এই রাজনৈতিক সংকটের মূল ইস্যু একাদশ সংসদ নির্বাচন-সম্পর্কীয় সংলাপ শুরুর উদ্যোগ না নেওয়ার একগুঁয়েমির জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভও ক্রমেই বাড়তে থাকবে। কারণ, সরল দৃষ্টিতে অনেকের কাছেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরকার সংলাপের নীতিগত ঘোষণা দিলেই বেগম জিয়া অবরোধ-হরতাল থেকে সরে আসবেন। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অধ্যাপক এমাজউদ্দীন এই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন। কিন্তু বেগম জিয়ার এ ব্যাপারে খুব একটা তাগিদ না দেখালেও চলবে। কারণ, মানুষ পোড়ানোর আয়োজনটা দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখা তাঁর জন্য মোটেও কষ্টসাধ্য হচ্ছে না। জামায়াত-শিবির যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, তাদের নেতাদের ফাঁসির রায় ভণ্ডুল করার জন্য বর্তমান সংকটকে দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া, তাই বোমাবাজি চালানোর জন্য তাদের ক্যাডারদের জিহাদি জোশ সহজে স্তিমিত হবে না। এই সরকারকে উৎখাত করার জন্য ‘গৃহযুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়াই তাদের কৌশল।
অন্যদিকে, বেগম জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির বিভিন্ন নেতা এবং তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এহেন নির্ভেজাল পৈশাচিকতার দায়ভার সরকার ও তার লেলিয়ে দেওয়া ‘এজেন্ট প্রোভোক্যাটিয়ারদের’ ওপর যেভাবে অবলীলাক্রমে চাপিয়ে দিয়ে ‘সাধু গণতন্ত্রী’ সাজার ভান করে চলেছেন, তাতে তাঁদের অভিনয় ক্ষমতার প্রশংসা করা গেলেও তাঁদের মানবিক গুণাবলির চরম ঘাটতি থাকার বিষয়টিও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপির এক মেজর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এসএসসি পরীক্ষার জন্য অবরোধ-হরতাল কিঞ্চিৎ শিথিল করার অনুরোধকে ‘কিসের কী পরীক্ষা’ বলে যেভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, তাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটা তাঁকে মনে করিয়ে দিতেই হচ্ছে। কবিতাটা হয়তো অনেক পাঠকেরই পড়া আছে, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি: কোনো এক রাজ্যের রানি তীব্র এক শীতের রাতে নদীতে সখী-পরিবৃত হয়ে স্নান সেরে প্রাসাদে ফেরার পথে শীতের কবল থেকে কিঞ্চিৎ আরাম পাওয়ার জন্য সখীদের পথের ধারের ধীবরদের কুটিরগুলোতে অগ্নিসংযোগের আদেশ দিয়েছিলেন। রানির কাছে জেলেদের জীর্ণ কুটির পোড়ানোটা বিবেচিত হয়েছিল ‘সামান্য ক্ষতি’ হিসেবে। কিন্তু তাঁর ওই আগুন পোহানোর বিলাসের খবর রাজার কানে গেলে তিনি রানির বসন কেড়ে নিয়ে রানিকে ছিন্নবস্ত্র পরিয়ে প্রাসাদ থেকে বিদায় করেছিলেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশটাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে এবং মানুষ পুড়িয়ে মারার মহাযজ্ঞ নির্বিকারে চলতে দিয়ে তাঁদের এই ক্ষমতার মসনদের দখল নেওয়ার কাড়াকাড়ি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। একজন বিতাড়িত রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষতার লেবাস পরে বিএনপির নেত্রীর পক্ষে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে চলেছেন। একবার তিনি বললেন, গুলশানের কার্যালয়ে যে তালার কারণে শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে পারেননি, ওই তালা নাকি সরকারই লাগিয়েছিল। এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিলেন, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাও পুরোনো খবর, জামায়াত-শিবির ২০১৩ সালেই গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এ রকম মেকি নিরপেক্ষতার কোনো গুরুত্ব কেউ দেবে বলে মনে হয় না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমস্যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্রচরিত্র। এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধনার্জনের লোভনীয় পন্থা হিসেবে ৪৪ বছর ধরে বহাল থাকাতেই গত ২৪ বছরের ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের নিরন্তর সংকট থেকে আমাদের নিস্তার মিলছে না। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমান বর্তমান ভোটের রাজনীতিকে ‘নির্বাচিত জমিদারতন্ত্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন, আমি আমার কয়েকটি লেখায় তাঁকে উদ্ধৃত করেছি। দেশের সংবিধানকে যতই আমরা গণতান্ত্রিক বলে প্রশংসা করি না কেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে এই সংবিধানটি রচিত হওয়ায় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক করে ফেলা হয়েছে।
১৯৯১ সালে যখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার থেকে আবার সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারে ফিরে আসা হয়েছিল, তখন বেগম জিয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করার জন্য আরও অনেক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘রুলস অব বিজনেস’ পরিবর্তন করে তা আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবেই দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এখন একনায়কের মতোই ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন। এর সঙ্গে যখন সংবিধানের ৭০ ধারা যোগ হয়ে গেছে, তখন প্রধান দুই দলের নেতা-কর্মীর কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে কেউ দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন!
সে জন্যই বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে আমি ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ বলে অভিহিত করে চলেছি। এ ধরনের রাষ্ট্রকে এসেমগলু এবং রবিনসন তাঁদের বেস্টসেলার বই হোয়াই নেশনস ফেইল-এ ‘এক্সট্রাকটিভ স্টেট’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যে রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী একচ্ছত্র শাসক নিজে এবং তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী-মাস্তান-চাঁদাবাজ, দলবাজ আমলা, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যবসায়ী-ঠিকাদার এবং শাসক দলের কৃপাধন্য বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা পুঁজি লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞে শরিক হয়ে ধনার্জনের ইঁদুর দৌড়ে মত্ত হয়ে যান। আমাদের দেশেও অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বের এই ‘এক্সট্রাকটিভ’ সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পাল্লায় পড়ে বারবার সংকটের দরিয়ায় নিমজ্জিত হয়ে চলেছি আমরা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গেড়ে বসে থাকা পরিবারতন্ত্রের নাগপাশ থেকে যদ্দিন দেশের রাজনীতির মুক্তি না মিলবে এবং গণতান্ত্রিক সংবিধানের নামে ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ কায়েমের সাংবিধানিক আয়োজন জাতি বদলাতে না পারবে, তদ্দিন শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের টেকসই ব্যবস্থা আমরা অর্জন করতে পারব না।
বাংলাদেশের অনুন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আমি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে চলেছি। এ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে আমার বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে রোল অব দ্য স্টেট ইন বাংলাদেশ’স আন্ডার ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনার দুই-তৃতীয়াংশের কাজ সম্পন্ন করেছি আমি। বইয়ের মূল হাইপোথিসিস হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্রই এ দেশের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের প্রধান অনুঘটক উপাদান। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে যে সুবা-বাংলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্যময় জনপদ বলে ফরাসি পর্যবেক্ষক বার্নিয়ার ও ট্যাভারনিয়ার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, সেই বাংলার প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার কেন ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন ১৭৫৭-১৮৫৮ পর্যায়ের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসন, ১৮৫৮-১৯৪৭ সালের সরাসরি ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯৪৭-১৯৭১ সালের পাকিস্তানি নব্য ঔপনিবেশিক শাসনকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরেও এ দেশটা কেন অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে হলেও এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রকেই বিশ্লেষণের মূল ফোকাসে নিয়ে আসতে হবে। এই কঠিন প্রয়াসই আমার বর্তমান গবেষণার ক্ষেত্র। গবেষণার ভিত্তিতে ওপরে সংকটের যে আসল কারণের কথা বলা হলো, সে সম্পর্কে সবাইকে ভেবে দেখতে বলি।
চলমান সংকটের ব্যাপারে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার ৪ ফেব্রুয়ারির কলামে সংকট সমাধানের যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি: দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। দুই পক্ষের গোপন সম্মতিতে তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি পদেক্ষপ আহ্বান করবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁদের বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য দাওয়াত দেবেন। দাওয়াত পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বেগম জিয়া অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করবেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করার পর একাদশ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার-সম্পর্কীয় সংলাপ শুরু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে, বিএনপির নেতাদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা হবে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া সত্যি সত্যি সমাধান চাইলে দুই পক্ষের জন্য সম্মানজনক সাময়িক সমাধানের এই প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারেন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
উপরন্তু, সংকট জিইয়ে রাখা গেলে এই রাজনৈতিক সংকটের মূল ইস্যু একাদশ সংসদ নির্বাচন-সম্পর্কীয় সংলাপ শুরুর উদ্যোগ না নেওয়ার একগুঁয়েমির জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভও ক্রমেই বাড়তে থাকবে। কারণ, সরল দৃষ্টিতে অনেকের কাছেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরকার সংলাপের নীতিগত ঘোষণা দিলেই বেগম জিয়া অবরোধ-হরতাল থেকে সরে আসবেন। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অধ্যাপক এমাজউদ্দীন এই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন। কিন্তু বেগম জিয়ার এ ব্যাপারে খুব একটা তাগিদ না দেখালেও চলবে। কারণ, মানুষ পোড়ানোর আয়োজনটা দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখা তাঁর জন্য মোটেও কষ্টসাধ্য হচ্ছে না। জামায়াত-শিবির যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, তাদের নেতাদের ফাঁসির রায় ভণ্ডুল করার জন্য বর্তমান সংকটকে দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া, তাই বোমাবাজি চালানোর জন্য তাদের ক্যাডারদের জিহাদি জোশ সহজে স্তিমিত হবে না। এই সরকারকে উৎখাত করার জন্য ‘গৃহযুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়াই তাদের কৌশল।
অন্যদিকে, বেগম জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির বিভিন্ন নেতা এবং তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এহেন নির্ভেজাল পৈশাচিকতার দায়ভার সরকার ও তার লেলিয়ে দেওয়া ‘এজেন্ট প্রোভোক্যাটিয়ারদের’ ওপর যেভাবে অবলীলাক্রমে চাপিয়ে দিয়ে ‘সাধু গণতন্ত্রী’ সাজার ভান করে চলেছেন, তাতে তাঁদের অভিনয় ক্ষমতার প্রশংসা করা গেলেও তাঁদের মানবিক গুণাবলির চরম ঘাটতি থাকার বিষয়টিও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপির এক মেজর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এসএসসি পরীক্ষার জন্য অবরোধ-হরতাল কিঞ্চিৎ শিথিল করার অনুরোধকে ‘কিসের কী পরীক্ষা’ বলে যেভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, তাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটা তাঁকে মনে করিয়ে দিতেই হচ্ছে। কবিতাটা হয়তো অনেক পাঠকেরই পড়া আছে, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি: কোনো এক রাজ্যের রানি তীব্র এক শীতের রাতে নদীতে সখী-পরিবৃত হয়ে স্নান সেরে প্রাসাদে ফেরার পথে শীতের কবল থেকে কিঞ্চিৎ আরাম পাওয়ার জন্য সখীদের পথের ধারের ধীবরদের কুটিরগুলোতে অগ্নিসংযোগের আদেশ দিয়েছিলেন। রানির কাছে জেলেদের জীর্ণ কুটির পোড়ানোটা বিবেচিত হয়েছিল ‘সামান্য ক্ষতি’ হিসেবে। কিন্তু তাঁর ওই আগুন পোহানোর বিলাসের খবর রাজার কানে গেলে তিনি রানির বসন কেড়ে নিয়ে রানিকে ছিন্নবস্ত্র পরিয়ে প্রাসাদ থেকে বিদায় করেছিলেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশটাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে এবং মানুষ পুড়িয়ে মারার মহাযজ্ঞ নির্বিকারে চলতে দিয়ে তাঁদের এই ক্ষমতার মসনদের দখল নেওয়ার কাড়াকাড়ি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। একজন বিতাড়িত রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষতার লেবাস পরে বিএনপির নেত্রীর পক্ষে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে চলেছেন। একবার তিনি বললেন, গুলশানের কার্যালয়ে যে তালার কারণে শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে পারেননি, ওই তালা নাকি সরকারই লাগিয়েছিল। এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিলেন, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাও পুরোনো খবর, জামায়াত-শিবির ২০১৩ সালেই গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এ রকম মেকি নিরপেক্ষতার কোনো গুরুত্ব কেউ দেবে বলে মনে হয় না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমস্যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্রচরিত্র। এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধনার্জনের লোভনীয় পন্থা হিসেবে ৪৪ বছর ধরে বহাল থাকাতেই গত ২৪ বছরের ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের নিরন্তর সংকট থেকে আমাদের নিস্তার মিলছে না। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমান বর্তমান ভোটের রাজনীতিকে ‘নির্বাচিত জমিদারতন্ত্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন, আমি আমার কয়েকটি লেখায় তাঁকে উদ্ধৃত করেছি। দেশের সংবিধানকে যতই আমরা গণতান্ত্রিক বলে প্রশংসা করি না কেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে এই সংবিধানটি রচিত হওয়ায় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক করে ফেলা হয়েছে।
১৯৯১ সালে যখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার থেকে আবার সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারে ফিরে আসা হয়েছিল, তখন বেগম জিয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করার জন্য আরও অনেক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘রুলস অব বিজনেস’ পরিবর্তন করে তা আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবেই দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এখন একনায়কের মতোই ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন। এর সঙ্গে যখন সংবিধানের ৭০ ধারা যোগ হয়ে গেছে, তখন প্রধান দুই দলের নেতা-কর্মীর কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে কেউ দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন!
সে জন্যই বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে আমি ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ বলে অভিহিত করে চলেছি। এ ধরনের রাষ্ট্রকে এসেমগলু এবং রবিনসন তাঁদের বেস্টসেলার বই হোয়াই নেশনস ফেইল-এ ‘এক্সট্রাকটিভ স্টেট’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যে রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী একচ্ছত্র শাসক নিজে এবং তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী-মাস্তান-চাঁদাবাজ, দলবাজ আমলা, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ব্যবসায়ী-ঠিকাদার এবং শাসক দলের কৃপাধন্য বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা পুঁজি লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞে শরিক হয়ে ধনার্জনের ইঁদুর দৌড়ে মত্ত হয়ে যান। আমাদের দেশেও অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বের এই ‘এক্সট্রাকটিভ’ সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পাল্লায় পড়ে বারবার সংকটের দরিয়ায় নিমজ্জিত হয়ে চলেছি আমরা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গেড়ে বসে থাকা পরিবারতন্ত্রের নাগপাশ থেকে যদ্দিন দেশের রাজনীতির মুক্তি না মিলবে এবং গণতান্ত্রিক সংবিধানের নামে ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ কায়েমের সাংবিধানিক আয়োজন জাতি বদলাতে না পারবে, তদ্দিন শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের টেকসই ব্যবস্থা আমরা অর্জন করতে পারব না।
বাংলাদেশের অনুন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আমি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে চলেছি। এ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে আমার বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে রোল অব দ্য স্টেট ইন বাংলাদেশ’স আন্ডার ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনার দুই-তৃতীয়াংশের কাজ সম্পন্ন করেছি আমি। বইয়ের মূল হাইপোথিসিস হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্রই এ দেশের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের প্রধান অনুঘটক উপাদান। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে যে সুবা-বাংলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্যময় জনপদ বলে ফরাসি পর্যবেক্ষক বার্নিয়ার ও ট্যাভারনিয়ার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, সেই বাংলার প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার কেন ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন ১৭৫৭-১৮৫৮ পর্যায়ের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসন, ১৮৫৮-১৯৪৭ সালের সরাসরি ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯৪৭-১৯৭১ সালের পাকিস্তানি নব্য ঔপনিবেশিক শাসনকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরেও এ দেশটা কেন অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে হলেও এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রকেই বিশ্লেষণের মূল ফোকাসে নিয়ে আসতে হবে। এই কঠিন প্রয়াসই আমার বর্তমান গবেষণার ক্ষেত্র। গবেষণার ভিত্তিতে ওপরে সংকটের যে আসল কারণের কথা বলা হলো, সে সম্পর্কে সবাইকে ভেবে দেখতে বলি।
চলমান সংকটের ব্যাপারে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার ৪ ফেব্রুয়ারির কলামে সংকট সমাধানের যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি: দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। দুই পক্ষের গোপন সম্মতিতে তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি পদেক্ষপ আহ্বান করবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁদের বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য দাওয়াত দেবেন। দাওয়াত পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বেগম জিয়া অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করবেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করার পর একাদশ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার-সম্পর্কীয় সংলাপ শুরু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে, বিএনপির নেতাদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা হবে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া সত্যি সত্যি সমাধান চাইলে দুই পক্ষের জন্য সম্মানজনক সাময়িক সমাধানের এই প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারেন।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments